বানূ মুসতালিকের যুদ্ধ, আনমার যুদ্ধ ও ইফ্ক-এর ঘটনা
বানূ মুসতালিকের যুদ্ধ, আনমার যুদ্ধ ও ইফ্ক-এর ঘটনা >> বুখারী শরীফ এর মুল সুচিপত্র পড়ুন
পর্বঃ ৬৪, মাগাযী, অধ্যায়ঃ (৩৩-৩৫)=৩টি
৬৪/৩৩. অধ্যায়ঃ বানূ মুসতালিকের যুদ্ধ। বানূ মুসতালিক খুযাআর একটি শাখা গোত্র। এ যুদ্ধকে মুরায়সীর যুদ্ধও বলা হয়
৬৪/৩৪. অধ্যায়ঃ আনমার-এর যুদ্ধঃ
৬৪/৩৫. অধ্যায়ঃ ইফ্ক-এর ঘটনা
৬৪/৩৩. অধ্যায়ঃ বানূ মুসতালিকের যুদ্ধ । বানূ মুসতালিক খুযাআর একটি শাখা গোত্র। এ যুদ্ধকে মুরায়সীর যুদ্ধও বলা হয়
ইবনু ইসহাক (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেছেন, এ যুদ্ধ ৬ষ্ঠ হিজরী সনে সংঘটিত হয়েছিল। মূসা ইবনু উকবাহ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেছেন, ৪র্থ হিজরী সনে। নুমান ইবনু রাশিদ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) যুহরী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) থেকে বর্ণনা করিয়াছেন যে, মুরাইসীর যুদ্ধে ইফ্কের ঘটনা ঘটেছিল।
৪১৩৮
ইবনু মুহাইরীয (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, একদা আমি মাসজিদে প্রবেশ করে আবু সাঈদ খুদরী (রাদি.)-কে দেখিতে পেয়ে তার কাছে গিয়ে বসলাম এবং আযল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। আবু সাঈদ খুদরী (রাদি.) বলিলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর সঙ্গে বানূ মুসতালিকের যুদ্ধে যোগদান করেছিলাম। এ যূদ্ধে আরবের বহূ বন্দী আমাদের হস্তগত হয়। মহিলাদের প্রতি আমাদের মনে আসক্তি জাগে এবং বিবাহ-শাদী ব্যতীত এবং স্ত্রীহীন অবস্থা আমাদের জন্য কষ্টকর অনুভূত হয়। তাই আমরা আযল করা পছন্দ করলাম এবং তা করিতে মনস্থ করলাম। তখন আমরা পরস্পর বলাবলি করলাম, রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) আমাদের মাঝে আছেন। এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস না করেই আমরা আযল করিতে যাচ্ছি। আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলিলেন, এটা না করলে তোমাদের কী ক্ষতি? ক্বিয়ামত পর্যন্ত যতগুলো প্রাণের আগমন ঘটবার আছে, ততগুলোর আগমন ঘটবেই। [২২২৯; মুসলিম ত্বলাক/২১, হাদীস ১৪৩৮, আহমাদ ১১৮৩৯] (আ.প্র. ৩৮২৬, ই.ফা. ৩৮২৯)
৪১৩৯
জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নাজদের যুদ্ধে আমরা রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর সঙ্গে যোগদান করেছি। কাঁটা গাছে ভরা উপত্যকায় প্রচন্ড গরম লাগলে রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) একটি গাছের নিচে অবতরণ করে তার ছায়ায় বিশ্রাম নিলেন এবং তাহাঁর তরবারীখানা লটকিয়ে রাখেন। সাহাবীগণ সকলেই গাছের ছায়ায় আশ্রয় নেয়ার জন্য ছড়িয়ে পড়লেন। আমরা এ অবস্থায় ছিলাম, হঠাৎ রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) আমাদের ডাকলেন। আমরা তাহাঁর নিকট গিয়ে দেখলাম, এক গ্রাম্য আরব তাহাঁর সামনে বসে আছে। তিনি বলিলেন, আমি ঘুমিয়েছিলাম। এমন সময় সে আমার কাছে এসে আমার তরবারীখানা নিয়ে উঁচিয়ে ধরল। এত আমি জেগে গিয়ে দেখলাম, সে খোলা তরবারি হাতে আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বলছে, এখন তোমাকে আমার থেকে কে রক্ষা করিবে? আমি বললাম, আল্লাহ। এতে সে তরবারিখানা খাপে ঢুকিয়ে বসে পড়ল। এ-ই সেই লোক। বর্ণনাকারী জাবির (রাদি.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) তাকে কোন শাস্তি দিলেন না। [২৯১০] (আ.প্র. ৩৮২৭, ই.ফা. . ৩৮৩০)
৬৪/৩৪. অধ্যায়ঃ আনমার-এর যুদ্ধঃ
৪১৪০
জাবির ইবনু আবদুল্লাহ আনসারী (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি নাবী (সাঃআঃ)-কে আনমার যুদ্ধে সাওয়ারীতে আরোহন করে মাশরিকের দিকে মুখ করে নাফল সলাত আদায় করিতে দেখেছি। [৪০০] (আ.প্র. ৩৮২৮, ই.ফা. ৩৮২১)
৬৪/৩৫. অধ্যায়ঃ ইফ্ক-এর ঘটনা
[ইমাম বুখারি (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন] (আরবী) শব্দটি (আরবী) ও (আরবী) এর মতো (আরবী) ও (আরবী) উভয়ভাবেই ব্যবহৃত হয়। তাই আরবীয় লোকেরা বলেন (আরবী) ও (আরবী) । যিনি (আরবী) পড়েছেন, তিনি বলেন যে, এর অর্থ তাদেরকে তিনি ঈমান হইতে ফিরিয়ে রেখেছিলেন এবং তাদেরকে মিথ্যুক আখ্যায়িত করেছিলেন।
৪১৪১
নাবী (সাঃআঃ)-এর সহধর্মিণী আয়েশা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
উরওয়াহ ইবনু যুবায়র, সাঈদ ইবনু মুসায়্যিব, আলক্বামাহ ইবনু ওয়াক্কাস ও উবাইদুল্লাহ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু উত্বাহ ইবনু মাসঊদ (রাদি.) সূত্রে নাবী (সাঃআঃ)-এর সহধর্মিণী আয়েশাহ (রাদি.) হইতে বর্ণিত যে, যখন অপবাদ রটনাকারীগণ তাহাঁর প্রতি অপবাদ রটিয়েছিল। রাবী যুহরী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, তারা প্রত্যেকেই হাদীসটির অংশবিশেষ আমার কাছে বর্ণনা করিয়াছেন। হাদীসটি স্মরণ রাখা ও সঠিকভাবে বর্ণনা করার ব্যাপারে তাদের কেউ কেউ একে অন্যের চেয়ে অধিকতর অগ্রগণ্য ও নির্ভরযোগ্য। আয়েশাহ (রাদি.) সম্পর্কে তারা আমার কাছে যা বর্ণনা করিয়াছেন আমি তাদের প্রত্যেকের কথাই ঠিকঠাকভাবে স্মরণ রেখেছি। তাদের একজনের বর্ণিত হাদীসের অংশ অপরের বর্ণিত হাদীসের সত্যতা প্রমাণ করে। যদিও তাদের একজন অন্যের চেয়ে অধিক স্মৃতিশক্তির অধিকারী। বর্ণনাকারীগণ বলেন, আয়েশাহ (রাদি.) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) যখন সফরে যেতে ইচ্ছে করিতেন তখন তিনি তাহাঁর স্ত্রীগণের (নির্বাচনের জন্য) কোরা ব্যবহার করিতেন। এতে যার নাম উঠত তাকেই তিনি সঙ্গে নিয়ে সফরে যেতেন।
আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, এমনি এক যুদ্ধে তিনি আমাদের মাঝে কোরা ব্যবহার করেন, এতে আমার নাম উঠে আসে। তাই আমিই রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর সঙ্গে সফরে গেলাম। এ ঘটনাটি পর্দার হুকুম নাযিলের পর ঘটেছিল। তখন আমাকে হাওদাসহ সাওয়ারীতে উঠানো ও নামানো হত। এমনিভাবে আমরা চলতে থাকলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) যখন এ যুদ্ধ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন, তখন তিনি (গৃহাভিমুখে) প্রত্যাবর্তন করিলেন। ফেরার পথে আমরা মদিনার নিকটবর্তী হলে তিনি একদিন রাতের বেলা রওয়ানা হওয়ার জন্য আদেশ করিলেন। রওয়ানা হওয়ার ঘোষণা দেয়া হলে আমি উঠলাম এবং (প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য) পায়ে হেঁটে সেনাছাউনী পেরিয়ে (সামনে) গেলাম। অতঃপর প্রয়োজন সেরে আমি আমার সাওয়ারীর কাছে ফিরে এসে বুকে হাত দিয়ে দেখলাম যে, (ইয়ামানের অন্তর্গত) যিফার শহরের পুতি দ্বারা তৈরি করা আমার গলার হারটি ছিঁড়ে কোথায় পড়ে গিয়েছে। তাই আমি ফিরে গিয়ে আমার হারটি খোঁজ করিতে লাগলাম। হার খুঁজতে খুঁজতে আমার আসতে দেরী হয়ে যায়। আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, যে সমস্ত লোক উটের পিঠে আমাকে উঠিয়ে দিতেন তারা এসে আমার হাওদা উঠিয়ে তা আমার উটের পিঠে তুলে দিলেন, যার উপর আমি আরোহণ করতাম। তারা ভেবেছিলেন, আমি ওর মধ্যেই আছি, কারণ খাদ্যাভাবে মহিলারা তখন খুবই হালকা হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের দেহ গোশতবহুল ছিল না। তাঁরা খুবই স্বল্প পরিমাণ খানা খেতে পেত। তাই তারা যখন হাওদা উঠিয়ে উপরে রাখেন তখন তারা হালকা হাওদাটিকে কোন প্রকার অস্বাভাবিক মনে করেননি। অধিকন্তু আমি ছিলাম একজন অল্প বয়স্কা কিশোরী। এরপর তারা উট হাঁকিয়ে নিয়ে চলে যায়। সৈন্যদল চলে যাওয়ার পর আমি আমার হারটি খুঁজে পাই এবং নিজ জায়গায় ফিরে এসে দেখি তাঁদের (সৈন্যদের) কোন আহবানকারী এবং কোন জওয়াব দাতা সেখানে নেই।
তখন আমি আগে যেখানে ছিলাম সেখানে বসে রইলাম। ভাবলাম, তাঁরা আমাকে দেখিতে না পেয়ে অবশ্যই আমার কাছে ফিরে আসবে। ঐ স্থানে বসে থাকা অবস্থায় ঘুম চেপে ধরলে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। বানূ সুলামী গোত্রের যাকওয়ান শাখার সাফওয়ান ইবনু মুআত্তাল (রাদি.) [যাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) ফেলে যাওয়া আসবাবপত্র সংগ্রহের জন্য পশ্চাতে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন] সৈন্যদল চলে যাওয়ার পর সেখানে ছিলেন। তিনি সকালে আমার অবস্থানস্থলের কাছে এসে একজন ঘুমন্ত মানুষ দেখে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে চিনে ফেললেন। পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। তিনি আমাকে চিনতে পেরে ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাযিউন পড়লে আমি তা শুনে জেগে উঠলাম এবং চাদর টেনে আমার চেহারা ঢেকে ফেললাম। আল্লাহর কসম! আমি কোন কথা বলিনি এবং তাহাঁর থেকে ইন্না লিল্লাহ…….. পাঠ ব্যতীত অন্য কোন কথাই শুনতে পাইনি। এরপর তিনি সওয়ারী থেকে নামলেন এবং সওয়ারীকে বসিয়ে তার সামনের পা নিচু করে দিলে আমি গিয়ে তাতে উঠে পড়লাম। পরে তিনি আমাকে সহ সওয়ারীকে টেনে আগে আগে চললেন, অতঃপর ঠিক দুপুরে প্রচন্ড গরমের সময় আমরা গিয়ে সেনাদলের সঙ্গে মিলিত হলাম। সে সময় তাঁরা একটি জায়গায় অবতরণ করছিলেন। আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, এরপর যাদের ধ্বংস হওয়ার ছিল তারা (আমার উপর অপবাদ দিয়ে) ধ্বংস হয়ে গেল। তাদের মধ্যে এ অপবাদ দেয়ার ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল সে হচ্ছে আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনু সুলূল।
বর্ণনাকারী উরওয়াহ (রাদি.) বলেন, আমি জানতে পেরেছি যে, তার (আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনু সুলূল) সামনে অপবাদের কথাগুলো প্রচার করা হত এবং আলোচনা করা হত আর অমনি সে এগুলোকে বিশ্বাস করত, খুব ভাল করে শুনত আর শোনা কথার ভিত্তিতেই ব্যাপারটিকে প্রমাণ করার চেষ্টা করত। উরওয়াহ (রাদি.) আরো বর্ণনা করিয়াছেন যে, অপবাদ আরোপকারী ব্যক্তিদের মধ্যে হাস্সান ইবনু সাবিত, মিসতাহ ইবনু উসাসা এবং হামনা বিনত জাহাশ (রাদি.) ব্যতীত আর কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। তারা কয়েকজন লোকের একটি দল ছিল, এটুকু ব্যতীত তাদের ব্যাপারে আমার আর কিছু জানা নেই। যেমন (আল-কুরআনে) মহান আল্লাহ তাআলা বলেছেন। এ ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তাকে আবদুল্লাহ ইবনু উবাই বিন সুলূল বলে ডাকা হয়ে থাকে। বর্ণনাকারী উরওয়াহ (রাদি.) বলেন, আয়েশাহ (রাদি.) এ ব্যাপারে হাস্সান ইবনু সাবিত (রাদি.)-কে গালমন্দ করাকে পছন্দ করিতেন না। তিনি বলিতেন, হাস্সান ইবনু সাবিত (রাদি.) তো সেই লোক যিনি তার এক কবিতায় বলেছেন,
আমার মান সম্মান এবং আমার বাপ দাদা
মুহাম্মাদ (সাঃআঃ)-এর মান সম্মান রক্ষায় নিবেদিত।
আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, অতঃপর আমরা মদীনায় আসলাম। মদিনা্য় এসে এক মাস পর্যন্ত আমি অসুস্থ থাকলাম। এদিকে অপবাদ রটনাকারীদের কথা নিয়ে লোকেদের মধ্যে আলোচনা ও চর্চা হইতে থাকল। কিন্তু এগুলোর কিছুই আমি জানি না। তবে আমি সন্দেহ করছিলাম এবং তা আরো দৃঢ় হচ্ছিল আমার এ অসুখের সময়। কেননা এর আগে আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) থেকে যে রকম স্নেহ-ভালবাসা পেতাম আমার এ অসুখের সময় তা আমি পাচ্ছিলাম না। তিনি আমার কাছে এসে সালাম করে কেবল তুমি কেমন আছ জিজ্ঞেস করে চলে যেতেন। তাহাঁর এ আচরণই আমার মনে ভীষণ সন্দেহ জাগিয়ে তোলে। তবে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাইরে বের হওয়ার আগে পর্যন্ত এ জঘন্য অপবাদের ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। উম্মু মিসতাহ (রাদি.) (মিসতাহর মা) একদা আমার সঙ্গে পায়খানার দিকে বের হন। আর প্রকৃতির ডাকে আমাদের বের হওয়ার অবস্থা এই ছিল যে, এক রাতে বের হলে আমরা আবার পরের রাতে বের হতাম। এটা ছিল আমাদের ঘরের পার্শ্বে পায়খানা তৈরি করার আগের ঘটনা। আমাদের অবস্থা প্রাচীন আরবের লোকদের অবস্থার মতো ছিল। তাদের মতো আমরাও পায়খানা করার জন্য ঝোপঝাড়ে চলে যেতাম। এমনকি (অভ্যাস না থাকায়) বাড়ির পার্শ্বে পায়খানা তৈরি করলে আমরা খুব কষ্ট পেতাম। আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, একদা আমি এবং উম্মু মিসতাহ যিনি ছিলেন আবু রূহম ইবনু মুত্তালিব ইবনু আবদে মুনাফির কন্যা, যার মা সাখার ইবনু আমির-এর কন্যা ও আবু বাকর সিদ্দীকের খালা এবং মিসতাহ ইবনু উসাসা ইবনু আববাদ ইবনু মুত্তালিব যার পুত্র একত্রে বের হলাম। আমরা আমাদের কাজ থেকে নিস্ক্রান্ত হয়ে বাড়ি ফেরার পথে উম্মু মিসতাহ তার কাপড়ে জড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে বলিলেন, মিসতাহ ধ্বংস হোক। আমি তাকে বললাম, আপনি খুব খারাপ কথা বলছেন। আপনি কি বদর যুদ্ধে যোগদানকারী ব্যক্তিকে গালি দিচ্ছেন? তিনি আমাকে বলিলেন, ওগো অবলা, সে তোমার সম্বন্ধে কী কথা বলে বেড়াচ্ছে তুমি তো তা শোননি।
আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, সে আমার সম্পর্কে কী বলছে? তখন তিনি অপবাদ রটনাকারীদের কথাবার্তা সম্পর্কে আমাকে জানালেন। আয়েশাহ (রাদি.) বর্ণনা করেন, এরপর আমার পুরানো রোগ আরো বেড়ে গেল। আমি বাড়ি ফেরার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) আমার কাছে আসলেন এবং সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করিলেন, তুমি কেমন আছ? আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, আমি আমার পিতা-মাতার কাছে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক খবর জানতে চাচ্ছিলাম, তাই আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ)-কে বললাম, আপনি কি আমাকে আমার পিতা-মাতার কাছে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেবেন? আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) আমাকে অনুমতি দিলেন। তখন আমি আমার আম্মাকে বললাম, আম্মাজান, লোকজন কী আলোচনা করছে? তিনি বলিলেন, বেটী এ ব্যাপারটিকে হালকা করে ফেল। আল্লাহর কসম! সতীন আছে এমন স্বামীর সোহাগ লাভে ধন্যা সুন্দরী রমণীকে তাহাঁর সতীনরা বদনাম করিবে না, এমন খুব কমই হয়।
আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, সুবহানাল্লাহ। লোকজন কি এমন গুজবই রটিয়েছে। আয়েশাহ (রাদি.) বর্ণনা করেন, সারারাত আমি কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে সকাল হয়ে গেল। এর মধ্যে আমার চোখের পানিও বন্ধ হল না এবং আমি ঘুমাতেও পারলাম না। এরপর ভোরবেলাও আমি কাঁদছিলাম। তিনি আরো বলেন যে, এ সময় ওয়াহী নাযিল হইতে দেরি হওয়ায় রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) তার স্ত্রীর (আমার) বিচ্ছেদের বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ ও আলোচনা করার নিমিত্তে আলী ইবনু আবু তালিব এবং উসামাহ ইবনু যায়দ (রাদি.)-কে ডেকে পাঠালেন।
তিনি [আয়েশাহ (রাদি.)] বলেন, উসামাহ (রাদি.) রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর স্ত্রীদের পবিত্রতা এবং তাদের প্রতি [নাবী (সাঃআঃ)-এর] ভালবাসার কারণে বলিলেন, তাঁরা আপনার স্ত্রী, তাদের সম্পর্কে আমি ভাল ব্যতীত আর কিছুই জানি না। আর আলী (রাদি.) বলিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ তো আপনার জন্য সংকীর্ণতা রাখেননি। তিনি ব্যতীত আরো বহু মহিলা আছে। অবশ্য আপনি এ ব্যাপারে দাসী [বারীরাহ (রাদি.)]-কে জিজ্ঞেস করুন। সে আপনার কাছে সত্য কথাই বলবে। আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বারীরাহ (রাদি.)-কে ডেকে বলিলেন, হে বারীরাহ! তুমি তাহাঁর মধ্যে কোন সন্দেহপূর্ণ আচরণ দেখেছ কি? বারীরাহ (রাদি.) তাঁকে বলিলেন, সে আল্লাহর শপথ যিনি আপনাকে সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন, আমি তার মধ্যে কখনো এমন কিছু দেখিনি যার দ্বারা তাঁকে দোষী বলা যায়। তবে তাহাঁর সম্পর্কে কেবল এটুকু বলা যায় যে, তিনি হলেন অল্প বয়স্কা কিশোরী, রুটি তৈরী করার জন্য আটা খামির করে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। আর বাকরী এসে অমনি তা খেয়ে ফেলে।
তিনি [আয়েশাহ (রাদি.)] বলেন, সেদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে মিম্বরে বসে আবদুল্লাহ ইবনু উবাই-এর ক্ষতি থেকে রক্ষার আহবান জানিয়ে বলিলেন, হে মুসলিম সম্প্রদায়! যে আমার স্ত্রীর ব্যাপারে অপবাদ রটিয়ে আমাকে কষ্ট দিয়েছে তার এ অপবাদ থেকে আমাকে কে মুক্ত করিবে? আল্লাহর কসম! আমি আমার স্ত্রী সম্পর্কে ভাল ব্যতীত আর কিছুই জানি না। আর তাঁরা এক ব্যক্তির (সাফওয়ান ইবনু মুআত্তাল) নাম উল্লেখ করছে যার ব্যাপারেও আমি ভাল ব্যতীত কিছু জানি না। সে তো আমার সঙ্গেই আমার ঘরে যায়। আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, বানী আবদুল আশহাল গোত্রের সাদ (ইবনু মুআয) (রাদি.) উঠে বলিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি আপনাকে এ অপবাদ থেকে মুক্তি দেব। সে যদি আউস গোত্রের লোক হয় তাহলে তার শিরচ্ছেদ করব। আর যদি সে আমাদের ভাই খাযরাজের লোক হয় তাহলে তার ব্যাপারে আপনি যা বলবেন তাই করব। আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, এ সময় হাস্সান ইবনু সাবিত (রাদি.)-এর মায়ের চাচাতো ভাই খাযরাজ গোত্রের নেতা সাঈদ ইবনু উবাদা (রাদি.) দাঁড়িয়ে এ কথার প্রতিবাদ করিলেন। আয়েশাহ (রাদি.) বলেনঃ এ ঘটনার আগে তিনি একজন সৎ ও নেককার লোক ছিলেন। গোত্রীয় অহঙ্কারে উত্তেজিত হয়ে তিনি সাদ ইবনু মুআয (রাদি.)-কে বলিলেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। আল্লাহর কসম! তুমি তাকে হত্যা করিতে পারবে না এবং তাকে হত্যা করার ক্ষমতাও তোমার নেই। সে তোমার গোত্রের লোক হলে তুমি তার নিহত হওয়া কখনো পছন্দ করিতে না। তখন সাদ ইবনু মুআয (রাদি.)-এর চাচাতো ভাই উসাইদ ইবনু হুযাইর (রাদি.) সাদ ইবনু উবাইদাহ (রাদি.)-কে বলিলেন, বরং তুমিই মিথ্যা বলছ। আল্লাহর কসম! আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করব। তুমি হলে মুনাফিক। তাই মুনাফিকদের পক্ষ নিয়ে কথাবার্তা বলছ।
তিনি [আয়েশাহ (রাদি.)] বলেন, এ সময় আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্র খুব উত্তেজিত হয়ে যায়। এমনকি তারা যুদ্ধের সংকল্প করে বসে। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) মিম্বরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) তাদের শান্ত করিলেন এবং নিজেও চুপ হয়ে গেলেন। আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, আমি সেদিন সারাক্ষণ কেঁদে কাটালাম। চোখের ধারা আমার বন্ধ হয়নি এবং একটু ঘুমও হয়নি। তিনি বলেন, আমি কান্না করছিলাম আর আমার পিতা-মাতা আমার পার্শ্বে উপবিষ্ট ছিলেন। এমনি করে একদিন দুই রাত কেঁদে কেঁদে কাটিয়ে দিলাম। এর মধ্যে আমার একটুও ঘুম হয়নি। বরং অনবরত আমার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। মনে হচ্ছিল যেন, কান্নার কারণে আমার কলিজা ফেটে যাবে। আমি ক্রন্দনরত ছিলাম আর আমার আববা-আম্মা আমার পার্শ্বে উপবিষ্ট ছিলেন। এমন সময় একজন আনসারী মহিলা আমার কাছে আসার অনুমতি চাইলে আমি তাকে আসার অনুমতি দিলাম। সে এসে বসল এবং আমার সঙ্গে কাঁদতে আরম্ভ করিল। তিনি বলেন, আমরা কান্না করছিলাম এই মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) আমাদের কাছে এসে সালাম করিলেন এবং আমাদের পাশে বসে গেলেন। আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, অপবাদ রটানোর পর আমার পার্শ্বে এসে এভাবে তিনি আর বসেননি। এদিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) একমাস অপেক্ষা করার পরও আমার ব্যাপারে তাহাঁর নিকট কোন ওয়াহী আসেনি। আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, বসার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) কালিমা শাহাদাত পড়লেন। এরপর বলিলেন, আয়েশাহ তোমার ব্যাপারে আমার কাছে অনেক কথাই পৌঁছেছে, যদি তুমি এর থেকে পবিত্র হও তাহলে শীঘ্রই আল্লাহ তোমাকে এ অপবাদ থেকে মুক্ত করবেন। আর যদি তুমি কোন গুনাহ করে থাক তাহলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তওবা কর। কেননা বান্দা গুনাহ স্বীকার করে তওবা করলে আল্লাহ তাআলা তওবা কবূল করেন।
তিনি [আয়েশাহ (রাদি.)] বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) তাহাঁর কথা শেষ করলে আমার অশ্রুধারা বন্ধ হয়ে যায়। এক ফোঁটা অশ্রুও আমি আর টের করিতে পারলাম না। তখন আমি আমার আববাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) যা বলছেন আমার হয়ে তার জবাব দিন। আমার আববা বলিলেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ)-কে কী জবাব দিব তা জানি না। তখন আমি আমার আম্মাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) যা বলছেন, আপনি তার উত্তর দিন। আম্মা বলিলেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ)-কে কী উত্তর দিব তা জানি না। তখন আমি ছিলাম অল্প বয়স্কা কিশোরী। কুরআনও বেশী পড়তে পারতাম না। তথাপিও এ অবস্থা দেখে আমি নিজেই বললাম, আমি জানি আপনারা এ অপবাদের ঘটনা শুনেছেন, আপনারা তা বিশ্বাস করিয়াছেন এবং বিষয়টি আপনাদের মনে দৃঢ়মূল হয়ে আছে। এখন যদি আমি বলি যে, এর থেকে আমি পবিত্র তাহলে আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন না। আর যদি আমি এ অপরাধের কথা স্বীকার করে নেই যে সম্পর্কে আল্লাহ জানেন যে, আমি এর থেকে পবিত্র, তাহলে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন। আল্লাহর কসম! আমি ও আপনারা যে বিপাকে পড়েছি এর জন্য ইউসুফ (আঃ)-এর পিতার কথা ব্যতীত আমি কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি বলেছিলেনঃ কাজেই পূর্ণ ধৈর্য্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছ এ ব্যাপারে আল্লাহই একমাত্র আমার আশ্রয়স্থল। অতঃপর আমি মুখ ঘুরিয়ে আমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আল্লাহ তাআলা জানেন যে, সে মুহূর্তেও আমি পবিত্র। অবশ্যই আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন তবে আল্লাহর কসম, আমি কক্ষণো ভাবিনি যে, আমার সম্পর্কে আল্লাহ ওয়াহী অবতীর্ণ করবেন যা পাঠ করা হইবে। আমার সম্পর্কে আল্লাহ কোন কথা বলবেন আমি নিজেকে এতটা উত্তম মনে করিনি বরং আমি নিজেকে এর চেয়ে অনেক অধম বলে ভাবতাম। তবে আমি আশা করতাম যে, হয়তো রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ)-কে স্বপ্নযোগে দেখানো হইবে যার ফলে আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করবেন। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) তখনো তাহাঁর বসার জায়গা ছেড়ে যাননি এবং ঘরের লোকজনও কেউ ঘর হইতে বেরিয়ে যাননি। এমন সময় তাহাঁর উপর ওয়াহী অবতরণ শুরু হল। ওয়াহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় তাহাঁর যে বিশেষ ধরনের কষ্ট হত তখনও সে অবস্থা হল। এমনকি ভীষণ শীতের দিনেও তাহাঁর শরীর হইতে মোতির দানার মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়ল ঐ বাণীর গুরুভারে, যা তাহাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর এ অবস্থা কেটে গেলে তিনি হাসিমুখে পহেলা যে কথা উচ্চারণ করিলেন সেটা হল, হে আয়েশাহ! আল্লাহ তোমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দিয়েছেন।
তিনি [আয়েশাহ (রাদি.)] বলেন, এ কথা শুনে আমার মা আমাকে বলিলেন, তুমি উঠে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর প্রতি সম্মান কর। আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমি তাহাঁর দিকে উঠে যাব না। মহান আল্লাহ ব্যতীত কারো প্রশংসা করব না। আয়েশাহ (রাদি.) বলিলেন, আল্লাহ (আমার পবিত্রতার ব্যাপারে) যে দশটি আয়াত অবতীর্ণ করিয়াছেন, তা হল, যারা এ অপবাদ রটনা করেছে তারা তো তোমাদেরই একটি দল; এ ঘটনাকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না; বরং এও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য আছে কঠিন শাস্তি। এ কথা শোনার পর মুমিন পুরুষ এবং নারীগণ কেন নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারণা করেনি এবং বলেনি যে, এটা তো সুস্পষ্ট অপবাদ। তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি? যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সেহেতু তারা আল্লাহর বিধানে মিথ্যাচারী। দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমরা যাতে লিপ্ত ছিলে তার জন্য কঠিন শাস্তি তোমাদেরকে স্পর্শ করত। যখন তোমরা মুখে মুখে এ মিথ্যা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিল না এবং একে তোমরা তুচ্ছ ব্যাপারে বলে ভাবছিলে, অথচ আল্লাহর কাছে তা ছিল খুবই গুরুতর ব্যাপার। এবং এ কথা শোনামাত্র তোমরা কেন বললে না যে, এ বিষয়ে বলাবলি করা আমাদের জন্য উচিত নয়। আল্লাহ পবিত্র মহান! এ তো এক গুরুতর অপবাদ। আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক তাহলে কখনো অনুরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি করিবে না; আল্লাহ তোমাদের জন্য তাহাঁর আয়াতসমূহ বিবৃত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতে মর্মন্তুদ শাস্তি। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউই অব্যাহতি পেত না। আল্লাহ দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু- (সুরা আন-নূর ২৪/১১-২০)। আমার পবিত্রতার ব্যাপারে আল্লাহ এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ করিলেন। আত্মীয়তা এবং দারিদ্রের কারণে আবু বাকর সিদ্দীক (রাদি.) মিসতাহ ইবনু উসাসাকে আর্থিক ও বৈষয়িক সাহায্য করিতেন। কিন্তু আয়েশাহ (রাদি.) সম্পর্কে তিনি যে অপবাদ রটিয়েছিলেন এ কারণে আবু বাকর সিদ্দীক (রাদি.) কসম করে বলিলেন, আমি আর কখনো মিসতাহকে আর্থিক সাহায্য করব না। তখন আল্লাহ তাআলা অবতীর্ণ করিলেন-তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ গ্রহণ না করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজন ও অভাবগ্রস্তকে এবং আল্লাহর রাস্তায় যারা গৃহত্যাগ করেছে তাদেরকে কিছুই দিবে না। তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে এবং তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। শোন! তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল; পরম দয়ালু- (সুরা আন-নূর ২৪/২২)। আবু বাকর সিদ্দীক (রাদি.) বলে উঠলেন, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম! অবশ্যই আমি পছন্দ করি যে, আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিন। এরপর তিনি মিসতাহ (রাদি.)-এর জন্য যে অর্থ খরচ করিতেন তা পুনঃ দিতে শুরু করিলেন এবং বলিলেন, আল্লাহর কসম! আমি তাঁকে এ অর্থ দেয়া আর কখনো বন্ধ করব না। আয়েশাহ (রাদি.) বলিলেন, আমার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) যায়নাব বিনত জাহাশ (রাদি.)-কেও জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি যায়নাব (রাদি.)-কে বলেছিলেন, তুমি আয়েশাহ (রাদি.) সম্পর্কে কী জান অথবা বলেছিলেন তুমি কী দেখেছ? তখন তিনি বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি আমার চোখ ও কানকে হিফাযত করেছি। আল্লাহর কসম! আমি তাহাঁর ব্যাপারে ভাল ব্যতীত আর কিছুই জানি না। আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, নাবী (সাঃআঃ)-এর স্ত্রীগণের মধ্যে তিনি আমার প্রতিদ্বনদ্বী ছিলেন। আল্লাহ তাহাঁর তাকওয়ার কারণে তাঁকে রক্ষা করিয়াছেন। আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, অথচ তাহাঁর বোন হামনা (রাদি.) তাহাঁর পক্ষ নিয়ে অপবাদ রটনাকারীদের মতো অপবাদ ছড়াচ্ছিল। ফলে তিনি ধ্বংসপ্রাপ্তদের সঙ্গে ধ্বংস হয়ে গেলেন।
বর্ণনাকারী ইবনু শিহাব (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, ঐ সমস্ত লোকের ঘটনা আমার কাছে যা পৌঁছেছে তা হলো এইঃ উরওয়াহ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, আয়েশাহ (রাদি.) বর্ণনা করিয়াছেন যে, আল্লাহর কসম! যে ব্যক্তি সম্পর্কে অপবাদ দেয়া হয়েছিল, তিনি এসব কথা শুনে বলিতেন, আল্লাহ মহান, ঐ সত্তার কসম! যাঁর হাতে আমার প্রাণ, আমি কোন রমণীর বস্ত্র অনাবৃত করে কোনদিন দেখিনি। আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, পরে তিনি আল্লাহর পথে শহীদ হন। [২৫৯৩] (আঃপ্রঃ ৩৮২৯, ইঃফাঃ ৩৮৩২)
৪১৪২
যুহরী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন যে, ওয়ালীদ ইবনু আবদুল মালিক (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) আমাকে জিজ্ঞেস করিলেন, আপনার নিকট কি এ খবর পৌছেছে যে, আয়েশাহ (রাদি.)-এর প্রতি অপবাদ রটনাকারীদের মধ্য আলী (রাদি.)-ও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন? আমি বললাম, না তবে আবু সালামাহ ইবনু আবদুর রহমান ও আবু বকর ইবনু আবদুর রহমান ইবনু হারিস নামক তোমার গোত্রের দুব্যক্তি আমাকে জানিয়েছে যে, আয়েশাহ (রাদি.) তাদের দুজনকে বলেছিলেন যে, আলী (রাদি.) তার ব্যাপারে পুরোপুরি নির্দোষ ছিলেন। (আ.প্র. ৩৮৩০, ই.ফা. ৩৮৩৩)
৪১৪৩
আয়েশাহ (রাদি.)-এর মা উম্মু রুমান (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি ও আয়েশাহ (রাদি.) উপবিষ্ট ছিলাম। এমন সময় এক আনসারী মহিলা এসে বলিতে লাগল আল্লাহ অমুক অমুককে ধ্বংস করুন। এ কথা উম্মু রুমান (রাদি.) বলিলেন, তুমি কী বলছ? সে বলিল, যারা অপবাদ রটিয়েছে তাদের মধ্যে আমার ছেলেও আছে। উম্মু রুমান (রাদি.) জিজ্ঞেস করিলেন, সেটা কী? সে বলিল, এই এই রটিয়েছে। আয়েশাহ (রাদি.) বলিলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) শুনেছেন? সে বলিল, হ্যাঁ। আয়েশাহ (রাদি.) বলিলেন, আবু বকরও কি শুনেছেন? সে বলিল, হ্যাঁ। এ কথা শুনে আয়েশাহ (রাদি.) বেহুশ হয়ে পড়ে গেলেন। জ্ঞান ফিরে আসলে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসল। তখন আমি একটি চাদর দিয়ে তাঁকে ঢেকে দিলাম। এরপর নাবী (সাঃআঃ) এসে জিজ্ঞেস করিলেন, তাহাঁর কি অবস্থা? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! তাহাঁর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে। রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলিলেন, হয়তো সে অপবাদের কারণে। তিনি বলিলেন, হ্যাঁ। এ সময় আয়েশাহ (রাদি.) উঠে বসলেন এবং বলিলেন, আল্লাহর কসম! আমি যদি কসম করি, তাহলেও আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন না, আর যদি ওযর পেশ করি তবুও আমার ওযর আপনারা গ্রহণ করবেন না, আমার এবং আপনাদের দৃষ্টান্ত নাবী ইয়াকুব (আ) ও তার ছেলেদের উদাহরণের মতো। তিনি বলেছিলেন, “তোমরা যা বলছ সে বিষয়ে আল্লাহই একমাত্র আমার আশ্রয়স্থল”। উম্মু রুমান (রাদি.) বলেন, তখন নাবী (সাঃআঃ) কিছু না বলেই চলে গেলেন। এরপর আল্লাহ তাআলা তাহাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করে আয়াত অবতীর্ণ করিলেন। আয়েশাহ (রাদি.) বলিলেন, একমাত্র আল্লাহরই প্রশংসা করি অন্য কারো না, আপনারও না। [৩৩৮৮] (আ.প্র. ৩৮৩১, ই.ফা. ৩৮৩৪)
৪১৪৪
আয়েশাহ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি আয়াতাংশ (بِأَلْسِنَتِكُمْ تَلَقَّوْنَهُ إِذْ) পড়তেন এবং বলিতেন
অর্থ (সুরাহ আন্-নূর ২৪/১৫)। ইবনু আবু মুলাইকাহ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেছেন, এ আয়াতের ব্যাখ্যা আয়েশাহ (রাদি.) অন্যান্যাদের চেয়ে অধিক জানতেন। কারণে এ আয়াত তারই সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছিল। [৪৭৫২] (আ.প্র. ৩৮৩২, ই.ফা. ৩৮৩৫)
৪১৪৫
হিশামের পিতা হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি আয়েশাহ (রাদি.)-এর সামনে হাস্সান ইবনু সাবিত (রাদি.)-কে গালি দিতে লাগলে তিনি বলিলেন, তাঁকে গালি দিও না। কারণ তিনি রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর পক্ষ হয়ে কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াই করিতেন। আয়েশাহ (রাদি.) বলেছেন হাস্সান ইবনু সাবিত (রাদি.) কবিতার মাধ্যমে মুশরিকের নিন্দাবাদ করার জন্য নাবী (সাঃআঃ)-এর কাছে অনুমতি চাইলে তিনি বলিলেন, তুমি কুরাইশদের নিন্দায় কবিতা রচনা করলে আমার বংশকে কি পৃথক করিবে? আমি আপনাকে তাদের থেকে এমনভাবে পৃথক করে রাখব যেমনভাবে আটার খামির থেকে চুল পৃথক করা হয়। [৩৫৩১]
মুহাম্মদ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেছেন, উসমান ইবনু ফারকাদ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) আমার কাছে বর্ণনা করিয়াছেন যে, আমি হিশাম (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)-কে তার পিতা উরওয়াহ (রাদি.) থেকে বর্ণনা করিতে শুনিয়াছি, তিনি বলেছেন, আমি হাস্সান ইবনু সাবিত (রাদি.)-কে গালি দিয়েছি। কেননা তিনি ছিলেন, আয়েশাহ (রাদি.)-এর প্রতি অপবাদ রটনাকারীদের একজন। (আ.প্র. ৩৮৩৩, ই.ফা. ৩৮৩৬)
৪১৪৬
মাসরূক (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি আয়েশাহ (রাদি.)-এর নিকট গেলাম। তখন তাহাঁর কাছে হাস্সান ইবনু সাবিত (রাদি.) তাঁকে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছেন। তিনি আয়েশাহ (রাদি.)-এর প্রশংসায় বলেছনে, “তিনি সতী, ব্যক্তিত্বসম্পন্না ও জ্ঞানবর্তী, তাহাঁর প্রতি কোন সন্দেহই আরোপ করা যায় না। তিনি অভুক্ত থাকেন, তবুও অনুপস্থিত লোকেদের গোশত খান না (অর্থাৎ গীবত করেন না)। এ কথা শুনে আয়েশাহ (রাদি.) বলিলেন, কিন্তু আপনি তো এরূপ নন। মাসরুক (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেছেন যে, আমি আয়েশাহ (রাদি.)-কে বললাম, আপনি কেন তাকে আপনার কাছে আসার অনুমতি দেন? অথচ আল্লাহ আআলা বলেছেন, “তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে, তার জন্য আছে কঠিন শাস্তি। আয়েশাহ (রাদি.) বলেন, অন্ধত্ব থেকে কঠিনতর শাস্তি আর কী হইতে পারে? তিনি তাঁকে আরো বলেন যে, হাস্সান ইবনু সাবিত (রাদি.) রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ)-এর পক্ষাবলম্বন করে কাফিরদের সঙ্গে মুকাবালা করিতেন অথবা কাফিরদের বিপক্ষে নিন্দাপূর্ণ কবিতা রচনা করিতেন। [৪৭৫৫, ৪৭৫৬; মুসলিম ৪৪/৩৪, হাদীস ২৪৮৮] (আ.প্র. ৩৮৩৪, ই.ফা. ৩৮৩৭)
Leave a Reply