ঈদের নামাজের মাসায়েল – সাত তাকবীর দেয়ার বিবরণ

ঈদের নামাজের মাসায়েল – সাত তাকবীর দেয়ার বিবরণ

ঈদের নামাজের মাসায়েল – সাত তাকবীর দেয়ার বিবরণ >> আল হিদায়া ফিকহ এর মুল সুচিপত্র দেখুন

কিতাবঃ আল হিদায়া, সপ্তদশ অনুচ্ছেদ : দুই ঈদের বিধান

পরিচ্ছেদঃ তাকবীরে তাশরীক

যাদের উপর জুমুআর নামাজ ওয়াজিব, তাহাদের সকলের উপর ঈদের নামাজ ওয়াজিব।
আল-জামেউস সাগীর কিতাবে বলা হইয়াছে, একই দিনে দুটি ঈদ একত্র হইয়াছে। প্রথমটি হল সুন্নাত আর দ্বিতীয়টি হল ফরয। তবে দুটির কোন একটিকেও তরক করা যাবে না।
গ্রন্থকার বলেন, এতে স্পষ্টভাবে সুন্নাত বলা হইয়াছে। পক্ষান্তরে প্রথমটি ওয়াজিব হওয়ার সুস্পষ্ট উক্তি। আর তা ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) হতে বর্ণীত রিওয়ায়াত।
প্রথমোক্ত বর্ণনার দলিল এই যে, রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃআঃ) নিয়মিত ভাবে তা পালন করেছেন।
দ্বিতীয় বর্ণনার দলিল রাসূলূল্লাহ্ (সাঃআঃ) এর উক্তি, যা এক গ্রাম্য সাহাবীর এ প্রশ্নে আমার উপর এ ছাড়াও কোন নামাজ ওয়াজিব আছে কি এর উত্তরে বলেন, না নেই, তবে যদি নফল আ্দায় কর (তবে তোমার ইচ্ছা)। প্রথমোক্ত বর্ণনাটি অধিক বিশুদ্ধ। আর তাকে সুন্নাত বলার কারণ এই যে, তা সুন্নাহ্ বা হাদিস দ্বারা ওয়াজিব সাব্যস্ত হইয়াছে।
আর মুস্তাহাব হল ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগায় যাওয়ার পূর্বে কিছু (মিষ্টি) খাবার গ্রহণ করা, গোসল করা, মিসওয়াক করা এবং খুশবু ব্যবহার করা। কেননা বর্ণীত আছে যে, নাবী (সাঃআঃ) ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগায় যাওয়ার পূর্বে আহার করিতেন এবং দুই ঈদেই গোসল করিতেন।
কেননা এ হল সমাবেশের দিন। সুতরাং তাতে গোসল করা্ ও খুশবু ব্যবহার করা সুন্নাত হবে। যেমন জুমুআর জন্য।
আর নিজের সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করবে। কেননা, নাবী (সাঃআঃ) এর একটি পুস্তিনের বা পশমের জুব্বা ছিল, যা তিনি ঈদে পরিধান করিতেন।
আর সাদকাতুল ফিতর আাদায় করবে। যাতে দরিদ্র ব্যক্তি সচ্ছলতা লাভ করিতে পারে এবং তার অন্তর নামাজের জন্য একাগ্র হতে পারে।
অতঃপর ঈদগাহ অভিমুখে গমন করবে। ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মতে ঈদগায় যাওয়ার পথে উচ্চৈস্বরে তাকবীর বলিবে না। আর সাহবাইনের মতে তাকবীর বলিবে। তাহারা ঈদুল আযহার উপর কিয়াস করেন।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর দলিল এই যে, সানা ও যিকির এর ব্যাপারে আসল হল গোপনীয়তা। কিন্তু ঈদুল আযহার ক্ষেত্রে শরীআত প্রকাশ্য যিকিরের আদেশ দিয়েছে। কেননা, তা তাকবীর দিবস। কিন্তু ঈদুল ফিতর সেরূপ নয়।
ঈদের নামাজের পূর্বে ঈদগায় নফল পড়বে না। কেননা নামাজের প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও নাবী (সাঃআঃ) তা করেননি। এরপর কেউ কেউ বলেন, এই মাকরূহ হওয়া ঈদগাহের জন্য নির্দিষ্ট।
আবার কেউ কেউ বলেন, সাধারণভাবে ঈদগাহ্ ও সব স্থানের জন্য ব্যাপক। কেননা নাবী (সাঃআঃ) তা করেননি। যখন সূর্য উপরে উঠে আসার মাধ্যমে নামাজ আদায় করা জা্ইয হয়ে যায়, তখন থেকে যাওয়াল পর্যন্ত ঈদের নামাজের সময় থাকে। যখন সূর্য ঢলে পড়ে তখন ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায়। কেননা নাবী (সাঃআঃ) সূর্য এক বা দুই বর্শা পরিমাণ উপরে উঠতে ঈদের নামাজ আদায় করিতেন। আর (একবার) যখন সাহাবায়ে কিরাম যাওয়ালের পর চাদ দেখার সাক্ষ্য দিলেন, তখন তিনি পরবর্তী দিন ঈদগায় যাওয়ার আদেশ করিলেন।

ইমাম লোকদের নিয়ে দুই রাকাআত নামাজ আদায় করবেন। প্রথম রাকাআতে এক তাকবীর বলিবেন তাহরীমার জন্য। তারপর তিনবার তাকবীর বলিবেন। এরপর ফাতিহা ও অন্য একটি সুরা পড়বেন এবং তাকবীর বলে রুকুতে যাবেন। এরপর দ্বিতীয় রাকাআতে কিরাত দিয়ে শুরু করবেন। তারপরে তিনবার তাকবীর বলিবেন এবং চতুর্থ তাকবীর বলে রুকুতে যাবেন।
এ হল ইব্‌ন মাসঊদ (রাঃআঃ) এর মত এবং তা আমাদের মাযহাব। ইব্‌ন ‘আব্বাস (রাঃআঃ) বলেন, প্রথম রাকাআতে তাহরীমা তাকবীর বলে তার পর পাচটি তাকবীর বলিবেন এবং দ্বিতীয় রাকাআতেও পাচবার তাকবীর বলার পর কিরাত পড়বে। অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, (দ্বিতীয় রাকাআতে) চারবার তাকবীর বলিবেন। বর্তমানে ইব্‌ন ‘আব্বাস (রাঃআঃ) এর বংশধর খলীফাদের শাসনের যুগ হওয়ার কারণে সাধারণ লোকের আমল তার মতের উপর প্রতিষ্ঠিত। তবে মাযহাব হল প্রথমোক্ত মত। কেননা, (অতিরিক্ত) তাকবীর এবং হাত উঠানো নামাজের নির্ধারিত প্রকৃতির বিপরীত। সুতরাং নিম্নতর সংখ্যাই গ্রহণ করা শ্রেয়।
আর (ঈদের) তাকবীরসমূহ হল দীনের প্রতীক। এ জন্য তা উচ্চৈস্বরে আদায় করা হয়। সুতরাং এর প্রকৃত চাহিদা হলো মিলিতভাবে পাঠ করা। প্রথম রাকাআতে এই তাকবীরগুলোকে তাকবীরে তাহরীমার সাথে যুক্ত করা ওয়াজিব। যেহেতু এ তাকবীর ফরয এবং প্র্রথমে হওয়ার প্রেক্ষিতে এটার শক্তি বেশী। আর দ্বিতীয় রাকাআতে রুকুর তাকবীর ছাড়া অন্য কোন তাকবীর নেই। সুতরাং (ঈদের তাকবীরগুলো) তার সাথে যুক্ত করাই ওয়াজিব।
ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) ইব্‌ন ‘আব্বাস (রাঃআঃ) এর মতামত গ্রহণ করেছেন। তবে তিনি বর্ণীত সব কটি তাকবীরকে অতিরিক্ত হিসাব গ্রহণ করেছেন। ফলে (তাকবীরে তাহরীমা ও রুকুর দুই তাকবীরসহ) মোট তাকবীর তার মতে পনেরটি কিংবা ষোলটি হবে।
ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) বলেন, দুই ঈদের তাকবীরগুলোতে উভয় হাত উপরে উঠাবে।
এটা দ্বারা ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) রুকুর তাকবীর ছাড়া অন্যান্য তাকবীর বুঝিয়েছেন। কেননা রাসূলূল্লাহ্ (সাঃআঃ) বলেছেন- সাতটি স্থান ছাড়া অন্য কোথাও হাত তোলা হবে না। তন্মেধ্যো ঈদের তাকবীরসমূহ উল্লেখ করা হইয়াছে। ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) হতে বর্ণীত যে, হাত তোলা হবে না।আমাদের বর্ণীত এ হাদিস এর বিপরীতে দলিল।
নামাজের পর (ইমাম) দুটি খুতবা দিবেন। এ সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণীত হইয়াছে।
তাতে লোকদের সাদকাতুল ফিত্‌র এর আহকাম শিক্ষা দিবস। কেননা এ খুতবা এ উদ্দেশ্যেই প্রবর্তিত হইয়াছে।
যে ব্যক্তির ইমামের সাথে সালাতুল ঈদ ফউত হয়ে গেছে, সে তা কাযা পড়বে না। কেননা এই প্রকৃতির নামাজ এমন কিছূ শর্তসাপেক্ষেই ইবাদত রূপে স্বীকৃত হইয়াছে, যা মুনফারিদ দ্বারা সম্পন্ন হতে পারে না।
যদি চাদ মেঘাবৃত হয়ে যায় আর লোকেরা শাওয়ালের পর শাসক (বা তার নিযুক্ত ব্যক্তির) নিকট চাদ দেখার সাক্ষ্য দেয়, তাহলে ইমাম আগামী দিন ঈদের নামাজ আদায় করবেন। কেননা এ বিলম্ব ওযরের কারণে। এ অনুযায়ী হাদিস বর্ণীত হইয়াছে। ( ঈদের নামাজের মাসায়েল )
যদি কোন ওযরবশত আগামী দিনও নামাজ আদায় সম্ভব না হয়, তাহলে এর পরে আর তা পড়বে না। কেননা জুমুআর ন্যায় এ ক্ষে্ত্রেও মূলনীতি হল কাযা না করা। তবে আমরা বর্ণীত হাদিসের কারণে তা বর্জন করেছি। আর হাদিসে ওযরবশত দ্বিতীয় দিন পর্যন্তই বিলম্বিত করার কথা বর্ণীত হইয়াছে। ঈদুল আযহার দিনও গোসল করা এবং খুশবু ব্যবহার করা মুসতাহাব। এর দলিল আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। আর নামাজ থেকে ফারেগ না হওয়া পর্যন্ত আহার বিলম্বিত করবে। কেননা হাদী্ছে আছে যে, নাবী (সাঃআঃ) কুরবানীর দিন (ঈদগাহ থেকে) ফিরে আসার আগে কিছু খেতেন না। এরপর আপন কুরবানীর গোশত থেকে খেতেন।
আর তাকবীর বলতে বলতে ঈদগাহে যাবে। কেননা নাবী করিম (সাঃআঃ) পথে তাকবীর বলতেন।
আর ঈদুল ফিতরের মত দুই রাকাআত নামাজ আদায় করবে। (সাহাবায়ে কিরাম থেকে) এরূপই বর্ণীত হইয়াছে।
অতঃপর ইমাম দুটি খুতবা দিবেন। কেননা নাবী করীম (সাঃআঃ) এরূপ করেছেন।
তাতে লোকদের কুরবানী (আহকাম) এবং তাকবীরে তাশরীক শিক্ষা দিবেন। কেননা এ হল সেই সময়ের আহকাম, আর তা শিক্ষা দানের জন্যই খুতবার বিধান প্রবর্তিত হইয়াছে।
যদি কোন ওযরবশতঃ ঈদুল আযহার দিন নামাজ আদায় করা সম্ভব না হয়, তবে পরের দিন এবং (সেদিন সম্ভব না হলে) তার পরের দিন নামাজ আদায় করবে। এরপরে তা আদায় করবে না। কেননা, এ নামাজ কুরবানীর সময়ের সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং কুরবানীর দিনগুলোর সাথে সীমিত থাকবে। তবে বিনা ওযরে বিলম্ব করিলে বর্ণীত আমলের বিরুদ্ধাচরণের কারণে গুনাহ্‌গার হবে।
আর আরাফা পালন নামে মানুষ যা পালন করে থাকে, তার কোন (শরীআতী) ভিত্তি নেই।
‘আরাফা পালন অর্থ আরাফা মাঠে অবস্থানকারীদের সাথে সাদৃশ্যের উদ্দেশ্যে আরাফা দিবসে (যিলহজ্জরে নয় তারিখে) কোন স্থানের মানুষের সমবেত হওয়া। কেননা একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করাই ইবাদত রূপে স্বীকৃত হইয়াছে। সুতরাং ঐ স্থান ছাড়া অন্যত্র তা ইবাদত (বলে গণ্য) হবে না। যেমন হজ্জের অন্যান্য আমল।

পরিচ্ছেদঃ তাকবীরে তাশরীক

আরাফা দিবসের ফজরের নামাজের পর থেকে তাকবীরে তাশরীক শুরু করবে এবং কুরবানী দিবসের আসরের নামাজের পর তা শেষ করবে।
এ হল ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মত। সাহেবাইন বলেন, আইয়ামে তাশরীকের শেষ দিন আসরের নামাজের পর তা শেষ করবে।
বিষয়টি সম্পর্কে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। তাই সাহেবাইন আলী (রাঃআঃ) এর মত গ্রহণ করেছেন, দিবসের সংখ্যাধিক্যের উপর প্রেক্ষিতে। কেননা, ইবাদতের ব্যাপারে এতেই সতর্কতা রহিয়াছে।
পক্ষান্তরে ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) নিম্নতর সংখ্যার উপর আমল করার উদ্দেশ্যে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃআঃ) এর মত গ্রহণ করেছেন। কেননা উচ্চৈস্বরে তাকবীর বলার মধ্যে নতুনত্ব রহিয়াছে (তাই নিশ্চিতের উপর আমল করা শ্রেয়ঃ)।
আর তাকবীর হল একবার বলবেঃ
কেননা ইবরাহীম খলীলুল্লাহ্‌ আলায়হিস সালাম থেকে এরূপই বর্ণীত রহিয়াছে।
আর এইটি ফরয নামাজসমূহের পর ওয়াজিব। ইমাম আবূ হানীফার মতে শহরে মুস্তাহাব জামাআতে নামাজ আদায়কারী মুকীমদের উপর। সুতরাং স্ত্রী লোকদের জামাআতের ক্ষেত্রে যেখানে কোন পুরুষ নেই, এবং মুসাফিরদের জামাআতের বেলায় যাদের সঙ্গে কোন মুকীম নেই, সেখানে তা ওয়াজিব হবে না।
সাহেবাইন বলেন, তা ওয়াজিব ফরয নামাজ আদায়কারী প্রত্যেকের উপর। কেননা এ তাকবীর ফরয নামাজের অনুগামী ।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর দলিল হল ইতোপূর্বে আমাদের বর্ণীত হাদিস।
তাশরীক অর্থ উচ্চৈস্বরে তাকবীর বলা। খলীল ইব্‌ন আহমদ থেকে এটি বর্ণীত। তাছাড়া উচ্চৈস্বরে তাকবীর বলা সুন্নতের খিলাফ। আর শরীআতে এর প্রমাণ পাওয়া যায় উপরোক্ত শর্তসমূহ একত্র হওয়ার বেলায়। অবশ্য স্ত্রী লোকেরা পুরুষের পিছনে ইকতিদা করিলে এবং মুসাফিরগণ মুকীমের পিছনে ইকতিদা করিলে অনুগামী হিসেবে তাহাদের উপরও (তাকবীরে তাশরীক) ওয়াজিব হবে।
ইমাম (আবূ ইউসুফ) ইয়াকূব (রঃআঃ) বলেন, আরাফা দিবসে মাগরিবের নামাজে আমি ইমামতি করলাম এবং তাকবীর বলতে ভুলে গেলাম। তখন ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) তাকবীর বলিলেন।
এতে প্রমাণিত হয় যে, ইমাম তাকবীর তরক করিলেও মুক্তাদী তা তরক করবে না। কেননা এটা নামাজের তাহরীমার মধ্যে আদায় করা হয় না। সুতরাং তাতে ইমাম অপরিহার্য নন। বর‌ং ইমামের অনুরণ মুস্তাহাব মাত্র। ( ঈদের নামাজের মাসায়েল )


Posted

in

by

Comments

Leave a Reply