হজ্জের মাসআলা – উকুফের সাথে সংশ্লিষ্ট

হজ্জের মাসআলা – উকুফের সাথে সংশ্লিষ্ট

হজ্জের মাসআলা – উকুফের সাথে সংশ্লিষ্ট >> আল হিদায়া ফিকহ এর মুল সুচিপত্র দেখুন

কিতাবঃ আল হিদায়া, পরিচ্ছেদ- উকুফের সাথে সংশ্লিষ্ট

মুহরিম যদি মক্কায় প্রবেশ না করেই আরাফা অভিমুখে গমন করে এবং আমাদের পূর্ব বর্ণীত নিয়ম অনুসারে সেখানে উকুফ করে তাহলে তার, যিম্মা থেকে তাওয়াফুল কুদুম রহিত হয়ে যাবে। কেননা তাওয়াফুল কুদূম হজ্জের শুরুতে এমনভাবে শরীআতের বিধান সাব্যস্ত হইয়াছে যে, তার উপর হজ্জের যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম পরস্পরায় আবর্তিত হয়ে থাকে। সুতরাং ঐ রূপ ছাড়া অন্য কোন রূপে তা আদায় করা সুন্নাত হবে না।

আর এটা তরক করার কারণে তার উপর কিছুই ওয়াজিব হবে না। কেননা এটা সুন্নাত। আর সুন্নাত তরক করার কারণে কোন ক্ষতিপূরণ ওয়াজিব হয় না। ( হজ্জের মাসআলা )

যে ব্যক্তি নয় তারিখের সূর্য হেলে পড়া থেকে দশ তারিখের ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত মধ্যবর্তী যে কোন সময়ে আরাফায় উকুফ করিতে পারে, সে হজ্জ পেয়ে গেলো।

সুতরাং আমাদের মতে উকুফের প্রথম ওয়াক্ত হলো যাওয়ালের পর। কেননা বর্ণীত আছে যে,নাবী করীম(সাঃআঃ) যাওয়ালের পর উকুফ করেছেন, আর এ হলো প্রথম ওয়াক্তের পর।

আর নাবী(সাঃআঃ) বলেছেন- যে ব্যক্তি অন্ততঃ রাত্রে আরাফার অবস্থান লাভ করিতে পারে সে হজ্জ পেয়ে গেলো, আর যে রাত্রেও আরাফার অবস্থান লাভ করিতে না, পারে  তার হজ্জ ফওত হয়ে গেলো। এ হলো উকুফের শেষ সময়ের বিবরণ।

ইমাম মালিক(রঃআঃ) যদিও বলতেন যে, উকুফের প্রথম ওয়াক্ত হলো ফজর উদিত হওয়ার কিংবা সূর্য উদিত হওয়ার পর থেকে, কিন্তু আমাদের এইমাত্র বর্ণীত হাদীস তার বিপক্ষে দলিল।

যদি যাওয়ালের পর উকুফ করে সেই মুহুর্তে রওয়ানা দিয়ে দেয়, তাহলে আমাদের মতে যথেষ্ট হবে। কেননা রাসূলু্ল্লাহ্‌(সাঃআঃ) বিষয়টিকে অব্যয় যোগে উল্লেখ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন- হজ্জ হলো আরাফার অবস্থান। সুতরাং যে ব্যক্তি রাত্রের বা দিনের কিছু সময় আরাফায় অবস্থান করলো, তার হজ্জ পূর্ণ হয়ে গেলো। অব্যয়টি হলো ইচ্ছা প্রদানমূলক অব্যয়।

ইমাম মালিক(রঃআঃ) বলেন, দিনের সহিত রাত্রের কিছু অংশে উকুফ না করলে যথেষ্ট হবে না। কিন্তু আমাদের বর্ণীত হাদীস তার বিপক্ষে দলিল। ( হজ্জের মাসআলা )

যে ব্যক্তি ঘুমন্ত অবস্থায় কিংবা বেহুশ অবস্থায়  কিংবা সে আরাফা না জেনে অতিক্রম করে, তবে তার উকুফ জাইয হয়ে যাবে। কেননা যা হজ্জের রকুন আর্থাত্‌ উকুফ, তা তো পাওয়া গেছে। অজ্ঞানাবস্থা কিংবা ঘুমের অবস্থার কারণে তো সেটা ব্যাহত হয় না; যেমন সাওমের রুকনের বেলায় নামাজের বিষয়টি এর বিপরীত। কেননা অজ্ঞান অবস্থায় নামাজ অব্যাহত থাকতে পারে না।

আর অজ্ঞান অবস্থায় আরাফা অতিক্রম করার সময় উকুফের নিয়্যত অনুপস্থিত, কিন্তু নিয়্যত তো হজ্জের প্রতিটি রুকনের জন্য শর্ত নয়।

কেউ যদি অজ্ঞান হয়ে যায় আর তার সাথীরা তার পক্ষ হতে ইহরাম বেধে দেয় তাহলে কেউ তা জাইয হবে ।

এ হল আবূ হানীফা(রঃআঃ) এর মাযহাব। সাহেবাইনের মতে তা জাইয হবে না। ( হজ্জের মাসআলা )

যদি কোন মানুষকে বলে রাখে যে, সে অজ্ঞান হয়ে গেলে কিংবা ঘুমিয়ে গেলে সে যেন তার পক্ষ থেকে ইহরাম বেধে দেয় আর আদিষ্ট ব্যক্তি তার পক্ষ থেকে ইহরাম বেধে নেয়, তাহলে তা শুদ্ধ হবে। এর উপর ফকীহ্‌দের ইজমা রহিয়াছে। সুতরাং যদি সে সংজ্ঞা ফিরে পায় কিংবা জাগ্রত হয় এবং হজ্জের ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন করে, তাহলে জাইয হয়ে যাবে।

সাহেবাইনের দলিল এই যে, (প্রথমোক্ত সুরতে) সে নিজেও ইহরাম বাধেনি আবার কাউকে ইহরাম বেধে দেয়ার আদেশও করেনি। কেননা সে তো স্পষ্টতঃ অনুমতি প্রদান করেনি। আর লক্ষণগত অনুমতি নির্ভর করে বিষয়টি তার জানা থাকার উপর। তাছাড়া লক্ষণগত অনুমতির বৈধতা তো অনেক ফকীহ্‌ এরই জানা নেই। সুতরাং সাধারণ মানুষ তা জানবে কিভাবে। অন্যকে এ বিষয়ে স্পষ্ট আদেশ দানের অবস্থা এর বিপরীত।

ইমাম আবূ  হানীফা(রঃআঃ) এর দলিল এই যে, যখন সে তাদের সফর সংগী হওয়ার ব্যাপারে বন্ধনে আবদ্ধ হইয়াছে তখন সে ঐ সকল বিষয়ে তাদের প্রত্যেকের নিকট সাহায্যের আশাক পোষণ করেছে, যা সে নিজে সম্পাদন করত সক্ষম নয়। আর এই সফরের উদ্দেশ্যমূলক বিষয় হলো ইহরাম। সুতরাং লক্ষণগতভাবে ইহরাম বেধে দেয়ার অনুমতি সাব্যস্ত হবে। আর প্র্রমাণের পরিপ্রেক্ষিতে জ্ঞাত রহিয়াছে বলে সাব্যস্ত হবে। আর হুকুম তো প্রমাণের উপরই নির্ভরশীল।

ইমাম কুদূরী(রঃআঃ) বলেন- এই সকল বিষয়ে স্ত্রী লোকের হুকুম পুরুষের অনুরূপ। কেননা পুরুষদের মতই তারাও সম্বোধনের অন্তর্ভূক্ত।

তবে সে তার মাথা খুলে রাখবে না। কেননা সেটা তার সতরের অন্তর্ভূক্ত।

আর তার চেহার খোলা রাখবে। কেননা রসূলুল্লাহ(সাঃআঃ) বলেছেন, স্ত্রী লোকের ইহরাম হলো তার চেহারার মধ্যে।

যদি মুখের উপর কোন কিছু ঝুলিয়ে দেয় এবং তা চেহারা থেকে পৃথক রাখে তাহলে জাইয হবে।

আইশা (রাঃআঃ) থেকে এরূপ বর্ণীত হইয়াছে। তাছাড়া এটা হলো হাওদার ছায়া গ্রহণের মত।

আর সে উচ্চৈস্বরে তালবিয়া পড়বে না। কেননা তাতে ফিতনার আশংকা রহিয়াছে। ( হজ্জের মাসআলা )

সে রামাল করবে না এবং সাঈ করার সময় উভয় চিহ্নের মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়াবে না। কেননা তা সতর ঢেকে রাখার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।

আর সে মাথা মুড়াবে না, বরং চুল ছাটবে। কেননা বর্ণীত আছে যে, নাবী করীম(সাঃআঃ) স্ত্রী লোকদেরকে হক করা থেকে নিষেধ করেছেন। এবং তাদের ছাটার আদেশ দান করেছেন।

তাছাড়া দলিল এই যে, তাদের ক্ষেত্রে মাথা মুড়ানো মুসলার (বিকৃতি সাধনের) হুকুম রাখে, পুরুষের ক্ষেত্রে দাড়ি চাছা যেমন।

আর সে ইচ্ছামত সেলাই করা কাপড় পরিধান করবে। কেননা সেলাই বিহীন কাপড় পরিধানে ছতর খুলে যাওয়ার আশংকা রহিয়াছে।

ফকীহ্‌গণ বলেছেন, ভিড় থাকলে তারা হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করিতে যাবে না। কেননা পুরুদের সংস্পর্শে যেতে তাদের নিষেধ করা হইয়াছে। তবে যদি ফাকা জায়গা পেয়ে যায় তাহলে স্পর্শ করিতে পারে।

জামে সাগীর প্রণেতা বলেন, যে ব্যক্তি নফল কুরবানী, কিংবা মান্নতের কিংবা কোন শিকারের ক্ষতি পূরণের অথবা অন্য যে কোন উদ্দেশ্যের উটনীকে কালাদা(কুরবানীর পশুর চিহ্ন) পরাল এবং তা নিয়ে হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলো তার ইহরাম হয়ে গেছে বলে গণ্য হবে।

কেননা রাসূলূল্লাহ্‌(সাঃআঃ) বলেছেন- যে ব্যক্তি উটনীকে কালাদা পরাল, সে ইহরাম বেধে নিল। তাছাড়া এই জন্য যে, (হযরত ইবরাহীম(আঃ) এর আহবানে) সাড়া দান প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কুরবানীর পশু সংগে নিয়ে যাওয়া তালবিয়া পাঠের সমতুল্য। কেননা এ কাজ সে ব্যক্তিই করে, যে হজ্জ বা উমরার ইচ্ছা করে। আর সাড়াদানের প্রকাশ কখনো কর্ম দ্বারাও হয়, যেমন কথা দ্বারা হয়। সুতরাং এমন কাজের সংগে নিয়্যতের দ্বারা সে মুহরিম হয়ে যাবে, যে কাজ ইহরামের বৈশিষ্ট্যভূক্ত।

কালাদা পরানোর সুরত এই যে, উটনীর ছেড়া জুতা, ডোলের রশি কিংবা গাছের ছাল ঝুলিয়ে দেওয়া।

যদি পশুকে কালাদা পরিয়ে লোক মারফত পাঠিয়ে দেয়, নিজে সংগে না নেয় তাহলে সে মুহরিম হবে না। কেননা আইশা (রাঃআঃ) হতে বর্ণীত আছে যে, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ(সাঃআঃ) এর হাদী(হারাম অভিমুখী যাবাহ করার পশু) এর কালাদা পাকিয়ে দিয়েছিলাম। আর তিনি লোক মারফত তা পাঠিয়ে দেন এবং হালাল অবস্থায় পরিবারের মধ্যে অবস্থান করেছেন। ( হজ্জের মাসআলা )

লোক মারফত প্রেরণের পর যদি রওয়ানা হয় তাহলে উক্ত পশুর সংগে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত সে মুহরিম হবে না। কেননা রওয়ানা হওয়ার সময় তার সংগে যদি কোন হাদী না থাকে, যা সে হাকিয়ে নিয়ে যাবে, তাহলে তো তার পক্ষ হতে নিয়্যত ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেলো না। আর শুধু নিয়্যতে মুহরিম হয় না।

যদি পথিমধ্যে সে প্রেরিত পশু পেয়ে যায় এবং তা হাকিয়ে নিয়ে যায় কিংবা শুধু পেয়ে গেলো, তাহলে যেহেতু তার নিয়্যত এমন একটি আমলের সংগে যুক্ত হইয়াছে, যা ইহরামের বৈশিষ্ট্যভূক্ত, সেহেতু সে মুহরিম হয়ে যাবে। যেমন শুরু থেকে হাকিয়ে নিলে হয়।

ইমাম মুহাম্মাদ(রঃআঃ) বলেন, হজ্জে তামাত্তু-এর উটনী এর অতিক্রম। কেননা সে  ক্ষেত্রে রওয়ানা দেওয়া মাত্র সে মুহরিম হয়ে যাবে। অর্থাত যদি ইহরামের নিয়্যত করে থাক। এটা হলো সূক্ষ্ম কিয়াস। সাধারণ কিয়াস তাই, যা ইতোপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি।

সূক্ষ্ম কিয়াসের কারণ এই যে, তামাত্তু-এর হাদী শরীআতের পক্ষ থেকে নির্ধারিত রূপে শুরু থেকেই হজ্জের আমলসমূহের অন্তর্ভূক্ত একটি আমল রূপে নির্ধারিত। কেননা এটা মক্কার সাথে বিশিষ্ট। এবং (হজ্জ ও উমরা এই) দুই ইবাদত একত্রে আদায়ের শোকর হিসাবে তা ওয়াজিব হইয়াছে।

আর অন্যান্য হাদী তো (ক্ষেত্র বিশেষে) অপরাধ জনিত কারণেও ওয়াজিব হতে পারে। যদিও তা মক্কা পর্যন্ত না পৌছে। এ কারণেই তামাত্তু-এর হাদীর ক্ষেত্রে হাজীর রওয়ানা হওয়াকেই যথেষ্ট মনে করা হইয়াছে। পক্ষান্তরে অন্যান্য হাদীর  ক্ষেত্রে প্রকৃত আমলের উপর (অর্থাত্‌ যুক্ত হয়ে হাকিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপর) নির্ভরশীল থাকবে।

যদি উটনীকে চট পরিয়ে দেয় কিংবা কুজে আচড় কেটে দেয়া করে, কিংবা  বকরীর গলায় কালাদা ঝুলিয়ে দেয়, তাহলে মুহরিম হবে না। কেননা চট পরানো গরম বা শীত বা মাছি থেকে রক্ষার জন্যেও হতে পারে। সুতরাং তা হজ্জের বৈশিষ্ট্য হলো না। ( হজ্জের মাসআলা )

ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মতে করা মাকরূহ। সুতরাং তা হজ্জের আমলের মধ্যে গণ্য নয়।

সাহেবাইনের মতে যদিও তা উত্তম তবে তা কখনো চিকিত্সার জন্যও হয়ে থাকে। আর কালাদা ঝুলানোর বিষয়টি এর বিপরীত। কেননা তা হাদীর সাথেই বিশিষ্ট।

আর বকরীর গলায় কালাদা ঝুলানো প্রচলিত নয়। এবং তা সুন্নাতও নয়।

ইমাম মুহাম্মাদ(রঃআঃ) বলেন, (হজ্জ প্রসংগে যেখানে বুদন এর কথা এসেছে সেখানে) বুদন অর্থ উট এবং গরু।

ইমাম শাফিঈ(রঃআঃ) বলেন  শুধু উট। কেননা রসূলুল্লাহ্‌ (সাঃআঃ) জুমুআর নামাজ প্রসংগে বলেছেন- যে তাড়াতাড়ি হাযির হয়, সে যেন বাদানাহ (উটনী) কুরবানী করলো, আর যে তার পরে হাযির হলো, সে যেন গাভী কুরবানী করলো।

আমাদের দলিল এই যে, বদনা শব্দটি বাদানাহ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ স্থূলদেহী। আর এই অর্থের দিক থেকে উটনী ও গাভী দুটোই সমতুল্য। এজন্যই তো উভয়ের প্রতিটি সাতজনের জন্য যথেষ্ট হয়।

আর হাদীছের বিশুদ্ধ বর্ণনায় বকরী প্রেরণকারীর ন্যায় রহিয়াছে। সঠিক বিষয় আল্লাহ অধিক অবগত।


Posted

in

by

Comments

Leave a Reply