সুরা তাহরীম তাফসীর । তাফসীর উল কুরাণ

সুরা তাহরীম তাফসীর । তাফসীর উল কুরাণ

সুরা তাহরীম তাফসীর । তাফসীর উল কুরাণ >> তিরমিজি শরিফের তাফসিরুল কোরআন অধ্যায়ের অন্যান্য সুরার তাফসীর পড়ুন >> সুরা তাহরীম আরবি তে পড়ুন বাংলা অনুবাদ সহ

অধ্যায়ঃ ৪৪, অনুচ্ছেদ-৬৬ঃ সুরা তাহরীম তাফসীর

৩৩১৮. উবাইদুল্লাহ ইবনি আবদুল্লাহ ইবনি আবী সাওর [রঃ]হইতে বর্ণীতঃ

ইবনি আব্বাস [রাদি.]-কে আমি বলিতে শুনিয়াছি, আমি উমার [রাদি.]-এর নিকট রসুলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর সেই দুজন সহধর্মিণী প্রসঙ্গে প্রশ্ন করিতে চাচ্ছিলাম যাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ “যদি তোমরা দুজন অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ তায়ালার দিকে রুজু হও তবে তা ভাল, কারণ তোমাদের দুজনের মন ঝুঁকে পড়েছে”- [সূরা তাহরীম ৪]। অবশেষে উমার [রাদি.] হাজ্জে গেলেন এবং আমিও তার সঙ্গে হাজ্জে গেলাম। পাত্র হইতে আমি পানি ঢেলে দিলাম এবং তিনি উযূ করিলেন। আমি বললাম, হে আমীরুল মুমিনীন! রসুলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর সেই দুজন স্ত্রী কে যাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ “যদি তোমরা দুজন অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ তায়ালার দিকে রুজু হও তবে ভাল, কেননা তোমাদের দুজনের মন ঝুঁকে পড়েছে”- [সূরা তাহরীম ৪]। উমার [রাদি.] বলেন, হে ইবনি আব্বাস! আশ্চর্য [তুমি এটুকুও জান না]! যুহরী [রঃ]বলেন, আল্লাহর কসম! এ কথায় প্রশ্ন করা তার নিকট মন্দ লেগেছে, কিন্তু তিনি তা লুকিয়ে রাখেননি। ইবনি আব্বাস [রাদি.] বলেন, তিনি আমাকে বলিলেন, তারা দুজন আয়িশাহ ও হাফসাহ।

তারপর তিনি ঘটনাটির ব্যাখ্যা দিতে আরম্ভ করেন। তিনি বলেন, আমরা কুরাইশগণ মহিলাদের উপর প্রভাবশালী ছিলাম। কিন্তু মাদীনায় পৌঁছে আমরা দেখলাম, এখানকার পুরুষদের উপর মহিলাদের প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। সুতরাং আমাদের মহিলারা এখানকার মহিলাদের অভ্যাস আয়ত্ত করে। একদিন আমি আমার সহধর্মিণীর উপর রাগ করলে সে আমার কথার প্রত্যুত্তর করে। কিন্তু তার প্রত্যুত্তর করাটাকে আমি অপছন্দ করলাম। সে বলল, এতে আপনার মন্দ লাগার কি আছে। আল্লাহর কসম! রসুলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর সহধর্মিণীগণও তাহাঁর কথার প্রত্যুত্তর করেন এবং সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাহাদের কেউ কেউ তো তাহাঁর সংস্পর্শ থেকে চলে যান। উমার [রাদি.] বলেন, আমি মনে মনে বললাম, যে তাহাদের মাঝে তা করে সে তো বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হল। উমার [রাদি.] বলেন, আমার বসতি ছিল মাদীনার উচ্চভূমিতে বনূ উমাইয়ার এলাকায়। আমার এক আনসারী প্রতিবেশী ছিল। পর্যায়ক্রমে আমরা দুজনে রসুলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর মাজলিসে আসা-যাওয়া করতাম। তদনুযায়ী একদিন সে তাহাঁর মাজলিসে গিয়ে ওয়াহী ও অন্যান্য বিষয়ের খবর নিয়ে এসে তা আমাকে জানাত এবং একদিন আমি তথায় গিয়ে [ফিরে এসে] তাকে একই রকম খবর দিতাম। উমার [রাদি.] বলেন, আমাদের মাঝে আলোচনা হচ্ছিল যে, আমাদের বিপক্ষে গাসসানীরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য তাহাদের ঘোড়াগুলো তৈরী করছে।

একদা রাতের বেলা সে আমার দরজায় এসে করাঘাত করলে আমি তার নিকটে বেরিয়ে এলাম। সে বলল, একটি মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে। আমি বললাম, গাসসানীরা কি এসে গেছে? সে বলল, তার তুলনায়ও আরো মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে। রসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] তাহাঁর স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন। উমার [রাদি.] বলেন, আমি মনে মনে বললাম, হাফসা হতভাগিনী ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি পূর্বেই ভাবছিলাম এমন একটা কিছু ঘটবে। তিনি বলেন, আমি ফজরের নামাজ আদায় করে কাপড়-চোপড় পরিধান করে রওয়ানা হলাম এবং হাফসার কক্ষে দিয়ে প্রত্যক্ষ করলাম যে, সে কাঁদছে। আমি বললাম, রসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] তোমাদেরকে তালাক দিয়েছেন কি? হাফসা [রাদি.] বলেন, আমি জানি না, তবে তিনি ঐ উপরের কুঠরিতে নির্জনতা অবলম্বন করিয়াছেন। তিনি বলেন, তারপর ওখান হইতে আমি বের হয়ে এক কৃষ্ণাঙ্গ গোলামের কাছে এসে বললাম, উমারের জন্য ঢোকার অনুমতি চাও। উমার [রাদি.] বলেন, তখন সে ভিতরে ঢুকল, তারপর আমার কাছে ফিরে এসে বলল, তাহাঁর নিকট আমি আপনার কথা বলেছি কিন্তু তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। উমার [রাদি.] বলেন, অতঃপর আমি মাসজিদে চলে এলাম। সেখানে আমি মিম্বারের আশেপাশে কিছু সংখ্যক লোককে কান্নারত দেখলাম। তাহাদের নিকট আমিও বসলাম, কিন্তু আমার অস্থিরতা বেড়ে গেল। তাই আমি পুনরায় ঐ দাসের নিকট এসে বললাম, তুমি উমারের জন্য ঢোকার অনুমতি চাও। অতঃপর সে ভিতর বাড়িতে প্রবেশ করে আবার ফিরে এসে বলল, আপনার কথা আমি তাঁকে বলেছি কিন্তু তিনি কিছুই বলেননি। আমি পুনরায় মসজিদে ফিরে এলাম এবং বসে পড়লাম, কিন্তু আমাকে একই চিন্তা চিন্তান্বিত করে তুলল। তাই আমি সেই গোলামের নিকট গিয়ে বললাম, উমারের জন্য ঢোকার অনুমতি চাও। সে ভিতরে ঢুকে ফিরে এসে বলল, আপনার কথা আমি তাকে বলেছি কিন্তু তিনি কিছুই বলেননি। উমার [রাদি.] বলেন, আমি ফিরে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দাসটি আমাকে ডেকে বলল, ভিতরে প্রবেশ করুন। তিনি আপনাকে ঢোকার অনুমতি দিয়েছেন।

তারপর ভিতরে প্রবেশ করে আমি প্রত্যক্ষ করলাম, রসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] চাটাইয়ের উপর হেলাম দিয়ে শুয়ে আছেন এবং তাহাঁর প্রত্যেক বাহুতে চাটাইয়ের দাগ পড়ে আছে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আপনার স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন কি? তিনি বললেনঃ না। আমি বললাম, আল্লাহু আকবার [আল্লাহ মহান]। হে আল্লাহর রাসূল! আপনি দেখুন, আমরা কুরাইশগণ মহিলাদের উপরে প্রভাব বিস্তার করে রাখতাম। কিন্তু মদীনায় পৌঁছে আমরা দেখলাম যে, একদল ব্যক্তিদের উপর তাহাদের নারীরাই প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। আমাদের মহিলারা তাহাদের নারীগণের এ অভ্যাস আয়ত্ত করে নিয়েছে। একদিন আমি আমার স্ত্রীর উপর রাগান্বিত হলাম, কিন্তু সে আমার প্রতিটি কথার প্রত্যুত্তর করিল। আমি তার এমন আচরণকে অতীব মন্দ মনে করলাম। সে বলল, কেন এটা আপনি পছন্দ করছেন না। আল্লাহর শপথ! রসুলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর স্ত্রীগণও তো তাহাঁর কথার প্রত্যুত্তর করেন, এমনকি তাহাদের কেউ কেউ সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাহাঁর সঙ্গ ত্যাগ করে কাটান। উমার [রাদি.] বলেন, আমি হাফসাকে প্রশ্ন করলাম, তুমি রসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] –এর সাথে কি কথা কাটাকাটি কর? সে বলল, হ্যাঁ, আর আমাদের কেউ কেউ তো সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাহাঁর সঙ্গ ত্যাগ করে কাটিয়ে দেয়। আমি বললাম, তোমাদের মাঝে যে এমন করেছে সে তো হতভাগিনী ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সম্পর্কে তোমাদের কেউ কি নিরাপদ হয়ে গেছে যে, রসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] তাহাদের কারো প্রতি নাখোশ হওয়ার কারণে আল্লাহ তায়ালাও তার উপর নাখোশ হইবেন এবং ফলে সে ধ্বংস হইবে? রসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] অল্প হাসলেন। উমার [রাদি.] বলেন, অতঃপর আমি হাফসাকে বললাম, তুমি রসুলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর সঙ্গে ঝগড়া করবেন না এবং তাহাঁর নিকট কোন কিছুর বায়না ধরবে না। যা কিছুর তোমার দরকার হয় আমার কাছে চাইবে। আর তুমি ধোঁকা খেও না, তোমার সতীন তোমার তুলনায় সুন্দরী এবং রসুলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর খুব বেশী প্রিয়। উমার [রাদি.] বলেন, [এ কথা শুনে] তিনি আবার মুচকি হাসি দিলেন। অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার সঙ্গে আরো কিছু সময় কাটাই? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। উমার [রাদি.] বলেন, মাথা তুলে ঘরের মাঝে তাকিয়ে আমি কেবল তিনটি চামড়া ব্যতীত আর কিছুই দেখিন। তাই আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আপনার উম্মাতের আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য আল্লাহ তাআলার নিকট দুআ করুন। তিনি তো পারস্য ও রোমের বসবাসকারীদেরকে প্রাচুর্য দান করিয়াছেন, অথচ তারা আল্লাহ তাআলার ইবাদাত করে না। [এ কথায়] রসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] উঠে সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেনঃ হে খাত্তাবের ছেলে! তুমি এখনো সন্দেহের মাঝে আছ কি? এরা তো এরূপ লোক যাদেরকে নিজস্ব সৎকর্মের প্রতিদান পার্থিব জীবনেই দেয়া হয়েছে। উমার [রাদি.] বলেন, রসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] একমাস তাহাঁর সহধর্মিণীদের সঙ্গে মেলামেশা না করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। এজন্য আল্লাহ তাআলা তাহাঁর উপর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের কাফফারার [ক্ষতিপূরণ] বন্দোবস্ত করেন।

যুহরী [রঃ]বলেন, উরওয়াহ [রঃ]আমার নিকট আয়িশাহ [রাদি.]-এর সূত্রে রিওয়ায়াত করিয়াছেন যে, তিনি বলেছেন, ঊনত্রিশ দিন পার হলে রসুলুল্লাহ [সাঃআঃ] সর্বপ্রথমে আমার নিকট আসেন। তিনি বলেনঃ হে আয়িশাহ! আমি তোমার নিকট একটি বিষয় উল্লেখ করছি, তোমার পিতা-মাতার সঙ্গে তুমি এ প্রসঙ্গে আলোচনা না করেই তাড়াহুড়া করে জবাব দিবে না। আয়িশাহ [রাদি.] বলেন, অতঃপর এ আয়াতটি তিনি পাঠ করেন [অনুবাদ]ঃ “হে নাবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে বলুন, যদি তোমরা পার্থিব জীবন ও তার সৌন্দর্য কামনা কর…” [সূরা আহযাব ২৮]। আয়িশাহ [রাদি.] বলেন, আল্লাহর কসম! তিনি অবগত যে, আমার পিতা-মাতা আমাকে তাহাঁর হইতে আলাদা হওয়ার অনুমতি দিবেন না। আয়িশাহ [রাদি.] বলেন, আমি বললাম, এ প্রসঙ্গে আমার পিতা-মাতার কি পরামর্শ চাইব? আমি তো আল্লাহ ও তাহাঁর রাসূল এবং আখিরাতের বাসস্থান প্রত্যাশা করি।

সহীহঃ বোখারি ও মুসলিম। মামার [রঃ]বলেন, আইউব আমাকে জানান যে, আয়িশাহ [রাদি.] তাঁকে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যে আপনাকেই বেছে নিয়েছি তা আপনার অন্যান্য স্ত্রীকে জানাবেন না। নাবী [সাঃআঃ]বললেনঃ নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা আমাকে মুবাল্লিগ [প্রচারক] হিসেবে পাঠিয়েছেন, কষ্ট-কাঠিন্যে নিক্ষেপকারী হিসেবে নয়। হাসানঃ সহীহ হাদীস সিরিজ [হাঃ ১৫১৬], মুসলিম জাবির [রাদি.] হইতে বর্ণনা করিয়াছেন। আবু ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান সহীহ গারীব। এ হাদীস ইবনি আব্বাস [রাদি.] হইতে একাধিক সূত্রে উল্লেখ রয়েছে। সুরা তাহরীম তাফসীর  – এই হাদিসটির তাহকিকঃ সহীহ হাদিস


Posted

in

by

Comments

Leave a Reply