মুসাফিরের নামাজের মাসয়ালা – ফিকাহ গ্রন্থ
মুসাফিরের নামাজের মাসয়ালা – ফিকাহ গ্রন্থ >> আল হিদায়া ফিকহ এর মুল সুচিপত্র দেখুন
কিতাবঃ আল হিদায়া, পণ্চদশ অনুচ্ছেদ : মুসাফিরের নামাজ
যে সফর দ্বারা শরীআতের আহকাম পরিবর্তিত হয়, তা হল তিন দিন তিন রাত্রি পরিমাণ দূরত্বে যাওয়ার ইচ্ছা করা উটের গতি বা হেটে চলার গতি হিসাবে। কেননা, রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন- মুকীম পূর্ণ একদিন একরাত্র মাস্হ করবে, আর মুসাফির করবে তিন দিন তিন রাত্র।
মাস্হ্র অবকাশ মুসাফির সম্প্রদায়কে সামগ্রিকভাবে শামিল করেছে। আর তার অনিবার্য প্রয়োজন হবে (সফরের) সময়সীমা সম্প্রসারণ। ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) তা নির্ধারণ করেছেন দুই দিন এবং তৃতীয় দিনের অধিকাংশ সময় পরিমাণ দ্বারা। আর ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) নির্ধারণ করেছেন একদিন একরাত্র পরিমাণ দ্বারা। আর উভয়ের বিপরীতে প্রমাণ হিসাবে আলোচ্য হাদিসই যথেষ্ট। ( মুসাফিরের নামাজের মাসয়ালা )
আর উল্লেখিত পথচলা দ্বারা মধ্যমগতির পথ চলা উদ্দেশ্য।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) হতে বর্ণীত আছে যে, তিনি মনজীল দ্বারা দূরত্ব নির্ধারণ করেছেন। আর এ মত হল প্রথমোক্ত দূরত্ব পরিমাণের নিকটবর্তী। ফরসখ মাইল দ্বারা দূরত্ব নির্ধারণ গ্রহণযোগ্য নয়। এ-ই বিশুদ্ধ মত।
আর নৌপথের চলার গতিকে পরিমাণ হিসাবে গ্রহণ করা হবে না। অর্থাত্ স্থল পথের জন্য নৌপথের যাত্রাকে পরিমাপ হিসাবে গণ্য করা হবে না। আর সমুদ্রে তার উপযোগী যাত্রা পরিমাপ বিবেচ্য, যেমন পার্বত্য পথের হুকুম।
ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) বলেন, চার রাকাআত বিশিষ্ট নামাজে মুসাফিরের জন্য ফরয হল দুই রাকাআত। এর অধিক আদায় করবে না।
ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) বলেন, মুসাফিরের (মূল) ফরয চার রাকাআত। তবে কসর করা্ হল রুখছত, সাওমের উপর কিয়াস করে।
আমাদের দলিল এই যে, দ্বিতীয়ার্থ দুই রাকাআত কাযা করিতে হয় না এবং তা তরক করার কারণে গুণাহ্ হয় না। আর এ হল নফল হওয়ার আলামত। পক্ষান্তরে সাওমের বিষয়টি এর বিপরীত। কেননা তা কাযা করিতে হয়।
আর যদি চার রাকাআত পড়ে নেয় এবং দ্বিতীয় রাকাআতে তাশাহ্হুদ পরিমাণ বৈঠক করে, তাহলে প্রথম দুই রাকাআত ফরয হিসাবে আদায় হয়ে যাবে এবং শেষ দুই রাকাআত নফল হবে।
ফজরের নামাজের উপর কিয়াস করে। অবশ্য সালাম বিলম্ব করার কারণে গুণাহ্গার হবে।
আর যদি দ্বিতীয় রাকাআতে তাশাহ্হুদ পরিমাণ বৈঠক না করে তাহলে নামাজ বাতিল হয়ে যাবে। কেননা, ফরযের রুকনসমূহ পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই নফল তার সাথে মিলে গেছে। ( মুসাফিরের নামাজের মাসয়ালা )
মুসাফির যখন বস্তির আবাদী ত্যাগ করবে তখন থেকেই দুরাকাআত আদায় করবে। কেননা, বস্তিতে প্রবেশের সাথে মুকীম হওয়া সম্পৃক্ত। সুতরাং সফরের সম্পর্ক হবে বস্তি থেকে বের হওয়ার সাথে। এ সম্পর্কে আলী (রাঃআঃ) থেকে নিম্নোক্ত বানী বর্ণীত আছে। যদি আমরা বস্তির গৃহসমূহ অতিক্রম করি তখনই অবশ্য নামাজ কসর করব।
সফরের হুকুম অব্যাহত থাকবে যতক্ষণ না কোন শহরে বা বস্তিতে পনের দিন বা তার বেশী থাকার নিয়্যত করে। যদি এর কম সময় থাকার নিয়্যত করে তাহলে কসর করবে। কারণ সফরের একটি মিয়াদ নির্ধারণ করা জরুরী। কেননা সফরে স্বভাবতঃ বিরতি ঘটে থাকে। তাই আমরা সফরের মিয়াদ নির্ধারণ করেছি (দুই হায়যের মধ্যবর্তী) তুহরের মিয়াদ দ্বারা। কেননা উভয় মিয়াদই কিছু আহকাম আরোপ করে।
আর এটি ইব্ন ‘আব্বাস ও ইব্ন উমর (রাঃআঃ) হতে বর্ণীত হইয়াছে। আর এ ধরণের ক্ষেত্রে সাহাবীর বাণী হাদিসের মত।
শহর বা বস্তির শর্ত এ দিকে ইংগিত করে যে, মাঠে প্রান্তরে ইকামতের নিয়্যত করা সহীহ্ নয়। এ-ই জাহির রিওয়ায়াত।
যদি এমন সুদৃঢ় ইচ্ছা নিয়ে কোন শহরে প্রবেশ করে যে, আগামীকাল অথবা পরশু এখান থেকে বের হয়ে যাবে এবং সে মুকীম হওয়ার নির্ধারিত মেয়াদের নিয়্যত করল না; এমন কি এভাবে সে কয়েক বছর অবস্থান করল, তাহলে সে কসর করিতে থাকবে। কেননা, ইব্ন ‘উমর (রাঃআঃ) আজারবাইজান শহরে ছয়মাস অবস্থান করেছেন এবং তিনি এ সময় কসর করিতে থাকেন। আরও বহু সাহাবায়ে কিরাম থেকেও অনুরূপ বর্ণীত আছে।
সৈন্যবাহিনী যখন শত্রু এলাকায় প্রবেশ করে এবং ইকামতের নিয়্যত করে তখন তাহারা কসরই পড়বে। তদ্রুপ যদি শত্রু দেশের কোন শহর বা দুর্গ অবরোধ করে। কেননা শত্রুভূমিতে প্রবেশকারীর অবস্থা দোদুল্যমান; হয়ত পরাজিত হয়ে স্থান ত্যাগ করবে, নয়ত (শত্রুভূমিকে) পরাস্ত করে তথায় স্থায়ী হবে। সুতরাং তা ইকামাতের স্থান হতে পারে না।
অনুরূপভাবে (কসর আদায় করবে) যদি (মুসলিম) বাহিনী দারুল ইসলামের বিদ্রোহীদের শহর বহির্ভূত কোন এলাকায় অবরোধ করে কিংবা সমুদ্রে তাহাদের অবরোধ করে। কেননা তাহাদের অবস্থা তাহাদের নিয়্যতের দৃঢ়তা বাতিল করে।
যুফার (রঃআঃ) এর মতে উভয় অবস্থায় (ইকামাতের নিয়্যত) গ্রহণযোগ্য হবে, যদি মুসলিম বাহিনীর শক্তিতে প্রাধান্য থাকে। কেননা, সে অবস্থায় বাহ্যতঃ তাহারা অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম।
ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) এর মতে যদি তাহারা বস্তি এলাকায় থাকে তবে (নিয়্যত) গ্রহণযোগ্য হবে; কেননা বস্তি এলাকা ইকামত করার স্থান।
আর তাঁবুবাসীদের সম্পর্কে ইকামতের নিয়্যত কারো কারো মতে দুরস্ত নয়। তবে বিশুদ্ধ মত এই যে, তাহারা মুকীম বিবেচিত হবে। ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) থেকে তাই বর্ণীত রহিয়াছে। কেননা ইকামত হলো (মানুষের জীবনের) আসল অবস্থা। সুতরাং এক চারণভূমিতে যাওয়ার কারণে তা বাতিল হবে না্।
আর যদি মুসাফির যদি ওয়াক্তিয়া নামাজের ক্ষেত্রে মুকীমের পিছনে ইক্তিদা করে তাহলে চার রাকাআত পুরা করবে। কেননা তখন অনুসরণের বাধ্যবাধকতায় তার ফরয চার রাকাআতে পরিবর্তিত হয়ে যাবে। যেমন তার নিজের ইকামতের নিয়্যত দ্বারা পরিবর্তিত হয়ে যায়। কারণ, পরিবর্তনকারী বিষয় (অর্থাত্ ইকতিদা) ‘সবব এর সাথে (অর্থাত্ ওয়াক্তের সাথে) যুক্ত হইয়াছে।
যদি মুকীম ইমামের সঙ্গে কাযা নামাজে শামিল হয়, তবে তা জাইয হবে না। কেননা, ফরয পরিবর্তিত হয় না ওয়াকতের পর সবব বিলুপ্ত হওয়ার কারণে; যেমন ইকামতের নিয়্যত দ্বারা পরিবর্তিথ হয় না। এমতাবস্থায় এটা বৈঠক ও কিরাতের ক্ষেত্রে নফল আদায়কারীর পিছনে ফরয আদায়কারীর ইকতিদার মত হয়ে যাবে, যা দুরস্ত নয়।
মুসাফির যদি দুই রাকাআতে মুকীমদের ইমামতি করে তবে সে (দুই রাকাআত শেষে) সালাম ফিরাবে আর মুকীমগণ তাহাদের নামাজ পূর্ণ করে নিবে। কেননা, মুকতাদীরা দুই রাকাআতের ক্ষেত্রে (মুসাফির ইমামের) অনুসরণে বাধ্যবাধকতা গ্রহণ করেছে। সুতরাং অবশিষ্ট নামাজের ক্ষেত্রে তাহারা মাসবূকের মত একাকী হয়ে পড়বে। তবে বিশুদ্ধ মতে সে কিরাত পড়বে না। কেননা তাহারা তাহরীমার বেলায় মুকতাদী, অন্যান্য কাজের বেলায় নয়। আর ফরয (কিরাত) আদায় হয়ে গেছে। সুতরাং সতর্কতা হিসাবে কিরাত তরক করবে। মাসবূকের বিষয়টি এর বিপরীত। কেননা, সে নফল কিরাত পেয়েছে। সুতরাং (কিরাতের) ফরয বিরতি আদায় হয়নি। সুতরাং (তার ক্ষেত্রে) কিরাত পড়াই উত্তম।
সালাম ফিরানোর পর (মুসাফির) ইমামের পক্ষে একথা বলে দেওয়া মুসতাহাব যে, তোমরা তোমাদের নামাজ পূর্ণ করে নাও। আমরা মুসাফির কাফেলা। কেননা, মুসাফির অবস্থায় মক্কাবাসীদের ইমামতি করার সময় রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) এরূপ বলেছিলেন।
মুসাফির যখন আপন শহরে প্রবেশ করবে তখন নামাজ পূর্ণ করবে। যদিও সেখানে সে ইকামতের নিয়্যথ না করে। কেননা, রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) ও সাহাবায়ে কিরাম সফর করিতেন। অতঃপর ইকামাতের নতুন নিয়্যত ব্যতীত ওয়াতানের দিকে ফিরে এসে মুকীম হিসাবে অবস্থান করিতেন।
যদিও কারও নিজস্ব আবাসভূমি থাকে অতঃপর সেখান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে অন্য স্থানকে আবাসভূমি রূপে গ্রহণ করে, তবে অতঃপর সফর করে প্রথম আবাসভূমিতে প্রবেশ করে, তবে সে কসর পড়বে। কেননা প্রথমটি তার আবাসভূমি থাকে না। একথা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, হিজরতের পর রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) নিজেকে মক্কায় মুসাফির গণ্য করেছিলেন।
এর কারণ এই যে, নীতি হল, স্থায়ী আবাসভূমি অনুরূপ আবাসভূমি দ্বারা বাতিল হয়ে যায়, সফর দ্বারা হয় না। পক্ষান্তরে অস্থায়ী অবস্থান স্থল দ্বারা, সফর দ্বারা এবং স্থায়ী আবাসভূমি দ্বারা বাতিল হয়ে যায়।
মুসাফির যদি মক্কায় ও মীনায় পনের দিন থাকার নিয়্যত করে তবে সে কসর পড়বে। কেননা দুই স্থানে ইকামতের নিয়্যত যদি এ তেবার করা হয়, তাহলে বিভিন্ন জায়গার ইকামতের নিয়্যতকেও মিলিতভাবে গ্রহণ করিতে হবে। আর তা নিষিদ্ধ। কেননা, সফর তো বিভিন্ন স্থানে অবস্থান থেকে মুক্ত নয়। তবে যদি উভয়ের মধ্যে একটিতে রাত্রিযাপন করার নিয়্যত করে থাক তবে সে সে স্থানে প্রবেশ করার সাথে সাথে মুকীম হয়ে যাবে। কেননা, লোকের ইকামতের বিষয়টি তার রাত্রি যাপনের স্থানের সাথে সম্পৃক্ত।
খলীফা কিংবা হিজাযের আমীরের সাথে বিষয়টিকে শর্তযুক্ত করার কারণ এই যে, ক্ষমতা তাহাদেরই রহিয়াছে। হজ্জ মওসুমের আমীর তো শুধু হজ্জ সংশ্লিষ্ট বিষয়ই তদারক করে থাকেন।
শাসক কিংবা শাসক নির্ধারিত লোক ছাড়া অন্য কারো জন্য জুমুআ জামাআত কায়েম করা জাইয নয়। কেননা জুমুআ বিশাল সমাবেশে অনুষ্ঠিত হয়। আর সেখানে ইমাম হওয়া কিংবা অন্যকে ইমাম করা এছাড়া অন্যান্য কারণে কোন কোন সময় ঝগড়ার সৃষ্টি হয়। সুতরাং জুমুআর নামাজ সূষ্ঠভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্য তা জরুরী। ( মুসাফিরের নামাজের মাসয়ালা )
জুমুআর আরেকটি শর্ত হল সময়। সুতরা্ং তা যুহরের সময় সহীহ্ হবে, তার পরে দুরস্ত নয়। কেননা, রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন- সূর্য হেলে পড়ে তখন তুমি লোকদের নিয়ে জুমু্আর নামাজ আদায় কর।
যদি জুমুআর নামাজে থাকা অবস্থায় ওয়াক্ত চলে যায় তবে পুনরায় যুহর শুরু করবে।
জুমুআর উপর যুহরের বিনা করবে না। কেননা উভয়টি ভিন্ন নামাজ।
জুমুআর নামাজের জন্য আরেকটি শর্ত হলো খুতবা। কেননা নাবী (সাঃআঃ) জীবনে কখনো খুতবা ছাড়া জুমুআর নামাজ আদায় করেননি।
আর এই খুতবা হবে সূর্য হেলে যাওয়ার পরে নামাজের পূর্বে। হাদিসে এরূপই বর্ণীত হইয়াছে।
ইমাম দুটি খুতবা দিবেন এবং উভয় খুতবার মাঝে একটি বৈঠকে ব্যবধান করবেন। এর উপরই আমল চলে এসেছে।
তাহরাত অবস্থায় দাড়িয়ে খূতবা দিবেন। কেননা দাড়িয়ে খুতবা একটি সর্বকালীন আমল। অতঃপর যেহেতু খুতবা হলো নামাজের শর্ত। এত তাহারাত মুসতাহাব, যেমন আযানের ধ্বনি।
যদি বসে কিংবা তাহারাত ছাড়া খুতবা পাঠ করে তবে তা জা্ইয হবে। কেননা খুতবার উদ্দেশ্য তার দ্বারা হাসিল হয়ে যায়।
তবে তা মাকরূহ হবে।
সর্বকালীন আমলের বিরুদ্ধাচারণ এবং নামাজ ও খুতবার মাঝে ব্যবধান সৃষ্টির কারণে।
যদি শূধু আল্লাহ্র যিকিরের উপর শেষ করে দেয়, ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মতে তা জা্ইয আর সাহেবাইনদের মতে এই পরিমাণ দীর্ঘ যিকির আবশ্যক, যাকে খুতবা বলা যায়। কেননা, খুতবা হল ওয়াজিব। শূধূ তাসবীহ এবং শুধু হামদ্কে খুতবা বলা হয় না।
ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) প্রচলিত রীতির উপর ভিত্তি করে বলেন, দুটি খুতবা পাঠ ছাড়া জা্ইয হবে না।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর দলিল আল্লাহ তা’আলার বাণী- তোমরা আল্লাহ্র যিকিরের দিকে ধাবিত হও। এতে কোন বিশ্লষণ করা হয়নি। উছমান (রাঃআঃ) সম্পর্কে বর্ণীত আছে যে, তিনি শূধু আল্হামদুলিল্লাহ্ বলার পর তার কথা থেমে গেলে তখন তিনি (মিম্বর থেকে) নেমে গেলেন এবং নামাজ আদায় করিলেন।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মতে জামাআতে সর্ব নিম্ন সংখ্যা হল ইমাম ছাড়া তিনজন। সাহেবাইনের মতে ইমাম ছাড়া দুইজন হতে হবে।
গ্রন্থকার বলেন, বিশুদ্ধতম কথা এই যে, এটি ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) এর একার মত। তার দলিল এই যে, দুইয়ের মাঝে সমাবেশের অর্থ রহিয়াছে।
তরফাইনের দলিল এই যে, প্রকৃতপক্ষে এটি হল তিন। কেননা, এটিই নাম ও অর্থ উভয় দিক থেকেই জামাআ জামাআত আলাদা শর্ত। তদ্রুপ ইমামও শর্ত। সুতরাং ইমাম জামাআতের মধ্যে গণ্য হবে না।
ইমাম রুকু ও সাজদা করার পূর্বেই যদি লোকেরা চলে যায়, শূধূ নারী ও শিশূরা থেকে যায়, তবে ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মতে ইমাম পুনরায় যুহর শূরু করবেন। সাহেবাইন বলেন, ইমাম নামাজ শূরু করার পর তাহারা যদি তাকে ছেড়ে চলে যায় তবু তাহারা চলে যায় তবে (সকলের মতে) তিনি জুমুআই অব্যাহত রাখবেন।
এতে ইমাম যুফার (রঃআঃ) এর ভিন্নমত রহিয়াছে। তিনি বলেন, যেহেতু এটা শর্ত সেহেতু এর স্থায়িত্ব আবশ্যক। যেমন ওয়াক্তের বিষয়টি।
সাহেবাইনের দলিল এই যে, জামাআত হল জুমুআ অনুষ্ঠিত হওয়ার শর্ত। সুতরাং তার স্থায়িত্ব শর্ত হবে না। যেমন খূতবার বিষয়টি।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর দলিল এই যে, জুমুআ অনুষ্ঠিত হওয়া সাব্যস্ত হবে নামাজ শূরু হওয়ার মাধ্যমে। আর এক রাকাআত পূর্ণ হওয়া ছাড়া নামাজের শূরু পূর্ণতা লাভ করে না। কেননা, এক রাকাআতের কম পরিমাণ নামাজ নয়। সুতরাং এক রাকাআত পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত জামাআতের স্থায়িত্ব জরুরী। খূতবার বিষয়টি ভিন্ন। কেননা তা নামাজের সাথে সামঞ্জস্যহীন। সুতরাং তার স্থায়িত্ব শর্ত হতে পারে না। নারী তেমনি ছেলেদের থেকে যাওয়া ধর্তব্য নয়। কেননা তাহাদের দ্বারা জুমুআ অনুষ্ঠিত হয় না। সুতরাং তাহাদের দ্বারা জামাআতের পূর্ণতা সাধিত হবে না।
মুসাফির, নারী, রোগী, দাস ও অন্ধের উপর জুমুআ ওয়াজিব নয়। কেননা, জুমুআর উপস্থিতিতে মুসাফিরের অসুবিধা হবে। রোগী ও অন্ধ সম্পর্কেও একই কথা। তদ্রুপ দাস তার মনিবের
খিদমতে এবং স্ত্রী তার স্বামীর খিদমতে ব্যস্ত থাকে। তাই ক্ষতি ও অসুবিধার জন্য তাহাদের ‘মাযূর গণ্য করা হইয়াছে।
তবে যদি তাহারা উপস্থিত হয়ে লোকদের সাথে জুমুআর নামাজ আদায় করে তাহলে ওয়াক্তিয়া ফরযের পরিবর্তে তা যথেষ্ট হবে। কেননা, তাহারা নিজেই তা বরদাশত করেছে। সুতরাং তাহারা ঐ মুসাফিরের মত হয়ে যাবে, যে সফরে সিয়াম পালন করল।
মুসাফির, দাস ও অসুস্থ ব্যক্তির পক্ষে জুমুআর ইমামতি করা জাইয আছে।
যুফার (রঃআঃ) বলেন, তা জাইয নেই। কেননা তাহাদের উপর (জুমুআর) ফরযিয়াত নেই। সুতরাং তাহারা বালক ও স্ত্রী লোকের সদৃশ হলো।
আমাদের দলিল এই যে, এ হল তাহাদের জন্য অবকাশ (প্রদত্ত সুবিধা)। সুতরাং যখন তাহারা উপস্থিত হয়ে থাকে তখন ফরয হিসাবেই আদায় হবে। যেমন, (ইতোপূর্বে) আমরা বর্ণনা করে এসেছি।
পক্ষান্তরে বালকের তো যোগ্যতাই নেই। আর স্ত্রী লোক, পুরুষদের ইমাম হওয়ার যোগ্য নয়।
মুসাফির, দাস ও অসুস্থদের দ্বারা জুমুআ অনুষ্ঠিত হবে। কেননা তাহারা যখন জুমুআর ইমামতিরই যোগ্য, তখন তাহাদের মধ্যে মুকতাদি হওয়ার যোগ্যতা আরও অধিক রহিয়াছে।
জুমুআর দিন যে ব্যক্তি ইমামের জুমুআ আদায়ের আগে আপন গৃহে যুহরের নামাজ আদায় করে ফেলল, অথচ তার কোন ওযর নেই, তার জন্য তা মাকরূহ হবে। তবে তার নামাজ আদায় হয়ে যাবে।
যুফার (রঃআঃ) বলেন, তার এই নামাজ আদায়ই হবে না। কেননা, চ মতে জুমুআ মূল ফরয আর যুহর হল তার বিকল্প। আর মূলের উপর সামর্থ্য থাকা অবস্থায় বিকল্পের অভিমুখী হওয়ার অবকাশ নেই।
আমাদের দলিল এই যে, সকলের ক্ষেত্রেই মূল ফরয হল যুহর এই যাহিরে মাযহাবে অভিমত। তবে জুমুআ আদায়ের মাধ্যমে ঐ ফরয নিরসন করার জন্য সে আদিষ্ট।
এ মত এ কারণে যে, সে নিজেই যুহর আদায় করিতে সক্ষম রহিয়াছে, জুমুআ আদায় করিতে সক্ষম নয়। কেননা, তা এমন কতিপয় শর্তের উপর নির্ভরশীল, যা তার একার মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়। আর নিজ সামর্থ্যের উপরই শরীআতের দায়িত্ব নির্ভরশীল।
এরপর যদি তার জুমুআর জামাআতে হাযির হওয়ার ইচ্ছা হয় এবং জুমুআর জামাআতে অভিমুখী হয় আর ইমাম জুমুআর নামাজরত থাকেন তবে ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মতে গমনের দ্বারাই তার যুহর বাতিল হয়ে যাবে।
আর সাহেবাইনের মতে ইমামের সাথে নামাজে দাখিল হওয়া পর্যন্ত যুহর বাতিল হবে না। কেননা সাঈ যুহরের চেয়ে নিম্নমানের। সুতরাং যুহর সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর সাঈ তা বাতিল করবে না। আর জুমুআ হল যুহরের চেয়ে উচু পর্যায়ের। সুতরাং তা যুহরকে বাতিল করে দেবে।
আর এটা জুমুআ থেকে ইমামের ফারেগ হওয়ার পর জুমুআ অভিমুখী হওয়ার মত হল।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর দলিল এই যে, জুমুআ অভিমুখে সাঈ করা জুমুআর বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং সতর্কতার খাতিরে যুহর বাতিল হওয়ার ক্ষেত্রে এটাকে জুমুআর স্থলবর্তী করা হবে। জুমুআ থেকে (ইমামের) ফারেগ হয়ে যাওয়ার পরবর্তী বিষয়টি এর বিপরীত। কেননা, প্রকৃতপক্ষে সেটা জুমুআ অভিমুখে সাঈ নয়। ( মুসাফিরের নামাজের মাসয়ালা )
জুমুআর দিন শহরে জামাআতের সাথে যুহর আদায় করা মাযূর লোকদের জন্য মাকরূহ। জেলখানায় কয়েদীরও এ হুকুম। কেননা, তাতে জুমুআর ব্যাপারে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হয়। কারণ জুমুআ হল সমস্ত জামাআতকে একত্রকারী। আর মাযূরদের সাথে কোন কোন সময় অন্যেরাও ইকতিদা করে ফেলে। গ্রামবাসীদের বিষয়টি ভিন্ন। কেননা তাহাদের উপর তো জুমুআ নেই।
তবে একদল লোক যদি যুহর জামাআতে পড়েই ফেলে তাহলে তাহাদের জন্য তা যথেষ্ট হবে। কেননা, যুহর জাইয হওয়ার যাবতীয় শর্ত পাওয়া গেছে।
যে ব্যক্তি জুমুআর দিন ইমামকে নামাজের মধ্যে পাবে সে ইমামের সাথে ঐ পরিমাণ নামাজ পড়বে, যা সে পেয়েছে, অতঃপর তার উপর জুমুআ ‘বিনা করবে। কেননা, রাসূ্লুল্লাহ্ (সাঃআঃ) বলেছেন- যে পরিমাণ নামাজ তোমরা পেয়েছ, তা পড়ে নাও, আর যে পরিমাণ ফউত হইয়াছে, তা কাযা করে নাও।
যদি ইমামকে তাশাহ্হুদের মাঝে কিংবা সাজদায়ে সাহ্ও এর মাঝে পায়। তবে শায়খাইনের মতে সে এর উপর জুমুআর বিনা করবে।
মুহাম্মাদ (রঃআঃ) বলেন, যদি ইমামের সাথে দ্বিতীয় রাকাআতের অধিকাংশ পায়, তবে তার উপর জুমুআার বিনা করবে। পক্ষান্তরে যদি দ্বিতীয় রাকাআতের কম অংশ পায় তবে তার উপর যুহর এর বিনা করবে। কেননা, একদিক থেকে তা জুমু্আ আবার অন্যদিকে তার থেকে কতিপয় শর্ত ফউত হওয়ার কারণে তা যুহর। সুতরাং যুহর বিবেচনায় সে চার রাকাআত পড়বে। এবং জুমুআর বিবেচনায় দুই রাকাআতের মাথায় অবশ্যই বসবে। আবার নফল হওয়ার সম্ভাবনার কারণে শেষ দুই রাকাআতে কিরাতও পড়বে।
শায়খাইনের দলিল এই যে, এই অবস্থাতেও সে জুমুআর নামাজ তো পেয়েছে। এ কারণেই জুমুআর নিয়্যত করা শর্ত। আর জুমুআর তো দুই রাকাআত। ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর পক্ষ থেকে যা উল্লেখ করা হইয়াছে, তার কোন কারণ নেই। কেননা উভয় নামাজ ভিন্ন। সুতরাং একটির তাহরীমার উপর অন্যটির বিনা্ করা যাবে না।
জুমুআর দিন ইমাম যখন (খুতবা দানের উদ্দেশ্যে) বের হন তখন লোকেরা খুতবা থেকে তার ফারেগ হওয়া পর্যন্ত নামাজ আদায় ও কথা বলা বন্ধ রাখবে। ( মুসাফিরের নামাজের মাসয়ালা )
গ্রন্থকার বলেন, এটা ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মত। সাহেবাইন বলেন, ইমামের বাহির হওয়ার পর খুতবা শূরু করার পূর্ব পর্যন্ত এবং মিম্বর থেকে নামার পর তাকবীর বলার পূর্ব পর্যন্ত কথা বলাতে কোন অসুবিধা নেই। কেননা, মাকরূহ হওয়ার কারণ হল মনোযোগের সাথে শ্রবণের ফরযে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়া। অথচ এ্ই সময়ে শ্রবণের কিছু নোই। নামাজের বিষয়টি এর বিপরীত। কেননা নামাজ তো দীর্ঘায়িত হয়।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর দলিল হল, রাসূলুল্লহ্ (সাঃআঃ) বলেছেন- ইমাম যখন বের হন (খুতবার উদ্দেশ্যে) তখন নামাজ নেই, কথাও নেই। এতে কোন পার্থক্য করা হয়নি। তাছাড়া কথাবার্তা স্বভাবতঃ কখনো দীর্ঘায়িত হয়। তাই তা নামাজের সদৃশ।
মুআযযিনগণ যখন প্রথম আযান দিবেন, তখন লোকদের কর্তব্য হল বেচা কেনা ছেড়ে দেওয়া এবং জুমুআ অভিমুখী হওয়া। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেছেন- তোমরা আল্লাহ্র যিকির অভিমুখে ধাবিত হও এবং বেচা-কেনা ছেড়ে দাও।
ইমাম যখন মিম্বরে আরোহণ করেন, তখন তিনি বসবেন এবং মুআযযিনগণ মিম্বরের সামনে দাড়িয়ে আযান দিবেন। এর পর যুগ পরম্পরায় আমল চলে এসেছে।
রাসূলূল্লাহ্ (সাঃআঃ) এর যামানায় এই আযানই শুধু প্রচলিত ছিল। একারণেই কেউ কেউ বলেন, সাঈ ওয়াজিব হওয়া এবং বেচা-কেনা হারাম হওয়ার ক্ষেত্রে এই আযানই ধর্তব্য। তবে বিশূদ্ধতম মত এই যে, প্রথম আযান ধর্তব্য, যদি সূর্য ঢলে পড়ার পরে হয়। কেননা, তা দ্বারাই জুমুআর অবহিতি অর্জিত হয়। ( মুসাফিরের নামাজের মাসয়ালা )
Leave a Reply