সূরা আন নূর এর তাফসীর । তাফসিরুল কুরআন
সূরা আন নূর এর তাফসীর । তাফসিরুল কুরআন >> তিরমিজি শরিফের তাফসিরুল কোরআন অধ্যায়ের অন্যান্য সুরার তাফসীর পড়ুন >> সুরা নুর আরবি তে পড়ুন বাংলা অনুবাদ সহ
অধ্যায়ঃ ৪৪, অনুচ্ছেদ-২৫ঃ সূরা আন নূর এর তাফসীর
৩১৭৭. আমর ইবনি শুআইব [রঃ]হইতে পর্যায়ক্রমে তার বাবার ও তার দাদা হইতে বর্ণীতঃ
মারসাদ ইবনি আবী মারসাদ নামক এক লোক যুদ্ধবন্দীদেরকে মক্কা হইতে মদিনায় নিয়ে যেতেন। বর্ণনাকারী বলেন, আনাক্ব নামে মক্কার এক দুশ্চরিত্রা নারী এই মারসাদের প্রেমিকা ছিল। সে [আবু মারসাদ] মক্কার এক বন্দি কে কথা দিয়েছিল যে, সে তাকে মদিনায় নিয়ে যাবে। মারসাদ বলেন, আমি এই উদ্দেশে রওনা হয়ে এক পূর্ণিমা রাতে মক্কার এক প্রাচীরের ছায়ায় পৌঁছলাম। আনাক্ব ও এলো। সে প্রাচীর গাত্রে আমার কাল ছায়া দেখিতে পেলো। সে আমার নিকট পৌঁছে আমাকে চিনে ফেলল। সে প্রশ্ন করলোঃ মারসাদ নাকি? আমি বললাম, মারসাদ। সে আমাকে অভ্যর্থনা জানায় এবং বলে, এসো এ রাতটা আমার সাথে কাটাও। আমি বললাম, হে আনাক্ব! আল্লাহ্ তাআলা যিনা হারাম করে দিয়েছেন। সে [নিজেদের তাবুতে ফিরে গিয়ে]বলল, হে তাবুর অধিবাসীরা! এই ব্যক্তি তোমাদের বন্দীদের নিয়ে যাচ্ছে। এ কথা শোনা মাত্র আটজন আমার পিছু নিলো। আমি চলতে চলতে খানদামা পাহাড়ে গিয়ে একটি গুহা পেয়ে তাতে ঢুকে পড়লাম। লোকগুলিও আমার পিছে পিছে আসলো। তারা গুহাটিকে খালি মনে করে আমার মাথায় পেশাব করে দিলো। তাহাদের পেশাব আমার মাথায় এসে পড়লো। আল্লাহ্ তাআলা এই লোকগুলিকে আমাকে দেখার ব্যাপারে অন্ধ করে দিলেন [তারা আমাকে দেখিতে পেলো না]। তারা ফিরে গেলো, আমিও যাকে আনতে গিয়েছিলাম তার নিকট ফিরে এলাম। আমি তাকে তুলে নিলাম। তার দেহের ওজন খুব বেশি ছিল। আমি তাকে নিয়ে ইযখির নামক স্থানে পৌঁছে তার জিঞ্জীর খুলে দিলাম। আমি তাকে পিঠে তুলে নিলাম। তাকে বহন করা আমার জন্য কষ্টদায়ক হয়ে পড়ল। অবশেষে আমি মদিনায় পৌঁছে রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] এর নিকট এসে বললাম, হে আল্লাহ্র রাসুল! আনাক্বকে আমি বিয়ে করিতে পারি? রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] নীরব থাকলেন এবং আমার কথার কোন উত্তর দিলেন না। অবশেষে এই আয়াত অবতীর্ণ হলঃ “যিনাকারী পুরুষ যিনাকারিনী নারী বা মুশরিক নারীকেই কে বিবাহ করিবে, আর যিনাকারিনী নারীকে শুধু যিনাকারী অথবা মুশরিক পুরুষরাই বিবাহ করিবে আর মুমিনদের জন্য তা হারাম করা হয়েছে”- [সূরা আন-নূর ৩]। রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] বললেনঃ হে মারসাদ, ব্যাভিচারী পুরুষ শুধু ব্যাভিচারী নারীকে বা মুশরিক নারীকেই বিয়ে করিবে। আর ব্যাভিচারিনীকে শুধু ব্যাভিচারী পুরুষ অথবা মুশরিক লোকই বিবাহ করিবে। অতএব তুমি তাকে বিয়ে করোনা।
সনদ হাসান। আবু ঈসা বলেন, এ হাদিসটি হাসান গারীব। শুধু উল্লেখিত সনদেই আমরা হাদিসটি জেনেছি। সূরা আন নূর এর তাফসীর – এই হাদিসটির তাহকিকঃ হাসান হাদিস
৩১৭৮. সাঈদ ইবনি জুবাইর [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, মুসআব ইবনিয যুবাইরের শাসনামলে আমাকে লিআনকারী দম্পতি প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলঃ তাহাদের কে পৃথক করে দিতে হইবে কিনা? আমি এর কি উত্তর দিবো তা বুঝতে পারছিলাম না। আমি আমার ঘর হইতে উঠে আবদুল্লাহ ইবনি উমার [রাদি.] এর ঘরের দিকে রওনা হলাম। আমি তার নিকট প্রবেশ করার অনুমতি চাইলাম। আমাকে বলা হল, তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। তিনি আমার আওয়াজ শুনতে পেয়ে বলিলেন, ইবনি জুবাইর! ভিতরে এসো। নিশ্চয়ই তুমি কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে এসেছ। তিনি বলেন, আমি ভিতরে ঢুকলাম। তিনি তার হাওদার চাটাই বিছিয়ে উহার উপর শুয়ে ছিলেন। আমি বললাম, হে আবু আব্দুর রহমান! লিআনকারী স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শেষ করে দিতে হইবে কি? তিনি বলিলেন, সুবহানআল্লাহ! হ্যাঁ। অমুকের ছেলে অমুকই প্রথম এই প্রশ্ন করেছিল। সে নাবী [সাঃআঃ] এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহ্র রাসুল! আপনার কি মত, যদি আমাদের কোন লোক তার স্ত্রী কে অশ্লীল কাজে [ব্যাভিচার] লিপ্ত দেখে তখন সে কি করিবে? সে যদি মুখে তা বলে, তবে সে একটা মারাত্মক বিষয়ে [যিনার অপবাদে] মুখ খুলল। আর যদি সে চুপ থাকে তাহলেও সে একটা চরম গর্হিত বিষয়ে মুখ বন্ধ রাখলো। বর্ণনাকারী বলেন, রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] চুপ থাকলেন এবং তাকে কিছুই বলিলেন না। লোকটি আবার নাবী [সাঃআঃ] এর নিকট এসে বলল, ইতোপূর্বে যে বিষয়ে আপনার নিকট জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখন আমি নিজেই সে পরীক্ষার সম্মুক্ষীন হয়েছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তাআলা সূরা আন-নূর এর আয়াত অবতীর্ণ করেন। [অনুবাদ]ঃ “আর যারা নিজেদের স্ত্রীর বিরুদ্ধে যিনার অভিযোগ উত্থাপন করে, অথচ তাহাদের দলে তারা নিজেরা ব্যতিত আর কোন প্রমান নেই, তাহাদের প্রত্যেক এর কথা হইবে যে, সে চারবার আল্লাহ্ তাআলার নামে শপথ করে বলবে, সে যদি মিথ্যাবাদী হয় তবে তার উপর আল্লাহ্ তাআলার আযাব পতিত হোক”। [সূরা আন-নূর ৬-৭]। তিনি আয়াতের শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত করিলেন। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি লোকটিকে ডেকে এই আয়াত গুলো পড়ে শুনান। তাকে ওয়াজ-নসিহত করে বুঝান এবং তাকে আরও অবহিত করেন যে, আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার শাস্তি অনেক হাল্কা ও সহজ। সে বলল, না, সেই সত্তার শপথ যিনি আপনাকে সত্য দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন! আমি তার ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ আনিনি। তারপর তিনি স্ত্রীলোকটিকে ডাকেন, তাকে ওয়াজ-নসিহত করে বুঝান এবং তাকে আরও অবহিত করেন যে, আখিরাতের কষ্টের তুলনায় দুনিয়ার কষ্ট খুবই হালকা। স্ত্রীলোকটি বলল, না, সেই সত্তার শপথ যিনি আপনাকে সত্য দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন! সে সত্য কথা বলেনি। তারপর তিনি পুরুষ লোকটিকে ডাকলেন। সে আল্লাহ্ তাআলার নামে শপথ করে চারবার সাক্ষ্য দিলো যে, সে সত্যবাদিদের অন্তর্ভুক্ত এবং পঞ্চম বারে বলল, সে যদি মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে তার উপর আল্লাহ্ তাআলার অভিশাপ পতিত হোক। তিনি স্ত্রীলোকটিকেও এভাবে শপথ করান। সে আল্লাহ্ তাআলার নামে শপথ করে চারবার বলল, সে [স্বামী] যদি সত্যবাদিদের অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে তার [স্ত্রীর] উপর আল্লাহ্ তাআলার গজব পতিত হোক। তারপর তিনি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক শেষ করে দিলেন।
সহীহঃ মুসলিম [২০৬, ২০৭] এ অনুচ্ছেদে সাহল ইবনি সাদ [রাদি.] হইতেও হাদীস বর্ণিত আছে। আবু ঈসা বলেন, এ হাদিসটি হাসান সহীহ। সূরা আন নূর এর তাফসীর – এই হাদিসটির তাহকিকঃ সহীহ হাদিস
৩১৭৯. ইবনি আব্বাস [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, হিলাল ইবনে উমাইয়াহ [রাদি.] নাবী [সাঃআঃ] এর নিকট ইবনি সাহমার সাথে তার স্ত্রীর যিনার অভিযোগ দায়ের করেন। রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] বলিলেন, প্রমান হাজির কর, অন্যথায় তোমার পিঠে চাবুক পড়বে। বর্ণনাকারী বলেনঃ হিলাল [রাদি.] বলিলেন, হে আল্লাহ্র রাসুল! আমাদের মাঝে কেউ যদি তার স্ত্রীর সাথে কোন পুরুষ লোককে গর্হিত কাজে লিপ্ত দেখে তখন সে কি সাক্ষী খুঁজে বেড়াবে? রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] বলিতে থাকেন, প্রমান দাও, অন্যথায় তোমার পিঠে শাস্তির চাবুক পড়বে। বর্ণনাকারী বলেন, হিলাল [রাদি.] বলিলেন, সেই সত্তার কসম যিনি আপনাকে সত্য দ্বীন সহ পাঠিয়েছেন! অবশ্যই আমি সত্যবাদী। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার বিষয়ে ওয়াহী অবতীর্ণ হইবে যা আমার পিঠ কে কষ্ট থেকে রেহাই দিবে। অতঃপর অবতীর্ণ হল- “আর যারা নিজেদের স্ত্রীর বিরুদ্ধে যিনার অভিযোগ উত্থাপন করে, অথচ তাহাদের দলে তারা নিজেরা ব্যতিত আর কোন সাক্ষী নেই, তাহাদের প্রত্যেকের সাক্ষ্য এই হইবে যে, সে চারবার আল্লাহ্ তাআলার নামে কসম করে সাক্ষ্য দিবে যে, সে [তার আনীত অভিযোগ] অবশ্যই সত্যবাদী এবং পঞ্চম বারে বলবে, সে মিথ্যাবাদী হলে তার উপর আল্লাহ্ তাআলার অভিসম্পাত হোক। আর স্ত্রীলোকটির কষ্ট রহিত হইবে যদি সে চারবার আল্লাহ্ তাআলার নামে কসম করে সাক্ষ্য দেয় যে, এ লোক [তার উত্থাপিত অভিযোগ] মিথ্যাবাদী। পঞ্চম বারে বলবে, সে [অভিযোগকারী স্বামী] সত্যবাদী হলে তার [স্ত্রীর] উপর আল্লাহ্ তাআলার গযব পতিত হোক”- [সূরা- আন নূর ৬-৯]। বর্ণনাকারী বলেন, রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] অবসর হয়ে তাহাদের [স্বামী-স্ত্রী] উভয় কে ডেকে পাঠান। তাহাদেরর উভয়ে হাজির হলে হিলাল [রাদি.] দাঁড়িয়ে সাক্ষী দিলেন। এ সময় রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] বলিতে থাকেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ্ অবগত আছেন যে তোমাদের একজন মিথ্যাবাদী, তোমাদের মধ্যে কে তওবা করিতে প্রস্তুত? তারপর মেয়ে লোকটি দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিলো। সে যখন পঞ্চম বারে বলিতে যাচ্ছিল যে, সে [স্বামী] যদি সত্যবাদী হয় তাহলে তার [স্ত্রীর] উপর আল্লাহ্র গজব নিপতিত হোক, তখন লোকেরা তাকে বলল, এ কথা [শাস্তিকে] অবশ্যম্ভাবী করে তুলবে। ইবনি আব্বাস [রাদি.] বলেন, এ কথা শুনে সে থেমে গেলো এবং পিছনে সরে আসলো। আমরা ধারনা করলাম যে সে তার কথা থেকে ফিরে আসবে। অতঃপর মেয়েলোকটি বলল, আমি চিরকালের জন্য আমার গোত্রে কালিমা লেপন করিতে পারিনা। রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] বলিলেন, তোমরা এই মেয়েলোকটির উপর নজর রেখো। সে যদি কাজল বর্ণের চোখ, প্রশস্ত নিতম্ব ও পায়ের মাংস গোছাযুক্ত সন্তান প্রসব করে তবে সে সন্তান ইবনি সাহমারই। পরবর্তীতে মহিলাটি ঐরূপ সন্তানই প্রসব করলে রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] বলেনঃ যদি আগেই আল্লাহ্ তাআলার হুকুম [লিআনের বিধান] না এসে যেত, তাহলে আমাদের এবং তার মধ্যে একটা বিরাট কিছু ঘটে যেত [তাকে শাস্তি দেওয়া হতো]।
সহীহঃ ইবনি মাজাহ, [২০৬৭] বোখারি [৪৭৪৭]। আবু ঈসা বলেন, হিশাম ইবনি হাসসানের বর্ণনা হিসেবে হাদিসটি হাসান গারীব। আব্বাদ ইবনি মানসূর-ইকরিমাহ হইতে, তিনি ইবনি আব্বাস [রাদি.] হইতে, তিনি নাবী [সাঃআঃ] হইতে এই সনদে পূর্বোক্ত হাদীসের একই রকম বর্ণনা করিয়াছেন। আইয়ুব এ হাদীস ইকরিমার সনদে মুরসাল হিসেবে বর্ণনা করিয়াছেন এবং তাতে ইবনি আব্বাসের উল্লেখ করেননি । এই হাদিসটির তাহকিকঃ সহীহ হাদিস
৩১৮০. আয়িশাহ [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, যখন আমার বিষয়ে চর্চা হচ্ছিল যে বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না, তখন রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] আমার প্রসঙ্গে বক্তব্য দিতে দাঁড়ালেন। তিনি তাশাহহূদ পড়ে আল্লাহ্ তাআলার যথোপযুক্ত সুনাম ও গুনাগুন করার পর বলেনঃ তারপর তোমরা আমাকে ওইসব ব্যক্তির বিষয়ে বুদ্ধি দাও, যারা আমার সহধর্মিণীর ব্যাপারে অপবাদ দিয়েছে। আল্লাহ্র কসম! আমি আমার পরিবারের [স্ত্রীর] মধ্যে কখনো কোন দোষ দেখিনি। এসব ব্যাক্তি যার ব্যাপারে বদনাম রটিয়ে বেড়াচ্ছে, আল্লাহ্র কসম আমি এ ধরনের দুষ্কর্ম তার মধ্যে কখনও দেখিনি। সে [সাফওয়ান] আমার অনুপস্থিতিতে কখনও আমার ঘরে ঢুকেনি, আমি যখন উপস্থিত থাকতাম তখনই সে আমার ঘরে ঢুকত। আমি যখন সফরের কারনে ঘরে অনুপস্থিত থাকতাম তখন সেও আমার সঙ্গেই থাকতো।
সাদ ইবনি মুআয [রাদি.] উঠে দাঁড়িয়ে বলিলেন, হে আল্লাহ্র রাসুল! আমাকে অনুমতি দিন, আমি এদের ঘাড় উড়িয়ে দেই। তখন খাযরাজ বংশের এক লোক উঠে দাঁড়ালো। হাসসান ইবনি সাবিতের মা এই বংশের সন্তান। লোকটি বলল তুমি মিথ্যাবাদী। আল্লাহ্র কসম, এরা যদি আওস গোত্রের লোক হত, তাহলে তুমি তাহাদের ঘাড় উড়িয়ে দেওয়া কখনও পছন্দ করিতে না। তর্ক-বিতর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেলো যে, আওস ও খাজরায বংশদ্বয়ের মধ্যে মসজিদের ভেতরেই মারামারি লেগে যাওয়ার উপক্রম হল। অথচ এ [অপবাদ] বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। ওইদিন সন্ধারাতে আমি প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বাইরে গেলাম। আমার সাথে মিসতাহর মাও ছিল। সে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে বলল, মিসতাহ শেষ হোক। আমি বললাম, হে! তুমি মা হয়ে ছেলের অমঙ্গল কামনা করছো? সে চুপ হয়ে গেলো। সে আবার হোঁচট খেলো এবং বলল, মিসতাহ শেষ হোক। আমি তাকে তিরস্কার করে বললাম, হে! তুমি কেমন মা, নিজের ছেলের অমঙ্গল ডাকছ? সে চুপ হয়ে গেলো। সে তৃতীয় বার হোঁচট খেলো এবং বলল, মিসতাহর সর্বনাশ হোক। আমি তাকে কঠোরভাবে বললাম, তুমি কেমন মা, নিজের ছেলের অমঙ্গল চাচ্ছ? সে বলল, আল্লাহ্র কসম আমি তোমার জন্যই তাকে গালমন্দ করছি। আমি প্রশ্ন করলাম আমার জন্য কিভাবে? আয়িশাহ [রাদি.] বলেন, সে আমার নিকট সমস্ত ব্যাপার বর্ণনা করলো। আমি [তা শুনে] বললাম, এইসব কথা রটেছে নাকি? সে বলল হ্যাঁ। আয়িশাহ [রাদি.] বলেন, আমি বাড়ি ফিরে আসলাম। আল্লাহর কসম! আমার এমন অবস্থা হল যে, যে জন্য এসেছিলাম সে প্রয়োজনের কথা ভুলেই গেলাম। আমার গায়ে জ্বর এসে গেলো। আমি রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] কে বললাম, আমাকে আমার বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দিন। তিনি আমার সাথে একটি বালককে দিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। আমি ঘরে ঢুকে উম্মু রুমানকে [মাকে] ঘরের নিচের অংশে দেখিতে পেলাম। আর আবু বকর [রাদি.] ঘরের উপরি তলে কুরআন পড়ছিলেন। মা প্রশ্ন করিলেন, কন্যা তুমি কেন এসেছো? আয়িশাহ [রাদি.] বলেন, আমি মাকে সম্পূর্ণ বিষয়টি খুলে বললাম। কিন্তু আমি যেভাবে ভেঙ্গে পড়েছি তিনি ততটা ভারাক্রান্ত নন। তিনি বলিলেন, “কন্যা! ব্যাপারটাকে হাল্কা ভাবে নাও। আল্লাহর কসম! কোন পুরুষের সুন্দরী স্ত্রী থাকলে, সে তাহাঁর প্রিয়পাত্রী হলে এবং তাহাঁর সতীন থাকলে তারা তাহাঁর সাথে হিংসা করিবে না, তার বিষয়ে কিছু রটাবে না এরুপ কমই হয়ে থাকে।
মোটকথা আমি যতটা দুঃখ পেলাম মা ততটা পেলেন না। আমি মাকে প্রশ্ন করলাম, আব্বাও কি ব্যাপারটা জানেন? তিনি বলিলেন, হ্যাঁ। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] ও কি? তিনি বলিলেন, হ্যাঁ। আমি ভারাক্রান্ত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আবু বকর [রাদি.] আমার কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি ঘরের উপরিতলে কুরআন পাঠ করছিলেন। তিনি নেমে এসে মাকে বলিলেন, ওর কি হয়েছে? মা বলিলেন, ওর বিষয়ে যে সব মিথ্যা বলা হচ্ছে, এ সংবাদ সে শুনে ফেলেছে। এ কথা শুনে বাবার দু চোখে পানি এলো। তিনি বলিলেন, কন্যা! তোমাকে আল্লাহ তাআলার নামে কসম করে বলছি, তুমি তোমার ঘরে ফিরে যাও। আমি ঘরে ফিরে এলাম।
রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] আমার ঘরে এসে আমার কাজের মেয়েকে আমার বিষয়ে প্রশ্ন করিলেন। সে বলল, আল্লাহর কসম! আমি তার মধ্যে কোন দোষ দেখিনি। তবে এতটুকু যে, সে ঘুমিয়ে পড়ত, আর বকরি এসে তার পেষা আটা খেয়ে যেত। তাহাঁর কিছু সাহাবী মেয়েটিকে ধমক দিয়ে বলিলেন, রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] এর নিকট সত্য কথা বল। তারা তাকে অনেক দাবালেন ও ধমকালেন। সে বলল, সুবহানআল্লাহ! আল্লাহর কসম! আমি তাহাঁর ব্যাপারে তাই জানি স্বর্ণকার খাঁটি রঙ্গিন সোনা প্রসঙ্গে যা জানে। যে ব্যক্তিকে এই অপবাদের সাথে জড়ান হয়েছিল তাহাঁর কানেও এ খবর পৌঁছল। সে বলল, সুবহানআল্লাহ! আল্লাহ্র কসম! আমি কখনও কোন নারীর সতর খুলিনি। আয়িশাহ [রাদি.] বলেন, সে আল্লাহ্ তাআলার রাস্তায় শহীদ হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে।
তিনি বলেন, আমার পিতা মাতা খুব ভোরে আমার নিকট এলেন। তারা আমার নিকট থাকতেই রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] আসরের নামাজ আদায় করে আমার ঘরে এলেন। আমার পিতা মাতা আমার ডান দিক বাঁ দিক হইতে আমাকে ঘিরে বসেছিলেন। রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] কালিমা শাহাদাত পাঠ করিলেন, আল্লাহ্ তাআলার যথোপযুক্ত সম্মান ও গুনাগুন করিলেন, তারপর বললেনঃ হে আয়িশাহ, তুমি যদি কোন মন্দ কাজ করে থাকো অথবা নিজের উপর জুলুম করে থাকো, তবে আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা চাও। কেননা আল্লাহ্ তাআলা তাহাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন। আয়িশাহ [রাদি.] বলেন, এ সময় আনসার বংশের একজন স্ত্রীলোক আসে। সে দরজার নিকট বসে ছিল। আমি বললাম, আপনি কি এ মহিলাটির সামনে এ কথা বলিতে লজ্জা বোধ করছেন না? মোটকথা রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] ওয়াজ-নসীহত করিলেন। আমি আমার পিতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, আপনি তাহাঁর কথার উত্তর দিন। তিনি বলিলেন, আমি তাঁকে কি উত্তর দিবো? আমি আমার মা এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, আপনি তাঁকে এর উত্তর দিন। তিনিও বলিলেন, আমি তাঁকে কি বলবো?
তাহাদের কেউই যখন উত্তর দেননি, তখন আমি কালেমা শাহাদাত তিলাওয়াত করলাম, আল্লাহ্ তাআলার যথোপযুক্ত সুনাম ও প্রশংসা করলাম, তারপর বললাম, আল্লাহ্র কসম! আমি যদি আপনাদের বলি, আমি কখনও তা করিনি এবং আল্লাহ্ তাআলা সাক্ষী আছেন, আমি সত্যবাদিনী, তা আপনাদের নিকট আমার কোন উপকারে আসবেনা। কেননা আপনারা তা আলোচনা করিয়াছেন এবং তাতে আপনাদের মন রঞ্জিত হয়েছে। আর আমি যদি বলি, আমি করেছি এবং আল্লাহ্ তাআলা জানেন আমি তা করিনি, তখন আপনারা বলবেন, সে নিজেই নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে। আল্লাহ্র কসম! আমি আপনাদের এবং আমার জন্য কোন উদাহরন খুঁজে পাচ্ছি না। আয়িশাহ [রাদি.] বলেন, আমি ইয়াকুব [আঃ] এর নাম স্মরণ করিতে চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। শুধু “ইউসুফ এর বাবা” স্মরনে আসছিলো। তিনি যখন বলেছিলেনঃ “পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছ সে প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তাআলা আমার সাহায্যস্থল”- [সুরা-ইউসুফ ১৮]। আয়িশাহ [রাদি.] বলেন, ঠিক সে সময় রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] এর নিকট ওয়াহি অবতীর্ণ হইতে লাগলো। আমরা চুপ থাকলাম। তাহাঁর উপর হইতে ওয়াহীর অবস্থা দূর হলে আমি তাহাঁর মুখমন্ডলে আনন্দের ছাপ দেখিতে পেলাম। তিনি তাহাঁর মুখমণ্ডলের ঘাম মুছছেন আর বলছেনঃ হে আয়িশাহ, তোমার জন্য সুসংবাদ। আল্লাহ্ তাআলা তোমাকে নির্দোষ ঘোষণা করিয়াছেন। আয়িশা [রাদি.] বলেন, আমি তখন উত্তেজিত অবস্থায় ছিলাম। আমার পিতা মাতা আমাকে বললেনঃ উঠে তাহাঁর নিকট যাও। আমি বললাম, আল্লাহ্র কসম! আমি তাহাঁর নিকট উঠে যাব না, তাহাঁর সুনাম ও করব না এবং আপনাদের প্রশংসাও করব না। বরং আমি সে আল্লাহ্ তাআলার সুনাম করবো যিনি আমার নির্দোষিতার ওয়াহী অবতীর্ণ করিয়াছেন। আপনারা এ অপবাদ শুনেছেন, কিন্তু প্রত্যাখ্যান বা প্রতিহত করেন নি।
আয়িশাহ [রাদি.] বলেন, জাহাশ-কন্যা যাইনাবের দীনদারীর জন্য আল্লাহ্ তাআলা তাকে হিফাজাত করিয়াছেন। সে ভালো ব্যতিত কখনও অন্য কিছু বলেনি। কিন্তু তাহাঁর বোন হামনা ক্ষতিগ্রস্থদের সাথে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। যারা এ অপবাদ রটায় তাহাদের মধ্যে ছিলঃ মিসতাহ, হাসান ইবনি সাবিত ও মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনি উবাই। সে অপবাদ রটাত এবং তা ছড়িয়ে বেড়াত। সে ও হামনা ছিল এই আপত্তিকর অপবাদ ছড়ানোর বড় হোতা। আয়িশাহ [রাদি.] বলেন, আবু বকর [রাদি.] কসম করেন যে, তিনি আর কখনও মিসতাহর কোনভাবে উপকার করবেন না [ভরন পোষণ বহন করবেন না]। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তাআলা আয়াত অবতীর্ণ করেনঃ “তোমাদের মধ্যে যারা [আবু বকর কে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে] ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন কসম না করে যে, তারা আত্মীয়, গরীব ও আল্লাহ্ তাআলার পথে মুহাজিরদের [মিসতাহ কে লক্ষ করে বলা হচ্ছে] কিছুই দেবে না … তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ্ তাআলা তোমাদের কে মাফ করুন?” আল্লাহ্ তালা বড়ই ক্ষমাশীল, পরম করুনাময়” -[সূরা আন-নূর ২২]। আবু বকর [রাদি.] বলেন, হে আমাদের প্রতিপালক! হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই আপনার ক্ষমাপ্রার্থী। তিনি আগের মত মিসতাহর ভরণপোষণের ভার বহন করেন।
সহীহঃ বোখারি [৪৭৫৭], মুসলিম। আবু ঈসা বলেন, এ হাদিসটি হাসান। সহীহ হিশাম ইবনি উরওয়াহর রিওয়াওয়াত হিসেবে গারীব। ইয়ুনুস ইবনে ইয়াজিদ, মামার যুহরী হইতে, তিনি উরওয়াহ ইবনিয যুবাইর হইতে, তিনি সাঈদ ইবনিল মুসাইয়াব হইতে, তিনি আলকামার ইবনূ ওয়াক্কাস আল লাইসি ও উবাইদুল্লাহ ইবনি আবদুল্লাহ হইতে, তিনি আয়িশাহ [রাদি.] হইতে এই সুত্রে উপর্যুক্ত হাদীসের বর্ণনা করিয়াছেন। হিশাম ইবনি উরওয়াহর রিওয়াতের তুলনায় এই রিওয়াতটি পুরনাঙ্গ ও দীর্ঘতর । সূরা আন নূর এর তাফসীর – এই হাদিসটির তাহকিকঃ সহীহ হাদিস
৩১৮১. আয়িশাহ [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, আমার নির্দোষিতার বর্ণনা করে আয়াত অবতীর্ণ হলে রাসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] মিম্বারে উঠে তা বর্ণনা করেন। তারপর কুরআন তিলাওয়াত করেন। মিম্বর হইতে অবতরন করে তিনি দুইজন পুরুষ ও একজন মহিলাকে বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দিলেন এবং তদানুযায়ী তাহাদেরকে [অপবাদ রতনাকারীদেরকে] হাদ্দের আওতায় শাস্তি দেওয়া হয়।
হাসানঃ ইবনি মাজাহ [২৫৬৭] আবু ঈসা বলেন, এ হাদিসটি হাসান গারীব। আমরা শুধু মুহাম্মাদ ইবনি ইশাকের সনদে এই হাদিসটি জেনেছি। সূরা আন নূর এর তাফসীর – এই হাদিসটির তাহকিকঃ হাসান হাদিস
Leave a Reply