ইতিকাফের মাসআলা মাসায়েল – ফিকাহ শাস্ত্র

ইতিকাফের মাসআলা মাসায়েল – ফিকাহ শাস্ত্র

ইতিকাফের মাসআলা মাসায়েল – ফিকাহ শাস্ত্র >> আল হিদায়া ফিকহ এর মুল সুচিপত্র দেখুন

কিতাবঃ আল হিদায়া, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ – ইতিকাফ

ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) বলেন, ইতিকাফ হলো মুস্তাহাব। তবে শুদ্ধতম মত এই যে, তা সুন্নতে মুআক্কাদা। কেননা নাবী করীম (সাঃআঃ) এর শেষ দশদিন নিয়মিত ভাবে তা পালন করেছেন। আর নিয়মিত আমল সুন্নাত প্রমাণ করে।

ইতিকাফ অর্থ সায়েম অবস্থায় মসজিদে ইতিকাফের নিয়্যতসহ অবস্থান করা। অবস্থান করাতো ইতিকাফের রুকন। কেননা ইতিকাফ শব্দটি অবস্থানের অর্থ প্রদান করে। সুতরাং অবস্থান দ্বারাই ইতিকাফের অস্তিত্ব হবে। আমাদের নিকট সাওম হলো ইবাদতের শর্ত। তিনি বলেন, সাওম একটি ইবাদত এবং তা স্বতন্ত্র ও মৌলিক ইবাদত। সুতরাং তা অন্য ইবাদতের শর্ত হতে পারে না।

আমাদের দলিল হলো রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃআঃ) এর বাণী- ইতিকাফ হয় না সাওম ব্যতীত।

আর বর্ণীত হাদিসের মুকাবিলায় কিয়াস গ্রহণযোগ্য নয়। তবে সিয়াম ওয়াজিব ইতিকাফে শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত। এ সম্পর্কে একটি মাত্র বর্ণনাই রহিয়াছে(অর্থাত্‌ দ্বিমত নেই)।

ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) থেকে হাসান (ইব্‌ন যিয়াদ) যে মত বর্ণনা করেছেন তাতে নফল ইতিকাফ শুদ্ধ হওয়ার জন্যও সিয়াম শর্ত। আমাদের বর্ণীত হাদিসের প্রকাশ্য অর্থের প্রেক্ষিতে।

এই বর্ণনা মুতাবিক ইতিকাফ এক দিনের কমে হতে পারে না। কিন্তু মাবসূতের বর্ণনা মতে- আর তা ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর মত-নফল ইতিকাফের সর্ব নিম্ন পরিমাণ হলো এক মুহূর্ত। সুতরাং তা সিয়াম ছাড়া হতে পারে। কেননা, নফলের ভিত্তি হলো সহজতার উপর। তুমি কি জান না যে, দাড়ানোর ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নফল নামাজ বসে আদায় করা যায়। আর যদি নফল ইতিকাফ শুরু করার পর ভংগ করে ফেলে তাহলে মাবসূতের বর্ণনা মতে তা কাযা করা জরুরী নয়। কেননা, তার সময় নির্ধারিত ছিল না। সুতরাং তা ভংগ করার দ্বারা বাতিল করা নয়।

হাসান (রাঃআঃ) এর বর্ণনা মতে কাযা করা জাইয হবে। কেননা তা সিয়ামের মত একদিন এর সাথে সীমাবদ্ধ।

আর জামাআত হয় এমন মসজিদ ছাড়া ইতিকাফ সহী্‌হ্‌ নয়। কেননা হুযায়ফা (রাঃআঃ) বলেছেন- জামাআত অনুষ্ঠিত মসজিদ ছাড়া ইতিকাফ হতে পারে না। ( ইতিকাফের মাসআলা )

ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) হতে বর্ণীত একটি মতে পাচ ওয়াক্ত নামাজ হয়, এমন মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও ইতিকাফ সহীহ্‌ নয়। কেননা ইতিকাফ হলো নামাজের জন্য অপেক্ষা করার ইবাদত। সুতরাং তা এমন স্থানের সাথে সম্পৃক্ত হবে, যেখানে তা আদায় করা হয়।

অবশ্য স্ত্রী লোক তার ঘরের মসজিদে (অর্থাত্‌ নামাজ আদায়ের নির্ধারিত স্থানে) ইতিকাফ করবে। কেননা সেটাই হলো তার নামাজের স্থান। সুতরাং নামাজের জন্য তার অপেক্ষা সেখানেই বাস্তবায়িত হয়। যদি ঘরে পূর্ব থেকে তার জন্য নামাজের নির্ধারিত কোন  স্থান না থাকে তাহলে একটি স্থান নির্ধারণ করে নেবে এবং সেখানে ইতিকাফ করবে।

প্রাকৃতিক প্রয়োজনে এবাং জুমুআর উদ্দেশ্য ছাড়া মসজিদ থেকে বের হতে পারিবে না। প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বের হওয়ার বৈধতার প্রমাণ হলো ‘আইশা (রাঃআঃ) হতে বর্ণীত হাদিস যে, নাবী করীম (সাঃআঃ) প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া তার ইতিকাফের স্থান থেকে বের হতেন না। ( ইতিকাফের মাসআলা )

তাছাড়া এ প্রয়োজন দেখা দেওয়া অবশ্যম্ভাবী ও জানা বিষয়। আর তা সারার জন্য বের হওয়া অনিবার্য, সুতরাং এ প্রয়োজনে বের হওয়াটা ইতিকাফের আওতা বহির্ভূত। তবে তাহারাত থেকে ফারেগ হওয়ার পর বাইরে বিলম্ব করবে না। কেননা প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে যা কার্যকরী, তা প্রয়োজন পরিমাণেই সীমাবদ্ধ। আর জুমুআর বিষয় এ কারণে যে, তা তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ (দীনী) প্রয়োজন। এবং এ প্রয়োজন দেখা দেওয়া জানা কথা।

আর ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) বলেন, জুমুআর উদ্দেশ্যে বের হওয়া ইতিকাফকে ফাসিদ করে দিবে। কেননা জামে মসজিদে ইতিকাফ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো।

আর এর উত্তরে আমাদের বক্তব্য এই যে, সকল মসজিদেই ইতিকাফ করা শরীআত সম্মত। আর শুরু করা যখন শুদ্ধ হলো তখন প্রয়োজন বের হওয়ার বৈধতা অবশ্যই দান করবে।

সূর্য যখন ঢলে পড়বে তখনই বের হবে। কেননা (জুমুআর নামাজ আদায়ের জন্য) ঐ সময়ের পরই সম্বোধন তার অভিমুখী হয়। যদি তার ইতিকাফের স্থান জুমুআর মসজিদ থেকে দূরে হয়, তাহলে এমন সময়ে বের হবে যেন জুমুআর নামাজ পাওয়া সম্ভব হয়, এবং তার পূর্বে চার রাকাআত, আরেক বর্ণনা মতে ছয় রাকাআত-চার রাকাআত সুন্নাত এবং দুরাকাআত তাহিয়্যাতুল মাসজিদ আদায় করিতে পারে। আর সেখানে জুমুআর পরে জুমুআর সুন্নাত সম্পর্কিত মতভেদ অনুযায়ী চার বা ছয় রাকাআত আদায় করবে।

জুমুআর সুন্নাত হলো জুমুআর আনুষঙ্গিক। সুতরাং এ গুলোকে জুমুআর সংগেই যুক্ত করা হয়। যদি জামে মসজিদে এর চেয়ে বেশী সময় অবস্থান করে তাহলে তার ইতকাফ নষ্ট হবে না। কেননা, এটাও ইতিকাফের স্থান। তবে তা পসন্দনীয় নয়। কেননা সে এক মসজিদে ইতিকাফ আদায়ের বাধ্যবাধকতা গ্রহণ করেছে, সুতরাং বিনা প্রয়োজনে দুই মসজিদে তা আদায় করবে না।

যদি বিনা প্রয়োজনে কিছু সময়ের জন্যও মসজিদ থেকে বাইরে যায় তাহলে তার ইতিকাফ ফাসিদ হয়ে যাবে।

এটা ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মত। কেননা ইতিকাফের বৈপরিত্য পাওয়া গেছে। এটাই কিয়াসের দাবী।

সাহেবাইন বলেন, অর্ধেক দিনের বেশী না হলে ইতিকাফ ফাসিদ হবে না। এটাই সূক্ষ্ম কিয়াসের দাবী। কেননা সামান্য সময় প্রয়োজনের অন্তর্ভূক্ত।

ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) বলেন, পানাহার ও ঘুম ইতিকাফ স্থলেই হবে। কেননা, নাবী করিম(সাঃআঃ) এর মসজিদ ছাড়া এসবের জন্য আর কোন স্থান ছিলো না। তাছাড়া এই প্রয়োজনগুলো তো মসজিদে সমাধা করা সম্ভব। সুতরাং বের হওয়ার প্রয়োনজন নেই।

মসজিদে পন্য উপস্থিত না করে ক্রয়-বিক্রয় করাতে কোন দোষ নেই। কেননা এর প্রয়োজন হতে পারে। যেমন তার প্রয়োজন সম্পন্ন করে দেয়ার মতো কাউকে পায় না। তবে ফকীহ্‌গণ বলেছেন যে, ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য পণ্য উপস্থিত করা মাকরূহ। কেননা মসজিদ বান্দাহর হক থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে। আর পণ্য উপস্থিত করায় মসজিদকে তাতে লিপ্ত করা হয়।

মুতাকিফ ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে মসজিদে ক্রয়-বিক্রয় করা মাকরূহ। কেননা রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃআঃ) বলেছেন- তোমরা তোমাদের মসজিদগুলোকে তোমাদের বাচ্চাদের থেকে পৃথক রাখবে এবং তোমাদের ক্রয়-বিক্রয় থেকেও।

ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) বলেন, আর ইতিকাফকারী কল্যাণমূলক ছাড়া কোন কথা বলিবে না। তবে তার পক্ষে একেবারে চুপ থাকা মাকরূহ। কেননা আমাদের শরীআতে নীরবতার সিয়াম ইবাদতরূপে গণ্য নয়। কিন্তু যেসব কথায় গুনাহ্‌ হয়, তা পরিহার করে চলবে।

আর মুতাকিফের জন্য সহাবাস হারাম। কেননা আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেছেন-

তোমরা মসজিদে ইতিকাফ করা অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করবে না।

অনুরূপভাবে স্পর্শ ও চুম্বনও হারাম। কেননা, তা সহবাসের আবেদন সৃষ্টিকারী। সুতরাং তা হারাম হবে। কারণ সহবাস হলো ইতিকাফের নিষিদ্ধ কাজ- যেমন ইহরাম অবস্থায় (এগুলো হারাম)। সিয়াম বিষয়টি এর বিপরীত। কেননা বিরত থাকা সিয়ামের রুকন। সিয়ামের নিষিদ্ধ কাজ নয়। সুতরাং আবেদন সৃষ্টিকারী বিষয়গুলোর দিকে তা সম্প্রসারিত হবে না।

যদি রাত্রে কিংবা দিনে ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা ভুলে সহবাস করে তাহলে তার ইতিকাফ বাতিল হয়ে যাবে। কেননা (দিবসের ন্যায়) রাত্রও ইতিকাফের সময়। সিয়াম বিষয়টি এর বিপরীত। (অর্থাত্‌ ভুলের দ্বারা ফাসিদ হয় কিন্তু) ইতিকাফকারীর অবস্থা স্বয়ং স্মরণ করিয়ে দেয়। সুতরাং ভুলের কারণে তাকে মাযুর ধরা হবে না।

যদি ‘যোনিপথ ছাড়া অন্যভাবে সংগম করে আর বীর্যস্খলন ঘটে কিংবা যদি স্পর্শ বা চুম্বন করে, ফলে বীর্যস্খলন ঘটে তাহলে তার ইতিকাফ বাতিল হয়ে যাবে। কেননা এর মধ্যে সংগমের মর্ম বিদ্যমান। এ কারণেই তা দ্বারা রোজা ফাসিদ হয়ে যায়। যদি বীর্যস্খলন ন ঘটে তাহলে ইতিকাফ ফাসিদ হবে না, যদিও তা হারাম । কেননা, তাতে সংগমের মর্ম বিদ্যমান নেই। আর সেটাই হলো ফাসিদকারী। এ কারণেই তা দ্বারা সিয়াম ফাসিদ হয় না।

যে ব্যক্তি নিজের উপর কতক দিনের ইতিকাফ ওয়াজিব করলো, তার উপর সেই দিনগুলোর রাত্রিসহ ইতিকাফ ওয়াজিব হবে। কেননা বহুবচন রূপে দিনগুলো উল্লেখ করিলে তার পাশাপাশি রাত্রগুলোও এর অন্তর্ভূক্ত হয় ।যেমন বলা হয় তোমাকে কয়েক দিন থেকে দেখিনি। এখানে সে দিনগুলোর রাত্রও উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।

আর দিনগুলো অবিরাম হবে, যদি ও অবিরমভাবে শর্ত আরোপ না করা হয়। কেননা ইতিকাফের ভিত্তিই হলো অবিরমতার উপর। কারণ রাত্র দিন সমগ্র সময়টুকুই ইতিকাফ যোগ্য। রোজার বিষয়টি এর বিপরীত। কেননা রোজার ভিত্তি হলো বিচ্ছিন্নতার উপর। কারণ রাত্রগুলো রোজার উপযুক্ত নয়, সুতরাং যতক্ষণ না অবিরামতার কথা স্পষ্ট বলিবে, ততক্ষণ বিচ্ছিন্নভাবে সিয়াম ওয়াজিব হবে।

কিন্তু যদি শুধু দিবসগুলোর ইতিকাফের নিয়্যত করে থাকে তাহলে তার নিয়্যত সহীহ্‌ হবে। কেননা সে শব্দটির হাকীকত বা মৌল অর্থ উদ্দেশ্য করেছে।

যে ব্যক্তি দুদিনের ইতিকাফ নিজের উপর ওয়াজিব করলো, তার উপর ঐ দুদিনের রাত্রসহ ইতিকাফ ওয়াজিব হবে।

ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) বলেন, প্রথম রাত্রটি দাখিল হবে না। কেননা দ্বিবচন তো বহুবচন থেকে ভিন্ন। আর মধ্যবর্তী রাত্রটি সংযুক্তির প্রয়োজনে অন্তর্ভূক্ত হবে।

যাহিরী রিওয়ায়াতের দলিল এই যে, দ্বিবচনের মাঝে বহুবচনের অর্থ রহিয়াছে। সুতরাং ইবাদতের ক্ষেত্রে সতর্কতার জন্য দ্বিবচনকে বহুবচনের সংগে যুক্ত করা হবে। আল্লাহ্‌ই অধিক জানেন। সিয়াম ( ইতিকাফের মাসআলা )


Posted

in

by

Comments

Leave a Reply