মুহরিমের অবরুদ্ধ হওয়া বিষয়ক মাসালা ও মাসায়েল

মুহরিমের অবরুদ্ধ হওয়া বিষয়ক মাসালা ও মাসায়েল

মুহরিমের অবরুদ্ধ হওয়া বিষয়ক মাসালা ও মাসায়েল >> আল হিদায়া ফিকহ এর মুল সুচিপত্র দেখুন

 কিতাবঃ আল হিদায়া, সপ্তম অনুচ্ছেদ – অবরুদ্ধ হওয়া

মুহরিম যদি শত্রু কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়, কিংবা অসুস্থতায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে হজ্জের কাজ পরিচালনায় বাধাপ্রাপ্ত হয়, তাহলে তার জন্য ইহরাম খুলে হালাল হয়ে যাওয়া জাইয।

ইমাম শাফিঈ(রঃআঃ) বলেন, শত্রু কর্তৃক অবরুদ্ধ হওয়া ছাড়া সাব্যস্ত হবে না। কেননা হাদী প্রেরণের মাধ্যমে হালাল হওয়ার বিধান অবরুদ্ধ ব্যক্তির জন্য অনুমোদনের উদ্দেশ্য হলো রেহাই লাভ করা। আর হালাল হওয়ার মাধ্যমে শত্রু  থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে, অসুস্থতা থেকে নয়।

আমাদের দলিল এই, ভাষাবিদের সর্বসম্মতিক্রমে সাব্যস্ত হইয়াছে যে, সংক্রান্ত আয়াতে শামিল হইয়াছে অসুস্থতার কারণে অবরুদ্ধ ব্যক্তি সম্পর্কে। কেননা তারা বলেন শব্দটি অসুস্থতার এবং শব্দটি দুশমন কর্তৃক অবরুদ্ধ হওয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়।

সময়ের পূর্বে হালাল হওয়ার উদ্দেশ্য হলো ইহরাম প্রলম্বিত হওয়ার কারণে উদ্ভুত কষ্ট দূর করা। আর অসুস্থ অবস্থায় ধৈর্যের সাথে ইহরাম আকড়ে ধরার কষ্ট তা থেকে বেশী।

যখন হালাল হয়ে যাওয়া তার জন্য জাইয হলো, তখন তাকে বলা হবে, একটি বকরী পাঠিয়ে দাও, যা হরমে যবাহ করা হবে এবং যাকে দিয়ে পাঠাবে তার নিকট থেকে একটি নির্ধারিত দিনে তা যবাহ করার ওয়াদা গ্রহণ করো। এরপর তুমি হালাল হবে।

হরমে পাঠানোর কারণ এই যে, এর দম হলো ইবাদত। আর বর্ণীত হইয়াছে যে, নির্ধারিত স্থান বা সময় ছাড়া রক্ত প্রবাহিত করা ইবাদত রুপে বিবেচিত নয়। সুতরাং হরম ছাড়া এটা ইবাদত হবে না এবং তা দ্বারা হালাল হওয়া যাবে না। নিম্নোক্ত আয়াতে আল্লাহ্‌ তা’আলা এদিকেই ইশারা করেছেন- হাদী তার নির্ধারিত স্থানে পৌছা পর্যন্ত তোমরা তোমাদের মাথা মুড়াবে না।

বস্তুতঃ হাদী ঐ পশূকেই বলা হয়, যাকে হরম-এ প্রেরণ করা হয়। ইমাম শাফিঈ(রঃআঃ) বলেন, হরমের সাথে আবদ্ধ হবে না। কেননা আবদ্ধ করা সহজ-সাধ্যতাকে রহিত করে। আমাদের দলিল এই যে, মূল সহজ-সাধ্যতার বিষয়িটই বিবেচনা করা হইয়াছে, চূড়ান্ত সহজ-সাধ্যতার বিষয়টি নয়।

(হাদী হিসাবে) বকরীই জাইয হবে। কেননা আয়াতে হাদীর কথা স্পষ্টভাবে বলা হইয়াছে। আর সর্বনিম্ন হাদী হলো বকরী। তবে কুরবানীর মতো এখানেও গরু বা উট যথেষ্ট হবে।

আমাদের উল্লেখিত বক্তব্যের উদ্দেশ্য অবশ্য বকরী পশূটিই পাঠানো নয়। কেননা তা কখনো কষ্টকরও হতে পারে। বরং সে মূল্য পাঠিয়ে দিতে পারে, যাতে সেখানে বকরী খরিদ করে তার পক্ষ থেকে যবাহ্‌ করা হয়।

ইমাম কুদূরী(রঃআঃ) এর বক্তব্য অতঃপর হালাল হয়ে যাবে এদিকে ইংগিত করে যে, হলক বা চুল ছাটা তার জন্য জরুরী নয়। এ হল ইমাম আবূ হানীফা(রঃআঃ) ও মুহাম্মাদ(রঃআঃ)এর মত। ইমাম আবূ ইউসুফ(রঃআঃ) বলেন, তার উচিত হবে হলক করা বা চুল ছাটা। আর যদি তা না করে তাহলে তার উপর কোন কিছু ওয়াজিব হবে না। কেননা রসূলুল্লাহ্‌ (সাঃআঃ) হুদায়বিয়ার বছর সেখানে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় হলক করেছিলেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে হলকের আদেশ দিয়েছিলেন।

ইমাম আবূ হানীফা(রঃআঃ) ও ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর দলিল এই যে, হলক ইবাদত রূপে বিবেচিত হয়, যদি তা হজ্জের ক্রিয়াকর্মের পরে সম্পন্ন হয়। সুতরাং তার আগে ইবাদত রূপে গণ্য হবে না ।

আর নাবী করিম(সাঃআঃ) ও সাহাবায়ে কিরাম তা করে ছিলেন, যাতে ফিরে যা্ওয়ার ব্যাপারে ইচ্ছার দৃঢ়তা প্রকাশ পায়।

ইমাম কুদুরী(রঃআঃ) বলেন, অবরূদ্ধ ব্যক্তি যদি কিরানকারী হয়, তাহলে দুটির দম প্রেরণ করবে। কেননা তার দুটি ইহরাম থেকে হালাল হওয়া প্রয়োজন।

যদি হজ্জ থেকে হালাল হওয়ার জন্য একটি হাদী প্রেরণ করে আর উমরার ইহরাম বহাল রাখে, তাহলে কোন  ইহরাম থেকেই হালাল হবে না। কেননা একই সাথে উভয় ইহরাম থেকে হালাল হওয়া শরীআত অনুমোদন করেছে।

এর দম হরম ছাড়া অন্য কোথাও যবাহ করা জাইয নয়। তবে ইয়াওমুন-নহরের পূর্বে যবাহ করা জাইয রহিয়াছে।

এ হল ইমাম আবূ হানীফা(রঃআঃ) এর মত। সাহেবাইন বলেন, হজ্জের অবস্থায় অবরূদ্ধ ব্যক্তির জন্য ইয়াওমুন-নহর ছাড়া অন্য সময় যবাহ করা জাইয নয়। পক্ষান্তরে উমরার অবস্থায় অবরূদ্ধ ব্যক্তি যখন ইচ্ছা যবাহ করিতে পারে।

হজ্জ অবরুদ্ধ ব্যক্তিকে এ বিধান দেওয়া হইয়াছে তামাত্তু ও কিরানের হাদীর-এর উপর কিয়াস করে।

সাহেবাইন অবরুদ্ধ ব্যক্তির যবাহ্‌কে সম্ভবতঃ হলক এর উপর কিয়াস করেছেন। কেননা উভয়ের প্রত্যেকটি ইহরাম থেকে হালালকারী।

ইমাম আবূ হানীফা(রঃআঃ) বলেন, এ হলো কাফ্‌ফারার দম। এজন্যই তা থেকে খাওয়া জাইয নেই। সুতরাং এটা স্থানের সাথে বিশিষ্ট হবে, কিন্তু কোন সময়ের সাথে আবদ্ধ হবে না, যেমন অন্যান্য কাফ্‌ফারার দম।

তামাত্তু ও কিরানের দম এর বিপরীত।কেননা সেটা হলো ইবাদতের দম। (কাফ্‌ফারার দম নয়)। হলকের বিষয়টিও ভিন্ন। কেননা সেটা যথাসময়ে হচ্ছে। কারণ হজ্জের প্রধান কাজ উকুফ হলকের মাধ্যমেই সমাপ্ত হয়।

ইমাম কুদুরী(রঃআঃ) বলেন, হজ্জ অবস্থায় অবরূদ্ধ ব্যক্তি যদি হালাল হয়ে যায়, তাহলে তাকে (পরবর্তীতে) একটি হজ্জ ও একটি উমরা করিতে হবে।

ইবন আব্বাস (রাঃআঃ) ও ইবনি উমর  (রাঃআঃ) থেকে এরূপই বর্ণীত হইয়াছে। তাছাড়া এ হেতু যে, হজ্জ কাযা করা তো ওয়াজিব হবে এই কারণে যে, তা শুরু করা সহীহ ছিলো। আর উমরা এই কারণে যে, সে হলো হজ্জ ফউতকারী ব্যক্তির সমপর্যায়ের।

উমরা অবস্থায় অবরুদ্ধ ব্যক্তির উপর পরে উমরা কাযা করা ওয়াজিব হবে।

আমাদের মতে উমরার ক্ষেত্রেও অবরোধ সাব্যস্ত হয়।

ইমাম মালিক (রঃআঃ) বলেন, সাব্যস্ত হবে না। কেননা, উমরা তো নির্ধারিত কোন সময়ের সাথে আবদ্ধ নয়।

আমাদের দলিল এই যে, নাবী(সাঃআঃ) ও সাহাবায়ে কিরাম উমরা অবস্থায় হুদায়বিয়ায় অবরুদ্ধ হয়েছিলেন।

তাছাড়া অসুবিধা দূর করার জন্যই হালাল হওয়া অনুমোদন করা হইয়াছে। আর এটা উমরার ইহরামেও বিদ্যমান রহিয়াছে। আর যখন অবরোধ সাব্যস্ত হইয়াছে, তখন তার উপর কাযা ওয়াজিব। যেহেতু সে হালাল হইয়াছে, যেমন হজ্জের ক্ষেত্রে।

কিরানকারীর উপর একটি হজ্জ ও দুটি উমরা ওয়াজিব হবে। হজ্জ ও দুটি উমরার একটি ওয়াজিব হওয়ার কারণ তো আমরা পূর্বেই বর্ণনা করেছি। আর দ্বিতীয় উমরা ওয়াজিব হওয়ার কারণ এই যে, শুরু করা শুদ্ধ হওয়ার পর সে তা থেকে বেরিয়ে এসেছে।

কিরানকারী(অবরূদ্ধ ব্যক্তি) যদি হাদী প্রেরণ করে এবং সংশ্লিষ্ট লোকদের নিকট হতে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করে যে, একটি নির্ধারিত দিনে তারা তা যবাহ করবে, এরপর বা অবরোধ উঠে যায়। এখন যদি অবস্থা এমন হয় যে, সে হজ্জ ও হাদী গিয়ে ধরতে পারবে না, তাহলে মক্কা অভিমুখে গমন করা তার জন্য জরুরী হবে না। বরং হাদী যবাহ করে হালাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। কেননা মক্কা অভিমুখে যাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য তথা হজ্জের ক্রিয়াকর্ম আদায় করার সময় ফউত হয়ে গেছে।

আর যদি সে উমরার মাধ্যমে হালাল হওয়ার উদ্দেশ্যে যায়, তাহলে সে তাও করিতে পারে। কেননা সে তো হজ্জ ফউতকারী।

আর যদি হজ্জ ও হাদী দুটোই পাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে যাওয়া তার জন্য জরুরী হবে। কেননা স্থলবর্তী দ্বারা উদ্দেশ্য অর্জিত হওয়ার পূর্বে অক্ষমতা দূর হয়ে গেছে।

যদি (সেখানে গিয়ে) সে হাদী পেয়ে যায়, তাহলে সেটাকে (বিক্রি করা, সাদাকা করা ইত্যাদি) যা ইচ্ছা তা করিতে পারে। কেননা সে তার মালিক, আর সেটা এমন একটা উদ্দেশ্যের জন্য নির্দিষ্ট করে ছিলো, যা থেকে সে এখন মুক্ত হয়ে গেছে।

যদি এমন হয় যে, হাদী পাবে কিন্তু হজ্জ পাবে না, তাহলে হালাল হয়ে যাবে। কেননা সে মূল বিষয় লাভে অপারগ। আর যদি হজ্জ পাওয়া সম্ভব হয়, হাদী পা্ওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে তার জন্য হালাল হওয়া জাইয হবে।

এ সিদ্ধান্ত সূক্ষ কিয়াসের ভিত্তিতে। এই শেষ প্রকারটি হজ্জ অবস্থায় অবরুদ্ধ ব্যক্তি সম্পর্কে সাহেবাইনের মত অনুযায়ী প্রযোজ্য হবে না্ কেননা তাদের মতে এর দম ইয়াওমুন নহরের সময় দ্বারা আবদ্ধ। সুতরাং যে হজ্জ পাবে সে হাদী অবশ্যই পাবে। অবশ্য ইমাম আবূ হানীফা(রঃআঃ) এর মতে এই প্রকারটি প্রযোজ্য হবে। আর উমরা অবস্থায় অবরুদ্ধ ব্যক্তির ক্ষেত্রে সর্বসম্মতিক্রমে সঠিক হবে। কেননা , (উমরার ক্ষেত্রে) যবাহ করার বিষয়টি দশ তারিখের সাথে আবদ্ধ নয়।

কিয়াসের দলিল এই যে, আর এটা হলো ইমাম যুফার(রঃআঃ) এর মত, সে তো স্থলবর্তী তথা হাদী দ্বারা উদ্দেশ্য লাভের পূর্বে মূল তথা হজ্জ আদায় করিতে সক্ষম।

সূক্ষ কিয়াসের দলিল এই যে, যদি আমরা মক্কা অভিমুখে যাওয়াকে তার জন্য আবশ্যকীয় বলে সাব্যস্ত করি, তাহলে তার সম্পদ নষ্ট হবে। কেননা, সে যবাহ্‌ করার জন্য হাদী অগ্রে প্রেরণ করেছে, অথচ তার উদ্দেশ্য লাভ হচ্ছে না। আর মালের সম্মানতো জানের সম্মানের মতই।

আর তার অধিকার রহিয়াছে। ইচ্ছা করলে সে সেখানে কিংবা অন্যখানে অবস্থান করবে, যাতে তার পক্ষ থেকে যবাহ্‌ করা হয়। আর সে হালাল হতে পারে। আর চাইলে ইহরামের মাধ্যমে যে ইবাদত আদায়ের বাধ্যবাধকতা সে গ্রহণ করেছে তা আদায় করার জন্য মক্কায় য়েতে পারে। আর এটাই উত্তম। কেননা এটা কৃত ওয়াদা পূর্ণ করার অধিক নিকটবর্তী।

যে ব্যক্তি আরাফায় উকূফ করার পর অবরুদ্ধ হয়ে পড়লো, সে অবরুদ্ধ বলে বিবেচিত হবে না। কেননা হজ্জ ফউত হওয়া থেকে নিরাপদ হয়ে গেছে। যে ব্যক্তি মক্কায় অবরুদ্ধ হইয়াছে এবং তাকে তাওয়াফ ও উকূফ হওয়া থেকে নিরাপদ হয়ে গেছে। যে ব্যক্তি মক্কায় অবরুদ্ধ হইয়াছে এবং তাকে তাওয়াফ ও উকূফ থেকে বাধা প্রাপ্ত হইয়াছে, সে অবরুদ্ধ বলেই অবরুদ্ধ হওয়ার মতই হলো। যদি তাওয়াফ ও উকূফ এ দুটির যে কোন একটি করিতে সক্ষম হয়, তাহলে সে অবরুদ্ধ বলে গণ্য হবে না।

তাওয়াফের ক্ষেত্রে কারণ এই যে, হজ্জ ফউতকারী ব্যক্তি তাওয়াফ দ্বারাই হালাল হয়ে থাকে। আর হালাল হওয়ার জন্য দম ওয়াজিব হয় তাওয়াফের স্থলবর্তী হিসাবে। উকূফের ক্ষেত্রে কারণ আমরা আগে বর্ণনা করেছি(অর্থাত্ আরাফার উকুফ করার পর সাব্যস্ত হয় না।

তাওয়াফের ক্ষেত্রে কারণ এই যে, হজ্জ ফউতকারী ব্যক্তি তাওয়াফ দ্বারাই হালাল হয়ে থাকে। আর হালাল হওয়ার জন্য দম ওয়াজিব হয় তাওয়াফের স্থলবর্তী হিসাবে। উকূফের ক্ষেত্রে কারণ আমরা আগে বর্ণনা করেছি (আর্থাত্‌ আরাফায় উকুফ করার পর সাব্যস্ত হয় না।

কেউ কেউ বলেছেন, আলোচ্য মাসআলায় ইমাম আবূ হানীফা ও আবূ ইউসুফ(রঃআঃ) এর মাঝে মতপার্থক্য রহিয়াছে। কিন্তু আমি যে বিশদ বিবরণ তোমাকে অবহিত করেছি, তা-ই শুদ্ধ।


Posted

in

by

Comments

Leave a Reply