সূরা আল ফাতিহা তাফসীর (ফাতিহাতুল কিতাব) প্রসঙ্গে

সূরা আল ফাতিহা তাফসীর (ফাতিহাতুল কিতাব) প্রসঙ্গে

সূরা আল ফাতিহা তাফসীর (ফাতিহাতুল কিতাব) প্রসঙ্গে >> বুখারী শরীফ এর মুল সুচিপত্র পড়ুন >> সুরা ফাতিহা আরবি তে পড়ুন বাংলা অনুবাদ সহ

৬৫/১/১. অধ্যায়ঃ সুরাতুল ফাতিহা (ফাতিহাতুল কিতাব) প্রসঙ্গে

{الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ} اسْمَانِ مِنْ الرَّحْمَةِ الرَّحِيْمُ وَالرَّاحِمُ بِمَعْنًى وَاحِدٍ كَالْعَلِيْمِ وَالْعَالِمِ.

রহমান ও রহীম শব্দদ্বয় রহমাত শব্দ থেকে নিষ্পন্ন এবং রহীম ও র-হিম দুটো শব্দই একই অর্ধবোধক যেমন আলীম ও আ-লিম।

সুরা (১) : ফাতিহা

وَسُمِّيَةْ أُمَّ الْكِةَابِ أَنَّهُ يُبْدَأُ بِكِةَابَةِهَا فِي الْمَصَاحِفِ وَيُبْدَأُ بِقِرَاءَةِهَا فِي الصَّلَاة.

وَ{الدِّيْنُ} الْجَزَاءُ فِي الْخَيْرِ وَقَالَ مُجَاهِدٌ {بِالدِّيْنِ} بِالْحِسَابِ {مَدِيْنِيْنَ} مُحَاسَبِيْنَ.

সুরা ফাতিহাকে উম্মুল কিতাব (কিতাবের মূল) হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে এজন্য যে, সুরা ফাতিহা লেখা দ্বারাই কুরআন গ্রন্থাকারে লেখা শুরু হয়েছে।

আর সুরা ফাতিহা পাঠের মাধ্যমে সালাতও আরম্ভ করা হয়। দ্বীন অর্থ -ভাল ও মন্দের প্রতিফল। যেমন বলা হয়ে থাকে وَالشَّرِّ كَمَا تَدِيْنُ تُدَانُ যেমন কর্ম তেমন ফল। আর মুজাহিদ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, بِالدِّيْنِ হিসাব-নিকাশ। مَدِيْنِيْنَ যার হিসাব নেয়া হইবে।

৪৪৭৪

আবু সাঈদ ইবনু মুআল্লা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আমি একদা মাসজিদে নাববীতে সলাত আদায় করছিলাম, এমন সময় রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) আমাকে ডাকেন। কিন্তু ডাকে আমি সাড়া দেইনি। পরে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি সলাত আদায় করছিলাম। তখন তিনি বলিলেন, আল্লাহ কি বলেননি যে, ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা সাড়া দেবে আল্লাহ ও রসূলের ডাকে, যখন তিনি তোমাদেরকে ডাক দেন (সুরা আনফাল ৮/২৪)। তারপর তিনি আমাকে বলিলেন, তুমি মাসজিদ থেকে বের হওয়ার আগেই তোমাকে আমি কুরআনের এক অতি মহান সুরা শিক্ষা দিব। তারপর তিনি আমার হাত ধরেন। এরপর যখন তিনি মাসজিদ থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা করেন তখন আমি তাঁকে বললাম, আপনি কি বলেননি যে আমাকে কুরআনের অতি মহান সুরা শিক্ষা দিবেন? তিনি বলিলেন, الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি বিশ্ব জগতের প্রতিপালক, এটা বারবার পঠিত সাতটি আয়াত এবং মহান কুরআন যা কেবল আমাকেই দেয়া হয়েছে। [৪৬৪৭, ৪৭০৩, ৫০০৬] (আ.প্র. ৪১১৬, ই.ফা. ৪১১৯)

[১] সুরাতুল ফাতিহা জ্ঞান লাভের, হিদায়াত গ্রহণের জন্য প্রতিটি মানুষের নিজের পরিবারের, দেশ, জাতি তথা সারা বিশ্ববাসীর জন্য অতীব কল্যাণকর এক মহাসাগর। উক্ত কল্যাণের এই অথৈ পারাবার হইতে স্বীয় আগ্রহে তাড়িত হয়ে এক সার্বিক পথ নির্দেশনা গ্রহণ করার অবারিত ও উন্মুক্ত সুযোগ মানব জাতির জন্য উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে আছে। যে কারণে উক্ত সুরাখানি মহাপবিত্র কুরআনের ভূমিকা হিসেবে কুরআনের শুরুতেই সন্নিবেশ করা হয়েছে। সুতরাং এর গভীর ও তাত্ত্বিক আলোচনা করিতে গিয়ে তাফসীরকারগণ বলেছেনঃ মানবজাতির হিদায়াতের জন্য কেবল এই একটি মাত্র সুরাই যথেষ্ট, যদি সে নিরপেক্ষ অনাবিল মন মানসিকতা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। সুতরাং আবদুল্লাহ ইবনু আববাস (রাদি.) সহ অন্যান্য সহাবায়ি কিরাম (y) আলোচ্য সুরাটিকে আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠ দান ও অপূর্ব নিমাত হিসেবে আখ্যায়িত করিয়াছেন। সুরা ফাতিহা দুবার নাযিলকৃত সুরা বটে। প্রথমবার মাক্কাহ্য় ওয়াহী নাযিলের প্রাথমিক অবস্থায় এবং দ্বিতীয়বার রাসুলুল্লাহ সাঃআঃ-এর মদিনায় হিজরাতের পরবর্তী সময়ে নাযিল হয়। যথা সহীহ হাদীসভিত্তিক তাফসীরের গ্রন্থসমূহে সনদ সহকারে উপরোক্ত বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন তাফসীরে ফাতহুল ক্বাদীর ১ম খন্ড, ১৩-১৪ পৃষ্ঠায় আছেঃ

وكان ذلك قبل الهجرة واخرج ابو بكر بن الانباري في المصاحف عن عبادة قال : فاتحة الكتاب نزلت المكة فهذا جملة ما استدل به من قال انها نزلت بمكة : واستدل من قال انها نزلت بالمدينة بما اخرجه ابن أبي شيبة في المصنف وأبو سعيد ابن الْأعرابي في معجمه والطبراني في الْأوسط من طرق مجاهد عن أبي هريرة رن ابليس حين انزلت فاتحة الكتاب وانزلت بالمدينت واخرج ابن أبي شيبت في المصنف وعبد بن حميد وابن المنذر وأبو نعيم في الحليت وغيرهم من طرق عن مجاهد قال : نزلت فاتحت الكتاب بالمدينت وقيل إنها نزلت مرتين مرت بمكت ومرت بالمدينت جمعًا بين هذه الروايات

প্রকাশ থাকে যে, ইমাম ইবনু কাসীর তাহাঁর বিখ্যাত তাফসীর ইবনু কাসীর ১ম খন্ড, ৮ম পৃষ্ঠায়ও সুরা ফাতিহা দুবার নাযিল হওয়ার কথা সমর্থন করে ভিন্ন আসমাউর রিজাল সম্বলিত এক শক্তিশালী তথ্য উপস্থাপন করেছেনঃ

وهي مكية : قال ابن عباس (رض) وقتادة وأبو العالية وقيل مدنية قاله أبو هريرة (رض) ومجاهد وعطاء بن يسار والزهري ويقال نزلت مرتين : مرة بمكة ومرة بالمدينة والأول اشبه لقوله تعالى : وَلَقَدْ آتَيْنَكَ سَبْعًا مِنَ الْمَثَانِيْ والله تعالى اعلم منها

উল্লেখ্য, সুরায়ে ফাতিহা দু দুবার নাযিল হওয়ার কারণে সুরাখানির গুরুত্ব, মহত্ব, আবশ্যকতা ও প্রয়োজনীয়তা অন্যান্য সুরা হইতে এক স্বতন্ত্র মর্যাদা লাভ করেছে, যা খুব সহজেই অনুমেয় বটে। এতদ্ব্যতীত উক্ত সুরার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করিতে গিয়ে স্বয়ং নাবী সাঃআঃ বলেছেনঃ سورة ما انزل في التوراة ولا في الانجيل ولا في الفرقان مثلها

অর্থাৎ এটা এমন একটি সুরা যা তাওরাত, ইঞ্জিল ও ফুরকানেও নাযিল করা হয়নি। অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাঃআঃ-কেই বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন উক্ত সুরাখানি প্রদান করা হয়েছে। (ফাতহুল ক্বাদীর ১ম খন্ড, ১৫ পৃষ্ঠা)

এখানে একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, উক্ত সুরাখানির স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যের আর একটি দিক এই যে, আলোচ্য সুরাখানির গুরুত্ব মানব জীবনের সব দিকে এতই বেশী পরিব্যপ্ত যে, স্থান বিশেষ ব্যাখ্যায় সম্মানিত তাফসীরকারগণ আলোচ্য সুরাখানির প্রায় ৪২টি নাম দিয়েছেন। যে নামগুলো তাফসীর ইবনু কাসীর, ইবনু জারীর, রুহুল মায়ানী, তাফসীর কবীর, তাফসীর খাযিন, তাফসীরে ফাতহুল ক্বাদীর, তাফসীরে কুরতুবী সহ নির্ভরযোগ্য তাফসীরাতের কিতাবসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে এতদ সমূদয় হইতে মাত্র কয়েকটি নাম চয়ন করা হলো। যথাক্রমেঃ (১) سورة مفتاح القرآنকুরআনের কুঞ্জিকা, (২) سورة أم القرآن কুরআনের মা বা আসল, (৩) سورة الدعاء দুআর সুরা, (৪) سورة الشفاءরোগ মুক্তির সুরা, (৫) سورة الحمد প্রশংসার সুরা, (৬) أساس القرآن কুরআনের ভিত্তি, (৭) سورة الرحمة রাহমাতের সুরা, (৮) سورة البركة বারকাতের সুরা, (৯) سورة النعمة নিআমাতের সুরা, (১০) سورة العبادة ইবাদাতের সুরা, (১১) سورة الهداية হিদায়াত প্রাপ্তির সুরা, (১২) سورة الإسةقامة দৃঢ়তার সুরা, (১৩) سورة الإسةعانة সাহায্য প্রার্থনার সুরা, (১৪) سورة الكافية অত্যধিক ও বিপুলতা দানকারী সুরা, (১৫) سورة الوافية পূর্ণত্ব প্রাপ্ত সুরা, (১৬) سورة الكنـز খণির সুরা (জ্ঞানের খনি, রাহমাত, বারাকাত, নিআমাত ও যাবতীয় সাফল্যের খণি বলে এ সুরাকে আখ্যায়িত করা হয়েছে), (১৭) سورة الشكر শুকর করার সুরা বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুরা (১৮) سورة الصبر সবরের উৎসাহ দানকারী সুরা, (১৯) سورة التكرار বার বার পঠিতব্য সুরা, (২০) سورة التعلق مع الله আল্লাহর সাথে বান্দার গভীর সম্পর্ক স্থাপনের সুরা, (২১) سورة الصراط المستقيم সরল সঠিক পথ লাভের সুরা, (২২) سورة الربوبية প্রভুত্ব সনাক্ত করণের সুরা, (২৩) سورة الوحدانية আল্লাহ তাআলার একত্ববাদের প্রতি স্বীকৃতি প্রকাশের সুরা, (২৪) سورة الاجةناب الغضب والضلالة আল্লাহর গযব ও গোমরাহী হইতে আত্মরক্ষা করার সুরা, (২৫) سورة الصلاة সলাতে একান্তই পঠিতব্য সুরা।

উল্লেখ্য, সর্বশেষ নামকরণ সলাত আদায়ে একান্তই পঠিতব্য সুরা নামকরণ থেকেও মনে হয়, উক্ত সুরা পাঠ ব্যতীত সলাত পূর্ণ হয় না। ইমাম মুক্তাদী সকলের জন্যই উক্ত সুরা পাঠ করা ওয়াজিব বটে। এ বিষয়ে চার মাযহাবের নিকট গ্রহণযোগ্য তাফসীরের কিতাব ইবনু কাসীর ১ম খন্ড ১১ পৃষ্ঠার যা বিবৃত হয়েছে তা সত্যিই প্রণিধানযোগ্য।

هل ةجب قرأة الفاةحة على المأموم ؟ فيه ثلاثة أقوال للعلماء أحدها أنه ةجب عليه قرأةها كما ةجب على امامه لعموم الْأحاديث المةقدمة-

প্রকাশ থাকে যে, উলামায়ে কিরামদের ৩টি قول এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী গ্রহণযোগ্য ও শক্তিশালী (أرجح)সিদ্ধান্ত যা তা-ই প্রথম সিদ্ধান্ত বলে ইবনু কাসীর (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) স্বীয় তাফসীরে উদ্ধৃত করিয়াছেন। অতঃপর দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। যেমন বলা হয়েছে,

والثاني لا تجب على المأموم قرأة بالكلية للفاتحة ولا غيرها ولا في صلاة الجهرية ولا في صلاة السرية لـما رواه الإمام أحمد بن حنبل (رح) في سنده عن جابر بن عبد الله عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال من كان له إمام فقرأة الإمام له قرأة ولكن في اسناده ضعيف ورواه مالك (رح) عن وهب ابن كسان عن جابر من كلامه وقد رواي هذا الحديث من طرق ولا يصح منها شيء عن النبي صلى الله عليه وسلم

অর্থাৎ দ্বিতীয় এই যে, সুরায়ে ফাতিহার পাঠ মুক্তাদীর উপর ওয়াজিব হইবে না বা অন্য কিছু পাঠ করাও ওয়াজিব হইবে না, তা জাহরী (প্রকাশ্য) ক্বিরাআতেই হোক, বা গোপন (سري) ক্বিরাআতেই হোক, যা আহমাদ বিন হাম্বল (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) স্বীয় কিতাব মুসনাদে আহমাদে রিওয়ায়াতে করিয়াছেন জাবির বিন আবদুল্লাহ হইতে, আর তিনি রাসুল সাঃআঃ হইতে। তিনি বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ইমামের ইক্তিদায় আছে, ইমামের ক্বিরাআতই তার ক্বিরাআত বলে গণ্য হইবে। এখানে ইমাম ইবনু কাসীর (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেছেন, উক্ত রিওয়ায়াতের সনদ যঈফ। ইমাম মালিক (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) উক্ত হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য করিতে গিয়ে উল্লেখ করেন যে, জাবির (রাদি.) উক্ত বাক্য দ্বারা নিজের মত পোষণ করিয়াছেন, এ বাক্যটি রাসুল সাঃআঃ-এর বাণী বা নির্দেশ এ কথা মোটেই সহীহ নয়।

والثالث أنه ةجب القرأة على الـماموم في السرية لـما ةقدم ولايحب ذلك في الجهرية-

তৃতীয় মত এই যে, সিররী (চুপি চুপি) সলাতে ফাতিহা পড়া ওয়াজিব হইবে, প্রকাশ্য সলাতে ওয়াজিব হইবে না।

সুরায়ে ফাতিহার বিষয়ে নিম্নোক্ত হাদীসটি আমাদের যাবতীয় তর্কের মীগোশতা করে দিয়েছে যা আবু দাউদ, নাসায়ী, তিরমিযীর ক্বিরাআত অধ্যায়ে নির্ভরযোগ্য রিওয়ায়াতে দেখা যায় যে, রাসুল সাঃআঃ একদিন ফাজ্রের সলাতের ক্বিরাআত আদায় করছেন, পেছনে সহাবায়ে কিরামদের অনেকেই রাসুল সাঃআঃ-এর সহিত সমস্ত ক্বিরাআত পাঠ করছিলেন। অতঃপর সলাত শেষে রাসুল সাঃআঃ বললেনঃ لا تفعلو إلَّا بأم القرأن فإنه لا صلاة لـمن لـم يقرأبها-

তোমরা সুরায়ে ফাতিহা ব্যতীত আর কোন সুরা পড়বে না। কেননা যে তা পড়ে না তার সলাত হয় না। এখানে ফাজরের ক্বিরাআত উচ্চ আওয়াজে পড়া হয়েছিল, এখানে নাবী সাঃআঃ থেকে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত পাওয়া গেল। নাবী সাঃআঃ সহাবায়ে কিরাম, অতঃপর ইমাম হাসান বাসরী, ইমাম জুহরী, ইমাম আওজাঈ, ইমাম ইবরাহীম নাখঈ, ইমাম মালিক, ইমাম আবদুল্লাহ বিন আল মুবারক, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিযী, ইমাম নাসায়ী, ইবনু হাজার আসক্বালানী, হাফিয আস সাখাবী, ইমাম শাফিঈ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি), ইমাম নাবাবী, ইমাম শওকানী, হাফিয ইবনু কাসীর, ইমাম গাযযালী, বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহিমাহুমুল্লাহ আজমাঈন) প্রমুখাত মনীষী সহ হিজাজ, নজদ, আসির, ইয়ামান, সিরিয়া, মিশর, মরক্কো, আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মাক্কাহ ও মাদীনাহর লক্ষ লক্ষ উলামায়ে কিরাম শতাব্দীর পর শতাব্দী এমন কি আজ পর্যন্ত ইমামের পিছনে সর্বাবস্থায় সুরা ফাতিহা পাঠ করে এসেছেন এবং বর্তমানেও পাঠ করে থাকেন, উপরে যেসব মনীষীদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের বদৌলতেই রাসুল সাঃআঃ-এর হাদীসশাস্ত্র, পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে অদ্যাবধি টিকে আছে। তাঁদের প্রত্যেকেই ইমাম মুক্তাদী উভয়ের জন্য সুরা ফাতিহা পাঠ অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন, তাই আমরাও অবশ্য পঠিতব্য বলে মনে করছি। ইমামের পিছনে ফাতিহা পাঠকারীদেরকে যদি গোমরাহ মনে করা হয়, তবে নাউযুবিল্লাহ, উল্লেখিত ইসলামের মহামনীষীদেরকেও তো এই দৃষ্টিতে তারা প্রকারান্তরে গোমরাহ বলেই মনে করছে। তাঁদের রিওয়ায়াতকে অমান্য করে, উক্ত রিওয়ায়াত পালনকারীদের বিভ্রান্ত ও গোমরাহ বলেই মনে করে কেবল উক্ত মনীষীদের নামের শেষে (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলে ভক্তি জাহির করা কি স্ববিরোধিতা নয়? অন্য কারো ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা, ইজতিহাদ মানতে গিয়ে যেন রাসুল সাঃআঃ-কে এবং তাহাঁর রেখে যাওয়া সহীহ হাদীসকে অগ্রাহ্য করা না হয়, সে দিকে আমাদের সকলের যত্নবান হওয়া আবশ্যক।

৬৫/১/২. অধ্যায়ঃ যারা ক্রোধে পতিত নয়।

৪৪৭৫

আবু হুরাইরাহ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেন, যখন ইমাম বলবে غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ তখন তোমরা বলবে آمِينَ আল্লাহ আপনি কবূল করুন। যার পড়া মালায়িকাদের পড়ার সময় হইবে, তার আগের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হইবে। [৭৮২] (আ.প্র. ৪১১৭, ই.ফা. ৪১২০)

[১] সলাতের ভেতরে, সলাতের বাইরে যে কোন অবস্থায় সুরা ফাতিহা শেষ করে آمِيْنَ বলিতে হইবে। নাবী সাঃআঃ ও তদীয় সহাবায়ে কিরাম (রাদি.) وَلَا الضَّالِّيْنَ বলার পরে آمِيْنَ বলিতেন। ফাতিহা চুপে চুপে পড়লে আ-মীনও চুপে চুপে বলিতেন। আর উক্ত সুরাটি যখন তাঁরা জোরে জোরে ও সশব্দে পাঠ করিতেন, তখন আ-মীনও সশব্দে পাঠ করিতেন, তা সলাত আদায়কালীন সময় হোক, কি সলাতের বাইরে। উক্ত পদ্ধতি নাবী সাঃআঃ হইতে পরবর্তী কালের তাবিঈনদের যুগ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে ইসলামের ফিক্বহ শাস্ত্রবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হওয়ার কারণে তাদের একদল সলাত আদায়কালে সশব্দে আ-মীন বলাকে অপছন্দ করিতেন এবং অপর জামাআত উচ্চ আওয়াজে আ-মীন বলাকেই সহীহ হাদীসের সঠিক অনুশীলন বলে মনে করে থাকেন। এখন পর্যালোচনা করে দেখা দরকার যে, উপরোক্ত দুটি নিয়মের কোনটি সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে বেশী গ্রহণযোগ্য। যেহেতু কিতাবুত তাফসীর অধ্যায় আলোচনা করা যাচ্ছে বিধায় চার মাযহাবের নিকট বেশী গ্রহণযোগ্য তাফসীরের কিতাব ইবনু কাসীরের উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। তাফসীরে ইবনু কাসীর ১ম খন্ড, ২৭ পৃষ্ঠায় আছে-

والدليل على استحباب التأمين ما رواه الإمام أحمد وأبو داود والترمذي عن وائل بن حجر قال: سمعت النبي صلى الله عليه وسلم قرأ “غير المغضوب عليهم ولا الضالين” فقال “آمين” مد بها صوته ولأبي داود رفع بها صوته وقال الترمذي هذا حديث حسن ورُوي عن علي وابن مسعود وغيرهم. وعن أبي هريرة قال: كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا تلا “غير المغضوب عليهم ولا الضالين” قال “آمين” حتى يسمع من يليه من الصف الْأول رواه أبو داود وابن ماجه وزاد فيه: فيرتج بها المسجد. والدارقطني وقال: هذا إسناد حسن.

অর্থাৎ সুরায়ে ফাতিহার শেষে উচ্চ আওয়াজে আ-মীন বলা মুস্তাহাব- এ কথার দলীল এই যে, এ বিষয়ে মহামতি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, আবু দাউদ, তিরমিযী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) ওয়ায়িল বিন হুজর থেকে রিওয়ায়াত করিয়াছেন। তিনি রাসুল সাঃআঃ থেকে বর্ণনা করেন যে, আমি নাবী সাঃআঃ-এর নিকট শুনিয়াছি, যখন তিনি غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّيْنَ পর্যন্ত পাঠ করিলেন, তখন বলিলেন, আ-মীন ও স্বীয় আওয়াজকে বাড়িয়ে দিলেন (সশব্দে) এবং ইমাম আবু দাউদ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, রাসুল সাঃআঃ স্বীয় আওয়াজকে উচ্চ করেই আ-মীন বলেছিলেন। ইমাম তিরমিযী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, উক্ত হাদীসটি হাসান বটে। অতঃপর একই বিষয়ে একই রকম বর্ণনা করিয়াছেন ইবনু মাসঊদ ও আলী (রাদি.) এবং আবু হুরাইরাহ (রাদি.) বলেন যে, আল্লাহর রাসুল সাঃআঃ যখন غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّيْنَ বলিতেন, তখন আ-মীন বলিতেন, যা এক কাতার পেছন থেকে শোনা যেত। আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ একটু বাড়িয়ে বর্ণনা করিয়াছেন যে, নাবী সাঃআঃ ও তদীয় সহাবায়ে কিরামদের আ-মীন বলার কারণে মাসজিদ কেঁপে উঠত। দারাকুতনী বলেন, এ হাদীসের সনদও হাসান পর্যায়েভুক্ত বটে। উল্লেখ্য, উক্ত সহীহুল বুখারীর ১ম খন্ডে কিতাবুস সলাত-এর মধ্যে ইমাম বুখারী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) সহীহ সনদের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেনঃ إذا أمن الإمام فأمنوا

ইমাম যখন আ-মীন বলবে, তোমরা তখন আ-মীন বল। ইমাম যদি চুপে চুপে আ-মীন বলে তাহলে মুক্তাদীরা কীভাবে আ-মীন বলবে? সুতরাং فأمنوا শব্দটিকে ব্যাখ্যা করলেই দেখা যাচ্ছে যে, আ-মীন সশব্দেই বলিতে হইবে। অন্যথায় ইমাম যখন বলবে তখন মুক্তাদীদের আ-মীন বলা সম্ভব হইবে না। বিস্তারিত জানার জন্য বুখারীর ১ম খন্ডের সলাত অধ্যায়ের টীকাটি পড়ে দেখুন। সহীহ হাদীস অনুযায়ী সলাত আদায় করলে মানুষ যদি গোমরাহ-বিভ্রান্ত হয়, তাহলে নাবী সাঃআঃ ছাড়া অন্য লোকদের মনগড়া ব্যাখ্যা মত আমাল করলে হিদায়াত পাওয়া কী করে সম্ভব?


Posted

in

by

Comments

Leave a Reply