নবী [সাঃআঃ]- এর হজ্জের বিবরণ
নবী [সাঃআঃ]- এর হজ্জের বিবরণ >> সহীহ মুসলিম শরীফ এর মুল সুচিপত্র দেখুন >> নিম্নে মুসলিম শরীফ এর একটি অধ্যায়ের হাদিস পড়ুন
১৮. অধ্যায়ঃ হজ্জ উমরা তে উপভোগ করা প্রসঙ্গে
১৯. অধ্যায়ঃ নবী [সাঃআঃ]- এর হজ্জের বিবরণ
১৮. অধ্যায়ঃ হজ্জ উমরা তে উপভোগ করা প্রসঙ্গে
২৮৩৭. আবু নায্রাহ্ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, ইবনি আব্বাস [রাদি.] তামাত্তু হজ্জ করার নির্দেশ দিতেন এবং ইবনি যুবায়র [রাদি.] তামাত্তু হজ্জ করিতে নিষেধ করিতেন। আমি বিষয়টি জাবির ইবনি আবদুল্লাহ [রাদি.]- এর সামনে পেশ করলাম। তিনি বলিলেন, এ ঘটনাটি আমার সামনেই ঘটেছে। আমরা রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]- এর সঙ্গে তামাত্তু হজ্জ করেছি। উমর [রাদি.] খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পর বলিলেন, আল্লাহ তাআলা রসূল [সাঃআঃ]- এর জন্য যে জিনিস ইচ্ছা এবং যে কারণে ইচ্ছা হালাল করেন এবং কুরআন নাযিল হওয়া সমাপ্ত হয়েছে। অতএব তোমরা আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে হজ্জ ও উমরাহ্ সম্পাদন কর- যেভাবে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন এবং যেসব নারীকে তোমরা মুত্আর [উপভোগ করার] মাধ্যমে বিবাহ করেছো- তাদের সঠিক বিবাহ বন্ধনে নিয়ে নাও। আমার নিকট মুতআর শর্তে বিবাহকারী কোন পুরুষ লোক এলে আমি অবশ্যই তাকে রজম [প্রস্তরাঘাতে হত্যা] করব।
[ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ২৮১৪, ইসলামিক সেন্টার- ২৮১২]
২৮৩৮. ক্বাতাদাহ্ [রাদি.]- এর সূত্রে হইতে বর্ণীতঃ
উপরোক্ত হাদীসের অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। তবে এ বর্ণনায় আরও আছে, উমর [রাদি.] বলেন, “তোমাদের হজ্জকে উমরাহ্ থেকে পৃথক কর। কারণ এতে তোমাদের হজ্জও পূর্ণাঙ্গ হইবে এবং উমরাও পূর্ণাঙ্গ হইবে”।
[ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ২৮১৫, ইসলামিক সেন্টার- ২৮১৩]
২৮৩৯. জাবির ইবনি আবদুল্লাহ [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, আমরা রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর সঙ্গে [মাক্কায়] পৌঁছলাম হজ্জের জন্য তালবিয়াহ্ উচ্চারণ করিতে করিতে। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] আমাদের ইহরামকে উমরার ইহরামে পরিবর্তন করার নির্দেশ দিলেন।
[ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ২৮১৬, ইসলামিক সেন্টার- ২৮১৪]
১৯. অধ্যায়ঃ নবী [সাঃআঃ]- এর হজ্জের বিবরণ
২৮৪০. জাফার ইবনি মুহাম্মাদ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] থেকে তার পিতার সূত্রে হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, আমরা জাবির ইবনি আবদুল্লাহ [রাদি.]- এর কাছে গেলাম। তিনি সকলের পরিচয় জিজ্ঞেস করিলেন। অবশেষে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। আমি বললাম, আমি মুহাম্মাদ ইবনি আলী ইবনি হুসায়ন। অতএব তিনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে আমার মাথার উপর রাখলেন। তিনি আমার জামার উপর দিকের বোতাম খুললেন তারপর নিচের বোতাম খুললেন। অতঃপর তার হাত আমার বুকের মাঝে রাখলেন। আমি তখন যুবক ছিলাম। তিনি বলিলেন, হে ভ্রাতুষ্পুত্র! তোমাকে স্বাগত জানাই, তুমি যা জানতে চাও, জিজ্ঞেস কর। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তখন তিনি [বার্ধক্যজনিত কারণে] দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ইতোমধ্যে নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেল। তিনি নিজেকে একটি চাদর আবৃত করে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি যখনই চাদরের প্রান্ত নিজ কাঁধের উপর রাখতেন – তা [আকারে] ছোট হবার কারণে নীচে পড়ে যেত। তার আরেকটি বড় চাদর তার পাশেই আনলায় রাখা ছিল। তিনি আমাদের নিয়ে নামাজের ঈমামত করিলেন। অতঃপর আমি বললাম, আপনি আমাদেরকে রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর [বিদায়] হজ্জ সম্পর্কে অবহিত করুন। জাবির [রাদি.] স্বহস্তে নয় সংখ্যার প্রতি ইঙ্গিত করে বললেনঃ রসূলুল্লাহ নয় বছর [মদীনায়] অবস্থান করেন এবং এ সময়ের মধ্যে হজ্জ করেননি। অতঃপর ১০ম বর্ষে লোকদের মধ্যে ঘোষণা দেয়া হল যে , রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]- এ বছর হাজ্জে যাবেন। সুতরাং মাদীনায় বহু লোকের আগমন হল। তাদের প্রত্যেকে রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]- এর অনুসরণ করিতে এবং তাহাঁর অনুরূপ আমল করিতে আগ্রহী ছিল। আমরা তাহাঁর সঙ্গে রওনা হলাম। আমরা যখন যুল হুলায়ফাহ্ নামক স্থানে পৌঁছলাম- আসমা বিনতু উমায়স [রাদি.] মুহাম্মাদ ইবনি আবু বাক্রকে প্রসব করিলেন। তিনি রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর নিকট লোক পাঠিয়ে জানতে চাইলেন – এখন আমি কী করব? তিনি বলিলেন, তুমি গোসল কর, একখণ্ড কাপড় দিয়ে পট্টি বেঁধে নাও এবং ইহরামের পোশাক পরিধান কর।
রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] মসজিদে [ইহরামের দু রাকআত] নামাজ আদায় করিলেন। অতঃপর ক্বাসওয়া নামক উষ্ট্রীতে আরোহণ করিলেন। অতঃপর বায়দা নামক স্থানে তাহাঁর উষ্ট্রী যখন তাঁকে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল – আমি সামনের দিকে যতদূর দৃষ্টি যায়, তাকিয়ে দেখলাম লোকে লোকারণ্য- কতক সওয়ারীতে, কতক পদব্রজে অগ্রসর হচ্ছে। ডানদিকে, বাঁদিকে এবং পিছনেও একই দৃশ্য। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] আমাদের মাঝখানে ছিলেন এবং তাহাঁর উপর কুরআন নাযিল হচ্ছিল। একমাত্র তিনিই এর আসল তাৎপর্য জানেন এবং তিনি যা করিতেন, আমরাও তাই করতাম। তিনি আল্লাহর তাওহীদ সম্বলিত এ তালবিয়াহ্ পাঠ করলেনঃ
لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ
অর্থঃ আমি তোমার দরবারে হাযির আছি, হে আল্লাহ! আমি তোমার দরবারে হাযির, আমি তোমার দরবারে হাযির, তোমার কোন শারীক নেই, আমি তোমার দরবারে উপস্থিত। নিশ্চিত সমস্ত প্রশংসা, নিআমাত তোমারই এবং সমগ্র রাজত্ব তোমার, তোমার কোন শারীক নেই”।
লোকেরাও উপরোক্ত তালবিয়াহ্ পাঠ করিল – যা [আজকাল] পাঠ করা হয়। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর থেকে বেশি কিছু বলেননি। আর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] উপরোক্ত তালবিয়াহ্ পাঠ করিতে থাকলেন।
জাবির [রাদি.] বলেন, আমরা হজ্জ ছাড়া অন্য কিছুর নিয়ত করিনি, আমরা উমরার কথা জানতাম না। অবশেষে আমরা যখন তাহাঁর সঙ্গে বায়তুল্লাহ্য় পৌঁছলাম- তিনি রুকন [হাজারে আসওয়াদ] স্পর্শ করিলেন, অতঃপর সাতবার কাবাহ্ ঘর ত্বওয়াফ করিলেন- তিনবার দ্রুতগতিতে এবং চারবার স্বাভাবিক গতিতে। এরপর তিনি মাক্বামে ইব্রাহীমে পৌঁছে এ আয়াত তিলাওয়াত করলেনঃ
وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى
অর্থঃ “তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়াবার স্থানকে নামাজের স্থানরূপে গ্রহণ কর”- [সুরা আল বাক্বারাহ্ ২ : ১২৫]। তিনি মাক্বামে ইব্রাহীমকে তাহাঁর ও বায়তুল্লাহর মাঝখানে রেখে [দু রাকআত নামাজ আদায় করিলেন]। [জাফার বলেন] আমার পিতা [মুহাম্মাদ] বলিতেন, আমি যতদূর জানি, তিনি [জাবির] রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] থেকে বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি দু রাকআত সলাতে সুরা কুল্ হুওআল্ল-হু আহাদ قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ ও কুল্ ইয়া আইয়ুহাল কা-ফিরূন قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ পাঠ করেন।
অতঃপর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] হাজারে আসওয়াদের কাছে প্রত্যাবর্তন করিলেন এবং তাতে চুমু খেলেন। অতঃপর তিনি দরজা দিয়ে সাফা পাহাড়ের দিকে বের হলেন এবং সাফার নিকটবর্তী হয়ে তিলাওয়াত করলেনঃ
إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ
অর্থঃ “নিশ্চয়ই সাফা-মারওয়াহ্ পাহাড়দ্বয় আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম”- [সুরা আল বাক্বারাহ্ ২ : ১৫৮] এবং আরো বলিলেন- আল্লাহ তাআলা যে পাহাড়ের উল্লেখ করে আরম্ভ করিয়াছেন, আমিও তা দিয়ে আরম্ভ করব। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] সাফা পাহাড় থেকে শুরু করিলেন, অতঃপর এতটা উপরে আরোহণ করিলেন যে, বায়তুল্লাহ দেখিতে পেলেন। তিনি ক্বিবলামুখী হলেন, আল্লাহর একত্ব ও মাহাত্ম্য ঘোষণা করিলেন এবং বললেনঃ
لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كَلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ أَنْجَزَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الأَحْزَابَ وَحْدَهُ
অর্থঃ আল্লাহ ছাড়া কোন মাবূদ নেই, তিনি এক, তাহাঁর কোন শারীক নেই। তাহাঁর জন্য রাজত্ব এবং তাহাঁর জন্য সমস্ত প্রশংসা, তিনি প্রতিটি জিনিসের উপর শক্তিমান। আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি এক, তিনি নিজের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করিয়াছেন”।
তিনি এ দুআ পড়লেন এবং তিনি অনুরূপ তিনবার বলেছেন। অতঃপর তিনি নেমে মারওয়াহ পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হলেন- যতক্ষণ না তাহাঁর পা মুবারক উপত্যকার সমতল ভূমিতে গিয়ে ঠেকল। তিনি দ্রুত চললেন- যতক্ষণ না উপত্যকা অতিক্রম করিলেন। মারওয়াহ্ পাহাড়ে ঊঠার সময় হেঁটে উঠলেন, অতঃপর এখানেও তাই করিলেন যা তিনি সাফা পাহাড়ে করেছিলেন। সর্বশেষ ত্বওয়াফে যখন তিনি মারওয়াহ্ পাহাড়ে পৌঁছলেন, তখন [লোকদের সম্বোধন করে] বললেনঃ যদি আমি আগেই ব্যাপারটি বুঝতে পারতাম, তাহলে আমি সাথে করে কুরবানীর পশু আনতাম না এবং [হজ্জের] ইহরামকে উমরায় পরিবর্তন করতাম। অতএব তোমাদের মধ্যে যার সাথে কুরবানীর পশু নেই, সে যেন ইহরাম খুলে ফেলে এবং একে উমরায় পরিণত করে। এ সময় সুরাক্বাহ ইবনি মালিক ইবনি জুশুম [রাদি.] দাঁড়িয়ে বলিলেন, হে আল্লাহর রসূল! এ ব্যবস্থা কি আমাদের এ বছরের জন্য, না সর্বকালের জন্য? রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] নিজ হাতের আঙ্গুলগুলো পরস্পরের ফাঁকে ঢুকালেন এবং দুবার বলিলেন, উমরাহ্ হজ্জের মধ্যে প্রবেশ করেছে। আরও বলিলেন, না বরং সর্বকালের জন্য, সর্বকালের জন্য।
এ সময় আলী [রাদি.] ইয়ামান থেকে নবী [সাঃআঃ]- এর জন্য কুরবানীর পশু নিয়ে এলেন এবং যারা ইহরাম খুলে ফেলেছে, ফাত্বিমাহ্ [রাদি.]-কে তাদের অন্তর্ভুক্ত দেখিতে পেলেন। তিনি রঙ্গীন কাপড় পরিহিতা ছিলেন এবং চোখে সুরমা দিয়েছিলেন। আলী [রাদি.] তা অপছন্দ করিলেন। ফাত্বিমাহ্ [রাদি.] বলিলেন, আমার পিতা আমাকে এরূপ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
রাবী বলেন, আলী [রাদি.] ইরাক্বে থাকতেন, অতএব ফাতিমাহ [রাদি.] যা করিয়াছেন তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে আমি তাকে জানালাম যে, আমি তার এ কাজ অপছন্দ করেছি। তিনি যা উল্লেখ করিয়াছেন, সে বিষয়ে জানার জন্য আমি রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] – এর কাছে গেলাম। রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] বলিলেন, ফাত্বিমাহ্ সত্য বলেছে, সত্য বলেছে। তুমি হজ্জের ইহরাম বাঁধার সময় কী বলেছিলে?আলী [রাদি.] বলিলেন, আমি বলেছি, হে আল্লাহ! আমি ইহরাম বাঁধলাম, যেরূপ ইহরাম বেঁধেছেন আপনার রসূল। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] বললেনঃ তোমার সঙ্গে হাদী [কুরবানীর পশু] আছে, অতএব তুমি ইহরাম খুলবে না।
জাবির [রাদি.] বলেন, আলী [রাদি.] ইয়ামান থেকে যে পশুপাল নিয়ে এসেছেন এবং নবী [সাঃআঃ] নিজের সঙ্গে করে যে সব পশু নিয়ে এসেছিলেন, সর্বসাকুল্যে এর সংখ্যা দাঁড়ালো একশত। অতএব নবী [সাঃআঃ] এবং যাদের সঙ্গে কুরবানীর পশু ছিল, তারা ব্যতীত আর সকলেই ইহরাম খুলে ফেললেন এবং চুল কাটলেন। অতঃপর যখন তালবিয়ার দিন [৮যিলহজ্জ] আসলো, লোকেরা পুনরায় ইহরাম বাঁধলো এবং মিনার দিকে রওনা হল। আর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] সওয়ার হয়ে গেলেন এবং সেখানে যুহর, আস্র, মাগরিব, ইশা ও ফাজ্রের নামাজ আদায় করিলেন। অতঃপর তিনি সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিলেন এবং নামিরাহ্ নামক স্থানে গিয়ে তার জন্য একটি তাঁবু খাটানোর নির্দেশ দিলেন এবং নিজেও রওনা হয়ে গেলেন।
কুরায়শগণ নিঃসন্দেহ ছিল যে, নবী [সাঃআঃ] মাশআরুল হারামের কাছে অবস্থান করবেন যেমন জাহিলী যুগে কুরায়শগণ করত। কিন্তু রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] সামনে অগ্রসর হলেন, তারপরে আরাফায় পৌঁছলেন এবং দেখিতে পেলেন নামিরায় তাহাঁর জন্য তাঁবু খাটানো হয়েছে। তিনি এখানে অবতরণ করলে। অতঃপর যখন সূর্য ঢলে পড়ল, তখন তিনি তাহাঁর ক্বাস্ওয়া [নামক উষ্ট্রী]-কে প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলেন। তার পিঠে হাওদা লাগানো হল। তখন তিনি বাত্বনে ওয়াদীতে এলেন এবং লোকদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। তিনি বলিলেন,
“তোমাদের রক্ত ও তোমাদের সম্পদ তোমাদের জন্য হারাম যেমন তা হারাম তোমাদের এ দিনে, তোমাদের এ মাসে এবং তোমাদের এ শহরে।”
“সাবধান! জাহিলী যুগের সকল ব্যাপার [অপসংস্কৃতি] আমার উভয় পায়ের নীচে। জাহিলী যুগের রক্তের দাবিও বাতিল হল। আমি সর্বপ্রথম যে রক্তপণ বাতিল করছি, তা হল আমাদের বংশের রবীআহ্ ইবনি হারিসের পুত্রের রক্তপণ। সে শিশু অবস্থায় বানূ সাদ এ দুগ্ধপোষ্য ছিল, তখন হুযায়ল গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করে।
“জাহিলী যুগের সুদও বাতিল হল। আমি প্রথম যে সুদ বাতিল করছি তা হল আমাদের বংশের আব্বাস ইবনি আবদুল মুত্ত্বালিবের সুদ। তার সমস্ত সুদ বাতিল হল”।
“তোমরা স্ত্রীলোকদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর কালিমার মাধ্যমে তাদের লজ্জাস্থান নিজেদের জন্য হালাল করেছ। তাদের উপরে তোমাদের অধিকার এই যে, তারা যেন তোমাদের শয্যায় এমন কোন লোককে আশ্রয় না দেয় যাকে তোমরা অপছন্দ কর। যদি তারা এরূপ করে, তবে হালকাভাবে প্রহার কর। আর তোমাদের উপর তাদের ন্যায়সঙ্গত ভরণ-পোষণের ও পোশাক-পরিচ্ছদের হাক্ব রয়েছে।
“আমি তোমাদের মাঝে এমন এক জিনিস রেখে যাচ্ছি- যা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকলে তোমরা পথভ্রষ্ট হইবে না। তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব।”
“আমার সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হলে, তখন তোমরা কী বলবে?” তারা বলিল, আমরা সাক্ষ্য দিব যে, আপনি [আল্লাহর বাণী] পৌঁছিয়েছেন, আপনার হাক্ব আদায় করিয়াছেন এবং সদুপদেশ দিয়েছেন। অতঃপর তিনি তর্জনী আকাশের দিকে তুলে লোকদের ইশারা করে বলিলেন, “ইয়া আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক, “ তিনবার এরূপ বলিলেন।”
অতঃপর [মুয়ায্যিন] আযান দিলেন ও ইক্বামাত দিলেন এবং রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] যুহরের নামাজ আদায় করিলেন। এরপর ইক্বামাত দিলেন এবং রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] আস্রের নামাজ আদায় করিলেন। তিনি এ দু নামাজের মাঝখানে অন্য কোন নামাজ আদায় করেননি।
অতঃপর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] সওয়ার হয়ে মাওক্বিফ [অবস্থানস্থল] এলেন, তাহাঁর ক্বাস্ওয়া উষ্ট্রীর পেট পাথরের স্তূপের দিকে করে দিলেন এবং লোকদের একত্র হবার জায়গা সামনে রেখে ক্বিবলামুখী হয়ে দাঁড়ালেন। সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনি এভাবে উকূফ করিলেন। হলদে আভা কিছু দূরীভূত হল, এমনকি সূর্য গোলক সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেল। তিনি উসামাহ্ [রাদি.]-কে তাহাঁর বাহনের পিছন দিকে বসালেন এবং ক্বাসওয়ার নাকের দড়ি সজোরে টান দিলেন- ফলে তার মাথা মাওরিক [সওয়ারী ক্লান্তি অবসাদের জন্য যাতে পা রাখে] স্পর্শ করিল। তিনি ডান হাতের ইশারায় বলিলেন, হে জনমণ্ডলী! ধীরে সুস্থে, ধীরে সুস্থে অগ্রসর হও। যখনই তিনি বালুর স্তূপের নিকট পৌঁছতেন, ক্বাসওয়ার নাকের রশি কিছুটা ঢিল দিতেন যাতে সে উপরদিকে উঠতে পারে।
এভাবে তিনি মুযদালিফায় পৌঁছলেন এবং এখানে একই আযানে ও দু ইক্বামাতে মাগরিব ও ইশার নামাজ আদায় করিলেন। এ নামাজের মাঝখানে অন্য কোন নাফ্ল নামাজ আদায় করেননি। অতঃপর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] শুয়ে পড়লেন। যাবৎ না ফাজ্রের ওয়াক্ত হল। অতঃপর ভোর হয়ে গেলে তিনি আযান ও ইক্বামাত সহ ফাজ্রের নামাজ আদায় করিলেন। অতঃপর ক্বাসওয়ার পিঠে আরোহণ করে “মাশআরুল হারাম” নামক স্থানে আসলেন। এখানে তিনি ক্বিবলামুখী হয়ে আল্লাহর নিকট দুআ করিলেন, তাহাঁর মহত্ব বর্ণনা করিলেন, কালিমাহ তাওহীদ পড়লেন এবং তাহাঁর একত্ব ঘোষণা করিলেন। দিনের আলো যথেষ্ট উজ্জ্বল না হওয়া পর্যন্ত তিনি দাঁড়িয়ে এরূপ করিতে থাকলেন।
সূর্যোদয়ের পূর্বে তিনি আবার রওনা করছিলেন এবং ফায্ল ইবনি আব্বাস [রাদি.] সওয়ারীতে তাহাঁর পিছনে বসলেন।
তিনি ছিলেন যুবক এবং তার মাথার চুল ছিল অত্যন্ত সুন্দর। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] যখন অগ্রসর হলেন- পাশাপাশি একদল মহিলাও যাচ্ছিল। ফায্ল [রাদি.] তাদের দিকে তাকাতে লাগলেন। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] নিজের হাত ফায্লের চেহারার উপর রাখলেন এবং তিনি তার মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন এবং ফায্ল [রাদি.] অপরদিক দেখিতে লাগলেন। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] পুনরায় অন্যদিক হইতে ফায্ল [রাদি.]-এর মুখমণ্ডলে হাত রাখলেন। তিনি আবার অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখিতে লাগলেন। তিনি বাত্বনে মুহাস্সাব নামক স্থানে পৌঁছলেন এবং সওয়ারীর গতি কিছুটা দ্রুত করিলেন। তিনি মধ্যপথে অগ্রসর হলেন- যা জামরাতুল কুবরার দিকে বেরিয়ে গেছে। তিনি বৃক্ষের নিকটের জামরায় এলেন এবং নিচের খালি জায়গায় দাঁড়িয়ে এখানে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করিলেন এবং প্রত্যেকবার আল্ল-হু আকবার বলিলেন। অতঃপর সেখান থেকে কুরবানীর স্থানে এলেন এবং নিজ হাতে তেষট্টিটি পশু যাবাহ করিলেন। তিনি কুরবানীর পশুতে আলী [রাদি.]-কেও শারীক করিলেন। অতঃপর তিনি প্রতিটি পশুর গোশ্তের কিছু অংশ নিয়ে একত্রে রান্না করার নির্দেশ দিলেন। অতএব তাই করা হল। তারা উভয়ে এ গোশ্ত থেকে খেলেন এবং ঝোল পান করিলেন।
অতঃপর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] সওয়ার হয়ে বায়তুল্লাহ্র দিকে রওনা হলেন এবং মাক্কায় পৌঁছে যুহরের নামাজ আদায় করিলেন। অতঃপর বানূ আবদুল মুত্ত্বালিব –এর লোকদের কাছে আসলেন, তারা লোকদের যামযামের পানি পান করাচ্ছিল। তিনি বলিলেন, হে আবদুল মুত্ত্বালিবের বংশধরগণ! পানি তোল। আমি যদি আশংকা না করতাম যে, পানি পান করানোর ব্যাপারে লোকেরা তোমাদের পরাভূত করে দিবে, তবে আমি নিজেও তোমাদের সাথে পানি তুলতাম। তখন তারা তাঁকে এক বালতি পানি দিল এবং তিনি তা থেকে কিছু পান করিলেন। [ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ২৮১৭, ইসলামিক সেন্টার- ২৮১৫]
২৮৪১. জাফার ইবনি মুহাম্মাদ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] থেকে তার পিতার সূত্রে হইতে বর্ণীতঃ
আমি জাবির ইবনি আবদুল্লাহ [রাদি.]- এর নিকট এলাম এবং তাকে রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর বিদায় হজ্জ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। …… হাদীসের অবশিষ্ট বর্ণনা পূর্বোক্ত হাতিম ইবনি ইসমাঈলের বর্ণিত হাদীসের অনুরূপ। তবে এ বর্ণনায় আছে : আরও আবু সাইয়্যারাহ্ নামক এক ব্যক্তি [জাহিলী যুগে] লোকদেরকে জীনবিহীন গাধার পিঠে করে [মুযদালিফাহ্ থেকে] নিয়ে যেত। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] যখন মুযদালিফাহ্ থেকে আল-মাশআরুল-হারাম-এর দিকে অগ্রসর হলেন, তখন কুরায়শরা নিঃসন্দেহ ছিল যে, তিনি এখানে থামবেন এবং অবস্থান করবেন। কিন্তু তিনি আরও সামনে অগ্রসর হলেন এবং এদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ করিলেন না-অবশেষে তিনি আরাফতে পৌঁছে সেখানে অবতরণ করিলেন।
[ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ২৮১৮, ইসলামিক সেন্টার- ২৮১৬]
Leave a Reply