নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম মাসআলা সমূহ

নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম মাসআলা সমূহ

নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম মাসআলা সমূহ >> আল হিদায়া ফিকহ এর মুল সুচিপত্র দেখুন

কিতাবঃ আল হিদায়া, চতুর্থ অনুচ্ছেদ : নামাজের ধারাবাহিক বিবরণ

পরিচ্ছেদ-কিরাত

নামাজের ফরয ছয়টি
(প্রথমতঃ) তাহরীমা। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেছেন- (তুমি তোমার প্রতিপালকের নামে তাকবীর বলো) আর (মুফাসসিরদের সর্বসম্মতিক্রমে) আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকবীরে তাহরীমা।
(দ্বিতীয়তঃ) কিয়াম। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেছেন- তোমরা একাগ্র চিত্তে আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হও)
(তৃতীয়তঃ) কিরাআত। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেছেন- কুরআনের যে অংশ সহজে সম্ভব হয় তোমরা পড়ো, রকু ও সাজদা করা, কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেছেন- তোমরা রুকু করো এবং সাজদা করো।

নামাজের পরে তাশাহুদ পরিমাণ বৈঠক। কেননা রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) ইবন মাসউদ (রাঃআঃ) কে তাশাহুদ শিক্ষাদান কালে বলেছেন- তুমি যখন এ বললে বা এ করিলে তখন তোমার নামাজ সমাপ্ত হল।
এখানে নামাজের সম্পূর্ণতারেক তিনি বসার কাজের সাথে যুক্ত করেছেন (তাশাহহুদ) পাঠ করুক বা না করুক।
ইমাম কুদূরী বলেন, এছাড়া আর যা কিছু, তা সুন্নাত। ( নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম মাসআলা )

ইমাম কুদূরী এখানে সুন্নাত শব্দটি ব্যবহার করেছেন।অথচ তাতে বিভিন্ন ওয়াজিব বিষয় রহিয়াছে। যেমন, ফাতিহা পাঠ, তার সাথে সুরা যোগ করা, যে কাজ শরীআত কর্তৃক একাধিকবার নির্ধারিত হইয়াছে, সেগুলোর মাঝে তারতীব রক্ষা করা। প্রথম বৈঠক, শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পাঠ, নামাজের কুনূত, দুই ঈদের তাকবীরসমূহ এবং যে সকল নামাজে উচ্চস্বরে কিরাত পাঠ করা সে সকল নামাজে উচ্চস্বরে কিরাত পাঠ এবং যে সকল নামাজে অনুচ্চস্বরে কিরাত পাঠ করা হয়, সে সকল নামাজে অনুচ্চস্বরে কিরাত পাঠ। এজন্যই এগুলোর কোন একটি তরক করিলে তার উপর দুটি সাজদাসহ ওয়াজিব হয়। এ-বিশুদ্ধ মত। কুদূরীতে একগুলোকে সুন্নাত বলার কারণ এই যে, এগুলোর ওয়াজিবত্ব সুন্নাহ্ দ্বারা নামাজ হইয়াছে।

যখন নামাজ শুরু করবে তখন তাকবীর বলিবে। ইতোপুর্বে আমাদের পঠিত আয়াতের কারণে। তাছাড়া রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন- তাকবীর হলো নামাজের তাহরীম। আমাদের মতে তাকবীরে তাহরীমা হলো নামাজের শর্ত। ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) ভিন্নমত পোষণ করেন (তাঁর মতে এটা রুকন)। (আমাদের মতে শর্ত হওয়ার কারণেই) যে ফরযের তাহরীমা বাঁধবে, সে ঐ তাহরীমা দ্বারা নফল নামাজ আদায় করিতে পারিবে।
তিনি বলেন, অন্যান্য রুকনের জন্য যে সব শর্ত রহিয়াছে, তাহারীমার জন্যও সেসব শর্ত রহিয়াছে। আর এটি রুকন হওয়ার আলামত।

আমাদের যুক্তি এই- সে তার প্রতিপালকের নামে নিলো অতঃপর নামাজ আদায় করল)।
এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা তাকবীরের উপর নামাজকে করেছেন। আর এর দাবী হলো উভয়ের বৈপরীত্য। আর একারণেই অন্যান্য রুকনের পুনঃ পৌনিকতার মতো এইটা পুনঃ পৌনিক হয় না।
(রুকনসমূহের) যাবতীয় শর্ত এখানে বিবেচনা করার কারণ এই যে, কিয়াম রুকনটি তার সংলগ্ন।
তাকবীরের সাথে উভয় হাত উত্তোলন করবে। এটি সুন্নাত। কেননা রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) এটা নিয়মিত করেছেন। এই শব্দটি এদিকে ইংগিত করে যে, তাকবীর ও হস্তদ্বয়ের উত্তোলন একত্রে হওয়া শর্ত। ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) থেকে এ মতামত বর্ণীত হইয়াছে এবং ইমাম তাহাবী (রাঃআঃ) এ আমল করেছেন বলে বর্ণীত হইয়াছে।

তবে বিশুদ্ধতম মত এই যে, প্রথমে উভয় হাত উঠাবে। তারপর তাকবীর বলিবে। কেননা তার একাজ গায়রুল্লাহ্ থেকে বড়ত্বের অস্বীকৃতি জ্ঞাপক। আর অস্বীকৃতি স্বীকৃতির উপর অগ্রবর্তী হয়ে থাকে।
উভয় হাত এতটা উপরে উঠাবে, যাতে বৃদ্ধাংগুলি দুটো উভয় কানের লতিকার বরাবর হয়।
ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) এর মতে হাত উভয় কাঁধ পর্যন্ত উঠাবে। কুনূতের তাকবীর, ঈদের তাকবীর ও জানাযার তাকবীর সম্পর্কেও একই মতপার্থক্য। ( নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম মাসআলা )

ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) এর দলিল হলো আবূ হুমায়াদ সাঈদী (রাঃআঃ) বর্ণীত হাদিস। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) যখন তাকবীর বলতেন, তখন উভয় হাত কাধ পর্যন্ত তুলতেন।
আমাদের দলিল হলো, ওয়াইল ইবন হাজার, বারা ও আনাস (রাঃআঃ) বর্ণীত হাদিস। তাহারা বলেন, নাবী (সাঃআঃ) যখন তাকবীর বলতেন, তখন উভয় হাত তাঁর কান পর্যন্ত উঠাতেন।

তাছাড়া হাত উঠানোর উপকারিতা হলো বধিরদেরকে অবহিত করণ। আর তা ঐ ভাবেই সম্ভব, যেভাবে আমরা বলেছি।
আর ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) বর্ণীত হাদিসকে অপারগতার অবস্থার উপর আরোপ করা হবে। স্ত্রীলোক তার উভয় হাত কাধ পর্যন্ত উঠাবে। এ-ই বিশুদ্ধ মত। কেননা এটা তার সতর রক্ষার জন্য অধিক উপযোগী।
যদি তাকবীরের পরিবর্তে আল্লাহু আকবার কিংবা আল্লাহর অন্যান্য নাম (ও গুণ) উচ্চারণ করে তাহলে ইমাম আবূ হানীফা ও মুহাম্মাদ (রঃআঃ)এর মতে তা যথেষ্ট হবে। আর ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) বলেন, যদি সে তাকবীরের শুদ্ধ উচ্চারণে সক্ষম হয়, তাহলে আল্লাহু আকবার ছাড়া অন্য কিছু জাইয হবে না।

ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) বলেন, প্রথম দুটি ছাড়া অন্য কিছু জাইয হবে না।
আর ইমাম মালিক (রঃআঃ) বলেন, প্রথমটি ছাড়া অন্য কিছু জা্ইয হবে না। কেননা (নাবী সা. এর আমল রূপে) এটিই বর্ণীত হইয়াছে। আর এক্ষেত্রে শুধু বর্ণীত হাদিস থেকে জ্ঞান লাভ করাই আসল।
ইমাম শাফি(রঃআঃ) (নীতিগতভাবে ইমাম মালিকের যুক্তি স্বীকার করে) বলেন, লাম্ আলিফ যুক্ত করা প্রশংসার ক্ষেত্রে অধিক অর্থবহ। সুতরাং এটি তার স্থলবর্তী।

ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) বলেন, আল্লাহর গুণাবলীর ক্ষেত্রে উভয় ‘মাপের শব্দ সমার্থক। তবে তাকবীরের শুদ্ধ উচ্চারণে অক্ষমতার বিষয়টি ব্যতিক্রম। কেননা তখন তো সে মর্ম প্রকাশেই শুধু সক্ষম।
ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর যুক্তি এই যে, তাকবীরের আভিধানিক অর্থ হলো মর্যাদা প্রকাশ। আর তা প্রকাশিত হইয়াছে।
যদি ফার্সীতে নামাজ শুরু করে। কিংবা ফারসী ভাষায় নামাজের কিরাত পাঠ করে কিংবা যবাহ্ করার সময় ফারসী ভাষায় বিসমিল্লাহ্ পড়ে অথচ সে শুদ্ধ আরবী বলতে পারে তাহলে ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ)এর মতে তা যথেষ্ট হবে। আর ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) বলেন, পশু যবাহ্ ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট হবে না। তবে যদি শুদ্ধ আরবী বলতে অক্ষম হয়, তাহলে যথেষ্ট হবে।

নামাজের উদ্বোধন (তথা তাকবীর) প্রসংগে আরবী ভাষায় হলে ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর সংগে একমত। পক্ষান্তরে ফারসী ভাষার হলে ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) এর সংগে একমত। কেননা আরবী ভাষার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্য ভাষার নেই।
আর কিরাত সম্পর্কে ইমাম আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর বক্তব্যের দলিল এই যে, কুরআন আরবী শব্দসমষ্টির নাম, যেমন কুরআনের আয়াতে তা বলা হইয়াছে। তবে আপারগতার সময় শুধু ভাব ও মর্মকেই যথেষ্ট মনে করা হবে। যেমন (রুকু সাজদা আদায়ে অপারগতার সময়) ইশারাকে যথেষ্ট মনে করা হয়। (তবে যবাহের সময়) বিসমিল্লাহির বিষয়টি ব্যতিক্রম। কেননা আল্লাহর যিকির যে কোন ভাষায় হতে পারে।

ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) দলিল হলো আল্লাহ তা’আলার নিম্নোক্ত বাণী- নিঃসন্দেহে এ কুরআন পূর্ববর্তীদের কিতাবসমূহে বিদ্যমান ছিলো আর সেখানে তা এ ভাষায় অবশ্যই ছিল না। একারণেই অপারগতার সময় অন্য ভাষায় জাইয রহিয়াছে। ক্রমাগত অনুসৃত নিয়মের বিরুদ্ধাচরণের কারণে সে গুনাহগার হবে। এটাই বিশুদ্ধ মত। কেননা ভাষার ভিন্নতার কারণে মর্ম ভিন্ন হয় না। ( নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম মাসআলা )

আর মতপার্থক্যটি হলো গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে। নামাজ ফাসিদ না হওয়ার ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। বর্ণীত আছে যে, মূল মাসআলায় ইমাম সাহেব উক্ত ইমামদ্বয়ের বক্তব্যের প্রতি প্রত্যাবর্তন করেছেন। আর তা-ই নির্ভরযোগ্য। খুতবা ও তাশাহহুদ সম্পর্কেও অনুরূপ মতপার্থক্য রহিয়াছে। আর আযানের ব্যাপারে স্থানীয় প্রচলন বিবেচ্য হবে।
যদি বলে নামাজ আরম্ভ করে, তাহলে তা জাইয হবে না। কেননা এতে তার স্বার্থের ‘মিশ্রণ রহিয়াছে। সুতরাং তা খালিস তাযীম থাকেনি। আর যদি শুধু বলে আরম্ভ করে তাহলে কারো কারো মতে জাইয হবে। কেননা এর অর্থ হলো তবে অন্য এক মতে তা জাইয হবে না। কেননা এর অর্থ হলো- হে আল্লাহ আমাদের কল্যাণ করুন) সুতরাং এটা প্রার্থনা হলো।
ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) বলেন, সে তার নাভির নীচে বাম হাতের উপর ডান হাত স্থাপন করবে। কেননা রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন- নাভির নীচে বাম হাতের উপর ডান হাত স্থাপন সুন্নাতের অন্তর্ভূক্ত।

এ হাদিস হাত ছেড়ে রাখার ব্যাপারে ইমাম মালিক (রঃআঃ) এর বিপক্ষে দলিল।
তাছাড়া হাত নাভির নীচে রাখা ‘তাযীম প্রকাশের অধিকতর নিকটবর্তী এবং তা-ই হলো উদ্দেশ্য।
আর ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) ও ইমাম আবূ ইউসূফের মতে ‘হাত বাঁধা হচ্ছে কিয়ামের সুন্নাত। সুতরাং ছানা পড়ার সময় তা ছেড়ে রাখবে না। মূল নীতি এই যে, যে কিয়ামের মধ্যে কোন যিকির সুন্নাত রহিয়াছে, তাতে হাত বেঁধে রাখা হবে, অন্যথায় নয়। এ-ই বিশুদ্ধ মত। সুতরাং কুনূতের অবস্থায় এবং জানাযার নামাজে হাত বেঁধে রাখবে, পক্ষান্তরে রুকুর পর দাঁড়ানো অবস্থায় এবং ঈদের তাকবীরসমূহের মধ্যবর্তী সময়ে হাত ছেড়ে রাখবে।

ইমাম আবূ ইউসুফ হতে বর্ণীত আছে যে, এর সাথে ইন্নি ওয়াযযাহাতু ওয়াযহিয়াহ্ থেকে শেষ পর্যন্ত দুআটি যোগ করবে। কেননা, হযরত ‘আলী (রাঃআঃ) হতে বর্ণীত আছে যে, নাবী (সাঃআঃ) তা বলতেন।
ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর দলিল হলো, আনাস (রাঃআঃ) হতে বর্ণীত আছে যে, নাবী করিম (সাঃআঃ) যখন নামাজ আরম্ভ করিতেন, তখন তাকবীর বলতেন এবং সুবাহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়াবিহামদিকা থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তেন। এর অতিরিক্ত কিছু পাঠ করিতেন না। ইমাম আবূ ইউসুফ বর্ণীত হাদিসটি তাহাজ্জুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
মশহুর হাদিসগুলোতে বাক্যটি নেই। সুতরাং ফরয নামাজে তা বলিবে না। তাকবীরের পূর্বে ইন্নি ওয়াযযাহাতু ওয়াযহিয়া বলিবে না, যাতে নিয়্যত তাকবীরের সাথে যুক্ত থাকে। এ-ই বিশুদ্ধ মত।

আর বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেছেন- যখন তুমি কুরআন পড়বে তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো।
এর অর্থ হলো, যখন কুরআন পাঠের ইচ্ছা করবে। বলাই হলো উত্তম, যাতে কুরআনের শব্দের সাথে মিল হয়। আউওযুবিল্লাহ্ শব্দটিও এর কাছাকাছি।

যা হোক, ইমাম আবূ হানীফা ও মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর মতে- তাজ্ হচ্ছে কিরাতের সাথে সংযুক্ত, ছানার সাথে নয়। আমাদের পেশকৃত আয়াত এর দলিল। তাই মসবূক বলিবে, কিন্তু মুক্তাদি বলিবে না। এবং ঈদের নামাজের তাকবীরসমূহের পরে বলিবে। আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) ভিন্নমত পোষণ করেন এবং বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়বে। মশহুর হাদিসগুলোতে এরূপই বর্ণীত হইয়াছে।

(আউযুবিল্লাহ্ ও বিসমিল্লাহ্) দুটোই অনুচ্চস্বরে পড়বে। কেননা ইবন মাসউদ (রাঃআঃ) বলেছেন- চারটি বাক্য ইমাম নীরবে পড়বে। তন্মেধ্যে তিনি আউযুবিল্লাহ্ বিসমিল্লাহ ও আমীন উল্লেখ করেছেন।
ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) বলেন, উচ্চৈস্বরে পড়ার সময় বিসমিল্লাহও উচ্চস্বরে পড়বে। কেননা বর্ণীত আছে যে, নাবী (সাঃআঃ) তার নামাজে বিসমিল্লাহ উচ্চৈস্বরে পড়েছেন।

এর জবাবে আমরা বলি যে, তা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ছিলো। কেননা, আনাস (রাঃআঃ) অবহিত করেছেন যে, নাবী (সাঃআঃ) বিসমিল্লাহ্ উচ্চৈস্বরে পড়তেন না।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) থেকে একটি বর্ণনা এরূপ আছে যে, তাজ এর ন্যায় বিসমিল্লাহ প্রত্যেক রাকাআতের শুরুতে বলিবে না (বরং শুধু নামাজের শুরুতে বলিবে)। তবে তার থেকে আরেকটি বর্ণনা আছে যে, সতর্কতামূলক প্রত্যেক রাকাআতে বিসমিল্লাহ্ পড়বে। ইমাম আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর মতও তাই।
সুরা ও ফাতিহার মাঝে বিসমিল্লাহ্ পাঠ করবে না। ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর মতে নীরব কিরাত বিশিষ্ট নামাজে তা পড়বে।

তারপর সুরাতুল ফাতিহা পড়বে এবং অন্য একটি সুরা কিংবা যে কোন সুরা থেকে ইচ্ছা তিনটি আয়াত।
মোটকথা, আমাদের মতে ফাতিহা পাঠ রুকন হিসাবে নির্ধারিত নয়। তদ্রূপ তার সাথে সুরা মিলানোও। ফাতিহা সম্পর্কে ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) ভিন্নমত পোষণ করেছেন। এবং উভয়টি সম্পর্কে ইমাম মালিক (রঃআঃ) এর ভিন্ন মত রহিয়াছে।
ইমাম মালিক (রঃআঃ) এর দলিল হলো রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) এর বাণী- ফাতিহা এবং তার সাথে সংযুক্ত একটি সুরা ছাড়া নামাজ হয় না।

ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) এর দলিল হলো রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) এর বাণী- সুরাতুল ফাতিহা ছাড়া নামাজ হয় না।
আমাদের দলিল হলো আল্লাহ তা’আলার বাণী – কুরআনের যে অংশ সহজে সম্ভব হয়, তোমরা পড়ো। আর ‘ খাবরুল ওয়াহিদ হাদিস দ্বারা কিতাবুল্লাহর সাথে অতিরিক্ত বিষয় যোগ করা বৈধ নয়। তবে তার উপর আমল ওয়াজিব। তাই আমরা সুরাতুল ফাতিহা ও অন্য সুরা মিলানোকে ওয়াজিব বলি।

ইমাম যখন ওয়ালাদদওয়াল্লিন বলিবে তখন আমিন বলিবে। এবং মুক্তাদিও তা বলিবে। কেননা রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) হাদিসের শেষে বলেছেন- কেননা ইমাম তা বলেন।
ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) বলেন, মুক্তাদিয়া তা অনুচ্চৈস্বরে বলিবে। কেননা আমাদের পূর্ব বর্ণীত আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদের হাদিসে এরূপ আছে।

তাছাড়া এটা দুআ বিশেষ। সুতরাং গোপন করার উপরই তার ভিত্তি হবে।
শব্দটিতে দীর্ঘ আলিফ ও হ্রস্ব আলিফ দুটো উচ্চারণই রহিয়াছে। শব্দে (মীমের) উপর তাশদীদ প্রয়োগ মারাত্মক ভুল।
ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) বলেন, তারপর তাকবীর বলিবে ও রকু করবে।
গ্রন্থে রহিয়াছে, নত হওয়ার সংগে তাকবীর বলিবে। কেননা রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) নামাযে প্রত্যেক উঠা-নামার সময় তাকবীর বলতেন।

তাকবীরকে খাটোভাবে উচ্চারণ করবে। কেননা তাকবীরের প্রথমাংশে লম্বা করা দীনের দৃষ্টিতে ভুল। কেননা তা প্রশ্নবোধক হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে শেষাংশে লম্বা করা ভাষাগত দিক থেকে ভুল।
উভয় হাত দুই হাটুতে স্থাপন করবে এবং আংগুলগুলোর মাঝে ফাঁক রাখবে। কেননা রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) আনাস (রাঃআঃ) কে বলেছেন- যখন তুমি রুকু করবে তখন তোমার দুহাত হাটুতে রাখবে। এবং তোমার আংগুলগুলোর মাঝে ফাক করবে।

এ অবস্থা ছাড়া অন্য কখনো আংগুল ফাক রাখা মুস্তাহাব নয়, যেন শক্ত করে ধরা হয়। তদ্রূপ সাজদার অবস্থা ছাড়া অন্য কখনো আংগুলগুলো মিলিয়ে রাখা মুস্তাহাব নয়। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দিবে।
আর পিঠকে সমতল ভাবে রাখবে। কেননা নাবী (সাঃআঃ) যখন রুকু করিতেন তখন তার পিঠ সমতলভাবে রাখতেন। এবং নিজ মাথা উপরের দিকে উঠাবে না এবং ঝুকাবেও না। কেননা নাবী (সাঃআঃ) যখন রুকু করিতেন তখন তিনি মাথা উপরের দিকে উঠাতেন না এবং ঝুকিয়েও রাখতেন না। ( নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম মাসআলা )

আর তিনবার সুবাহানা রাব্বিয়াল আযিম বলিবে। আর এটা হলো তাসবীহের সর্বনিম্ন পরিমাণ। কেননা রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন- তোমাদের কেউ যখন রুকু করে তখন সে যেন তার রুকুতে তিনবার সুবাহানা রাব্বিয়াল আযিম বলে। আর এটা হলো তার সর্বনিম্ন পরিমাণ।
অর্থাত্ বহুবচন পূর্ণ করার সর্বনিম্ন পরিমাণ।

তারপর মাথা তুলবে এবং সামিআল্লাহ হুলিমান হামীদা বলিবে আর মুক্তাদি রাব্বানা লাকাল হামদ বলিবে। আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মতে ইমাম তা বলিবেন। ইমাম আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (রঃআঃ) বলেন, ইমাম তা মনে মনে বলিবেন। কেননা আবূ হুরায়রা (রাঃআঃ) বর্ণনা করেছেন যে, নাবী (সাঃআঃ) উভয় যিকিরকেও একত্র করিতেন।
তাছাড়া ইমাম অন্যকে (তা বলতে ) উদ্বুদ্ধ করছেন। সুতরাং তিনি নিজেকে তা বলতে পারেন না।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর দলিল হলো রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) এর বাণী-

ইমাম যখন বলেন সামিআল্লাহ……… বলেন তখন তোমরা রাব্বানা…….. বলো। এ হলো বন্টন, যা শরীকির পরিপন্থী। এজন্যই তো আমাদের মতে মুক্তদি সামিআল্লাহ……. বলিবে না। অবশ্য ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) ভিন্নমত পোষণ করেন।
তাছাড়া ইমামের তাহমীদ মুক্তাদির তাহমীদের পরে হয়ে যাবে, যা ইমামত পদবীর পরিপন্থী।

আর আবূ হুরায়রা (রাঃআঃ) বর্ণীত হাদিস মুনাফারিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিশুদ্ধ মতে মুনাফারিদ উভয়টিকে একত্র করবে। যদিও শুধু সামিআল্লাহ……বলা এবং অপর রিওয়ায়াতে রাব্বানা………. বলার কথাও বর্ণীত হইয়াছে।
আর ইমাম মুক্তাদিকে তাহমীরের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে তা পালন করেছেন।
ইমাম কুদূরী বলেন- অতঃপর যখন সোজা হয়ে দাঁড়াবে তখন তাকবীর বলিবে এবং সাজদায় যাবে।

তাকবীর ও সাজদার কারণ তা যা আমরা বর্ণনা করে এসেছি। তবে সোজা হয়ে দাড়ানো অবশ্য ফরয নয়। তদ্রূপ দুই সাজদার মাঝে বসা এবং রুকু ও সাজদায় সুস্থির হওয়াও ফরয নয়। এটি ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর মত।

ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) বলেন, এগুলো সবই ফরয। ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) এরও এইমত। কেননা দ্রুততার সাথে নামাজ আদায়কারী জনৈক বেদুঈন সাহাবীকে রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন- দাড়াও এবং পুনঃ নামাজ আদায় কর। কেননা তুমি নামাজ আদায় করনি। ইমাম আবূ হানীফা ও মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর দলিল এই যে, এর আভিধানিক অর্থ মাথা ঝুকানো এবং এর আভিধানিক অর্থ মাথা পূর্ণ অবনত করা। সুতরাং রুকু ও সাজদার সর্বনিম্ন পরিমাণের সাথে রুকুনের সম্পর্ক হবে। তদ্রূপ (রুকু থেকে সাজদায় বা সাজদা থেকে সাজদায়) গমনের ক্ষেত্রেও সর্বনিম্ন পরিমাণ বিবেচ্য হবে। কেননা তা উদ্দেশ্য নয়।

আর বর্ণীত হাদিসের শেষাংশে বেদুঈন সাহাবীর আমলকে নামাজ আখ্যায়িত করা হইয়াছে। কেননা রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন তা থেকে যে পরিমাণ তুমি কম করিলে, মূলতঃ তুমি তোমার নামাজ থেকে সেই পরিমাণ ক্ষতি করিলে।
ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর মতে, তারপর ‘কাওমাহ ও জালছা সুন্নাত। তদ্রূপ ইমাম (আবূ আবদুল্লাহ্) জুরজানী (রঃআঃ) এর তাখরীজ (মাসআলা বিশ্লেষণ) মুতাবিক সুস্থিরতা অবলম্বন করাও সুন্নাত। আর ইমাম কারখী (রঃআঃ) এর তাখরীজ মুতাবিক তা ওয়াজিব। সুতরাং তার মতে সুস্থিরতা বর্জন করিলে সাজদা সাহু ওয়াজিব হবে। আর উভয় হাত মাটিতে রাখবে। কেননা ওয়াইল ইবন হুজুর (রাঃআঃ) রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) এর নামাজের স্বরূপ দেখাতে গিয়ে সাজদা করেছেন এবং উভয় হাতের তালুর উপর ভর দিয়েছেন এবং নিতম্ব উচু করে রেখেছেন।

আর মুখমণ্ডল দুই হাতের তালুর মধ্যবর্তী স্থানে করবে। এবং উভয় হাত উভয় কান বরাবর রাখবে। কেননা, বর্ণীত আছে যে, নাবী (সাঃআঃ) এরূপ করেছেন।
ইমাম কুদূরী বলেন- আর নিজের নাক ও কপালের উপর সাজদা করবে। কেননা নাবী (সাঃআঃ) নিয়মিত এরূপ করেছেন।

তবে যদি দুটির একটির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে তাহলে তা ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মতে জাইয। ইমাম মুহাম্মাদ ও ইমাম আবূ ইউসুফ বলেন, ওযর ছাড়া শুধু নাকের উপর সীমাবদ্ধ করা জাইয হবে না।
আর এটা হচ্ছে ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) থেকে প্রাপ্ত আরেক রিওয়ায়াত। কেননা রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন- আমাকে ‘সপ্ত প্রত্যঙ্গের উপর সাজদা করার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। তন্মধ্যে কপালকেও তিনি গণ্য করেছেন।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর দলিল এই যে, ভূমিতে মুখমণ্ডলের অংশ বিশেষ স্থাপন দ্বারাই সাজদা সম্পন্ন হয়। আর তাই আদিষ্ট বিষয়। তবে সর্বসম্মতিক্রমে গণ্ডদেশ ও চিবুক এর থেকে বহির্ভূত।

আর আলোচ্য হাদিসের প্রসিদ্ধ বর্ণনায় মুখমণ্ডল শব্দটি রহিয়াছে।
উভয় হাত এরং উভয় হাটু মাটিতে স্থাপন করা আমাদের নিকট সুন্নাত। কেননা এ দুটো ছাড়াও সাজদা সম্পন্ন হয়।
আর দুই পা মাটিতে রাখা সম্পর্কে ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) বলেছেন যে, সাজদায় তা ফরয।
আর যদি পাগড়ীর ‘প্যাঁচ এর উপর বা বাড়তি কাপড়ের উপর সাজদা করে তবে তা জাইয হবে। কেননা নাবী (সাঃআঃ) তার পাগড়ীর প্যাচের উপর সাজদা করিতেন। আরো বর্ণীত আছে যে, নাবী (সাঃআঃ) এক কাপড়ে নামাজ আদায় করেছেন এবং বাড়তি অংশ দ্বারা ভুমির গরম ও ঠাণ্ডা থেকে নিজেকে রক্ষা করেন।

এবং নিজের উভয় বাহু খোলা রাখবে। কেননা নাবী (সাঃআঃ) বলেছেন- তুমি তোমার উভয় বাহু খোলা রাখবে। কোন কোন বর্ণনায় যার অর্থ প্রসারিত করা। আর প্রথমটি থেকে নিষ্পন্ন, যার অর্থ প্রকাশ করা।
এবং তার পেট উভয় উরূ থেকে পৃথক রাখবে। কেননা নাবী (সাঃআঃ) সাজদা করার সময় এতটা পৃথক রাখতেন যে, বকরীর ছোট বাচ্চা ইচ্ছা করিলে তার নীচে দিয়ে অতিক্রম করিতে পারতো। বলা হইয়াছে যে, কাতারে নামাজ আদায়ের সময় বাহু বেশী পৃথক করবে না, যাতে পার্শ্ববর্তী মুসল্লী কষ্ট না পায়।

আর পায়ের আাংগুলগুলো কিবলামুখী করে রাখবে। কেননা রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন- মুমিন যখন সাজদা করে তখন তার প্রতিটি অংগ সাজদা করে। সুতরাং সে যেন তার অংগগুলোর যতদূর সম্ভব কিবলামুখী করে রাখে।
আর সাজদার মধ্যে তিনবার সুবাহা্নাকা রাব্বিয়াল আলা বলিবে। আর তা হল তার সর্বনিম্ন পরিমাণ। কেননা রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন- আর তোমাদের কেউ যখন সাজদা করে তখন সে যেন তার সাজদার তিনবার সুবাহানাকা রাব্বিয়াল আলা বলে। আর এটি হল তার সর্বনিম্ন পরিমাণ।

অর্থাত্ পূর্ণ বহুবচনের সর্বনিম্ন পরিমাণ। রুকু ও সাজদার ক্ষেত্রে বেজোড় সংখ্যায় শেষ করা সহ তিনবারের অধিক বলা মুসতাহাব। কেননা রাসূলূল্লাহ্ (সাঃআঃ) বেজোড় সংখ্যায় শেষ করিতেন।
আর যদি কেউ ইমাম হয় তাহলে সংখ্যা এত বৃদ্ধি করবে না যা মুসল্লিগণের ক্লান্তির কারণ হয় এবং অবশেষে (জামাআতের প্রতি) তা বিরক্তি সৃষ্টি করে।

রুকু ও সাজদায় তাসবীহ পাঠ সুন্নাত। কেননা আয়াতে উভয়টি তাসবীহ ব্যতিরেকেই উল্লেখ করা হইয়াছে। সুতরাং আয়াতের উপর বৃদ্ধি করা যাবে না।
আর স্ত্রীলোক নীচু হয়ে সাজদা করবে এবং তার পেট উরুদ্বয়ের সাথে মিলিয়ে রাখবে। কেননা এটি তার জন্য সতরের অধিক উপযোগী।

ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) বলেন, অতঃপর সে তার মাথা উঠাবে এবং তাকবীর বলিবে। এর দলিল ইতোপূর্বে আমাদের বর্ণীত হাদিস যখন সুস্থির হয়ে বসবে তখন তাকবীর বলিবে ও সাজদায় যাবে। কেননা বেদুঈন (কে নামায শিক্ষাদান) সম্পর্কিত হাদিসে রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন- তারপর তুমি তোমার মাথা তুলবে এমনকি সোজা হয়ে বসবে।
যদি সোজা হয়ে না বসে তাকবীর বলে আর এক সাজদায় চলে যায়, তাহলে ইমাম আবূ হানীফা ও মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর মতে তার জন্য তা যথেষ্ট হবে। পূর্বেই আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। ( নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম মাসআলা )

মাথা তোলার পরিমাণ সম্পর্কে মাশায়েখগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে বিশুদ্ধতম মত এই যে, যদি সে সাজদার অধিক নিকটবর্তী থেকে যায়, তাহলে জাইয হবে না। কেননা, তাকে (পূর্ববর্তী) সাজদায় রয়ে গেছে বলে গণ্য করা হবে। তাতে দ্বিতীয় সাজদা হয়ে যাবে।

ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) বলেন, যখন সাজদায় গিয়ে সুস্থির হবে এরপর তাকবীর বলিবে। এর দলিল আমরা বলে এসেছি।
আর উভয় পায়ের অগ্রভাগের উপর ভর করে সোজা হয়ে দাড়াবে, বসবে না এবং এর দলিল আমরা বলে এসেছি।
ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) বলেন, সামান্য সময় বসার পর যমীনের উপর ভর দিয়ে দাড়াবে। কেননা, নাবী (সাঃআঃ) এরূপ করেছেন।
আমাদের দলিল হল আবূ হুরায়রা (রাঃআঃ) বর্ণীত হাদিস। নাবী (সাঃআঃ) নামাজে তার উভয় পায়ের সম্মখ ভাগের উপর ভর করে দাড়াতেন।

ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) বর্ণীত হাদিসটি বার্ধক্যের অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত। তাছাড়া এটি বিশ্রাম বৈঠক। আর নামাজ তো বিশ্রাম লাভের জন্য প্রবর্তিত হয়নি।
প্রথম রাকাআতে যা করেছে, দ্বিতীয় রাকাআতে তাই করবে। কেননা দ্বিতীয় রাকাআত হচ্ছে রুকানসমূহের পুনরাবৃত্তি।
তবে ছানা পড়বে না এবং আউযুবিল্লাহ পড়বে। কেননা উভয়টি একবারই পাঠ করা শরীআতে প্রমাণিত।

প্রথম তাকবীর ছাড়া আর কখনো দুই হাত উঠাবে না। রুকুতে যাওয়া এবং রুকু থেকে উঠার ক্ষেত্রে ইমাম শাফিঈ(রঃআঃ) ভিন্নমত পোষণ করেন। আমাদের দলিল এই যে, নাবী (সাঃআঃ) বলেছেন- সাতটি স্থান ছাড়া আর কোথাও হাত তোলা হবে না।তাকবীরে তাহরীমা, কুনূতের তাকবীর ও ঈদের তাকবীরসমূহ।
বাকী চারটি স্থান হজ্জ প্রসংগে উল্লেখ করেছেন। ( নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম মাসআলা )

হাত তোলা সম্পর্কে যে হাদিস বর্ণনা করা হয়, তা ইসলামের প্রথম যুগের উপর ধর্তব্য। এরুপ ইবন যুবায়র (রাঃআঃ) হতে বর্ণীত আছে।
দ্বিতীয় রাকাআতের দ্বিতীয় সাজদা থেকে যখন মাথা তুলবে, তখন বাম পা বিছিয়ে তার উপর বসবে এবং ডান পা সম্পূর্ণ দাড় করায়ে রাখবে এবং আংগুলগুলো কিবলামুখী করে রাখবে।
নামাজে রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) এর বসার এরূপ বিবরণই আইশা (রাঃআঃ) দিয়েছেন।
আর উভয় হাত উরুদ্বয়ের উপর রাখবে ও আংগুলগুলো বিছিয়ে রাখবে এবং তাশাহুদ পড়বে।

ওয়াইল (রাঃআঃ) এর হাদিসে এরূপ বর্ণীত হইয়াছে। তাছাড়া এতে হাতের আংগুলগুলো কিবলামূখী হয়।
আর যদি নামাজ আদায়কারী মহিলা হয়, তবে সে বাম নিতম্বের উপর বসবে এবং ডান দিক দিয়ে উভয় পা বের করে দেবে। কেননা এটা তার সতরের জন্য অধিক উপযোগী। আর তাশাহুদ হলো এই-
যাবতীয় মৌখিক ইবাদাত আল্লাহর জন্য। হে নাবী আমাদের উপর সালাম—শেষ পর্যন্ত। (অর্থাত্ আল্লাহর রহমত ও বরকত হোক। আমাদের উপর এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের উপর সালাম হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সাঃআঃ) তার বান্দা ও তার রাসূল।)

এটা আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ (রাঃআঃ) বর্ণীত তাশাহুদ। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) আমার হাত ধরে আমাকে তাশাহুদ শিক্ষা দিলেন; যেমন তিনি আমাকে কুরআনের কোন সুরা শিক্ষা দিতেন। তিনি বলিলেন- (বলো, আত্তাহিয়াতু লিল্লাহি———-ইলা আখেরিহি)। ইবন মাসউদ (রাঃআঃ) এর তাশাহুদ গ্রহণ করা উত্তম ইবন ‘আব্বাস (রাঃআঃ) বর্ণীত তাশাহুদ থেকে। তার তাশাহুদ হচ্ছে-

কেননা, ইবন মাসউদের হাদিসে আদেশবাচক ক্রিয়া রহিয়াছে, যার নূন্যতম চাহিদা হলো মুস্তাহাব হওয়া। তাছাড়া যুক্ত রহিয়াছে, যা সামগ্রিকতা বুঝায়। আর মধ্যে ওয়াও আলিফ ওয়াও অতিরিক্ত রহিয়াছে, যা বক্তব্যের নবায়ন বুঝায়। যেমন কসমের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। তাছাড়া শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এতে অধিক জোর দেওয়া হইয়াছে।

প্রথম বৈঠকে এর উপর কিছু অতিরিক্ত করবে না। কেননা ইবন মাসউদ (রাঃআঃ) বলেছেন, রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) আমাকে নামাজের মাঝের এবং নামাজের শেষের তাশাহুদ শিক্ষা দিয়েছেন। যখন নামাজের মধ্যবর্তী তাশাহুদ হতো, তখন তিনি তাশাহুদ শেষ করে দাড়িয়ে যেতেন। আর যখন নামাজের শেষদিকের তাশাহুদ হতো তখন (এরপর) নিজের জন্য তা ইচ্ছা তা দুআ করিতেন।

শেষ দুই রাকাআত শুধু সুরাতুল ফাতিহা পড়বে। কেননা, আবূ কাতাদা (রাঃআঃ) বর্ণীত হাদিসে আছে যে, নাবী (সাঃআঃ) শেষ রাকাআতে কেবল সুরাতুল ফাতিহা পড়েছেন।
এ বর্ণনার উদ্দেশ্য হলো ফাতিহা পাঠ উত্তম। এ-ই বিশুদ্ধ মত। কেননা প্রথম দুই রাকাআতেই কিরাত ফরয, যার বিবরণ ইনশাল্লাহ্ পরে আসবে। ( নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম মাসআলা )

আর শেষ বৈঠকে ঐ অবস্থাতেই বসবে, যে অবস্থায় প্রথম বৈঠকে বসেছিলো। কেননা ওয়াইল (রাঃআঃ) ও ‘আইশা (রাঃআঃ) বর্ণীত হাদিসে এরূপই আছে।
তাছাড়া এরূপ বসা শরীরের জন্য কষ্টদায়ক। সুতরাং তা উভয় পা ডান দিক দিয়ে বের করে নিতম্বের উপর বসা, যা ইমাম মালিক (রাঃআঃ) গ্রহণ করেছেন, তার তুলনায় উত্তম হবে। ( নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম মাসআলা )

আর রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) নিতম্বের উপর বসেছেন বলে বর্ণীত হাদিসকে ইমাম তাহাবী (রঃআঃ) দুর্বল বলেছেন, অথবা তা বাধ্যক্যের অবস্থার উপর আরোপ করা হবে।
আর তাশাহুদ পড়বে। আমাদের নিকট তা ওয়াজিব।

আর নাবী (সাঃআঃ) এর উপর দুরূদ পড়বে। আমাদের নিকট তা ফরয নয়।
উভয় ক্ষেত্রেই শাফিঈ (রঃআঃ) ভিন্নমত পোষণ করেন। (আমাদের দলিল) কেননা রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন-
যখন তুমি এটা বলিবে বা করবে তখন তোমার নামাজ পূর্ণ হয়ে গেলো। যদি তুমি উঠে পড়তে চাও তাহলে উঠে পড়ো আর যদি আরো বসতে চাও তাহলে বসো।

আর নামাজের বাইরে রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) এর উপর পাঠ ওয়াজিব। ইমাম কারখী (রঃআঃ) এর মতে শুধু একবার আর ইমাম তাহাবী (রঃআঃ) এর মতে যখনই নাবী (সাঃআঃ) এর আলোচনা হয়। সুতরাং আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালিত হয়ে যায়, এর মাধ্যমে। আর তাশাহুদের ক্ষেত্রে শব্দটি যে বর্ণীত হইয়াছে, (তার উত্তর এই যে) তার অর্থ হলো নির্ধারিত সময়।
ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) বলেন, এবং কুরআনের শব্দাবলী ও হাদিসে বর্ণীত দুআসমূহের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ দুআ করবে।
প্রমাণ, ইতোপূর্বে আমাদের বর্ণীত ইবন মাসউদ (রাঃআঃ) এর হাদিস।নাবী (সাঃআঃ) তাকে বলেছেন, এরপর তুমি তোমার কাছে উত্তম ও পসন্দনীয় দুআ নির্বাচন করে নাও।

আর যে সকল প্রার্থনা মানুষের কাছে করা অসম্ভব নয়, সেগুলোই মানুষের কালামের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যেমন এ কথা বলা, হে আল্লাহ! আমাকে অমুক নারী বিয়ে করিয়ে দিন। পক্ষান্তরে যা মানূষের কাছে চাওয়া সম্ভব নয়, তা মানুষের কালামের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। যেমন এ কথা বলা, (হে আল্লাহ আমাকে মাফ করুন) আর বলাটা প্রথম শ্রেণীভূক্ত। কেননা মানুষের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার রহিয়াছে। বলা হয় (শাসক বাহিনীকে বেতন বা রেশন দিলেন)।
এরপর আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্ বলে নিজের ডান দিকে সালাম ফিরাবে। এবং বাম দিকে অনুরূপভাবে সালাম ফিরাবে। কেননা ইবন মাসউদ (রাঃআঃ) বর্ণনা করেছেন যে, নাবী (সাঃআঃ) তার ডান দিকে এমন ভাবে সালাম ফিরাতেন যে, তার ডান গণ্ডদেশের শুভ্রতা দেখা যেতো এবং তার বাম দিকে এমন ভাবে সালাম ফিরাতেন যে, তার গণ্ডদেশের শুভ্রতা দেখা যেতো।

প্রথম সালাম দ্বারা তার ডান দিকের নারী-পুরূষ ও ফেরেশতাহাদের নিয়্যত করবে। তদ্রূপ দ্বিতীয় সালামে। কেননা আমল নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল। বর্তমান যুগে স্ত্রী লোকদের নিয়্যত করবে না। এবং তাহাদেরও নিয়্যত করবে না, যারা তার শরীক নয়। এটাই বিশুদ্ধ মত। কেননা সম্বোধন উপস্থিতদের প্রাপ্য।
(সালামের সময়) মুক্তাদির জন্য তার ইমামের নিয়্যত করা জরুরী। সুতরাং ডানে বা বামে থাকলে তাহাদের সাথেই তার নিয়্যত করে নিবে।

আর যদি তার বরাবরে থাকেন, তাহলে ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) এর মতে ডান দিকের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রথম সালামের সময় তার নিয়্যত করবে। ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর মতে- আর এটা আবূ হানীফা (রঃআঃ) হতে প্রাপ্ত একটি মত- উভয় সালামে তার নিয়্যত করবে। কেননা তিনি উভয় দিকের অংশীদার।
আর একা একা নামাজ আদায়কারী শুধু ফেরেশতাহাদের নিয়্যত করবে, অন্য কারো নিয়্যত করবে না। কেননা, তার সাথে তাহারা ব্যতীত অন্য কেউ নেই। আর ইমাম উভয় সালামে উক্ত (মুক্তাদি ও ফেরেশতাহাদের) নিয়্যত করবে।
এ-ই বিশুদ্ধ মত। ফেরেশতাহাদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন সংখ্যার নিয়্যত করবে না। কেননা তাহাদের সংখ্যা সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিস বর্ণীত আছে। সুতরাং তা আম্বিয়ায়ে কিরামের প্রতি ঈমান আনয়নের সদৃশ।

আমাদের মতে ‘সালাম শব্দ উচ্চারণ করা ওয়াজিব, ফরয নয়। এ সম্পর্কে ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) এর নিম্নোক্ত বাণী দ্বারা প্রমাণ পেশ করেন-
নামাজ শুরু করবে তাকবীর দ্বারা আর তা থেকে বের হবে সালাম দ্বারা।
আমাদের দলিল হলো বর্ণীত ইবন মাসউদ (রাঃআঃ) এর হাদিস (যাতে শেষ বৈঠকের পর বসে থাকার কিংবা উঠে পড়ার ইখতিয়ার প্রদান করা হইয়াছে) আর এই ইখতিয়ার প্রদান ফরয বা ওয়াজিব হওয়ার পরিপন্থী। তবে আমরা সতর্কতা অবলম্বনে ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) বর্ণীত হাদিস দ্বারা ওয়াজিব হ্ওয়া সাব্যস্ত করেছি। আর এ পযায়ের হাদিস দ্বারা ফরয হওয়া প্রমাণিত হয় না। আর আল্লাহই অধিক জানেন।

পরিচ্ছেদ-কিরাত

ইমাম হলে ফজরে এবং মাগরিবে ও ঈশার প্রথম দুই রাকাআতে উচ্চৈস্বরে কিরাত পড়বে এবং শেষ দুই রাকাআতে অনুচ্চৈস্বরে পড়বে। এটাই পরস্পরায় চলে এসেছে। আর যদি মু্নফারিদ হয় তা হলে সে ইচ্ছাধীন। চাইলে সে উচ্চৈস্বরে পাঠ করবে এবং নিজকে শোনাবে। কেননা নিজের ব্যাপারে সে নিজের ইমাম। আর চাইলে চুপে চুপে পাঠ করবে। কেননা, তার পিছনে এমন কেউ নেই, যাকে সে শোনাবে। তবে উচ্চৈস্বরে পাঠ করাই উত্তম। যাতে জামাআতের অনুরূপ আদায় হয়। ( নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম মাসআলা )

যুহর ও আসরে ইমাম কিরাত চুপে চুপে পড়বে। এমন কি আরাফাতে হলেও। কেননা, রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন- দিবসের নামাজ নির্বাক। অর্থাত্ তাতে শ্রুত কিরাত নেই।

আরাফা সম্পর্কে ইমাম মালিক (রঃআঃ) এর ভিন্নমত রহিয়াছে। আর আমাদের বর্ণীত হাদিসটি তার বিপক্ষে দলিল।
আর জুমুআ ও দই ঈদে উচ্চৈস্বরে পাঠ করবে। কেননা উচ্চৈস্বরে পাঠের বর্ণনা মশহূর ভাবে চলে এসেছে। দিবসে নফল নামাজ চুপে চুপে পাঠ করবে। আর ফরয নামাজের উপর কিয়াস করে রাত্রের নামাজে মুনাফারিদের ইখতিয়ার রহিয়াছে। কেননা, নফল নামাজ হলো ফরযের সম্পূরক। সুতরাং (কিরাআতের বেলায়) নফল ফরযের অনুরূপ হবে।
যে ব্যক্তির ঈশার নামাজ ফউত হয়ে যায় এবং সূর্যোদয়ের পর তা পড়ে, সে যদি উক্ত নামাজে ইমামতি করে তাহলে উচ্চস্বরে কিরাত পড়বে।

এর সকালে জামাআতের সাথে ফজরের নামাজ কাযা করার সময় রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) যেমন করেছিলেন।
আর যদি সে একা নামাজ পড়ে, তাহলে অবশ্যই নীরবে কিরাত পড়বে। (উভয় রকম পড়ার) ইখতিয়ার থাকবে না। এটাই বিশুদ্ধ মত। কেননা উচ্চৈস্বরে কিরাত সম্পৃক্ত রহিয়াছে জামাআতের সাথে অবশ্যম্ভাবীরূপে, কিংবা সময়ের সাথে স্বেচ্ছামূলকভাবে মুনাফারিদের ক্ষেত্রে। অথচ এখানে দুটোর কোনটাই পাওয়া যায় নি।
যে ব্যক্তি ঈশার প্রথম দুই রাকাআতে সুরা পাঠ করল কিন্তু সুরাতুল ফাতিহা পাঠ করেনি, সে শেষ দুই রাকাআতে তা দোহরাবে না। পক্ষান্তরে যদি সুরাতুল ফাতিহা পড়ে থাকে কিন্তু তার সাথে অন্য সুরা যোগ না করে থাকে, তাহলে শেষ দুই রাকাআতে ফাতিহা ও সুরা দুটোই পড়বে এবং উচ্চৈস্বরে পড়বে।

এটা ইমাম আবূ হানীফা ও মুহাম্মাদ (রঃআঃ)এর মত। তবে ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) বলেন, দুটোর মধ্যে কোনটাই কাযা করবে না। কেননা ওয়াজিব যখন নিজ সময় থেকে ফউত হয়ে যায়, তখন পরবর্তীতে বিনা দলীলে সেটাকে কাযা করা যায় না।

উল্লেখিত ইমামদ্বয়ের পক্ষে দলিল – যা উভয় অবস্থার পার্থক্যের সাথে সম্পৃক্ত যে, সুরাতুল ফাতিহাকে শরীআতে এমন অবস্থায় নির্দিষ্ট করা হইয়াছে যে, তার পরে সুরা সংযুক্ত হবে। সুতরাং যদি ফাতিহাকে শেষ দুই রাকাআতে কাযা করা হয় তাহলে তরতীবের দিক থেকে সুরার পর সুরাতুল ফাতিহা এসে যাবে। অর্থাত্ এটা নির্ধারিত অবস্থানের বিপরীত। আর (প্রথম দুই রাকাআতে) সুরা ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি ভিন্ন। কেননা তা শরীআত নির্ধারিতরূপে কাযা করা সম্ভব।
উল্লেখ্য যে, এখানকার পাঠে শব্দ ব্যবহার করা হইয়াছে, যাতে (কাযা করা) ওয়াজিব হওয়া বুঝায়। আর মূল গ্রন্থের উল্লেখিত শব্দে মুস্তাহাব হওয়া বুঝায়। কেননা সুরার কাযা যদিও ফাতিহার পরে হচ্ছে তবু এ সুরা নিজ ফাতিহার সাথে সংযুক্ত হচ্ছে না। সুতরাং নির্ধারিত অবস্থান সর্বাংশে বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

আর উভয়টিতে উচ্চৈস্বরে পাঠ করবে।
এটাই বিশুদ্ধ মত। কেননা একই রাকাআতে সরব ও নীরব পাঠ একত্র করা মানায় না। আর নফল তথা ফাতিহার মধ্যে পরিবর্তন আনা উত্তম।
অনুচ্চৈস্বরে পাঠ হল যেন নিজে শোনতে পায়। আর উচ্চৈস্বরের পাঠ হল অপরে শোনতে পায়। এ হল ফকীহ্ আবূ জাফর হিন্দওয়ানীর মত। কেননা, আওয়াজ ব্যতীত শুধু জিহবা সণ্চালনকে কিরাত বলা হয় না।

ইমাম কারখী (রঃআঃ) এর মতে উচ্চৈস্বরের সর্বনিম্ন পরিমাণ হলো নিজেকে শোনানো আর অনুচ্চৈস্বরের পরিমাণ হলো হরফের বিশুদ্ধ উচ্চারণ। কেননা, কিরাত বা পাঠ মুখের কাজ, কানের কাজ নয়। কুদূরী গ্রন্থের শব্দে এর প্রতি ইংগিত রহিয়াছে।
তালাক প্রদান, আযাদ করা, ব্যতিক্রম যোগ করা ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণমূলক যাবতীয় মাসআলার মধ্যে মতপার্থক্যের ভিত্তি হল উক্ত নীতির পার্থক্যের উপর। ( নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম মাসআলা )

নামাজে যে পরিমাণ কিরাত যথেষ্ট হয়, তার সর্বনিম্ন পরিমাণ হলো ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মতে এক আয়াত আর ইমাম আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর মতে ছোট তিন আয়াত অথবা দীর্ঘ এক আয়াত। কেননা, এর চেয়ে কম পরিমাণ হলে তাকে কারী বলা হয় না। সুতরাং তা এক আয়াতের কম পাঠ করার সমতূল্য।

ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর দলিল হলো, আল্লাহ তা’আলার বাণী- কুরআনের যতটুকু পরিমাণ সহজ হয়, তা তোমরা পড়ো। এখানে (এক আয়াতে বা তার অধিকের মাঝে) কোন পার্থক্য করা হয়নি। তবে এক আয়াতের কম পরিমাণ (সর্বসম্মতিক্রমেই কুরআন গণ্য হওয়ার হুকুমের) বহির্ভূত। আর পূর্ণ আয়াত আয়াতের অংশবিশেষের সমার্থক নয়।
আর সফরের সুরা ফাতিহার সাথে অন্য যে কোন সুরা ইচ্ছা হয় পড়বে। কেননা বর্ণীত আছে যে, নাবী (সাঃআঃ) তার সফরে ফজরের নামাজে ফালাক ও নাস সুরাদ্বয় পাঠ করেছিলেন। তাছাড়া নামাজের অর্ধেক রহিত করার ক্ষেত্রে সফরের প্রভাব রহিয়াছে। সুতরাং কিরাত হ্রাস করণের ব্যাপারে তার প্রভাব থাকা স্বাভাবিক।এ হুকুম তখন, যখন সফরে তাড়াহুড়া থাকে। পক্ষান্তরে যদি (মুসাফির) স্থিতি ও শান্তির পরিবেশ থাকে, তাহলে ফজরের নামাজে সুরা বুরূজ ও ইনশাক্কা পরিমাণ সুরা পাঠ করবে। কেননা, এভাবে তাখফীক সহকারে সুন্নাতের উপরও আমল সম্ভব হয়ে যাবে।

মুকীম অবস্থায় ফজরের উভয় রাকাআতে সুরাতূল ফাতিহা ছাড়া চল্লিশ বা পণ্চাশ আয়াত পড়বে। চল্লিশ থেকে ষাট এবং ষাট থেকে একশ আয়াত পাঠ করার কথাও বর্ণীত রহিয়াছে। আর এ সব সংখ্যার সমর্থনে হাদিস এসেছে। বর্ণনাগুলোর মাঝে সামঞ্জস্য বিধান এভাবে হতে পারে যে, (কিরাত শ্রবণে) আগ্রহীদের ক্ষেত্র্রে একশ আয়াত এবং অলসদের ক্ষেত্রে চল্লিশ আয়াত এবং মধ্যমদের ক্ষেত্রে পণ্চাশ থেকে ষাট আয়াত পাঠ করবে।

কারো কারো মতে রাত্র ছোট বড় হওয়া এবং কর্মব্যস্ততা কম-বেশী হওয়ার অবস্থা বিবেচনা করা হবে।
ইমাম কুদূরী বলেন, যুহরের নামাযেও অনুরূপ পরিমাণ পাঠ করবে। কেননা সময়ের প্রশস্ততার দিক দিয়ে উভয় নামাজ সমান। মবসূত গ্রন্থে বলা হইয়াছে- ‘কিংবা তার চেয়ে কম। কেননা তা কর্মব্যস্ততার সময়। সুতরাং অনীহা এড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে ফজর থেকে কমানো হবে। ( নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম মাসআলা )

আসর ও ‘ঈশা একই রকম। দুটোতেই আওসাতে মুফাসসাল পাঠ করবে। আর মাগরিবে তার চেয়ে কম অর্থাত্ তাতে ‘কিসারে মুফাসসাল পাঠ করবে।
এ বিষয়ে মূল দলিল হলো আবূ মূসা আশআরী (রাঃআঃ) এর নামে প্রেরিত উমর ইবন খাত্তাব (রাঃআঃ) এর এই মর্মে লিখিত পত্র যে, ফজরে ও যুহরে ‘তিওয়ালে মুফাসসাল পড়ো।
তাছাড়া মাগরিবের ভিত্তিই হলো দ্রুততার উপর। সুতরাং হালকা কিরাতই তার জন্য অধিকতর উপযোগী। আর আসর ও ‘ঈশায় মুস্তাহাব হলো বিলম্বে পড়া। আর কিরাত দীর্ঘ করিলে নামাজ দুটি মুস্তাহাব ওয়াক্ত অতিক্রম করার আশংকা রহিয়াছে। সুতরাং এ দুই নামাজে আওসাতে মুফাসসাল নির্ধারণ করা হয়।
ফজরে প্রথম রাকাআতকে দ্বিতীয় রাকাআতের তুলনায় দীর্ঘ করবে, যাতে লোকদের জামাআত ধরার ব্যাপারে সহায়ক হয়।

ইমাম কুদূরী বলেন, যুহরের উভয় রাকাআত সমান।
তা ইমাম আবূ হানীফা ও আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) এর মত। আর ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) বলেন, সব নামাজেই প্রথম রাকাআতকে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ করা আমার কাছে পসন্দনীয়। কেননা, বর্ণীত আছে যে, নাবী (সাঃআঃ) সব নামাজেই প্রথম রাকাআতকে অন্য রাকাআতের তুলনায় দীর্ঘ করিতেন। প্রথমোক্ত ইমামদ্বয়ের দলিল এই যে, উভয় রাকাআতই কিরাতের সমান হকদার। সুতরাং পরিমাণের ক্ষেত্রেও উভয় রাকাআত সমান হতে হবে। তবে ফজরের নামাজ এর বিপরীত। কেননা, তা ঘুম ও গাফলাতের সময়। আর উদ্ধৃত হাদিসটি সানা, আউযুবিল্লাহ্ ও বিসমিল্লাহ্ পড়ার প্রেক্ষিতে দীর্ঘ হওয়ার সাথে সম্পৃক্ত।

আর কম, বেশীর ক্ষেত্রে তিন আয়াতের কম ধর্তব্য নয়। কেননা অনায়াসে এতটুকু কম-বেশী থেকে বেঁচে থাকা সম্ভবপর নয়।
আর কোন নামাজের সহিত এমন কোন সুরা নির্দিষ্ট নেই যে, এটি ছাড়া নামাজ জাইয হবে না। কেননা, আমরা পূর্বে যে আয়াত পেশ করেছি, তা নিঃশর্ত।
বরং কোন নামাজের জন্য কুরআনের কোন অংশকে নির্ধারণ করে নেওয়া মাকরূহ। কেননা, তাতে অবশিষ্ট কুরআনকে বর্জন করা হয় এবং বিশেষ সুরার ফযীলতের ধারণা জন্মে।

মুক্তাদী ইমামের পিছনে কিরাত পাঠ করবে না। সুরাতুল ফাতিহার ব্যাপারে ইমাম শাফিই (রঃআঃ) এর ভিন্নমত রহিয়াছে। তার দলিল এই যে, কিরাত হলো নামাজের অন্যন্য রুকনের মত একটি রুকন। সুতরাং তা পালনে ইমাম ও মুক্তাদী উভয়ে শরীক থাকবেন।
আমাদের দলিল হলো রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) এর বাণী- যে ব্যক্তির ইমাম রহিয়াছে, সেক্ষেত্রে ইমামের কিরাত তার কিরাত রূপে গণ্য। এবং এর উপরই সাহাবীদের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।
আর কিরাত হলো উভয়ের মাঝে শরীকানামূলক রুকন। তবে মুক্তাদীর অংশ হলো নীরব থাকা ও মনোযোগসহ শ্রবণ। রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন- (ইমাম) যখন কুরআন পাঠ করেন তখন তোমরা খামুশ থাকো।

তবে ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) হতে বর্ণীত আছে যে, সতর্কতা অবলম্বন হিসাবে পাঠ করাই উত্তম। কিন্তু ইমাম আবূ হানীফা ও আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) এর মতে তা মাকরূহ। কেননা এ সম্পর্কে হুশিয়ারি রহিয়াছে।
আর মনোযোগ সহকারে শুনবে এবং নীরবে থাকবে। যদিও ইমাম আশা ও ভয়ের আয়াত পাঠ করেন। কেননা, নীরবে শ্রবণ ও নীরবতা আয়াত দ্বারা ফরয সাব্যস্ত হইয়াছে। আর নিজে পাঠ করা, কিংবা জান্নাত প্রার্থনা করা এবং জাহান্নাম থেকে পানাহ চাওয়া এ সকল এতে বাধা সৃষ্টি করে।

খুতবার হুকুমও অনুরূপ। তেমনি হুকুম নাবী (সাঃআঃ) এর উপর দুরূদ পাঠ করার সময়ও। কেননা, মনোযোগ সহকারে খুতবা শ্রবণ করা ফরয। তবে যদি খতীব এ আয়াত পড়েন- তখন শ্রোতা মনে মনে দুরূদ পড়বে।
অবশ্য মিম্বর থেকে দূরের লোকদের সম্পর্কে আলিমগণের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। তবে নীরব থাকার মধ্যে ইহতিয়াত রহিয়াছে, যাতে (কমপক্ষে) খামুশ থাকার ফরয পালিত হয়। সঠিক বিষয় আল্লাহই উত্তম জানেন। ( নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম মাসআলা )


Posted

in

by

Comments

Leave a Reply