খাইবার যুদ্ধ
খাইবার যুদ্ধ >> বুখারী শরীফ এর মুল সুচিপত্র পড়ুন
পর্বঃ ৬৪, মাগাযী, অধ্যায়ঃ (৩৯-৪২)=৪টি
৬৪/৩৯. অধ্যায়ঃ খাইবার [৪৭]-এর যুদ্ধ
৬৪/৪০. অধ্যায়ঃ খাইবারবাসীদের জন্য নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক প্রশাসক নিযুক্তি
৬৪/৪১.অধ্যায়ঃ নাবী (সাঃআঃ) কর্তৃক খাইবার অধিবাসীদের কৃষি ভূমির বন্দোবস্ত প্রদান
৬৪/৪২. অধ্যায়ঃ খাইবারে নাবী (সাঃআঃ)-এর জন্য বিষ মিশ্রিত বাক্রীর (হাদিয়া পাঠানোর) বর্ণনা
৬৪/৩৯. অধ্যায়ঃ খাইবার এর যুদ্ধ
[৪৭] সপ্তম হিজরী, মুহাররম মাস। খাইবার ছিল সিরিয়া প্রান্তরে এক বিশাল শ্যামল ভূখণ্ডের নাম। এটা মাদীনাহ হইতে তিন মঞ্জিলের (প্রায় এক শ মাইল) পথ। ক্ষুদ্র বৃহৎ বহু দুর্গ দ্বারা এই স্থানটি সুরক্ষিত ছিল। মাদীনার বানু কানুইকা ও বানু নাযীর গোত্রের ইয়াহূদীরা এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। নাবী সাঃআঃ এর হুদাইবিয়ার সফর হইতে ফিরে আসা অল্প দিন মাত্র (এক মাসেরও কম) গত হয়েছে। এমন সময় শোনা গেল যে, খাইবারের ইয়াহূদীরা মাদীনার উপর আক্রমণ চালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে-(তবকাতে কাবীর, ইবনু সাদ, ৭ পৃষ্ঠা) । তারা আহযাবের যুদ্ধে অকৃতকার্যতার প্রতিশোধ গ্রহণ এবং নিজেদের হারানো সাময়িক মর্যাদা ও শক্তিকে গোটা রাজ্যে পুনর্বহাল করার জন্য এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।
তারা বানু গাফতান গোত্রের চার হাজার জঙ্গী বীর পুরুষকেও নিজেদের সাথে যুক্ত করে নিয়েছে। তারা এ চুক্তি করেছে যে, যদি মাদীনাহ বিজিত হয় তাহলে খাইবারের উৎপাদিত শস্যের অর্ধাংশ তারা বানু গাফতানকে চিরস্থায়ীভাবে দিতে থাকবে।
ইতোপূর্বে আহযাবের যুদ্ধে মুসলিমদেরকে খাইবারের দুর্গ অবরোধ করিতে যে কঠিন বেগ পেতে হয়েছিল তা তারা ভুলেনি। সুতরাং সবাই এ ব্যাপারে এক মত হলেন যে, এই আক্রমণেচ্ছুক শত্রুদেরকে সামনে অগ্রসর হয়ে প্রতিরোধ করিতে হইবে।
নাবী সাঃআঃ শুধু মাত্র ঐ সাহাবীদেরকে এই যুদ্ধে গমনের অনুমতি দান করেছিলেন যাদেরকে শুভ সংবাদ দিতে গিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল করেনঃ (لقد رضى الله عن المؤ منين اذ يبا يعو نك تحت الشجرة فعلم ما فى قلو بهم (سو ر ة الفتح:١٨
“আল্লাহ অবশ্যই মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন যখন তারা গাছের নীচে তোমার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেছে, তাদের অন্তরে যা আছে আল্লাহ তা জানেন।” (সুরাহ ফাতহ ৪৮/১৮)
আর যাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (وعد كم الله مغا نم كثيرة تا خذو نها (سو ر ة الفتح:٢٥
“আল্লাহ তোমাদের সাথে বড় বড় বিজয়ের ও গানীমাতের ওয়াদা করিয়াছেন যা তোমরা লাভ করিবে। ” (সুরা ফাতহ ৪৮/২০)
তারা সংখ্যায় চৌদ্দশ জন ছিলেন। তাদের মধ্যে দুশজন ছিলেন আশ্বারোহী।
সেনাবাহিনীর সম্মুখ ভাগের নেতা বা সেনাপতি ছিলেন উকাশাহ ইবনু মুহসিন আসাদী (রাদি.) [উকাশাহ ইবনু মুহসিন (রাদি.) মর্যাদা সম্পন্ন সহাবীদের অন্যতম ছিলেন। তার সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাঃআঃ সুসংবাদ দান করেছিলেন যে, তিনি বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবেন। বাদর, উহূদ, খন্দক এবং অন্যান্য যুদ্ধে তিনি হাযির হন। সিদ্দীকে আকবার (রাদি.)-এর খেলাফাতকালে ৪৫ বছর বয়সে তিনি শহীদ হন।] ডান দিকের সেনাবাহিনীর সরদার ছিলেন উমার ইবনুল খাত্তাব (রাদি.)-(মাদারিজুন নুবুওয়াহ, ২৯০ পৃষ্ঠা।) বাম দিকের সেনাবাহিনীর নেতা অন্য একজন সাহাবী (রাদি.) ছিলেন। বিশজন মহিলাও (রাযিয়াল্লাহু আনহুম্মা) সেনাবাহিনীর মধ্যে ছিলেন যারা রুগ্ন ও আহতদের দেখাশুনা ও সেবা শশ্রুষা করার জন্য সাথে এসেছিলেন।
ইসলামের সেনাবাহিনী রাত্রিকালে খাইবারের বসতি সংলগ্ন জায়গায় পৌঁছে গেল। কিন্তু নাবী সাঃআঃ-এর কল্যাণময় অভ্যাস এই ছিল যে, তিনি রাত্রে যুদ্ধ শুরু করিতেন না-[বুখারী, আনাস (রাদি.) হইতে বর্ণিত]। এজন্যে ইসলামের সেনাবাহিনী ময়দানে শিবির স্থাপন করে। যুদ্ধের জন্য এ স্থানটি যুদ্ধ অভিজ্ঞ ব্যক্তি হাব্বাব ইবনুল মুনযির (রাদি.) নির্বাচন করেছিলেন। এ জায়গাটি খাইবারবাসী ও বানু গাফতান গোত্রের মধ্যস্থলে ছিল। এই কৌশল অবলম্বনের উপকার এই ছিল যে, বানু গাফতান গোত্র যখন খাইবারের ইয়াহূদীদের সাহায্যের জন্য বের হয় তখন তারা ইসলামের সেনাবাহিনীকে প্রতিবন্ধকরূপে পায়। এ কারণে তারা চুপচাপ নিজেদের বাড়ীতে ফিরে যায়।
রাসুল সাঃআঃ হুকুম দেন যে, সেনাবাহিনী বড় ক্যাম্প এখানেই থাকবে এবং আক্রমণমুখী সৈন্যদের দল এই ক্যাম্প থেকে যেতে থাকবে। সৈন্যদের মাঝে তৎক্ষণাৎ মাসজিদ নির্মাণ করে নেয়া হয়। আর যুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে ইসলামের তাবলীগের ধারাও জারী রাখা হয়।
উসমান (রাদি.) ঐ ক্যাম্পের প্রধান দায়িত্বশীল নির্বাচিত হন।
খাইবারের জন বসতির ডানে-বামে যে দূর্গ অবস্থিত ছিল ঐগুলি সংখ্যায় ছিল দশটি। ঐ দূর্গগুলোর মধ্যে দশ হাজার করে বীর যোদ্ধা অবস্থান করতো।
খাইবারে জনবসতি ডানে-বামে দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। একভাগে ছিল নিতাত দূর্গ নামে পরিচিত চারটি দূর্গ-(১) নায়িম (২) নিতাত (৩) সাআব ইবনু মুআয (৪) কিলআতুয যুবায়র এবং শান্না দূর্গ নামে পরিচিত তিনটি দূর্গ-(১) শান্না (২) বার (৩) উবাই। অপর পাশে ছিল আরও তিনটি দূর্গ যা কুতাইবাহ দূর্গ নামে পরিচিত ছিল। তা হচ্ছে-(১) কামূস তাবারী (২) অতীহ (৩) সালিম বা নাবউইন হাকীক।
মাহমুদ ইবনু মাসলামাহ (রাদি.) পাঁচ দিন পর্যন্ত ক্রমাগত আক্রমণ চালাতে থাকেন। কিন্তু দূর্গ বিজিত হলো না। পঞ্চম বা ষষ্ঠ দিনের বর্ণনা এই যে, মাহমুদ (রাদি.) যুদ্ধ ক্ষেত্রের প্রখরতায় ক্লান্ত হয়ে দূর্গ প্রাচীরের ছায়ায় কিছু সময় বিশ্রাম গ্রহণের জন্য শুয়ে পড়েন। ইত্যবসরে কিনানাহ ইবনু হাকীক নামক এক ইয়াহূদী তাকে গাফেল দেখে তার মাথায় এক পাথর মেরে দেয়। এতেই তিনি শহীদ হয়ে যান। সেনাবাহিনীর পতাকা মাহমুদ ইবনু মাসলামাহ (রাদি.)-এর ভাই মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাদি.) ধারণ করেন এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করিতে থাকেন। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাদি.) এই মত প্রদান করেন যে, ইয়াহূদীদের খেজুর বাগানের খেজুর গাছগুলি কেটে ফেলা হোক। কেননা, তাদের নিকট এক একটি খেজুর গাছ এক একটি ছেলের মতই প্রিয়। এই কৌশল অবলম্বন করলে দূর্গবাসীর উপর প্রভাব ফেলা যাবে। এই কৌশলের উপর কাজ শুরু হয়েই গিয়েছিল। এমন সময় আবু বাক্র (রাদি.) নাবী (সাঃআঃ)-এর খিদমাতে হাযির হয়ে আরয করলেনঃ “এ এলাকা নিশ্চিতরূপে মুসলিমদের হাতে বিজিত হইতে যাচ্ছে। সুতরাং আমরা এটাকে নিজেদের হাতে নষ্ট করবো কেন? রাসুল (সাঃআঃ) আবু বাক্রের (রাদি.) এই মতকে পছন্দ করিলেন এবং ইবনু মাসলামাহ (রাদি.)-এর নিকট খেজুর গাছগুলি কেটে ফেলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা পাঠিয়ে দিলেন। সন্ধ্যার সময় মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাদি.) স্বীয় ভ্রাতার নিষ্ঠুরভাবে শহীদ হওয়ার ঘটনাটি নাবী (সাঃআঃ)-এর খিদমাতে এসে বর্ণনা করেন।
রাসুল (সাঃআঃ) তখন বলেনঃ [আরবী]
“আগামী দিন পতাকা ঐ ব্যক্তিকে প্রদান করা হইবে (অথবা ঐ ব্যক্তি পতাকা গ্রহণ করিবে) আল্লাহ ও তাহাঁর রাসুল (সাঃআঃ) ভালবাসেন এবং তার হাতে আল্লাহ বিজয় দান করবেন। “
এটা এমন এক প্রশংসা ছিল, যা শুনে বড় বড় বীর পুরুষ আগামী দিনের পতাকা লাভের আশায় আশান্বিত হয়ে থাকলেন।
ঐ রাত্রে সেনাবাহিনীর পাহারা দেয়ার দায়িত্ব উমার ইবনুল খাত্তাবের (রাদি.) উপর অর্পিত হয়েছিল। তিনি চক্কর দিতে দিতে একজন ইয়াহূদীকে গ্রেফতার করেন। তৎক্ষণাৎ তিনি তাকে নাবী (সাঃআঃ)-এর খিদমাতে আনয়ন করেন। ঐ সময় রাসুল (সাঃআঃ) তাহাজ্জুদের সলাতে ছিলেন। সলাত শেষে তিনি ইয়াহূদীর সাথে কথোপকথন করেন। ইয়াহূদী বললঃ “যদি আমাকে এবং দূর্গে অবস্থানরত আমার স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে নিরাপত্তা দান করা হয় তাহলে আমি সামরিক গোপন বিষয়ের বহু কিছু প্রকাশ করে দিতে পারি। ” ঐ ইয়াহূদীর সাথে নিরাপত্তা ওয়াদা করা হলে সে বলিতে শুরু করেঃ “নিতাত দূর্গের ইয়াহূদীরা আজ রাত্রে তাদের স্ত্রী ও শিশু সন্তানদেরকে শান দূর্গে পাঠাচ্ছে এবং তাদের মালধন ও টাকা পয়সা নিতাত দূর্গের মধ্যে প্রোথিত করছে। ঐ জায়গা আমার জানা আছে। যখন মুসলিমরা নিতাত দূর্গদখল করে নিবেন তখন আমি ঐ জায়গাটি দেখিয়ে দিবো। শান্না দূর্গের নীচে ভূগর্ভে নির্মিত কুঠরিতে বহু মূল্যবান অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। যখন মুসলমানরা শান্না দূর্গ জয় করে নিবেন তখন আমি তাদের কে ভূগর্ভে নির্মিত ঐ কুঠরিটিও দেখিয়ে দিবো। “
আলী (রাদি.) নায়েম দূর্গের উপর আক্রমণের সূত্রপাত করিলেন। মুকাবালার জন্যে দূর্গের বিখ্যাত সরদার মুরাহহাব ময়দানে বেরিয়ে এলো। সে নিজেকে হাজার বীরের সমান মনে করতো।
মুরাহহাব তাকে তরবারী দ্বারা আঘাত করে। আমির (রাদি.) ওটাকে ঢাল দ্বারা প্রতিহত করেন এবং মুরাহহাবের দেহের নিম্নভাগে আঘাত করেন। কিন্তু তার তরবারিটি যা দৈর্ঘ্যে ছোট ছিল, তার নিজেরই হাঁটুতে লেগে যায়, যার ফলে অবশেষে তিনি শহীদ হয়ে যান। অতঃপর আলী (রাদি.) বেরিয়ে আসেন।
আলী মুরতযা (রাদি.) এক হাতেই এমন জোরে তরবারীর আঘাত করেন যে, মুরাহহাবের শিরস্ত্রাণ কেটে পাগড়ী কর্তন করতঃ মাথাকে দু টুকরো করে গর্দান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। মুরাহহাবের ভাই বেরিয়ে আসলে যুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রাদি.) তাকে মাটিতে শুইয়ে দেন। এরপর আলী (রাদি.)-এর সাধারণ আক্রমণের মাধ্যমে নায়েম দূর্গটি বিজিত হয়।
ঐ দিনই সাআব দূর্গটি হাব্বাব মুনযির (রাদি.) অবরোধ করে তৃতীয় দিনে জয় করে নেন। সাআব দূর্গটি জয় করার ফলে মুসলিমরা প্রচুর পরিমাণে যব, খেজুর, মাখন, রওগণ, যায়তুন এবং চর্বি লাভ করেন। এর ফলে মুসলিমদের ঐ কষ্ট দূরীভূত হয় যে কষ্ট তারা রসদের স্বল্পতার কারণে ভোগ করছিলেন। এই দূর্গ হইতেই তারা বড় বড় গুপ্ত অস্ত্র লাভ করেন যার খবর ইয়াহূদী গুপ্তচর তাদের কে প্রদান করেছিল। এর পূর্বদিন নিতাত দূর্গ বিজিত হয়েছিল। এখন যুবায়ের দূর্গ, যা একটি পাহাড়ী টিলার উপর অবস্থিত ছিল এবং যুবায়েরের নামে যার নামকরণ করা হয়েছিল, ওর উপর আক্রমণ করা হয়। দুদিন পর একজন ইয়াহূদী ইসলামের সৈন্যদের মধ্যে আসে। সে বলেঃ “এ দূর্গটি তো এক মাস পর্যন্ত চেষ্টা চালালেও জয় করিতে পারবেন না। আমি একটি গোপন কথা বলে দিচ্ছি। “এ দূর্গের মাটির নিচের নালা পথে পানি এসে থাকে। যদি পানির পথ বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে বিজয় সম্ভব। ” তার এ কথা শুনে মুসলিমরা পানির উপর অধিকার লাভ করে নেন। তখন দূর্গবাসী দূর্গ হইতে বের হয়ে খোলা ময়দানে এসে যুদ্ধ করে এবং মুসলিমরা তাদেরকে পরাজিত করেন।
তারপর উবাই দূর্গের উপর আক্রমণ করা শুরু হয়। এই দূর্গবাসীরা কঠিন ভাবে প্রতিরোধ করে। তাদের মধ্যে গাযওয়ান নামক একটি লোক ছিল। সে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের জন্য বেরিয়ে আসে। হাব্বাব (রাদি.) তার সাথে মুকাবালার জন্য এগিয়ে যান। গায্ওয়ানের বাহু কেটে যায়। সে দূর্গের দিকে পালাতে থাকে। হাব্বাব (রাদি.) তার পশ্চাদ্ধাবন করেন। সে পড়ে যায় এবং তাকে হত্যা করা হয়।
দূর্গ হইতে আর একজন যোদ্ধা বেরিয়ে আসে। একজন মুসলিম তার মুকাবালা করেন। কিন্তু মুসলিমটি তার হাতে শহীদ হয়ে যান। অতঃপর আবু দাজনা (রাদি.) বেরিয়ে আসেন। তিনি এসেই তার পা কেটে দেন এবং পরে তাকে হত্যা করে ফেলেন।
ইয়াহূদীরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং বাইরে বের হওয়া থেকে বিরত থাকে। আবু দাজনা (রাদি.) সামনে অগ্রসর হন। মুসলিমরা তার সঙ্গী হন। তারা তাকবীর পাঠ করিতে করিতে দূর্গের প্রাচীরের উপর চড়ে যান এবং দূর্গ জয় করে নেন। দূর্গবাসীরা পালিয়ে যায়। এই দূর্গ হইতে প্রচুর বকরী, কাপড় এবং আসবাবপত্র পাওয়া যায়।
এবার মুসলিমরা বার দূর্গ আক্রমণ করেন। এখানে দূর্গরক্ষীরা মুসলিমদের উপর এত তীর ও পাথর বর্ষণ করেন যে, তাদের মুকাবালা করার জন্য মুসলিমদেরকেও ভারী অস্ত্র ব্যবহার করিতে হয় যে অস্ত্র তারা সাআব দূর্গ হইতে গানীমাত স্বরূপ লাভ করেছিলেন। এই ভারী অস্ত্র দ্বারা এ দূর্গের প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে তা জয় করা হয়। (রহমাতুল লিল আলামীন-আল্লামা কাযী মুহাম্মাদ সুলাইমনা মানসূর পূরী)
৪১৯৫
সুওয়াইদ ইবনু নুমান (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি (সুওয়াইদ ইবনু নুমান) খাইবার অভিযানের বছর নাবী (সাঃআঃ)-এর সঙ্গে বেরিয়েছিলেন। [তিনি বলেন] যখন আমরা খাইবারের নীচু এলাকায় সাহবা নামক স্থানে পৌঁছলাম, তখন নাবী (সাঃআঃ) আসরের সলাত আদায় করিলেন। তারপর তিনি পাথেয় পরিবেশন করিতে হুকুম দিলেন। কিন্তু ছাতু ব্যতীত কিছুই দেয়া গেল না। তিনি ছাতু গুলতে বলিলেন। ছাতু গুলা হলো। তখন তিনিও খেলেন, আমরাও খেলাম। তারপর তিনি মাগরিবের সলাতের জন্য উঠে পড়লেন এবং কুল্লি করিলেন। আমরাও কুল্লি করলাম। তারপর তিনি সলাত আদায় করিলেন আর সেজন্য নতুনভাবে উযূ করিলেন না। [২০৯] (আ.প্র. ৩৮৭৫, ই.ফা. ৩৮৭৮)
৪১৯৬
সালামাহ ইবনু আকওয়া (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা নাবী (সাঃআঃ)-এর সঙ্গে খাইবার অভিযানে বেরোলাম। আমরা রাতের বেলা চলছিলাম, তখন দলের এক ব্যক্তি আমির (রাদি.)-কে বলিল, হে আমির! তোমার সমর সঙ্গীত থেকে আমাদের কিছু শোনাবে না কি? আমির (রাদি.) ছিলেন একজন কবি। তখন তিনি সওয়ারী থেকে নামলেন এবং সঙ্গীতের তালে তালে কাফেলাকে এগিয়ে নিয়ে চললেন। তিনি গাইলেনঃ
হে আল্লাহ! তুমি না হলে আমরা হিদায়াত লাভ করতাম না,
সদাকাহ দিতাম না সলাত আদায় করতাম না।
তাই আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন, যতদিন আপনার প্রতি সমর্পিত হয়ে থাকব।
আমাদের উপর শান্তি বর্ষণ করুন এবং শত্রুর মুকাবালায় আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখুন।
আমাদেরকে যখন (কুফরের দিকে) ডাকা হয় আমরা তখন তা প্রত্যাখ্যান করি।
আর এ কারণে তারা চীৎকার করে আমাদের বিরুদ্ধে লোক-লস্কর জমা করে।
রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলিলেন, এ সঙ্গীতের গায়ক কে? তাঁরা বলিলেন, আমির ইবনুল আকওয়া। রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলিলেন, আল্লাহ তাকে রহম করুন। কাফেলার একজন বললঃ হে আল্লাহর নাবী! তার (শাহাদাত) নিশ্চিত হয়ে গেল। (হায়) আমাদেরকে যদি তার নিকট হইতে আরো উপকার লাভের সুযোগ দিতেন! অতঃপর আমরা খাইবারে পৌঁছলাম এবং তাদেরকে অবরোধ করলাম। এক সময় আমরা ভীষণ ক্ষুধায় আক্রান্ত হলাম। কিন্তু পরেই মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাদের উপর বিজয় দান করিলেন। বিজয়ের দিন সন্ধ্যায় মুসলিমগণ (রান্নার জন্য) অনেক আগুন জ্বালালেন। নাবী (সাঃআঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ এ সব কিসের আগুন? তোমরা কী রান্না করছ? তারা জানালেন, গোশত। নাবী (সাঃআঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ কিসের গোশত? লোকেরা বলিলেন, গৃহপালিত গাধার গোশত। নাবী (সাঃআঃ) বলিলেন, এগুলি ঢেলে দাও এবং ডেকচিগুলো ভেঙ্গে ফেল। একজন বলিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! গোশ্তগুলো ঢেলে দিয়ে যদি পাত্রগুলো ধুয়ে নেই? তিনি বলিলেন, তাও করিতে পার। এরপর যখন সবাই যুদ্ধের জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন, আর আমির ইবনুল আকওয়া (রাদি.)-এর তলোয়ারটা ছিল ছোট, তা দিয়ে তিনি জনৈক ইয়াহূদীর পায়ের গোছায় আঘাত করলে তরবারির তীক্ষ্ণ ভাগ ঘুরে এসে তাহাঁর নিজের হাঁটুতে লেগে যায়। এতে তিনি মারা যান। সালামাহ ইবনুল আকওয়া (রাদি.) বলেনঃ তারপর লোকেরা খাইবার থেকে ফিরতে শুরু করলে রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলিলেন, কী খবর? আমি বললামঃ আমার পিতামাতা আপনার জন্য উৎসর্গিত হোক। লোকজন ধারণা করছে, (নিজ আঘাতে মারা যাওয়ায়) আমির (রাদি.)-এর আমাল নষ্ট হয়ে গেছে। নাবী (সাঃআঃ) বলিলেন, এ কথা যে বলেছে সে মিথ্যা বলেছে। বরং আমিরের জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সাওয়াব, নাবী (সাঃআঃ) তাহাঁর দুটি আঙ্গুল একত্রিত করে দেখালেন। অবশ্যই সে একজন সচেষ্ট ব্যক্তি ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী। তাহাঁর মত গুণের অধিকারী আরাব খুব কমই আছে। আমাদের নিকট হাতিম কুতাইবাহর মাধ্যমে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। (আ.প্র. ৩৮৭৬, ই. ফা ৩৮৭৯)
৪১৯৭
আনাস (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) রাত্রিকালে খাইবারে পৌঁছলেন। আর তিনি (কোন অভিযানে) কোন গোত্রের এলাকায় রাত্রিকালে গিয়ে পৌঁছলে, সকাল না হওয়া পর্যন্ত তাদের উপর আক্রমণ চালাতেন না। সকাল হলে ইয়াহূদীরা তাদের কৃষি সরঞ্জাম ও টুকরি নিয়ে বাইরে আসল, আর রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-কে দেখিতে পেল, তখন তারা (ভয়ে) বলিতে লাগল, মুহাম্মাদ, আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদ তার দলবল নিয়ে এসে পড়েছে। তখন নাবী (সাঃআঃ) বলিলেন, খাইবার ধ্বংস হয়েছে। আমরা যখনই কোন গোত্রের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হই তখন সেই সতর্ক করা গোত্রের সকাল হয় মন্দভাবে। [৩৭১] (আ.প্র. ৩৮৭৭, ই.ফা. ৩৮৮০)
৪১৯৮
আনাস ইবনু মালিক (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা খুব সকালে খাইবারে গিয়ে পৌঁছলাম। তখন সেখানকার লোকেরা কৃষির সরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। তারা যখন নাবী (সাঃআঃ)-কে দেখিতে পেল তখন বলিল, মুহাম্মাদ, আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদ তার দলবল নিয়ে এসে পড়েছে। নাবী (সাঃআঃ) আল্লাহু আকবার ধ্বনি উচ্চারণ করে বলিলেন, খাইবার ধংস হয়েছে। আমরা যখনই কোন গোত্রের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হই, তখন সেই সতর্ক করা গোত্রের সকাল হয় মন্দভাবে। [আনাস (রাদি.) বলেন] এ যুদ্ধে আমরা গাধার গোশত লাভ করেছিলাম (আর তা পাক করা হচ্ছিল)। তখন নাবী (সাঃআঃ)-এর ঘোষণাকারী ঘোষণা করিলেন, আল্লাহ ও তাহাঁর রাসুল (সাঃআঃ) তোমাদেরকে গাধার গোশত খেতে নিষেধ করিয়াছেন। কারণ তা নাপাক। [৩৭১] (আ.প্র. ৩৮৭৮, ই.ফা. ৩৮৮১)
৪১৯৯
আনাস ইবনু মালিক (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর কাছে একজন আগন্তুক এসে বলিল, (গানীমাতের) গাধাগুলো খেয়ে ফেলা হচ্ছে। রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) চুপ রইলেন। এরপর লোকটি দ্বিতীয়বার এসে বলিল, গাধাগুলো খেয়ে ফেলা হচ্ছে। রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) তখনো চুপ থাকলেন। লোকটি তৃতীয়বার এসে বলিল, গাধাগুলো খতম করে দেওয়া হচ্ছে। তখন তিনি একজন ঘোষণাকারীকে হুকুম দিলেন। সে লোকজনের সামনে গিয়ে ঘোষণা দিলঃ আল্লাহ এবং তাহাঁর রাসুল (সাঃআঃ) তোমাদেরকে গৃহপালিত গাধার গোশত খেতে নিষেধ করিয়াছেন। তখন ডেকচিগুলো উল্টে দেয়া হল। অথচ ডেকচিগুলোতে গোশ্ত তখন টগবগ করে ফুটছিল। [৩৭১০] (আ.প্র. ৩৮৭৯, ই.ফা. ৩৮৮২)
৪২০০
আনাস (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নাবী (সাঃআঃ) খাইবারের নিকটে সকালে কিছু অন্ধকার থাকতেই ফাজ্রের সলাত আদায় করিলেন। তারপর আল্লাহু আকবার ধ্বনি উচ্চারণ করে বলিলেন, খাইবার ধ্বংস হয়েছে। আমরা যখনই কোন গোত্রের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হই তখনই সতর্ক করা গোত্রের সকালটি হয় মন্দরূপে। এ সময়ে খাইবারের অধিবাসীরা অলি-গলিতে গিয়ে আশ্রয় নিতে আরম্ভ করিল। নাবী (সাঃআঃ) তাদের মধ্যকার যোদ্ধাদেরকে হত্যা করিলেন। আর শিশু ও নারীদেরকে বন্দী করিলেন। বন্দীদের মধ্যে ছিলেন সফিয়্যাহ। প্রথমে তিনি দাহইয়াতুল কালবীর অংশে এবং পরে নাবী (সাঃআঃ)-এর অংশে বন্টিত হন। নাবী (সাঃআঃ) তাহাঁর মুক্তিদানকে (বিবাহের) মাহর হিসেবে গণ্য করেন। আবদুল আযীয ইবনু সুহাইব (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) সাবিত (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)-কে বলিলেন, হে আবু মুহাম্মাদ! আপনি কি আনাস (রাদি.)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, নাবী (সাঃআঃ) তাহাঁর [সফিয়্যাহ (রাদি.)-এর] মোহর কী ধার্য করেছিলেন? তখন সাবিত (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) হ্যাঁ বুঝানোর জন্য মাথা নাড়লেন। [৩৭১] (আ.প্র. ৩৮৮০, ই.ফা. ৩৮৮৩)
৪২০১
আনাস ইবনু মালিক (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নাবী (সাঃআঃ) সাফিয়্যা (রাদি.)-কে বন্দী করেছিলেন। পরে তিনি তাঁকে আযাদ করে বিয়ে করেছিলেন। সাবিত (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) আবাস (রাদি.)-কে জিজ্ঞেস করিলেন, নাবী (সাঃআঃ) তাহাঁর মোহর কত নির্দিষ্ট করেছিলেন? আনাস (রাদি.) বললেনঃ স্বয়ং সাফিয়্যা (রাদি.)-কেই মোহর ধার্য করেছিলেন এবং তাঁকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। [৩৭১] (আ.প্র. ৩৮৮১, ই.ফা. ৩৮৮৪)
৪২০২
আবু মূসা আশআরী (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) যখন খাইবার যুদ্ধের জন্য বের হলেন কিংবা রাবী বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) যখন খাইবারের দিকে যাত্রা করিলেন, তখন সাথী লোকজন একটি উপত্যকায় পৌঁছে এই বলে উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর দিতে শুরু করিল-আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। (আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ ব্যতীত কোন প্রকৃত ইলাহ নেই)। তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলিলেন, তোমরা নিজেদের প্রতি দয়া কর। কারণ তোমরা এমন কোন সত্তাকে ডাকছ না যিনি বধির বা অনুপস্থিত। বরং তোমরা তো ডাকছ সেই সত্তাকে যিনি শ্রবণকারী ও অতি নিকটে অবস্থানকারী, যিনি তোমাদের সঙ্গেই রয়েছেন। [আবু মূসা আশআরী (রাদি.) বলেন] আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর সাওয়ারীর পেছনে ছিলাম। তিনি আমাকে লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ বলিতে শুনে বলিলেন, হে আবদুল্লাহ ইবনু কায়স! আমি বললাম, আমি উপস্থিত হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বলিলেন, আমি তোমাকে এমন একটি কথা শিখিয়ে দেব কি যা জান্নাতের ভাণ্ডারসমূহের মধ্যে একটি ভাণ্ডার? আমি বললাম, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসুল। আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান হোক। তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলিলেন, তা হল লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ [২৯৯২] (আ.প্র. ৩৮৮৪, ই.ফা. ৩৮৮৭)
৪২০৩
সাহল ইবনু সাদ সাঈদী (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
(খাইবারের যুদ্ধে) রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) এবং মুশরিকরা মুখোমুখী হলেন। পরস্পরের মধ্যে তুমুল লড়াই হল। (দিনের শেষে) রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) তাহাঁর সেনা ছাউনিতে ফিরে আসলেন আর অন্যপক্ষও তাদের ছাউনিতে ফিরে গেল। রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর সাহাবীগণের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি তার তরবারি থেকে একাকী কিংবা দলবদ্ধ কোন শত্রু সৈন্যকেই রেহাই দেননি। বরং পিছু ধাওয়া করে তাকে তরবারির আঘাতে হত্যা করিয়াছেন। তাদের কেউ বলিলেন, অমুক ব্যক্তি আজ যা করেছে আমাদের মধ্যে আর অন্য কেউ তা করিতে সক্ষম হয়নি। তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলিলেন, কিন্তু সে তো জাহান্নামী। সাহাবীগণের একজন বলিলেন, (ব্যাপারটা দেখার জন্য) আমি তার সঙ্গী হব। সাহল ইবনু সাদ সাঈদী (রাদি.) বলেন, পরে তিনি ঐ লোকটির সঙ্গে বের হলেন, লোকটি থামলে তিনিও থামতেন, লোকটি দ্রুত চললে তিনিও দ্রুত চলতেন। বর্ণনাকারী বলেন, এক সময়ে লোকটি ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হল এবং (যন্ত্রণার চোটে) শীঘ্র মৃত্যু কামনা করিল। তাই সে তার তরবারির গোড়ার অংশ মাটিতে রেখে এর ধারালো দিক বুকের মাঝে রাখল। এরপর সে তরবারির উপর নিজেকে জোরে চেপে ধরে আত্মহত্যা করিল। তখন লোকটি (অনুসরণকারী সহাবী) রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর কাছে এসে বলিলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসুল। রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলিলেন, ব্যাপার কী? তিনি বলিলেন, একটু আগে আপনি যে লোকটির কথা বলেছিলেন যে, লোকটি জাহান্নামী, তাতে লোকেরা আশ্চর্যান্বিত হয়েছিল। তখন আমি তাদেরকে বলেছিলাম, আমি লোকটির পিছু নিয়ে দেখব। কাজেই আমি ব্যাপারটির খোঁজে বেরিয়ে পড়ি। এক সময় লোকটি মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হল এবং শীঘ্র মৃত্যু কামনা করিল, তাই সে তার তরবারির হাতলের দিক মাটিতে বসিয়ে এর তীক্ষ্ম ভাগ নিজের বুকের মাঝে রাখল। এরপর নিজেকে তার উপর জোরে চেপে ধরে আত্মহত্যা করিল। এ সময় রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলিলেন, অনেক সময় মানুষ জান্নাতীদের মত আমাল করিতে থাকে, যা দেখে অন্যরা তাকে জান্নাতীই মনে করে। অথচ সে জাহান্নামী। আবার অনেক সময় মানুষ জাহান্নামীদের মতো আমাল করিতে থাকে যা দেখে লোকজনও সেরূপই মনে করে থাকে, অথচ সে জান্নাতী। [২৯০২] (আ.প্র. ৩৮৮২, ই.ফা. ৩৮৮৫)
৪২০৪
আবু হুরাইরাহ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা খাইবার যুদ্ধে গিয়েছিলাম। রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) তখন তাহাঁর সঙ্গীদের মধ্য থেকে মুসলিম হওয়ার দাবীদার এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলিলেন, লোকটি জাহান্নামী। এরপর যুদ্ধ আরম্ভ হলে লোকটি ভীষণভাবে যুদ্ধ চালিয়ে গেল, এমন কি তার দেহ বিক্ষত হয়ে গেল। এতে কারো কারো [রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণীর উপর] সন্দেহ সৃষ্টি হল। অতঃপর লোকটি আঘাতের যন্ত্রণায় অসহ্য হয়ে তূণীরের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে সেখান থেকে তীর বের করে আনল। আর তীরটি নিজের বক্ষদেশে ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করিল। তা দেখে কতিপয় মুসলিম দ্রুত ছুটে এসে বলিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ আপনার কথাকে সত্য প্রমাণিত করিয়াছেন। ঐ লোকটি নিজেই নিজের বক্ষে আঘাত করে আত্মহত্যা করেছে। তখন তিনি বলিলেন, হে অমুক! দাঁড়াও এবং ঘোষণা দাও যে, মুমিন ব্যতীত কেউ জান্নাতে প্রবেশ করিতে পারবে না। অবশ্য আল্লাহ ফাসিক ব্যক্তি দ্বারাও দ্বীনের সাহায্য করে থাকেন। মামার (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) যুহরী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) থেকে উপরোক্ত হাদীস বর্ণনায় শুআয়ব (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর অনুসরণ করিয়াছেন। [২৮৯৮, ৩০৬২] (আ.প্র. ৩৮৮৩, ই.ফা. ৩৮৮৬)
৪২০৫
আবু হুরাইরাহ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা নাবী (সাঃআঃ)-এর সঙ্গে খাইবার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলাম ……। (আবদুল্লাহ) ইবনু মুবারাক হাদীসটি ইউনুস-যুহরী-সাঈদ [ইবনুল মুসাইয়্যাব (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)] সূত্রে নাবী (সাঃআঃ) থেকে বর্ণনা করিয়াছেন। সালিহ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) যুহরী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) থেকে ইবনু মুবারাক (রাদি.)-এর মতই বর্ণনা করিয়াছেন। আর যুবাইদী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) যুহরী, আবদুর রহমান ইবনু কাব, উবাইদুল্লাহ ইবনু কাব (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) নাবী (সাঃআঃ)-এর সঙ্গে খাইবারে অংশগ্রহণকারী জনৈক সাহাবী থেকে বর্ণনা করিয়াছেন। (যুবাইদী আরো বলেন) যুহরী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) এ হাদীসটিকে উবাইদুল্লাহ ইবনু আবদুল্লাহ এবং সাঈদ (ইবনুল মুসাইয়্যাব) (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) সূত্রে নাবী (সাঃআঃ) থেকে বর্ণনা করিয়াছেন। [৩০৬২] (আ.প্র. ৩৮৮৩, ই.ফা. ৩৮৮৬)
৪২০৬
ইয়াযীদ ইবনু আবু উবায়দ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি সালামাহ (ইবনু আকওয়া) (রাদি.)-এর পায়ের নলায় আঘাতের চিহ্ন দেখে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, হে আবু মুসলিম! এ আঘাতটি কিসের? তিনি বলিলেন, এ আঘাত আমি খাইবার যুদ্ধে পেয়েছিলাম। লোকজন বলাবলি করিল, সালামাহ মারা যাবে। আমি নাবী (সাঃআঃ)-এর কাছে আসলাম। তিনি ক্ষতটিতে তিনবার ফুঁ দিলেন। ফলে আজ পর্যন্ত এসে কোন ব্যথা অনুভব করিনি। (আ.প্র. ৩৮৮৫, ই.ফা ৩৮৮৮)
৪২০৭
সাহল (ইবনু সাদ) (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, কোন এক যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) এবং মুশরিকরা মুখোমুখী হলেন। তাদের মধ্যে তুমুল লড়াই হল। (শেষে) সকলেই আপন আপন সেনা ছাউনীতে ফিরে গেল। মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি ছিল, যে মুশরিকদের কোন একাকী কিংবা দলবদ্ধ কোন শত্রুকেই রেহাই দেয়নি বরং তাড়িয়ে নিয়ে তরবারি দ্বারা হত্যা করেছে। তখন বলা হল “হে আল্লাহর রাসুল! অমুক লোক আজ যতটা আমাল করেছে অন্য কেউ ততটা করিতে পারেনি। রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলিলেন, সে ব্যক্তি জাহান্নামী। তারা বলিল, তা হলে আমাদের মধ্যে আর কে জান্নাতী হইবে যদি এ ব্যক্তিই জাহান্নামী হয়? তখন কাফেলার মধ্য থেকে একজন বলিল, অবশ্যই আমি তাকে অনুসরণ করে দেখব (তিনি বলেন) লোকটির দ্রুত গতিতে বা ধীর গতিতে আমি তার সঙ্গে থাকতাম। শেষে, লোকটি আঘাতপ্রাপ্ত হলে যন্ত্রণার চোটে সে দ্রুত মৃত্যু কামনা করে তার তরবারির বাঁট মাটিতে রাখলো এবং ধারালো দিক নিজের বুকের মাঝে রেখে এর উপর সজোরে চেপে ধরে আত্মহত্যা করিল। তখন (অনুসরণকারী) সহাবী নাবী (সাঃআঃ)-এর কাছে এসে বলিলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসুল। তিনি [নাবী (সাঃআঃ)]জিজ্ঞেস করিলেন,কী ব্যাপার? তিনি তখন নাবী (সাঃআঃ)-কে সব ঘটনা জানালেন। তখন নাবী (সাঃআঃ) বলিলেন, কেউ কেউ জান্নাতবাসীদের মতো আমাল করিতে থাকে আর লোকজন তাকে তেমনই মনে করে থাকে অথচ সে জাহান্নামী। আবার কেউ কেউ জাহান্নামীর মতো আমাল করে থাকে আর লোকজনও তাকে তাই মনে করে অথচ সে জান্নাতী। [২৮৯৮] (আ.প্র. ৩৮৮৬, ই.ফা. ৩৮৮৯)
৪২০৮
আবু ইমরান (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, কোন এক জুমুআহর দিনে আনাস (রাদি.) লোকজনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তাদের (মাথায়) তায়ালিসাহ [৪৮] চাদর। তখন তিনি বলিলেন, এ মুহূর্তে এদেরকে খাইবারের ইয়াহূদীদের মতো দেখাচ্ছে। (আ.প্র. ৩৮৮৭, ই.ফা. ৩৮৯০)
[৪৮] এক প্রকারের চাদরকে ত্বয়ালিসাহ বলা হয়। খায়বারে ইয়াহূদ সম্প্রদায় এগুলো অধিক ব্যবহার করতো। তাই আনাস (রাদি.) বসরায় আগমনের পর খুতবায় দাঁড়িয়ে মুসল্লীগণকে তয়ালিসাহ চাদর পরা অবস্থায় দেখিতে পেয়ে স্বীয় অনুভূতি ব্যক্ত করিলেন।
৪২০৯
সালামাহ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, চক্ষু রোগ হওয়ায় আলী (রাদি.) নাবী (সাঃআঃ)-এর থেকে খাইবার অভিযানে পেছনে পড়ে গিয়েছিলেন। [নাবী (সাঃআঃ) মাদীনাহ থেকে রওয়ানা হয়ে এসে পড়লে] আলী (রাদি.) বলেন, আমি পেছনে বসে থাকব। সুতরাং তিনি গিয়ে তাহাঁর সঙ্গে মিলিত হলেন। [সালামাহ (রাদি.) বলেন] খাইবার বিজিত হওয়ার আগের রাতে তিনি [নাবী (সা.] বলিলেন, আগামীকাল সকালে আমি এমন ব্যক্তির হাতে পতাকা তুলে দেব অথবা তিনি বলেছেন, আগামীকাল সকালে এমন এক ব্যক্তি পতাকা গ্রহণ করিবে যাকে আল্লাহ এবং তাহাঁর রাসুল ভালবাসেন। আর তার হাতেই খাইবার বিজিত হইবে। কাজেই আমরা সবাই সেটি কামনা করছিলাম। তখন বলা হল, এই তো আলী। এরপর রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) তাঁকে পতাকা প্রদান করিলেন এবং তাহাঁর হাতেই খাইবার বিজিত হল। [২৯৭৫] (আ.প্র. ৩৮৮৮, ই.ফা. ৩৮৯১)
৪২১০
সাহল ইবনু সাদ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
খাইবারের যুদ্ধে একদা রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলিলেন, আগামীকাল সকালে আমি এমন এক লোকের হাতে ঝাণ্ডা তুলে দেব যার হাতে আল্লাহ খাইবারে বিজয় দান করবেন যে আল্লাহ এবং তাহাঁর রাসুলকে ভালবাসে এবং যাকে আল্লাহ এবং তাহাঁর রাসুল ভালবাসেন। সাহল (রাদি.) বলেন, মুসলিমগণ এ জল্পনায় রাত কাটালো যে, তাদের মধ্যে কাকে দেয়া হইবে এ ঝাণ্ডা। সকালে সবাই রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর কাছে আসলেন, আর প্রত্যেকেই তা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করছিলেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলিলেন, আলী ইবনু আবু ত্বলিব (রাদি.) কোথায়? সাহাবীগণ বলিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! তিনি তো চক্ষুরোগে আক্রান্ত। তিনি বলিলেন, তার কাছে লোক পাঠাও। সে মতে তাঁকে আনা হল। রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) তার উভয় চোখে থুথু লাগিয়ে তার জন্য দুআ করিলেন। ফলে চোখ এমন ভাল হয়ে গেল যেন কখনো চোখে কোন রোগই ছিল না। এরপর তিনি তার হাতে ঝাণ্ডা প্রদান করিলেন। তখন আলী (রাদি.) বলিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! তারা আমাদের মতো (মুসলিম) না হওয়া পর্যন্ত আমি তাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাব। রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলিলেন, তুমি বর্তমান অবস্থায়ই তাদের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে হাজির হও, এরপর তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের প্রতি আহবান করো, আল্লাহর অধিকার প্রদানে তাদের প্রতি যে দায়িত্ব বর্তায় সে সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত কর। কারণ আল্লাহর কসম! তোমার দাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ যদি মাত্র একজন মানুষকেও হিদায়াত দেন তাহলে তা তোমার জন্য লাল রঙের (মূল্যবান) উটের [৪৯] মালিক হওয়ার চেয়ে উত্তম। [২৯৪২] (আ.প্র. ৩৮৮৯, ই.ফা. ৩৮৯২)
[৪৯] আরবীয় উটের যত প্রকার আছে তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর, অভিজাত, আকর্ষণীয় ও মূল্যবান উট হচ্ছে লাল রঙের উট।
৪২১১
আনাস ইবনু মালিক (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা খাইবারে এসে পৌঁছলাম। এরপর যখন আল্লাহ তাঁকে খাইবার দূর্গের বিজয় দান করিলেন তখন তাহাঁর কাছে (ইয়াহূদী দলপতি) হুয়াঈ ইবনু আখতারের কন্যা সফিয়্যাহ (রাদি.)-এর সৌন্দর্যের ব্যাপারে আলোচনা করা হল। তার স্বামী (এ যুদ্ধে) নিহত হয়। সে ছিল নববধূ। নাবী (সাঃআঃ) তাকে নিজের জন্য মনোনীত করেন এবং তাকে সঙ্গে করে (খাইবার থেকে) যাত্রা করেন। এরপর আমরা যখন সাদ্দুস সাহবা নামক স্থানে গিয়ে পৌঁছলাম তখন সফিয়্যাহ (রাদি.) তাহাঁর মাসিক ঋতুস্রাব থেকে মুক্ত হলে রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) তাহাঁর সঙ্গে বাসর করিলেন। তারপর একটি ছোট দস্তরখানে (খেজুর-ঘি ও ছাতু মিশ্রিত) হায়স নামক খানা সাজিয়ে আমাকে বলিলেন, তোমার আশেপাশে যারা আছে সবাইকে ডাক। আর এটিই ছিল সফিয়্যাহ (রাদি.)-এর সঙ্গে বিয়ের ওয়ালীমা। তারপর আমরা মাদীনাহর দিকে রওয়ানা হলাম, আমি নাবী (সাঃআঃ)-কে তাহাঁর সাওয়ারীর পেছনে সফিয়্যাহ (রাদি.)-এর জন্য একটি চাদর বিছাতে দেখেছি। এরপর তিনি তাহাঁর সাওয়ারীর ওপর হাঁটুদ্বয় মেলে বসতেন এবং সফিয়্যাহ নাবী (সাঃআঃ)-এর হাঁটুর উপর পা রেখে সাওয়ারীতে উঠতেন। [৩৭১] (আ.প্র. ৩৮৯০, ই.ফা. ৩৮৯৩)
৪২১২
আনাস ইবনু মালিক (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
নাবী (সাঃআঃ) খাইবার থেকে ফেরার পথে সফিয়্যাহ (রাদি.) বিনতে হুয়াঈ-এর কাছে তিনদিন অবস্থান করে তার সঙ্গে বাসর যাপন করিয়াছেন। আর (রাদি.) ছিলেন তাদের একজন যাদের জন্য পর্দার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। [৫০] [৩৭১] (আ.প্র. ৩৮৯১, ই.ফা. ৩৮৯৪)
[৫০] ইসলামী শরীআহতে ক্রীতদাসীর জন্য পর্দার হুকুম পালন করিতে হতো না। কিন্তু স্বাধীন নারীদের জন্য পর্দা করিতে হতো। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাফিয়া (রাদি.)-এর জন্য পর্দার ব্যবস্থা করায় বুঝা গেল তিনি তাকে ক্রীতদাসী নয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করিয়াছেন।
৪২১৩
আনাস (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন,নাবী (সাঃআঃ) খাইবার ও মাদীনাহর মাঝে একস্থানে তিনদিন অবস্থান করেছিলেন যাতে তিনি সফিয়্যাহ (রাদি.)-এর সঙ্গে বাসর করিয়াছেন। আমি মুসলিমদেরকে ওয়ালীমার জন্য দাওয়াত দিলাম। অবশ্য এ ওয়ালীমাতে গোশতও ছিল না, রুটিও ছিল না। কেবল এতটুকু ছিল যে, তিনি বিলাল (রাদি.)-কে দস্তরখান বিছাতে বলিলেন। তা বিছানো হল। এরপর তাতে কিছু খেজুর, পনির ও ঘি রাখা হল। এ অবস্থা দেখে মুসলিমগণ পরস্পর বলাবলি করিতে লাগল যে, তিনি [সফিয়্যাহ (রাদি.)] কি উম্মাহাতুল মুমিনীনের একজন, না ক্রীতদাসীদের একজন? তাঁরা (আরো) বলিলেন, যদি রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) তাহাঁর জন্য পর্দার ব্যবস্থা করেন তাহলে তিনি উম্মাহাতুল মুমিনীনেরই একজন বোঝা যাবে। আর পর্দার ব্যবস্থা না করলে তিনি দাসীদের অন্তর্ভুক্ত। এরপর যখন তিনি [নাবী (সাঃআঃ)] রওয়ানা হলেন তখন তিনি নিজের পেছনে সফিয়্যাহ (রাদি.)-এর জন্য বসার জায়গা করে দিয়ে পর্দা খাটিয়ে দিলেন। [৩৭১] (আ.প্র. ৩৮৯২, ই.ফা. ৩৮৯৫)
৪২১৪
আবদুল্লাহ ইবনু মুগাফ্ফাল (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা খাইবারের দূর্গ অবরোধ করে রাখলাম, এমন সময় এক লোক একটি থলে ছুঁড়ে ফেলল। তাতে ছিল চর্বি। আমি সেটি নেয়ার জন্য দ্রুত এগিয়ে গেলাম, হঠাৎ পেছনে ফিরে দেখি নাবী (সাঃআঃ)। এতে আমি লজ্জিত হয়ে গেলাম। (আ.প্র. ৩৮৯৩, ই.ফা. ৩৮৯৬)
৪২১৫
ইবনু উমার (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
খাইবার যুদ্ধের দিন রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) রসুন ও গৃহপালিত গাধার গোশত খেতে নিষেধ করিয়াছেন। রসূন খেতে নিষেধ করিয়াছেন কথাটি এক্ষেত্রে নাফি হইতে বর্ণিত হয়েছে, আর গৃহপালিত গাধার গোশত খেতে নিষেধ করিয়াছেন কথাটি সালিম [ইবনু আবদুল্লাহ (রাদি.)] হইতে বর্ণিত হয়েছে। [৮৫৩] (আ.প্র. ৩৮৯৪, ই.ফা. ৩৮৯৭)
৪২১৬
আলী ইবনু আবু ত্বলিব (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) খাইবার যুদ্ধের দিন মহিলাদের মুতআহ [৫১] করা থেকে এবং গৃহপালিত গাধার গোশত খেতে নিষেধ করিয়াছেন। [৫১১৫, ৫৫২৩, ৬৯৬১; মুসলিম ১৬/২, হাদীস ১৪০৭] (আ.প্র. ৩৮৯৫, ই.ফা. ৩৮৯৮)
[৫১] নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকে মুতআহ বিবাহ বলা হয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ক্ষেত্র বিশেষে যেমন যুদ্ধ চলাকালীন সময় ও সফরে বৈধ ছিল। কিন্তু তখনও সাধারণতঃ এভাবে বিবাহ বৈধ ছিল না। পরে খায়বারের যুদ্ধে এ ধরনের বিবাহকে হারাম ঘোষণা করা হয়। অতঃপর অষ্টম হিজরীতে মাক্কাহ বিজয়ের সময় মাত্র তিন দিনের জন্য তা বৈধ করা হয়েছিল। এরপর তা চিরতরে হারাম করা হয়। কিন্তু শিয়া মতাবলম্বীদের মতে মুতআহ বিবাহ অদ্যাবধি বৈধ এবং পুণ্যের কাজ। এবং মুতআহকারী ব্যক্তি বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। (নাউযুবিল্লাহ)
৪২১৭
ইবনু উমার (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) খাইবার যুদ্ধের দিন গৃহপালিত গাধার গোশত খেতে নিষেধ করিয়াছেন। [৮৫৩] (আ. প্র ৩৮৯৬, ই.ফা. ৩৮৯৯)
৪২১৮
ইবনু উমার (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) গৃহপালিত গাধার গোশত খেতে নিষেধ করিয়াছেন। [৮৫৩] (আ. প্র ৩৮৯৭, ই.ফা. ৩৯০০)
৪২১৯
জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) খাইবারের যুদ্ধের দিন (গৃহপালিত) গাধার গোশত খেতে নিষেধ করিয়াছেন এবং ঘোড়ার গোশত খেতে অনুমতি দিয়েছেন। [৫৫২০-৫৫২৪; মুসলিম ৩৪/৬. হাদীস ১৯৪১, আহমাদ ১৪৮৯৬] (আ.প্র. ৩৮৯৮, ই.ফা. ৩৯০১)
৪২২০
ইবনু আবী আওফা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
(তিনি বলেন) খাইবারের দিন আমরা ভীষণ ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলাম, আর তখন আমাদের পাতিলগুলোতে (গাধার গোশত) টগবগ করে ফুটছিল। রাবী বলেন, কোন কোন পাতিলের গোশত পাকানো হয়ে গিয়েছিল। এমন সময়ে নাবী (সাঃআঃ)-এর ঘোষণাকারী এসে ঘোষণা দিলেন, তোমরা (গৃহপালিত) গাধার গোশত থেকে একটুও খাবে না এবং তা ঢেলে দেবে। ইবনু আবী আওফা (রাদি.) বলেন, ঘোষণা শুনে আমরা পরস্পর বলাবলি করলাম যে, যেহেতু গাধাগুলো থেকে খুমুস (এক-পঞ্চমাংশ) বের করা হয়নি এ কারণেই তিনি সেগুলো খেতে নিষেধ করিয়াছেন। কেউ কেউ বলিলেন, তিনি চিরদিনের জন্যই গাধার গোশত খেতে নিষেধ করিয়াছেন। কেননা গাধা অপবিত্র জিনিস খেয়ে থাকে। [৩১৫৫] (আ.প্র. ৩৮৯৯, ই.ফা. ৩৯০২)
৪২২১
বারাআ এবং আবদুল্লাহ ইবনু আবু আওফা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
(খাইবার যুদ্ধে) তাঁরা নাবী সাঃআঃ-এর সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা গাধার গোশত পেলেন। তাঁরা তা রান্না করিলেন। এমন সময়ে নাবী সাঃআঃ-এর ঘোষণাকারী ঘোষণা করিলেন, ডেকচিগুলো উল্টে ফেল। [৩১৫৫, ৪২২৩, ৪২২৫, ৪২২৬, ৫৫২৫; মুসলিম ৩৪/৫, হাদীস ১৯৩৮, আহমাদ ১৮৬৪৬] (আঃপ্রঃ ৩৯০০, ইঃফাঃ ৩৯০৩)
৪২২২
বারাআ এবং আবদুল্লাহ ইবনু আবু আওফা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
(খাইবার যুদ্ধে) তাঁরা নাবী সাঃআঃ-এর সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা গাধার গোশত পেলেন। তাঁরা তা রান্না করিলেন। এমন সময়ে নাবী সাঃআঃ-এর ঘোষণাকারী ঘোষণা করিলেন, ডেকচিগুলো উল্টে ফেল। [৩১৫৫, ৪২২৩, ৪২২৫, ৪২২৬, ৫৫২৫; মুসলিম ৩৪/৫, হাদীস ১৯৩৮, আহমাদ ১৮৬৪৬] (আঃপ্রঃ ৩৯০০, ইঃফাঃ ৩৯০৩)
৪২২৩
আদী ইবনু সাবিত (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
(তিনি বলেন) আমি বারাআ এবং ইবনু আবু আওফা (রাদি.)-কে নাবী সাঃআঃ থেকে বর্ণনা করিতে শুনিয়াছি যে, খাইবারের দিন তাঁরা গাধার গোশত রান্না করার জন্য ডেকচি বসিয়েছিলেন, তখন নাবী সাঃআঃ বলিলেন, ডেকচিগুলো উল্টে ফেল। [৩১৫৩, ৩৩৫৫] (আঃপ্রঃ ৩৯০১, ইঃফাঃ ৩৯০৪)
৪২২৪
আদী ইবনু সাবিত (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
(তিনি বলেন) আমি বারাআ এবং ইবনু আবু আওফা (রাদি.)-কে নাবী সাঃআঃ থেকে বর্ণনা করিতে শুনিয়াছি যে, খাইবারের দিন তাঁরা গাধার গোশত রান্না করার জন্য ডেকচি বসিয়েছিলেন, তখন নাবী সাঃআঃ বলিলেন, ডেকচিগুলো উল্টে ফেল। [৩১৫৩, ৩৩৫৫] (আঃপ্রঃ ৩৯০১, ইঃফাঃ ৩৯০৪)
৪২২৫
বারাআ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা নাবী (সাঃআঃ)-এর সঙ্গে খাইবারে অভিযানে গিয়েছিলাম…….। তিনি উপরোল্লিখিত বর্ণনার অনুরূপ বর্ণনা করিয়াছেন। [৪২২১] (আ.প্র. ৩৯০২, ই.ফা. ৩৯০৫)
৪২২৬
বারাআ ইবনু আযিব (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, খাইবার যুদ্ধের দিন নাবী (সাঃআঃ) আমাদেরকে কাঁচা ও রান্না করা গৃহপালিত গাধার গোশত ফেলে দিতে হুকুম করিয়াছেন। এরপরে আর কখনো তা খাওয়ার অনুমতি দেননি। [৪২২১] (আ.প্র. নাই, ই.ফা. ৩৯০৬)
৪২২৭
ইবনু আব্বাস (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি জানি না, গৃহপালিত গাধাগুলো মানুষের মালপত্র বহন করে, কাজেই তার গোশত খেলে মানুষের বোঝা বহনকারী পশু নিঃশেষ হয়ে যাবে, এজন্য রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) তা খেতে নিষেধ করেছিলেন, না খাইবারের দিনে এর গোশত স্থায়ীভাবে হারাম ঘোষণা করিয়াছেন। [মুসলিম ৩৪/৫, হাদীস ১৯৩৯] (আ.প্র. ৩৯০৩, ই.ফা. ৩৯০৭)
৪২২৮
ইবনু উমার (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, খাইবার যুদ্ধের দিন রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) ঘোড়ার দুই অংশ এবং পদাতিক সৈন্যের জন্য এক অংশ হিসেবে (গানীমাতের) মাল বণ্টন করিয়াছেন। বর্ণনাকারী [উবাদুল্লাহ ইবনু উমার (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)] বলেন, নাফি হাদীসটির ব্যাখ্যা করে বলেছেন, (যুদ্ধে) যার সঙ্গে ঘোড়া থাকে সে পাবে তিন অংশ এবং যার সঙ্গে ঘোড়া থাকে না, সে পাবে এক অংশ। [২৮৬৩] (আ.প্র.৩৯০৪, ই.ফা. ৩৯০৮)
৪২২৯
যুবায়র ইবনু মুতঈম (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি এবং উসমান ইবনু আফ্ফান (রাদি.) নাবী (সাঃআঃ)-এর কাছে গিয়ে বললাম, আপনি খাইবারের প্রাপ্ত খুমুস থেকে বানু মুত্তালিবকে অংশ দিয়েছেন, আমাদেরকে দেননি। অথচ আমরা ও তারা সম্পর্কের দিক থেকে আপনার কাছে একই পর্যায়ের। তখন নাবী (সাঃআঃ) বলিলেন, নিঃসন্দেহে বানী হাশিম এবং বানু মুত্তালিব সম-মর্যাদার অধিকারী। যুবায়র (রাদি.) বলেন, নাবী (সাঃআঃ) বানু আবদে শামস ও বানু নাওফিলকে (খাইবার যুদ্ধের খুমুস থেকে) কিছুই বণ্টন করেননি। [৩১৪০] (আ.প্র.৩৯০৫, ই.ফা. ৩৯০৯)
৪২৩০
আবু মূসা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা ইয়ামানে থাকা অবস্থায় আমাদের কাছে নাবী (সাঃআঃ)-এর হিজরতের খবর পৌঁছল। তাই আমি ও আমার দুভাই আবু বুরদা ও আবু রুহম এবং আমাদের কাওমের আরো মোট বায়ান্ন কি তিপ্পান্ন কিংবা আনেরা কিছু লোকজনসহ আমরা হিজরতের উদ্দেশে বের হলাম। আমি ছিলাম আমার অপর দুভাইয়ের চেয়ে বয়সে ছোট। আমরা একটি জাহাজে উঠলাম। জাহাজটি আমাদেরকে আবিসিনিয়া দেশের (বাদশাহ) নাজ্জাশীর নিকট নিয়ে গেল। সেখানে আমরা জাফর ইবনু আবু তালিবের সাক্ষাৎ পেলাম এবং তাহাঁর সঙ্গেই আমরা থেকে গেলাম। অবশেষে নাবী (সাঃআঃ)-এর খাইবার বিজয়ের সময় সকলে এক যোগে (মদিনায়) এসে তাহাঁর সঙ্গে মিলিত হলাম। এ সময়ে মুসলিমদের কেউ কেউ আমাদেরকে অর্থাৎ জাহাজে আগমনকারীদেরকে বলিল, হিজরতের ব্যাপারে আমরা তোমাদের চেয়ে অগ্রগামী। আমাদের সঙ্গে আগমনকারী আসমা বিনত উমাইস একবার নাবী (সাঃআঃ)-এর সহধর্মিণী হাফসাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে এসেছিলেন। তিনিও (তাহাঁর স্বামী জাফরসহ) নাজ্জাশীর দেশে হিজরাতকারীদের সঙ্গে হিজরাত করেছিলেন। আসমা (রাদি.) হাফসাহর কাছেই ছিলেন। এ সময়ে উমার (রাদি.) তাহাঁর ঘরে প্রবেশ করিলেন। উমার (রাদি.) আসমাকে দেখে জিজ্ঞেস করিলেন, ইনি কে? হাফসাহ (রাদি.) বলিলেন, তিনি আসমা বিনত উমাইস (রাদি.)। উমার (রাদি.) বলিলেন, ইনি হাবশায় হিজরাতকারিণী আসমা? ইনিই কি সমুদ্রগামিনী? আসমা (রাদি.) বলিলেন, হ্যাঁ! তখন উমার (রাদি.) বলিলেন, হিজরাতের ব্যাপারে আমরা তোমাদের চেয়ে আগে আছি। সুতরাং তোমাদের তুলনায় রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর প্রতি আমাদের হক অধিক। এতে আসমা (রাদি.) রেগে গেলেন এবং বলিলেন, কখনো হইতে পারে ন। আল্লাহর কসম! আপনারা তো রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর সঙ্গে ছিলেন, তিনি আপনাদের ক্ষুধার্তদের খাবারের ব্যবস্থা করিতেন, আপনাদের অবুঝ লোকদেরকে নাসীহাত করিতেন। আর আমরা ছিলাম এমন এক এলাকার অথবা তিনি বলেছেন এমন এক দেশে যা রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) থেকে বহুদূরে এবং সর্বদা শত্রু বেষ্টিত হাবশা দেশে। আল্লাহ ও তাহাঁর রসূলের উদ্দেশেই ছিল আমাদের এ হিজরাত আল্লাহর কসম! আমি কোন খাবার খাবো না, পানিও পান করিবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি যা বলেছেন তা আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-কে না জানাব। সেখানে আমাদেরকে কষ্ট দেয়া হত, ভয় দেখানো হত। শীঘ্রই আমি নাবী (সাঃআঃ)-কে এসব কথা বলিল এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করব। তবে আল্লাহর কসম! আমি মিথ্যা বলব না, পেঁচিয়ে বলব না, বাড়িয়েও কিছু বলব না। [৩১৩৬] (আ.প্র. ৩৯০৬, ই.ফা. ৩৯১০)
৪২৩১
বর্ণনাকারী হইতে বর্ণিতঃ
এরপর যখন নাবী সাঃআঃ আসলেন, তখন আসমা (রাদি.) বলিলেন, হে আল্লাহর নাবী! উমার (রাদি.) এই কথা বলেছেন, তিনি জিজ্ঞেস করিলেন, তুমি কী উত্তর দিয়েছ? আসমা (রাদি.) বললেনঃ আমি তাঁকে এই এই বলেছি। নাবী সাঃআঃ বলিলেন, (এ ব্যাপারে) তোমাদের চেয়ে উমার (রাদি.) আমার প্রতি অধিক হক রাখে না। কারণ উমার (রাদি.) এবং তাহাঁর সাথীরা একটি হিজরাত লাভ করেছে, আর তোমরা যারা জাহাজে হিজরাতকারী ছিলে তারা দুটি হিজরাত লাভ করেছ। আসমা (রাদি.) বলেন, এ ঘটনার পর আমি আবু মূসা (রাদি.) এবং জাহাজযোগে হিজরাতকারী অন্যদেরকে দেখেছি যে, তাঁরা সদলবলে এসে আমার নিকট থেকে এ হাদীসখানা শুনতেন। আর নাবী সাঃআঃ তাঁদের সম্পর্কে যে কথাটি বলেছিলেন সে কথাটির চেয়ে তাঁদের কাছে দুনিয়ার অন্য কোন জিনিস অধিকতর প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আবু বুরদাহ (রাদি.) বলেন যে, আসমা (রাদি.) বলেছেন, আমি আবু মূসা [আশআরী (রাদি.)]-কে দেখেছি, তিনি বারবার আমার নিকট হইতে এ হাদীসটি শুনতে চাইতেন। [মুসলিম ৪৪/৪১, হাদীস ২৫০২, ২৫০৩] (আঃপ্রঃ ৩৯০৬, ইঃফাঃ ৩৯১০)
৪২৩২
আবু বুরদা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
আবু মূসা (রাদি.) থেকে আরো বর্ণনা করেনে যে, নাবী (সাঃআঃ) বলেছেন, আশআরী গোত্রের লোকেরা রাতের বেলায় এলেও আমি তাদেরকে তাদের কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ দিয়েই চিনতে পারি এবং রাতের বেলায় তাদের কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ শুনেই আমি তাদের বাড়িঘর চিনতি পারি। যদিও আমি দিবাভাগে তাদেরকে নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করিতে দেখিনি। হাকীম ছিলেন আশআরীদের একজন। যন তিনি কোন দল কিংবা (বর্ণনাকারী বলেছেন) কোন দুশমনের মুখোমুখী হইতেন তখন তিনি তাদেরকে বলিতেন, আমার সাথীরা তোমাদের বলেছেন, যেন তোমরা তাঁদের জন্য অপেক্ষা কর। [মুসলিম ৪৪/৩১, হাদীস ২৪৯৯] (আ.প্র ৩৯০৬, ই.ফা. ৩৯১০)
৪২৩৩
আবু মূসা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, খাইবার বিজয়ের পরে আমরা নাবী (সাঃআঃ)-এর কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। তিনি আমাদের জন্য গানীমাতের মাল বণ্টন করিয়াছেন। আমাদের ব্যতীত বিজয়ে অংশ নেয়নি এমন কারোর জন্য তিনি (খাইবারের গানীমাত) বণ্টন করেননি। [৩১৩৬] (আ.প্র. ৩৯০৭, ই.ফা. ৩৯১১)
৪২৩৪
আবু হুরাইরাহ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, খাইবার যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি কিন্তু গানীমাত হিসেবে আমরা সোনা, রূপা কিছুই পাইনি। আমরা গানীমাত হিসেবে পেয়েছিলাম গরু, উট, বিভিন্ন দ্রব্য-সামগ্রী এবং ফলের বাগান। (যুদ্ধ শেষে) আমরা রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর সঙ্গে ওয়াদিউল কুরা পর্যন্ত ফিরে এরাম। তাহাঁর [নাবী (সাঃআঃ)] সঙ্গে ছিল মিদআম নামে তাহাঁর একট গোলাম। বানী যিবাব (রাদি.)-এর এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-কে এটি হাদিয়া দিয়েছিল। এক সময়ে সে রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর হাওদা নামানোর কাজে ব্যস্ত ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে অজ্ঞাত একটি তীর ছুটে এসে তার গায়ে পড়ল। তাতে গোলামটি মারা গেল। তখন লোকেরা বলিতে লাগল, কী আনন্দদায়ক তার এ শাহাদাত! তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলিলেন, আচ্ছা? সেই মহান সত্তার কসম! তাহাঁর হাতে আমার প্রাণ, বণ্টনের আগে খাইবারের গানীমাত থেকে যে চাদরখানা তুলে নিয়েছিল সেটি আগুন হয়ে অবশ্যই তাকে দগ্ধ করিবে। নাবী (সাঃআঃ)-এর এ কথা শুনে আরেক লোক একটি অথবা দুটি জুতার ফিতা নিয়ে এসে বলিল, এ জিনিসটি আমি বণ্টনের আগেই নিয়েছিলাম। রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলিলেন, এ একটি অথবা দুটি ফিতাও হয়ে যেত আগুনের (ফিতা)। [৫২] [৬৭০৭; মুসলিম ১/৪৯, হাদীস ১১৫] (আ.প্র ৩৯০৮, ই.ফা. ৩৯১২)
[৫২] গানীমাতের মাল সব একত্র করা হইবে এবং সেখান থেকে বণ্টন করা হইবে। বণ্টিত ব্যতীত গানীমাতের কোন মাল হস্তগত করা বা চুরি করা মারাত্মক রকমের খিয়ানাত। কুরআন মাজীদের সূর আলু ইমরানের ১৬১ আয়াতে এ ব্যাপারে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে যা বলা হয়েছে অত্র হাদীসটি তারই ব্যাখ্যা স্বরূপ।
৪২৩৫
উমার ইবনু খাত্তাব (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, মনে রেখ! সেই সত্তার কসম! যাঁর হাতে আমার প্রাণ, যদি পরবর্তী বংশধরদের নিঃস্ব ও রিক্ত-হস্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা না থাকত তা হলে আমি আমার সকল বিজিত এলাকা ঐভাবে বণ্টন করে দিতাম যেভাবে নাবী (সাঃআঃ) খাইবার বণ্টন করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি তা তাদের জন্য গচ্ছিত রেখে যাচ্ছি যেন পরবর্তী বংশধরগণ তা নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নিতে পারে। [২৩৩৪] (আ.প্র. ৩৯০৯, ই.ফা. ৩৯১৩)
৪২৩৬
উমার (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, পরবর্তী মুসলিমদের উপর আমার আশঙ্কা না থাকলে আমি তাদের (মুজাহিদগণের) বিজিত এলাকাগুলো তাদেঁর মধ্যে সেভাবে বণ্টন করে দিতাম যেভাবে নাবী (সাঃআঃ) খাইবার বণ্টন করে দিয়েছিলেন। [২৩৩৪] (আ.প্র. ৩৯১০, ই.ফা. ৩৯১৪)
৪২৩৭
আমবাসা ইবনু সাঈদ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) হইতে বর্ণিতঃ
আবু হুরাইরা (রাদি.) নাবী (সাঃআঃ)-এর কাছে এসে (খাইবার যুদ্ধের গানীমাতের) অংশ চাইলেন। তখন বনূ সাঈদ ইবনু আস গোত্রের জনৈক ব্যক্তি বলে উঠল, না, তাকে (অংশ) দিবেন না। আবু হুরাইরা (রাদি.) বলিলেন, এ লোক তো ইবনু কাওকালের হত্যাকারী। কথাটি শুনে সে ব্যক্তি বলিল, পাহাড়ের চূড়া থেকে লাফিয়ে পড়া (উড়ে এসে জুড়ে বসা) বুনো বিড়ালের কথায় আশ্চর্যবোধ করছি। [২৮২৭] (আ.প্র. ৩৯১১, ই.ফা. ৩৯১৫ প্রথমাংশ)
৪২৩৮
যুবাইদী-যুহরী-আমবাসাহ ইবনু সাঈদ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) হইতে বর্ণিতঃ
আবু হুরাইরা (রাদি.) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি সাঈদ ইবনু আস (রাদি.)-কে সংবাদ দিচ্ছেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) আবান [ইবনু সাঈদ (রাদি.)]-এর নেতৃত্বে একটি সৈন্যদল মাদীনাহ থেকে নাজদের দিকে পাঠিয়েছিলেন। আবু হুরাইরা (রাদি.) বলেন, নাবী (সাঃআঃ) খাইবার বিজয়ের পর সেখানে অবস্থঅনকালে আবান (রাদি.) এ তাহাঁর সঙ্গীগণ সেখানে এসে তাহাঁর [নাবী (সাঃআঃ)-এর] সঙ্গে মিলিত হলেন। তাদের ঘোড়াগুলোর লাগাম ছিল খেজুরের ছালের তৈরি। আবু হুরাইরা (রাদি.) বলেনঃ আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! তাদেরকে কোন অংশ দিবেন না। তখন আবান (রাদি.) বরলেন, পাহাড়ের চূড়া থেকে লাফিয়ে পড়া বুনো বিড়াল, তোমাকেই দেয়া হইবে না। নাবী (সাঃআঃ) বলিলেন, হে আবান! বস। নাবী (সাঃআঃ) তাদেরকে (আবান ও তার সঙ্গীদেরকে) অংশ দিলেন না। [২৮২৭] (আ.প্র. ৩৯১১, ই.ফা. ৩৯১৫)
৪২৩৯
আমর ইবনু ইয়াহইয়া ইবনু সাইদ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমার দাদা [সাঈদ ইবনু আমর ইবনু সাঈদ ইবনুল আস (রাদি.) আমাকে জানিয়েছেন যে, আবান ইবনু সাঈদ (রাদি.) নাবী (সাঃআঃ)-এর কাছে সালাম দিলেন। তখন আবু হুরাইরা (রাদি.) বলিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এ তো ইবনু কাওকাল (রাদি.)-এর হত্যাকারী! তখন আবান (রাদি.) আবু হুরাইরা (রাদি.)-কে বলিলেন, দান পর্বতের চূড়া থেকে হঠাৎ নেমে আসা বুনো বিড়ালের কথায় আশ্চর্য হচ্ছি! সে এমন এক লোকের ব্যাপারে আমাকে দোষারাপ করছে যাকে আল্লাহ আমার হাত দিয়ে সম্মানিত করিয়াছেন (শাহাদাত দান করিয়াছেন)। আর তাহাঁর হাত দিয়ে লাঞ্ছিত হওয়া থেকে আমাকে রক্ষা করিয়াছেন [৫৩]। [২৮২৭] (আ.প্র. ৩৯১২, ই.ফা. ৩৯১৬)
[৫৩] কারণ উহুদের যুদ্ধের সময় তিনি কাফির হয়ে মারা গেলে চিরকাল তাকে জাহান্নামে লাঞ্ছিত হয়ে থাকতে হত।
৪২৪০
আয়েশাহ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
নাবী সাঃআঃ-এর কন্যা ফাতেমাহ (রাদি.) আবু বাকর (রাদি.)-এর নিকট রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ-এর পরিত্যক্ত সম্পত্তি মদিনা্ ও ফাদাক-এ অবস্থিত ফাই (বিনা যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ) এবং খাইবারের খুমুসের (পঞ্চমাংশ) অবশিষ্ট থেকে মিরাসী স্বত্ব চেয়ে পাঠালেন। তখন আবু বাকর (রাদি.) উত্তরে বলিলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ বলে গেছেন, আমাদের (নাবীদের) কোন ওয়ারিশ হয় না, আমরা যা ছেড়ে যাব তা সদাকাহ হিসেবে গণ্য হইবে। অবশ্য মুহাম্মাদ সাঃআঃ-এর বংশধরগণ এ সম্পত্তি থেকে ভরণ-পোষণ চালাতে পারবেন। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ-এর সদাকাহ তাহাঁর জীবদ্দশায় যে অবস্থায় ছিল আমি সে অবস্থা থেকে এতটুকুও পরিবর্তন করব না। এ ব্যাপারে তিনি যেভাবে ব্যবহার করে গেছেন আমিও ঠিক সেভাবেই ব্যবহার করব। এ কথা বলে আবু বাকর (রাদি.) ফাতেমাহ (রাদি.)-কে এ সম্পদ থেকে কিছু দিতে অস্বীকার করিলেন। এতে ফাতিমাহ (রাদি.) (মানবোচিত কারণে) আবু বাকর (রাদি.)-এর উপর নাখোশ হলেন এবং তাহাঁর থেকে সম্পর্কহীন থাকলেন। তাহাঁর মৃত্যু অবধি তিনি আবু বাকর (রাদি.)-এর সঙ্গে কথা বলেননি। নাবী সাঃআঃ-এর পর তিনি ছয় মাস জীবিত ছিলেন। তিনি ইন্তিকাল করলে তাহাঁর স্বামী আলী (রাদি.) রাতের বেলা তাঁকে দাফন করেন। আবু বাকর (রাদি.)-কেও এ খবর দিলেন না এবং তিনি তার জানাযার সালাত আদায় করে নেন।[১] ফাতেমাহ (রাদি.)-এর জীবিত অবস্থায় লোকজনের মনে আলী (রাদি.)-এর মর্যাদা ছিল। ফাতিমাহ (রাদি.) ইন্তিকাল করলে আলী (রাদি.) লোকজনের চেহারায় অসন্তুষ্টির চিহ্ন দেখিতে পেলেন। তাই তিনি আবু বাকর (রাদি.)-এর সঙ্গে সমঝোতা ও তাহাঁর কাছে বাইআতের ইচ্ছা করিলেন। এ ছয় মাসে তাহাঁর পক্ষে বাইআত গ্রহণের সুযোগ হয়নি। তাই তিনি আবু বাকর (রাদি.)-এর কাছে লোক পাঠিয়ে জানালেন যে, আপনি আমার কাছে আসুন। (এটা জানতে পেরে) উমার (রাদি.) বলিলেন, আল্লাহর কসম! আপনি একা একা তাহাঁর কাছে যাবেন না। আবু বাকর (রাদি.) বলিলেন, তাঁরা আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করিবে বলে তোমরা আশঙ্কা করছ? আল্লাহর কসম! আমি তাঁদের কাছে যাব। তারপর আবু বাকর (রাদি.) তাঁদের কাছে গেলেন। আলী (রাদি.) তাশাহুদ পাঠ করে বলিলেন, আমরা আপনার মর্যাদা এবং আল্লাহ আপনাকে যা কিছু দান করিয়াছেন সে সম্পর্কে ওয়াকেবহাল। আর যে কল্যাণ (অর্থাৎ খিলাফাত) আল্লাহ আপনাকে দান করিয়াছেন সে ব্যাপারেও আমরা আপনার উপর হিংসা পোষণ করি না। তবে খিলাফাতের ব্যাপারে আপনি আমাদের উপর নিজস্ব মতামতের প্রাধান্য দিচ্ছেন অথচ রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ-এর নিকটাত্মীয় হিসেবে খিলাফাতের কাজে আমাদেরও কিছু পরামর্শ দেয়ার অধিকার আছে। এ কথায় আবু বাকর (রাদি.)-এর চোখ থেকে অশ্রু উপচে পড়ল। এরপর তিনি যখন আলোচনা আরম্ভ করিলেন তখন বলিলেন, সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ, আমার কাছে আমার নিকটাত্মীয় চেয়েও রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ-এর আত্মীয়বর্গ অধিক প্রিয়। আর এ সম্পদগুলোতে আমার এবং আপনাদের মধ্যে যে মতবিরোধ হয়েছে সে ব্যাপারেও আমি কল্যাণকর পথ অনুসরণে পিছপা হইনি। বরং এ ক্ষেত্রেও আমি কোন কাজ পরিত্যাগ করিনি যা আমি রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ-কে করিতে দেখেছি। তারপর আলী (রাদি.) আবু বাকর (রাদি.)-কে বললেনঃ যুহরের পর আপনার হাতে বাইআত গ্রহণের ওয়াদা রইল। যুহরের সালাত আদায়ের পর আবু বাকর (রাদি.) মিম্বারে বসে তাশাহুদ পাঠ করিলেন, তারপর আলী (রাদি.)-এর বর্তমান অবস্থা এবং বাইআত গ্রহণে তার দেরি করার কারণ ও তাহাঁর পেশকৃত আপত্তিগুলো তিনি বর্ণনা করিলেন। এরপর আলী (রাদি.) দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাশাহুদ পাঠ করিলেন এবং আবু বাকর (রাদি.)-এর মর্যাদার কথা উল্লেখ করে বলিলেন, তিনি যা কিছু করিয়াছেন তা আবু বাকর (রাদি.)-এর প্রতি হিংসা কিংবা আল্লাহ প্রদত্ত তাহাঁর মর্যাদাকে অস্বীকার করার জন্য করেননি। (তিনি বলেন) তবে আমরা ভেবেছিলাম যে, এ ব্যাপারে আমাদেরও পরামর্শ দেয়ার অধিকার থাকবে। অথচ তিনি [আবু বাকর (রাদি.)] আমাদের পরামর্শ ত্যাগ করে স্বাধীন মতের উপর রয়ে গেছেন। তাই আমরা মানসিক কষ্ট পেয়েছিলাম। মুসলিমগণ আনন্দিত হয়ে বলিলেন, আপনি ঠিকই করিয়াছেন। এরপর আলী (রাদি.) আমর বিল মারূফ-এর পানে ফিরে আসার কারণে মুসলিমগণ আবার তাহাঁর নিকটবর্তী হইতে শুরু করিলেন। [৩০৯২, ৩০৯৩] (আঃপ্রঃ ৩৯১৩, ইঃফাঃ ৩৯১৭)
[১] ফাতিমাহ (রাদি.) মৃত্যুর পূর্বে ওয়াসিয়াত করেন যে, তার মৃত্যু হলে যেন অনতিবিলম্বে দাফন করা হয়। লোকজন ডাকাডাকি করলে তাতে পর্দার ব্যাঘাত ঘটবে, সেজন্য আলী (রাদি.) রাতের ভিতরেই সব কাজ সমাধা করিয়াছেন।
৪২৪১
আয়েশাহ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
নাবী সাঃআঃ-এর কন্যা ফাতেমাহ (রাদি.) আবু বাকর (রাদি.)-এর নিকট রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ-এর পরিত্যক্ত সম্পত্তি মদিনা্ ও ফাদাক-এ অবস্থিত ফাই (বিনা যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ) এবং খাইবারের খুমুসের (পঞ্চমাংশ) অবশিষ্ট থেকে মিরাসী স্বত্ব চেয়ে পাঠালেন। তখন আবু বাকর (রাদি.) উত্তরে বলিলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ বলে গেছেন, আমাদের (নাবীদের) কোন ওয়ারিশ হয় না, আমরা যা ছেড়ে যাব তা সদাকাহ হিসেবে গণ্য হইবে। অবশ্য মুহাম্মাদ সাঃআঃ-এর বংশধরগণ এ সম্পত্তি থেকে ভরণ-পোষণ চালাতে পারবেন। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ-এর সদাকাহ তাহাঁর জীবদ্দশায় যে অবস্থায় ছিল আমি সে অবস্থা থেকে এতটুকুও পরিবর্তন করব না। এ ব্যাপারে তিনি যেভাবে ব্যবহার করে গেছেন আমিও ঠিক সেভাবেই ব্যবহার করব। এ কথা বলে আবু বাকর (রাদি.) ফাতেমাহ (রাদি.)-কে এ সম্পদ থেকে কিছু দিতে অস্বীকার করিলেন। এতে ফাতিমাহ (রাদি.) (মানবোচিত কারণে) আবু বাকর (রাদি.)-এর উপর নাখোশ হলেন এবং তাহাঁর থেকে সম্পর্কহীন থাকলেন। তাহাঁর মৃত্যু অবধি তিনি আবু বাকর (রাদি.)-এর সঙ্গে কথা বলেননি। নাবী সাঃআঃ-এর পর তিনি ছয় মাস জীবিত ছিলেন। তিনি ইন্তিকাল করলে তাহাঁর স্বামী আলী (রাদি.) রাতের বেলা তাঁকে দাফন করেন। আবু বাকর (রাদি.)-কেও এ খবর দিলেন না এবং তিনি তার জানাযার সালাত আদায় করে নেন।[১] ফাতেমাহ (রাদি.)-এর জীবিত অবস্থায় লোকজনের মনে আলী (রাদি.)-এর মর্যাদা ছিল। ফাতিমাহ (রাদি.) ইন্তিকাল করলে আলী (রাদি.) লোকজনের চেহারায় অসন্তুষ্টির চিহ্ন দেখিতে পেলেন। তাই তিনি আবু বাকর (রাদি.)-এর সঙ্গে সমঝোতা ও তাহাঁর কাছে বাইআতের ইচ্ছা করিলেন। এ ছয় মাসে তাহাঁর পক্ষে বাইআত গ্রহণের সুযোগ হয়নি। তাই তিনি আবু বাকর (রাদি.)-এর কাছে লোক পাঠিয়ে জানালেন যে, আপনি আমার কাছে আসুন। (এটা জানতে পেরে) উমার (রাদি.) বলিলেন, আল্লাহর কসম! আপনি একা একা তাহাঁর কাছে যাবেন না। আবু বাকর (রাদি.) বলিলেন, তাঁরা আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করিবে বলে তোমরা আশঙ্কা করছ? আল্লাহর কসম! আমি তাঁদের কাছে যাব। তারপর আবু বাকর (রাদি.) তাঁদের কাছে গেলেন। আলী (রাদি.) তাশাহুদ পাঠ করে বলিলেন, আমরা আপনার মর্যাদা এবং আল্লাহ আপনাকে যা কিছু দান করিয়াছেন সে সম্পর্কে ওয়াকেবহাল। আর যে কল্যাণ (অর্থাৎ খিলাফাত) আল্লাহ আপনাকে দান করিয়াছেন সে ব্যাপারেও আমরা আপনার উপর হিংসা পোষণ করি না। তবে খিলাফাতের ব্যাপারে আপনি আমাদের উপর নিজস্ব মতামতের প্রাধান্য দিচ্ছেন অথচ রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ-এর নিকটাত্মীয় হিসেবে খিলাফাতের কাজে আমাদেরও কিছু পরামর্শ দেয়ার অধিকার আছে। এ কথায় আবু বাকর (রাদি.)-এর চোখ থেকে অশ্রু উপচে পড়ল। এরপর তিনি যখন আলোচনা আরম্ভ করিলেন তখন বলিলেন, সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ, আমার কাছে আমার নিকটাত্মীয় চেয়েও রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ-এর আত্মীয়বর্গ অধিক প্রিয়। আর এ সম্পদগুলোতে আমার এবং আপনাদের মধ্যে যে মতবিরোধ হয়েছে সে ব্যাপারেও আমি কল্যাণকর পথ অনুসরণে পিছপা হইনি। বরং এ ক্ষেত্রেও আমি কোন কাজ পরিত্যাগ করিনি যা আমি রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ-কে করিতে দেখেছি। তারপর আলী (রাদি.) আবু বাকর (রাদি.)-কে বললেনঃ যুহরের পর আপনার হাতে বাইআত গ্রহণের ওয়াদা রইল। যুহরের সালাত আদায়ের পর আবু বাকর (রাদি.) মিম্বারে বসে তাশাহুদ পাঠ করিলেন, তারপর আলী (রাদি.)-এর বর্তমান অবস্থা এবং বাইআত গ্রহণে তার দেরি করার কারণ ও তাহাঁর পেশকৃত আপত্তিগুলো তিনি বর্ণনা করিলেন। এরপর আলী (রাদি.) দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাশাহুদ পাঠ করিলেন এবং আবু বাকর (রাদি.)-এর মর্যাদার কথা উল্লেখ করে বলিলেন, তিনি যা কিছু করিয়াছেন তা আবু বাকর (রাদি.)-এর প্রতি হিংসা কিংবা আল্লাহ প্রদত্ত তাহাঁর মর্যাদাকে অস্বীকার করার জন্য করেননি। (তিনি বলেন) তবে আমরা ভেবেছিলাম যে, এ ব্যাপারে আমাদেরও পরামর্শ দেয়ার অধিকার থাকবে। অথচ তিনি [আবু বাকর (রাদি.)] আমাদের পরামর্শ ত্যাগ করে স্বাধীন মতের উপর রয়ে গেছেন। তাই আমরা মানসিক কষ্ট পেয়েছিলাম। মুসলিমগণ আনন্দিত হয়ে বলিলেন, আপনি ঠিকই করিয়াছেন। এরপর আলী (রাদি.) আমর বিল মারূফ-এর পানে ফিরে আসার কারণে মুসলিমগণ আবার তাহাঁর নিকটবর্তী হইতে শুরু করিলেন। [৩০৯২, ৩০৯৩] (আঃপ্রঃ ৩৯১৩, ইঃফাঃ ৩৯১৭)
[১] ফাতিমাহ (রাদি.) মৃত্যুর পূর্বে ওয়াসিয়াত করেন যে, তার মৃত্যু হলে যেন অনতিবিলম্বে দাফন করা হয়। লোকজন ডাকাডাকি করলে তাতে পর্দার ব্যাঘাত ঘটবে, সেজন্য আলী (রাদি.) রাতের ভিতরেই সব কাজ সমাধা করিয়াছেন।
৪২৪২
আয়েশাহ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, খাইবার বিজয়ের পর আমরা বলাবলি করলাম, এখন আমরা পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেজুর খেতে পারব। (আ.প্র. ৩৯১৪, ই.ফা. ৩৯১৮)
৪২৪৩
ইবনু উমার (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, খাইবার বিজয় করার পূর্ব পর্যন্ত আমরা তৃপ্ত হয়ে খেতে পাইনি [৫৫]। (আ.প্র. ৩৯১৫, ই.ফা. ৩৯১৯)
[৫৫] খাইবার বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজ পরিবারকে নিয়ে অত্যন্ত দুঃখ কষ্ট সহ্য করিয়াছেন। এমনকি পেট পুরে খাবার মত খেজুরও তাদের ভাগ্যে জোটেনি। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সহাবীগণও অনুরূপ কষ্ট সহ্য করেছিলেন।
৬৪/৪০. অধ্যায়ঃ খাইবারবাসীদের জন্য নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক প্রশাসক নিযুক্তি
৪২৪৪
আবু সাঈদ খুদরী ও আবু হুরাইরাহ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ খাইবারের অধিবাসীদের জন্য এক ব্যক্তিকে প্রশাসক নিয়োগ করিলেন। এক সময়ে তিনি উন্নত জাতের কিছু খেজুর নিয়ে আসলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ বলিলেন, খাইবারের সব খেজুরই কি এ রকম? প্রশাসক জবাব দিলেন, জ্বী না, আল্লাহর শপথ, হে আল্লাহর রাসুল! তবে আমরা এ রকম খেজুরের এক সা সাধারণ খেজুরের দু সার বদলে কিংবা এ রকম খেজুরের দু সা সাধারণ খেজুরের তিন সার বদলে গ্রহণ করে থাকি। রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ বলিলেন, এমন করো না। দিরহামের বদলে সব খেজুর বিক্রি করে দিবে। তারপর দিরহাম দিয়ে উত্তম খেজুর কিনে নিবে।[১] [২২০১, ২২০২] (আঃপ্রঃ ৩৯১৬, ইঃফাঃ ৩৯২০ প্রথমাংশ)
[১] খেজুরের বিনিময়ে খেজুর বেচাকেনা সম পরিমাণে না হলে সুদে পরিণত হয়ে যাবে। যে কোন শস্যের ক্ষেত্রে একই বিধান। তবে অর্থের মাধ্যমে কেনাবেচা করলে হারামে জড়িয়ে পড়ার আশংকা থাকে না।
৪২৪৫
আবু সাঈদ খুদরী ও আবু হুরাইরাহ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ খাইবারের অধিবাসীদের জন্য এক ব্যক্তিকে প্রশাসক নিয়োগ করিলেন। এক সময়ে তিনি উন্নত জাতের কিছু খেজুর নিয়ে আসলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ বলিলেন, খাইবারের সব খেজুরই কি এ রকম? প্রশাসক জবাব দিলেন, জ্বী না, আল্লাহর শপথ, হে আল্লাহর রাসুল! তবে আমরা এ রকম খেজুরের এক সা সাধারণ খেজুরের দু সার বদলে কিংবা এ রকম খেজুরের দু সা সাধারণ খেজুরের তিন সার বদলে গ্রহণ করে থাকি। রাসূলুল্লাহ সাঃআঃ বলিলেন, এমন করো না। দিরহামের বদলে সব খেজুর বিক্রি করে দিবে। তারপর দিরহাম দিয়ে উত্তম খেজুর কিনে নিবে।[১] [২২০১, ২২০২] (আঃপ্রঃ ৩৯১৬, ইঃফাঃ ৩৯২০ প্রথমাংশ)
[১] খেজুরের বিনিময়ে খেজুর বেচাকেনা সম পরিমাণে না হলে সুদে পরিণত হয়ে যাবে। যে কোন শস্যের ক্ষেত্রে একই বিধান। তবে অর্থের মাধ্যমে কেনাবেচা করলে হারামে জড়িয়ে পড়ার আশংকা থাকে না।
৪২৪৬
সাঈদ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
আবু সাঈদ ও আবু হুরাইরা (রাদি.) তাঁকে বলিলেন, নাবী সাঃআঃ আনসারদের বানী আদী গোত্রের এক ব্যক্তিকে খাইবার পাঠিছিলেন এবং তাঁকে সেখানকার অধিবাসীদের প্রশাসক নিযুক্ত করেছিলেন। অন্য সনদে আবদুল মাজীদ-আবু সালিহ সাম্মান (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)-আবু হুরাইরা ও আবু সাঈদ (রাদি.) থেকে এভাবেই বর্ণনা করিয়াছেন। [২২০১, ২২০২] (আঃপ্রঃ ৩৯১৬, ইঃফাঃ ৩৯২০)
৪২৪৭
সাঈদ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
আবু সাঈদ ও আবু হুরাইরা (রাদি.) তাঁকে বলিলেন, নাবী সাঃআঃ আনসারদের বানী আদী গোত্রের এক ব্যক্তিকে খাইবার পাঠিছিলেন এবং তাঁকে সেখানকার অধিবাসীদের প্রশাসক নিযুক্ত করেছিলেন। অন্য সনদে আবদুল মাজীদ-আবু সালিহ সাম্মান (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)-আবু হুরাইরা ও আবু সাঈদ (রাদি.) থেকে এভাবেই বর্ণনা করিয়াছেন। [২২০১, ২২০২] (আঃপ্রঃ ৩৯১৬, ইঃফাঃ ৩৯২০)
৬৪/৪১.অধ্যায়ঃ নাবী (সাঃআঃ) কর্তৃক খাইবার অধিবাসীদের কৃষি ভূমির বন্দোবস্ত প্রদান
৪২৪৮
আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নাবী (সাঃআঃ) খাইবারের ভূমি সেখানকার ইয়াহূদীদেরকে এ চুক্তিতে প্রদান করেছিলেন যে, তারা চাষাবাদ করিবে আর উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক লাভ করিবে [৫৭]। [২২৮৫] (আ.প্র. ৩৯১৭, ই.ফা. ৩৯২১)
[৫৭] জিহাদে পরাজিত শত্রুর সমস্ত সম্পদই গানীমাত নয়। শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাপ্ত সম্পদই গানীমাত। আর ভূসম্পত্তি ও ঘর-বাড়ী ফাই এর অন্তর্ভুক্ত।
৬৪/৪২. অধ্যায়ঃ খাইবারে নাবী (সাঃআঃ)-এর জন্য বিষ মিশ্রিত বাক্রীর (হাদিয়া পাঠানোর) বর্ণনা
উরওয়াহ (রাদি.) আয়েশাহ (রাদি.)-এর মাধ্যমে নাবী (সাঃআঃ) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন।
৪২৪৯
আবু হুরাইরাহ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
যখন খাইবার বিজিত হলো তখন (ইয়াহূদীদের পক্ষ থেকে) রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-কে একটি বাক্রী হাদিয়া দেয়া হয়। যাতে বিষ মেশানো ছিল। [৫৮] [৩১৬৯] (আ.প্র. ৩৯১৮, ই.ফা. ৩৯২২)
[৫৮] সেই বিষপ্রয়োগকৃত গোশত খেয়ে রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর কোন ক্ষতি না হলেও সহাবী বারা ইবনু মারূর বিষক্রিয়ায় ইন্তেকাল করেন।
Leave a Reply