সিয়াম ও রোজার মাসআলা মাসায়েল – হেদায়া

সিয়াম ও রোজার মাসআলা মাসায়েল – হেদায়া

সিয়াম ও রোজার মাসআলা মাসায়েল – হেদায়া>> তাহারাত অধ্যায় (উযূ গোসল তায়াম্মুম ) আল হিদায়া >> সালাত অধ্যায় (আযান জানাযা রমাযান ঈদ)- আল হিদায়া >> যাকাত অধ্যায় (পশু সম্পদ উশর ফিতর)- আল হিদায়া >> হজ্জ অধ্যায় (ইহরাম শিকার তামাত্তু কিরান)- আল হিদায়

সিয়াম অধ্যায়

সিয়াম – ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) বলেন, রোজা দুপ্রকার। ওয়াজিব ও নফল। আবার ওয়াজিব দুপ্রকার। এক প্রকার হলো নির্ধারিত সময়ের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন রমযানের রোজা এবং নির্ধারিত দিনের মান্নাতের রোজা। এই প্রকার রোজা রাত্রে নিয়্যত করা দ্বারা জাইয হয়। আর যদি নিয়্যত না করে অথচ ভোর হয়ে যায়, তাহলে ভোর ও যাওয়াল এর মধ্যবর্তী সময়ে নিয়্যত করিলেও যথেষ্ট হবে।

কিন্তু ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) বলেন, তা যথেষ্ট হবে না। জেনে রাখা কর্তব্য যে, রমযানের রোজা হলো ফরয। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেছেন- তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে। তাছাড়া রোজার ফরয হওয়া সম্পর্কে ‘ইজমা সংগঠিত হয়েছে। এ জন্যই রমাযানের রোজা অস্বীকারকারীকে কাফির সাব্যস্ত করা হয়। ( রোজার মাসআলা মাসায়েল )

নযরের সিয়াম ওয়াজিব। কেননা আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেছেন- তাহারা যেন তাহাদের মান্নতসমূহ পুরা করে। প্রথমটির সবব হলো (রমযান) মাসের উপস্থিতি। এ কারণেই উক্ত রোজাকে মাসের দিকে সম্বোধন করা হয় এবং মাসের পুনরাগমনে রোজারও পুনরাগমন ঘটে। আর রমাযানের প্রতিটি দিবস হচ্ছে সেই দিবসের রোজা ওয়াজিব হওয়ার সবব।

দ্বিতীয় প্রকার রোজা ওয়াজিব হওয়ার কারণ হচ্ছে মান্নত করা। আর নিয্‌ত হচ্ছে তার জন্য শর্ত। ইনশাল্লাহ্ এ বিষয়ে সামনে বিশদ আলোচনা করবো।

বিরোধপূর্ণ বিষয়ে ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) এর বক্তব্যের প্রমাণ হলো নাবী (সাঃআঃ) এর বাণী- যে ব্যক্তি রাত্রে রোজার নিয়্যত করেনি, তার রোজা নেই।

তাছাড়া নিয়্যত না থাকার কারণে রোজার প্রথম অংশটুকু যখন ফাসিদ হয়ে গেলো তখন দ্বিতীয় অংশটুকুও অনিবার্যভাবে ফাসিদ হয়ে যাবে। কেননা (ফরয) রোজা বিভক্তিযোগ্য নয়। নফলের বিষয়টি এর বিপরীত, কারণ নফল রোজা তার মতে বিভক্তিযোগ্য। ( রোজার মাসআলা মাসায়েল )

আমাদের দলিল এই যে, জনৈক বেদুঈন চাদ দেখার সাক্ষ্য প্রদানের পর রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন- শোন, যে ব্যক্তি পানাহার করে ফেলেছে, সে যেন অবশিষ্ট দিন পানাহার না করে। আর যে পানাহার করেনি, সে যেন রোজা রাখে।      

আর ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) বর্ণীত হাদিসটি পূর্ণতা ও ফযীলত অর্জিত না হওয়ার উপর প্রযোজ্য। কিংবা এর অর্থ এই যে, সে এই নিয়্যত করেনি যে, তার রোজা রাত্র থেকে শুরু হবে।

তাছাড়া যুক্তিগত কারণ এই যে, এটা হলো রোজার জন্য নির্ধারিত দিন। সুতরাং প্রথমাংশের পানাহার থেকে বিরত থাকাটা বিলম্বিত নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল হবে। যা উক্ত রোজার অধিকাংশের সংগে যুক্ত, যেমন নফলের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।

এই কারণ এই যে, সিয়াম হচ্ছে একটি দীর্ঘায়িত রুকন। আর নিয়্যতের প্রয়োজন হলো সেটাকে আল্লাহ্‌র জন্য নির্ধারণ করার উদ্দেশ্যে। সুতরাং আধিক্যের দ্বারা রোজার অস্তিত্বের দিকটি অগ্রাধিকার লাভ করবে।

নামায ও হজ্জের বিষয়টি এর বিপরীত। কেননা নামায ও হজ্জ হচ্ছে কয়েকটি রুকন সমন্বিত। সুতরাং ইবাদত দুটি আদায়ের সংঘটনের সময়ের সংগে নিয়্যত যুক্ত হওয়া জরুরী।

কাযা রোজার বিষয়টি এর বিপরীত। কেননা, তা ঐ দিনের রোজার উপর নির্ভরশীল। আর ঐ রোজাটি হলো নফল।

যাওয়ালের পরে নিয়্যত করার বিষয়টি এর বিপরীত। কেননা, সেক্ষেত্রে রোজার নিয়্যতটি দিনের অধিকাংশের সংগে যুক্ত হয়নি। ফলে সিয়াম ফউত হওয়ার দিকটি অগ্রাধিকার লাভ করবে।

মুখতাসারুল কুদূরীতে (নিয়্যত গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে) ভোর ও যাওয়ালের মধ্যবর্তী সময়ের কথা বলা হয়েছে। আর জামেউস্‌ সাগীর কিতাবেও অর্ধ দিবসের পূর্বের কথা বলা হয়েছে। এ-ই বিশুদ্ধ মত। কেননা দিবসের অধিকাংশ সময় নিয়্যত বিদ্যমান থাকা জরুরী। আর (শরীআত মতে) দিবসের অর্ধেক হলো ফজরের উদয় থেকে বৃহত্ পূর্বাহ্ন পর্যন্ত, যাওয়ালের সময় পর্যন্ত নয়। সুতরাং এর পূর্বেই নিয়্যত বিদ্যমান হওয়া জরুরী, যাতে নিয়্যত দিবসের অধিকাংশ বিদ্যমান থাকে।

(দিবসের নিয়্যত গ্রহণযোগ্য হওয়ার ক্ষেত্রে)মুসাফির-মুকীমের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কেননা আমাদের বর্ণীত দলীলে কোন ‘পার্থক্য নির্দেশ নেই। অবশ্য ইমাম যুফার ভিন্ন মত পোষণ করেন।

এই প্রকার সিয়াম সাধারণ নিয়্যত দ্বারা, নফলের নিয়্যত দ্বারা এবং অন্য ওয়াজিব রোজার নিয়্যত দ্বারা আদায় হয়।

ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) বলেন, নফলের নিয়্যত করিলে তা নিরর্থক হবে। (ফরযও হবে না, নফলও হবে না)।

সাধারণ নিয়্যত সম্পর্কে তার দুটি মত রহিয়াছে। কেননা নফলের নিয়্যত দ্বারা সে ফরয রোজার উপেক্ষাকারী হলো। সুতরাং তার জন্য ফরয আদায় হবে না।

আমাদের দলিল এই যে, সেই দিনটিতে ফরয নির্ধারিত রহিয়াছে। সুতরাং মূল নিয়্যত দ্বারাই তা হাছিল হয়ে যাবে। যেমন ঘরে একা বিদ্যমান ব্যক্তিকে তার জাতিবাচক নামে ডাকলেও উদ্দেশ্য হাছিল হয়ে যায়।

আর যদি নফল কিংবা অন্য ওয়াজিব রোজার নিয়্যত করে থাকে, তাহলেও সে মূল সিয়াম এবং অন্য একটি অতিরিক্ত দিকের নিয়্যত করলো। সুতরাং যখন অতিরিক্ত দিকটি বাতিল হয়ে গেলো তখন মূল বিষয় (রোজা) অবশিষ্ট থাকলো। আর তা-ই রোজা আদায়ের জন্য যথেষ্ট।

ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর মতে মুসাফির ও মুকীম এবং সুস্থ ও অসুস্থ ব্যক্তির মাঝে এ ব্যাপারে কোন পার্থক্য নেই। কেননা (রোজা না রাখার) অবকাশ দানের কারণ এই যে, ‘মাযূর ব্যক্তির যেন কষ্ট না হয়। কিন্তু যখন সে স্বেচ্ছায় কষ্ট গ্রহণ করে নিলো, তখন সে ‘অ-মাযূর ব্যক্তির সংগে যুক্ত হয়ে গেলো।

ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মতে অসুস্থ ও মুসাফির ব্যক্তি যখন অন্য ওয়াজিব রোজার নিয়্যতে সিয়াম রাখে, তখন সেই রোজাই সাব্যস্ত হবে। ( রোজার মাসআলা মাসায়েল )

কারণ ‘সময় কে সে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিয়োজিত করেছে। কেননা অন্য ওয়াজিবের কাযা এই মূহুর্তে তার উপর আরোপিত। পক্ষান্তরে রমাযানের রোজার ব্যাপারে পরবর্তীতে সময় লাভ করা পর্যন্ত সে ইখতিয়ার প্রাপ্ত।

নফলের নিয়্যত করার ব্যাপারে তার পক্ষ থেকে দুটি মত বর্ণীত হয়েছে।

একটি বর্ণনা (অর্থাত্ ফরয হিসাবে গণ্য হওয়ার) মতে পার্থক্যের কারণ এই যে, এখানে সময়টিকে সে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিযুক্ত করেনি।

দ্বিতীয় প্রকার হলো এমন রোজা, যা (অনির্ধারিত ভাবে) তার যিম্মায় ওয়াজিব। যেমন, রমাযান মাসের রোজা এবং কাফ্‌ফারার সিয়াম । সুতরাং রাত্রেকৃত নিয়্যত ছাড়া তা দুরস্ত হবে না। কেননা, তা নির্ধারিত নয়। অথচ প্রথম থেকে নির্ধারণ করা জরুরী।

সকল সিয়াম যাওয়ালের পূর্বে নিয়্যত করা দ্বারা জাইয।

ইমাম মালিক (রঃআঃ) ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি আমাদের উল্লেখিত হাদিসটি ব্যাপকতা প্রমাণ রূপে গ্রহণ করেন।

আমাদের প্রমাণ এই যে, রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) অ-রোজাদার অবস্থায় ভোর বেলা হওয়ার পরে বলেছেন- (এখন থেকে আমি রোজা রেখে নিলাম)।

তাছাড়া যুক্তিগত কারণ এই যে, রমাযানের বাইরে নফল সিয়াম শরীআত অনুমোদিত ইবাদাত। সুতরাং দিবসের প্রথমাংশের পানাহার সংযমটি রোজা রূপে গৃহীত হওয়া নিয়্যতের উপর নির্ভর করবে। যেমন আমরা আগে উল্লেখ করে এসেছি। মতে রোজা বিভাজন গ্রহণ করে। কারণ নফলের ভিত্তি হচ্ছে মনের প্রফুল্লতার উপর। আর এমন হতে পারে যে, যাওয়ালের পর সে প্রফুল্লতা অনুভব করলো। তবে তার জন্য শর্ত এই যে, দিবসের শুরু থেকেই পানাহার থেকে বিরত থাকা।

আমাদের মতে দিবসের শুরু থেকেই সে রোজাদার গণ্য হবে। কেননা, এটা হলো আত্ম-দমনের বিশেষ ইবাদত। আর তা নির্ধারিত সময়ে রোজা বিরুদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা দ্বারা সংঘটিত হয়। সুতরাং দিবসের অধিকাংশ সময়ের সংগে নিয়্যত যুক্ত হওয়া বিবেচ্য হবে।

ইমাম কুদূরী বলেন, মানুষের কর্তব্য হলো শাবান মাসের ঊনত্রিশ তারিখে চাদ অনুসন্ধান করা। যদি তাহারা চাদ দেখিতে পায়, তাহলে সিয়াম রাখবে। আর যদি (মেঘের কারণে) চাদ তাহাদের অগোচরে থাকে তাহলে শাবান মাসের ত্রিশ দিন পূর্ণ করবে। অতঃপর রোজা রাখবে। কেননা, রাসূলুল্লাহ্‌(সাঃআঃ) বলেছেন- তোমরা চাদ দেখে রোজা রাখো এবং চাদ দেখে ইফতার করো। আর যদি চাদ তোমাদের অগোচরে থাকে তাহলে শাবান মাসের ত্রিশ দিন পূর্ণ করো।

তাছাড়া এই কারণে যে, প্রকৃত অবস্থা হল মাস অব্যাহত থাকা। সুতরাং প্রমাণ ছাড়া উক্ত মাস থেকে বের হওয়া যাবে না। আর এখানে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ( রোজার মাসআলা মাসায়েল )

(ত্রিশ তারিখের ) সন্দেহ পূর্ণ দিনটিতে নফল ছাড়া অন্য কোন রোজা রাখবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃআঃ) বলেছেন- যে দিনটি সম্পর্কে সন্দেহ হয় যে, তা রমাযান কিনা, সে দিনে নফল ছাড়া অন্য কোন রোজা রাখা যাবে না।

এই মাসাআলাটি কয়েক প্রকার।

০১) প্রথমতঃ রমাযানের নিয়্যত করে সিয়াম রাখা মাকরূহ। প্রমাণ হলো আমাদের উপর বর্নিত হাদিস।

আরো এ কারণে যে, এতে আহলে কিতাবের সংগে সাদৃশ্য হয়। কেননা তাহারার তাহাদের রোজার পরিমাণে বর্ধিত করেছিল।

তবে রোজা রাখার পর যদি দেখা যায় যে, দিনটি রমাযানেরই দিন, তাহলে তা রমাযানের রোজা হিসাবে যথেষ্ট হবে। কেননা সে মাস পেয়েছে এবং তাতে রোজা রেখেছে। আর যদি প্রকাশ পায় যে, দিনটি শাবান মাসের ছিল, তাহলে তা নফল হয়ে যাবে। আর যদি রোজা ভংগ করে তাহলে তার কাযা করবে না। কেননা তা ধারণা পর্যায়ের অন্তর্ভূক্ত।

০২) দ্বিতীয় প্রকার এই যে, (রমাযান ছাড়া) অন্য কোন ওয়াজিব রোজার নিয়্যত করলো। সেটাও মাকরূহ। প্রমাণ ইতোপূর্বে উপরে বর্ণীত হাদিস। তবে মাকরূহ হওয়ার ক্ষেত্রে এটি প্রথমটার তুলনায় গৌণ।

এরপর যদি দেখা যায় যে, দিনটি রমাযানের দিন ছিল, তাহলে রমাযানের রোজা হিসাবে যথেষ্ট হয়ে যাবে। কেননা, রোজার মূল নিয়্যত বিদ্যমান রহিয়াছে। পক্ষান্তরে যদি প্রকাশ পায় যে, তা শাবানের দিন ছিল, তাহলে কারো কারো মতে তা নফল হবে। কেননা, এ রোজা নিষিদ্ধ ছিল। সুতরাং তাহা ছাড়া ওয়াজিব রোজা আদায় হবে না।

কোন কোন মতে যে রোজার নিয়্যত করেছে, তা আদায় হয়ে যাবে। এটা শুদ্ধতম মত। কেননা যে রোজাকে নিষেধ করা হয়েছে,তা হল রমাযানের উপর রমাযানের রোজাকে নিষেধ করা হয়েছে, তা হল রমাযানের উপর রমাযানের রোজাকে অগ্রবর্তী করা। অন্য রোজা দ্বারা তা বাস্তবায়িত হয় না। ঈদের দিনের বিষয়টি এর বিপরীত। কেননা এখানে নিষিদ্ধ বিষয়টি অর্থাত্ আল্লাহ্‌র দাওয়াত গ্রহণকে বর্জন করা যে কোন  রোজা দ্বারা অনিবার্য হয়ে পড়ে। আর সেখানে মাকরূহ হওয়া সাব্যস্ত হয়েছে নিষেধ রূপের কারণে।

০৩) তৃতীয় প্রকার এই যে, নফলের নিয়্যত করে। এটি মাকরূহ নয়। প্রমাণ ইতোপূর্বে আমাদের বর্ণীত হাদিস। আর এই হাদিস ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) এর বিপক্ষে প্রমাণ। তার মতে (পূর্ব অভ্যাস ছাড়া) নতুনভাবে ঐদিন রোজা রাখা মাকরূহ।

রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃআঃ) এর নিম্নোক্ত বাণী- (তোমরা একটি বা দুটি রোজা দ্বারা রমাযানের অগ্রগামী হয়ো না)। এর উদ্দেশ্য হলো রমাযানের রোজা রেখে অগ্রবর্তী হওয়া থেকে নিষেধ করা। কেননা এতে সময়ের পূর্বেই রমাযানের রোজা রাখা হয়ে যায়। পক্ষান্তরে যদি ঐ দিবসটি এমন কোন দিবস হয়, যা সে পূর্ব হতেই রোজা রেখে আসছে তাহলে সকলের ঐকমত্যেই রোজা রাখা উত্তম।

তদ্রুপ যদি এমন হয় যে, (শাবান ) মাসের (কিংবা প্রত্যেক মাসের) শেষ তিন দিন কিংবা ততোধিক দিন সে রোজা রেখে এসেছে, তা হলে রোজা রাখাই উত্তম। পক্ষান্তরে যদি শুধু ঐ একদিন রোজা রাখার অভ্যাস হয়ে থাকে, তাহলে কোন কোন মতে বাহ্যতঃ নিষেধ থেকে বেচে থাকার জন্য রোজা না রাখাই উত্তম। আর কোন কোন মতে ‘আলী ও ‘আইশা (রাঃআঃ) –এর অনুসরণে রোজা রাখাই উত্তম। কেননা তাহারা ঐ দিন রোজা রাখতেন।

আর স্বীকৃত মত এই যে, মুফতী (ও অন্যান্য বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিগণ) সতর্কতার খাতিরে নিজে তা রোজা রাখবেন কিন্তু সাধারণ লোকদের যাওয়াল পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর পানাহার করার ফাতওয়া দান করবেন। (নিজে গোপনে রোজা রাখবেন) অভিযোগ থেকে মুক্ত থাকার জন্য। ( রোজার মাসআলা মাসায়েল )

০৪) চুতর্থ প্রকার এই যে, মূল নিয়্যতের মধ্যে দোদুল্যমান হওয়া। অর্থাত্ এভাবে নিয়্যত করা যে, আগামীকাল রমাযান হলে রোজা রাখবে, আর শাবান হলে রোজা রাখবে না। এইভাবে সে রোজাদার হবে না। কেননা তার নিয়্যতকে স্থির করেনি। সুতরাং এমনই হলো, যেন সে নিয়্যত করলো যে, আগামীকাল যদি সে খাবার পায় তাহলে রোজা রাখবে না, আর খাবার না পেলে রোজা রাখবে।

০৫) পঞ্চম প্রকার এই যে, নিয়্যতের প্রকৃতির ক্ষেত্রে দ্বিধা পোষণ করে। অর্থাত্ এই নিয়্যত করে যে, আগামীকাল রমাযানের দিন হলে রমাযানের রোজা রাখবে। আর শাবানের দিন হলে অন্য ওয়াজিব রোজা রাখবে। এটা মাকরূহ। কেননা সে দুটি মাকরূহ বিষয়ের মাঝে দোদুল্যমান রহিয়াছে। অতঃপর যদি প্রকাশ পায় যে, দিবসটি রমাযানের দিবস, তাহলে ঐ রোজাই যথেষ্ট হবে। কেননা মূল নিয়্যতের ক্ষেত্রে তো দ্বিধা নেই। পক্ষান্তরে যদি প্রকাশ পায় যে, তাহারা শাবানের দিবস, তা হলে এ রোজা অন্য কোন ওয়াজিব রোজা রূপে যথেষ্ট হবে না। কেননা দ্বিধান্বিত থাকার কারণে দিক নির্ধারন হয়নি। আর মূল নিয়্যত তার জন্য যথেষ্ট নয়। তবে তা এমন নফল রোজায় রূপান্তরিত হবে, যা (ভঙ্গ করিলে) কাযা যিম্মায় আসে না। কেননা তা সে শুরুই করেছে যিম্মা থেকে অব্যাহতির নিয়্যতে।

আর যদি সে এই নিয়্যত করে যে, আগামীকাল রমাযান হলে তার রোজা রমাযানের হবে; আর শাবানের হলে নফল রোজা হবে, তাহলে তাও মাকরূহ। কেননা এক দিক থেকে সে (রমাযানের) ফরয রোজার নিয়্যত করছে। অতঃপর যদি প্রকাশ পায় যে দিবসটি রমাযানের দিবস, তাহলে তা রমাযানের রোজা হিসাবে যথেষ্ট হবে। কারণ ইতোপূর্বে বর্ণীত হয়েছে।

আর যদি প্রকাশ পায় যে, তা শাবানের দিবস, তাহলে নফল হিসাবে তা জাইয হবে। কেননা নফল মূল নিয়্যতের দ্বারা আদায় হয়ে যায়।

যদি তা ফাসিদ করে ফেলে তাহলে কাযা না হওয়াই উচিত। কেননা, তার নিয়্যতের মধ্যেই এক হিসাবে যিম্মা থেকে অব্যাহতির লক্ষ্য বিদ্যমান।

যে ব্যক্তি একা রমাযানের চাদ দেখলো, সে রোজা রাখবে। যদিও ইমাম তার সাক্ষ্য গ্রহণ না করেন। কেননা রাসূলুল্লাহ্‌(সাঃআঃ) বলেছেন- তোমরা চাদ দেখে রোজা রাখো এবং চাদ দেখে রোজা ইফতার কর।

আর সে তো স্পষ্টভাবে চাদ দেখেছে। যদি সে রোজা ভংগ করে ফেলে, তাহলে তার উপর কাযা ওয়াজিব হবে, কাফ্‌ফরা ওয়াজিব হবে না।

ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) বলেন, স্ত্রী সহবাস দ্বারা রোজা ভংগ করে, তাহলে তার উপর কাফ্‌ফরাও ওয়াজিব হবে। কেননা সে রমাযান সম্পর্কে, নিশ্চিত ছিল। আর হুকুম হিসাবেও (সে রমাযানের রোজা ভংগ করেছে) কেননা, তার উপর রোজা ওয়াজিব ছিল।

আমাদের মতে কাযী শরীআত সম্মত দলীলের ভিত্তিতে তার সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যান করেছেন। দলিলটি হলো ভুল দেখার সম্ভাবনা। ফলে তা সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। আর এরূপ কাফ্‌ফরা সন্দেহের দ্বারা রহিত হয়ে যায়।

ইমাম তার সাক্ষ্য প্রত্যাখান করার পূর্বেই যদি সে রোজা ভংগ করে ফেলে, তাহলে সে বিষয়ে মাশায়েখগণের মতভেদ রহিয়াছে।

(সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যাত) এই লোক যদি ত্রিশদিন রোজা পূর্ণ করে, তাহলেও সে ইমামের সংগে ছাড়া রোজা বর্জন করিতে পারিবে না। কেননা সতর্কতা হিসাবেই তার উপর রোজা ওয়াজিব হয়েছিলো। আর পরবর্তীতে সতর্কতা হলো ‘রোজা বর্জন বিলম্বিত করার মধ্যে।

তবে যদি রোজা ভঙ্গ করে ফেলে তাহলে তার ধারণা অনুযায়ী সাব্যস্ত প্রকৃত অবস্থার প্রেক্ষিতে তার উপর কাফ্‌ফরা ওয়াজিব হবে না।

যদি আকাশ অপরিষ্কার থাকে তাহলে চাদ দেখার ব্যাপারে ইমাম একজন ‘আদিল (সত্‌ ব্যক্তি) ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন, সে পুরুষ হোক কিংবা স্ত্রীলোক, স্বাধীন হোক কিংবা দাস। কেননা, এটা দায়িনী বিষয়। সুতরাং তা হাদিস বর্ণনার সদৃশ হলো। এ জন্য তা ‘সাক্ষ্য‘ শব্দের উপর নির্ভরশীল নয়। ন্যায়-পরায়ণতার শর্ত আরোপ করার কারণ এই যে, দীনী বিষয়ে কাফিরের কথা গ্রহণযোগ্য নয়।

ইমাম তাহাবীর বক্তব্য ‘ন্যায়পরায়ণ হোক কিংবা ন্যায়পরায়ণ না হোক; তা এ অবস্থার উপর প্রযোজ্য, যখন তার ন্যায়পরায়ণতা অজানা থাকে।

আর আকাশ ‘অপরিষ্কার- এর অর্থ মেঘ, ধুলিঝড় ইত্যাদি থাকা। ইমাম কুদূরীর নিঃশর্ত বিবরণে ঐ ব্যক্তি অন্তর্ভূক্ত, যে যিনার অপবাদ দেওয়ার কারণে শাস্তিপ্রাপ্তির পর তওবা করে নিয়েছে। এ হল জাহিরে রিওয়ায়াত। কেননা এটা হচ্ছে খবর প্রদান। ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) হতে বর্ণীত এক মতে তার কথা গ্রহণ করা হবে না। কেননা একদিক থেকে এটি সাক্ষ্যের পর্যায়ের।

ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) হতে বর্ণীত দুটি মতের একটিতে দুজনের শর্ত আরোপ করেছেন। তার বিপক্ষে আমাদের দলিল তাই, যা উপরে আমরা উল্লেখ করেছি।

তাছাড়া বিশুদ্ধ হাদিসে বর্ণীত হয়েছে যে, নাবী (সাঃআঃ) রমাযানের চাদ দেখার ব্যাপারে একজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন।

এরপর ইমাম একজনের সাক্ষ্য গ্রহণের ভিত্তিতে যদি লোকেরা রোজা ত্রিশদিন পূর্ণ করে, তাহলে ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) থেকে হাসান (ইব্‌ন যিয়াদ) কর্তৃক বর্ণীত মতে সতর্কতা হিসাবে রোজা ত্যাগ করবে না। কেননা, রোজা ত্যাগ করার বৈধতা একজনের সাক্ষ্য দ্বারা সাব্যস্ত হয় না।

ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) হতে বর্ণীত যে, লোকেরা সিয়াম ত্যাগ করে ফেলবে। কেননা রোজা ত্যাগ করার বৈধতা এই ভিত্তিতে সাব্যস্ত হবে যে, রমাযান এক ব্যক্তির সাক্ষ্য দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছিলো। যদিও স্বতন্ত্রভাবে প্রথম অবস্থায় এক ব্যক্তির সাক্ষ্য দ্বারা সিয়াম ত্যাগ করার বৈধতা প্রমাণিত হয় না। যেমন ধাত্রীর সাক্ষ্য ছাড়া প্রমাণিত ‘নসব-এর উপর ভিত্তি করে মীরাসের অধিকার সাব্যস্ত হয়ে থাকে।

আকাশ যদি অপরিষ্কার না থাকে তাহলে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না, যতক্ষণ না এমন একটা বড় দল তা দেখিতে পায়, যাদের সংবাদে নিশ্চিত হওয়া যায়। কেননা, এমন অবস্থায় একা চাদ দেখার মধ্যে ভুলের সম্ভাবনা রহিয়াছে। সুতরাং একটা বড় দলের দেখা পর্যন্ত সে বিষয়ে অপেক্ষা করা কর্তব্য হবে। আকাশ পরিষ্কার থাকার বিষয়টি এর বিপরীত। কেননা কখনো কখনো চাদের স্থান থেকে মেঘ কেটে যায়, ফলে কারো পক্ষে চাদ দেখে ফেলা সম্ভব হতে পারে। ‘বড় দলের সংজ্ঞা হিসাবে কেউ কেউ মহল্লাবাসী বুঝিয়েছেন। ( রোজার মাসআলা মাসায়েল )

ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) থেকে পঞ্চাশ জনের কথা বর্ণীত হয়েছে ‘কাসামাহ এর উপর কিয়াস করে।

শহরবাসী এবং শহরের বাহির থেকে আগত লোকদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই।

ইমাম তাহাবী (রঃআঃ) বলেন, শহরের বাহির থেকে আগত হলে এক জনের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে। কেননা (তথায় ধুয়া-ধূলা ইত্যাদির ) প্রতিবন্ধকতা কম। কিতাবুল ইসতিহসান এ এ দিকেই ইংগিত করা হয়েছে।

যদি কেউ শহরের কোন উচু স্থান থেকে চাদ দেখে তবে তার হুকুম অনুরূপ। যে ব্যক্তি একা ঈদের চাদ দেখেছে সে সিয়াম ভঙ্গ করবে না। এর কারণ সতর্কতা অবলম্বন। আর সিয়ামের ক্ষেত্রে ওয়াজিব করার মধ্যেই হলো সতর্কতা।

যদি আকাশ অপরিষ্কার থাকে তাহলে ঈদের চাদ প্রমাণিত হবে না কমপক্ষে দুজন পুরুষ কিংবা একজন পুরুষ ও দুজন স্ত্রী লোকের সাক্ষ্য ব্যতীত। কেননা, এই চাদ দেখার সাথে বান্দার উপর সম্পর্কিত। আর তা হলো রোজা না রাখা। সুতরাং তার অন্যান্য হকসমূহের সদৃশ হয়ে গেলো। যাহিরে রিওয়ায়াত অনুযায়ী ঈদুল আযহা এ ক্ষেত্রে ঈদুল ফিতরের অনুরূপ। এ-ই বিশুদ্ধতম মত।

অবশ্য ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) থেকে ভিন্নমত বর্ণীত আছে, এ জন্য যে, তা রমাযানের চাদ দেখার মতো।

(যাহিরে রিওয়ায়াতের দলিল এই যে) এর সাথে বান্দাদের উপকার সম্পর্কিত রহিয়াছে। আর তা হলো কুরবানীর গোশত আহারের সুযোগ গ্রহণ।

আর যদি আকাশ অপরিষ্কার না থাকে তাহলে এমন এক জামাআতের সাক্ষ্য ব্যতীত চাদ প্রমাণিত হবে না, যাদের সংবাদ দ্বারা নিশ্চিত জ্ঞান অর্জিত হয়।

যেমন ইতোপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি।

রোজার সময় হলো ফজর ছানী (সুবহে সাদিক) এর উদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। কেননা আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেছেন-

শুভ্র রেখা ফজরের কৃষ্ণরেখা হতে পৃথক হওয়া পর্যন্ত তোমরা পানাহার করো। এরপর তোমরা রাত্র পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করো(০২:১৮৭)।

আর উভয় রেখা দ্বারা দিবসের শুভ্রতা এবং রাত্রির কৃষ্ণতা উদ্দেশ্য।

সিয়াম হলো নিয়্যতসহ দিবসে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা-শরীআতের পরিভাষায়। কেননা, আভিধানিক অর্থে শুধু বিরত থাকার নামই সিয়াম । কারণ, এ অর্থে তার ব্যবহার রহিয়াছে। তবে শরীআত তার সংগে নিয়্যত যুক্ত করেছে, যাতে ইবাদত অভ্যাস হতে পৃথক হয়ে যায়।

দিবসের সংগে বিশিষ্ট হওয়ার কারণ হলো আমাদের বর্ণীত আয়াত।

তাছাড়া যুক্তিগত কারণ এই যে, দিনরাতের একটানা রোজা রাখা যখন দুঃসাধ্য তখন দিবসের অংশকে নির্ধারণ করাই উত্তম। যাতে আমলটি অভ্যাসের বিপরীত হয়। আর ইবাদতের ভিত্তিই হলো অভ্যাসের বিপরীত করার উপর।

নারীদের ক্ষেত্রে রোজা আদায়ের বৈধতা সাব্যস্ত হওয়ার জন্য হায়িয ও নিফাস থেকে পবিত্র হওয়া শর্ত। ( রোজার মাসআলা মাসায়েল )


Posted

in

by

Comments

5 responses to “সিয়াম ও রোজার মাসআলা মাসায়েল – হেদায়া”

Leave a Reply