সাদাকাতুল ফিতর ফরয হওয়া প্রসঙ্গে এবং এর পরিমাণ
সাদাকাতুল ফিতর ফরয হওয়া প্রসঙ্গে এবং এর পরিমাণ >> বুখারী শরীফ এর মুল সুচিপত্র পড়ুন
পর্বঃ ২৪, যাকাত, অধ্যায়ঃ (৭০-৭৮)=৯টি
২৪/৭০. অধ্যায়ঃ সদকাতুল ফিতর ফরয হওয়া প্রসঙ্গে।
২৪/৭১. অধ্যায়ঃ মুসলিমদের গোলাম ও অন্যান্যদের পক্ষ থেকে সাদকাতুল ফিতর আদায় করা
২৪/৭২. অধ্যায়ঃ সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ এক সা যব।
২৪/৭৩. অধ্যায়ঃ সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ এক সা খাদ্য।
২৪/৭৪. অধ্যায়ঃ সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ এক সা খেজুর।
২৪/৭৫. অধ্যায়ঃ (সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ) এক সা কিসমিস।
২৪/৭৬. অধ্যায়ঃ ঈদের সালাতের পূর্বেই সদকাতুল ফিতর আদায় করিতে হইবে।
২৪/৭৭. অধ্যায়ঃ আযাদ ও গোলামের পক্ষ হইতে সদকাতুল ফিতর আদায় করিতে হইবে।
২৪/৭৮. অধ্যায়ঃ অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও প্রাপ্ত বয়স্কদের পক্ষ হইতে সদকাতুল ফিতর আদায় করা কর্তব্য
২৪/৭০. অধ্যায়ঃ সাদকাতুল ফিতর ফরয হওয়া প্রসঙ্গে।
আবুল আলীয়া আত্বা ও ইবনু সীরীন (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) – এর অভিমত হলো সাদকাতুল ফিতর আদায় করা ফরয।
১৫০৩. ইবনু উমর (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, প্রত্যক গোলাম, আযাদ, পুরুষ, নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমের উপর আল্লাহর রাসুল (সাঃআঃ) সাদকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা পরিমাণ আদায় করা ফরয করিয়াছেন এবং লোকজনের ঈদের সালাতের বের হবার পূর্বেই তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।
২৪/৭১. অধ্যায়ঃ মুসলিমদের গোলাম ও অন্যান্যদের পক্ষ থেকে সাদকাতুল ফিতর আদায় করা
১৫০৪. ইবনু উমর (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
মুসলিমদের প্রত্যেক আযাদ, গোলাম পুরুষ ও নারীর পক্ষ হইতে সাদকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর অথবা যব-এর এক সা পরিমাণ [৪৭] আদায় করা আল্লাহর রাসুল (সাঃআঃ) ফরয করিয়াছেন।
[৪৭] সকল প্রকার খাদ্যদ্রব্য থেকে এক সা পরিমাণ ফিতরা দিতে হইবে। এটাই বিভিন্ন সহীহ হাদীসের দাবী এবং নাবী (সাঃআঃ) ও ৪ খলীফাহর যুগের বাস্তব আমল। মুআবিয়া (রাদি.) তাহাঁর খিলাফতকালে যখন আসলেন এবং সেখানে গম আমদানী হল তখন তিনি বলিলেন, আমার মতে গমের এক মুদ (অন্য বস্তুর) দু মুদের সমান। তিরমিযীর বর্ণনায় রয়েছে। – অর্থাৎ লোকেরা গমের অর্ধ সা এর সাথে অন্য বস্তুর এক সা এর সমান হিসাব করিলেন। অতএব বুঝা গেল এক সা খেজুর, কিসমিস, পনির, যব এবং অন্য খাদ্যদ্রব্যের যে মূল্য ছিল সে পরিমাণ মূল্য ছিল অর্ধ সা গমের। সে কারণে মুয়াবিয়া (রাদি.) অর্ধ সা ফিতরাহ আদায়ের ফতোয়া দিলেন। কিন্তু সাহাবীদের অধিকাংশই তাহাঁর প্রতিবাদ করিয়াছেন। যেমন আবু সাঈদ খুদরী (রাদি.) প্রতিবাদ করে বললেনঃ
আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন সর্বদা ঐভাবেই ফিতরা আদায় করব যেভাবে আগে আদায় করতাম। (মুসলিম ১ম খণ্ড ৩১৮ পৃষ্ঠা) ইমাম হাকিম ও ইবনু খুজাইমাহ সহীহ সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেন যে,
আইয়ায বিন আবদুল্লাহ হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু সাঈদ খুদরী (রাদি.) বলেন, তার নিকট রমযানের সাদকা সম্পর্কে বর্ণনা করা হলে তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) এর যামানায় যে পরিমাণ সাদকাতুল ফিতর আদায় করতাম তা ব্যতীত অন্যভাবে বের করব না। এক সা খেজুর, এক সা গম, এক সা যব, এক সা পনির। কোন ব্যক্তি প্রশ্ন করিল, গমের দু মুদ দ্বারা কি আদায় হইবে না? তিনি বলিলেন, না। এটা মুয়াবিয়া (রাদি.)-এর মনগড়া নির্ধারিত। আমি সেটা গ্রহণও করব না বাস্তবায়নও করব না। (ফাতহুল বারী ৩য় খণ্ড ৪৩৭ পৃষ্ঠা)
ইমাম নাববী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, যারা মুআবিয়ার কথা মত গমের দু মুদ আদায় করাকে গ্রহণ করেছে তাতে ত্রুটি রয়েছে। কেননা এ ব্যাপারে সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাদি.) এবং অন্যান্য সাহাবাগণ বিরোধিতা করিয়াছেন যাঁরা দীর্ঘ সময় নাবী (সাঃআঃ) এর সাথে ছিলেন এবং তাঁরা নাবী (সাঃআঃ) এর অবস্থা সম্পর্কে অধিক অবগত ছিলেন। মুআবিয়া (রাদি.) নিজের রায় দ্বারা মত ব্যক্ত করিয়াছেন। তিনি নাবী (সাঃআঃ) হইতে শুনে বলেননি। আবু সাঈদ খুদরী (রাদি.)-এর হাদীসে ইত্তিবাহ ও সুন্নাত গ্রহণের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। (ফাতহুল বারী ৩য় খণ্ড ৪৩৮ পৃষ্ঠা, মুসলিম শরহে নাববী ১ম খণ্ড ৩১৭-৩১৮ পৃষ্ঠা, শরহুল মুহাযযাব ইমাম নাববী)
ইমাম শাফিয়ী, আহমাদ, ইসহাক এক সা ফিতরায় হাদীস প্রমাণ পেশ করেন। কেননা নাবী (সাঃআঃ) সাদকাতুল ফিতর খাদ্যদ্রব্যের এক সা আদায় ফরয করিয়াছেন। আর গম হচ্ছে খাদ্যদ্রব্যেরই একটি। অতএব এক সা ব্যতীত ফিতরা আদায় বৈধ হইবে না। আর আবু সাঈদ খুদরী (রাদি.), আবুল আলিয়া, আবুশ শাসআ, হাসান বাসরী, জাবির বিন যায়িদ, ইমাম শাফিয়ী, ইমাম মালিক, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল ও ইসহাক (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) প্রমুখ এ দলীল গ্রহণ করিয়াছেন। নাইলুল আওতারে এভাবেই রয়েছে। তাতে আরো রয়েছে গম ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে পার্থক্য করা যাবে না। আর যারা অর্ধ সা গমের কথা যে হাদীস দ্বারা বলে তা সম্পূর্ণ যঈফ। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৩য় খণ্ড ২৮০-২৮১ পৃষ্ঠা)
এ বিষয় সকল হাদীস পর্যালোচনা করে দেখা যায় মুআবিয়া (রাদি.) যখন মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন, হজ্জ মৌসুমে হজ্জ করে যখন লোকদের সাথে কথা বলিলেন তখন জানতে পারলেন শাম বা সিরিয়ার এক মুদ গমের যে দাম হিজাযের দু মুদ খেজুর, কিসমিস ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের একই দাম অথবা যখন হিজাযে গম আমদানী করা হল তখন দেখা গেল এক সা খেজুর বা কিসমিসের মূল্য অর্ধ সা গমের মূল্যের সমান। তাই মুআবিয়া (রাদি.) দামের দিক দিয়ে সমান করে দুই মুদ বা অর্ধ সা গম আদায়ের কথা বলেন এবং সাহাবাদের প্রতিবাদের মুখ পড়েন।
বর্তমানে যদি কেউ মুআবিয়া (রাদি.)-এর কথা মানতে চায় তাহলে তার কথাকে বর্তমান সময়ের দ্রব্যমূল্যের সাথে তুলনা করে মানতে হইবে। মক্কা মদীনার পরিমাপ হিসাবে এক সা-এর ওজন হয় বর্তমানে দুই কেজি একশত বাহাত্তর গ্রাম। যদি নিম্ন মানের খেজুরের দাম ধরা হয় তাহলে ৩০ টাকা দরে দুই কেজি একশত বাহাত্তর গ্রাম খেজুরের দাম আসে ৬৫ টাকা। যেহেতু মুআবিয়া (রাদি.)-এর সময় খেজুরের দাম বেশী ছিল তাই অর্ধ সা আদায় করার কথা তিনি বলেছেন। কিন্তু বর্তমানে গমের দ্বারা ফিতরা আদায় করিতে হলে ৬৫ টাকার গম দিতে হইবে। বর্তমানে প্রতি কেজি গমের মূল্য ১০ টাকা ধরলে মাথাপিছু সাড়ে ছয় কেজি গম দিয়ে ফিতরা আদায় করিতে হইবে। নচেৎ নাবী (সাঃআঃ) যে এক সার (২.১৭২ কেজির) কথা বলেছেন সেই পরিমাণ আপন আপন খাদ্যদ্রব্য দিয়ে আদায় করিতে হইবে।
রাসুলুল্লাহ (সাঃআঃ) এর যামানায় দীনার, দিরহাম ইত্যাদি মুদ্রা চালু ছিল। কিন্তু দীনার, দিরহামের দ্বারা অর্থাৎ আমাদের যামানায় প্রচলিত টাকা পয়সার দ্বারা যাকাতুল ফিতর আদায় করার প্রমাণ কোন হাদীস পাওয়া যায় না। তাঁরা তাঁদের খাদ্যবস্তু দিয়েই ফিতরা আদায় করিতেন। আল্লাহর রাসুল (সাঃআঃ) এর এ ব্যবস্থাপনায় বহুবিধ কল্যাণ নিহিত আছে। ফিতরাহ দানকারী যখন ফিতরার খাদ্যবস্তু কিনে তখন বিক্রেতা উপকৃত হয়। ফিতরাহ গ্রহণকারী খাদ্যবস্তু বিক্রি করে দিলে ফিতরাহ গ্রহণ করে না এমন সব গরীব ক্রেতা উপকৃত হয়।
২৪/৭২. অধ্যায়ঃ সাদকাতুল ফিতরের পরিমাণ এক সা যব।
১৫০৫. আবু সাঈদ খুদরী (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা এক সা পরিমাণ যব দ্বারা সাদকাতুল ফিতর আদায় করতাম।
২৪/৭৩. অধ্যায়ঃ সাদকাতুল ফিতরের পরিমাণ এক সা খাদ্য।
১৫০৬. আবু সাঈদ খুদরী (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা এক সা পরিমাণ খাদ্য অথবা এক সা পরিমাণ যব অথবা এক সা পরিমাণ খেজুর অথবা এক সা পরিমাণ পনির অথবা এক সা পরিমাণ কিসমিস দিয়ে সাদকাতুল ফিতর আদায় করতাম।
২৪/৭৪. অধ্যায়ঃ সাদকাতুল ফিতরের পরিমাণ এক সা খেজুর।
১৫০৭. আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সাঃআঃ) সাদকাতুল ফিতর হিসেবে এক সা পরিমাণ খেজুর বা এক সা পরিমাণ যব দিয়ে আদায় করিতে নির্দেশ দেন। আবদুল্লাহ (রাদি.) বলেন, অতঃপর লোকেরা যবের সমপরিমাণ হিসেবে দু মুদ (অর্ধ সা) গম আদায় করিতে থাকে।
২৪/৭৫. অধ্যায়ঃ (সাদকাতুল ফিতরের পরিমাণ) এক সা কিসমিস।
১৫০৮. আবু সাঈদ খুদরী (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা নাবী (সাঃআঃ)-এর যুগে এক সা খাদ্যদ্রব্য বা এক সা খেজুর বা এক সা যব বা এক সা কিসমিস দিয়ে সাদকাতুল ফিতর আদায় করতাম। মুআবিয়া (রাদি.)-এর যুগে যখন গম আমদানী হল তখন তিনি বলিলেন, এক মুদ গম (পূর্বোক্তগুলোর) দু মুদ-এর সমপরিমাণ বলে আমার মনে হয়।
২৪/৭৬. অধ্যায়ঃ ঈদের সালাতের পূর্বেই সাদকাতুল ফিতর আদায় করিতে হইবে।
১৫০৯. (আবদুল্লাহ) ইবনু উমর (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
নাবী (সাঃআঃ) লোকদেরকে ঈদের সালাতের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই [৪৮] সাদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দেন।
[৪৮] ঈদুল ফিতরের সালাতের জন্য বের হবার পূর্বেই ফিতরা বন্টন শেষ করিতে হইবে। ইবনু আব্বাস হইতে বর্ণিত, যাকাতুল ফিতর যে সালাতের পূর্বে আদায় করিবে সেটা মকবুল বা গ্রহণযোগ্য। আর যে সালাতের পরে আদায় করিবে সেটি সাধারণ সাদকার মত। (আবু দাউদ হাদীস ১৬০৯, ইবনু মাজাহ হাদীস ১৮২৭, দারাকুতনী, হাকিম, বাইহাকী, বুলূগুল মারাম- সাদকাতুল ফিতর অধ্যায়)
১৫১০. আবু সাঈদ খুদরী (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা নাবী (সাঃআঃ)-এর যুগে ঈদের দিন এক সা পরিমাণ খাদ্য সাদাকাতুল ফিতর হিসেবে আদায় করতাম। আবু সাঈদ (রাদি.) বলেন, আমাদের খাদ্যদ্রব্য ছিল যব, কিসমিস, পনির ও খেজুর।
২৪/৭৭. অধ্যায়ঃ আযাদ ও গোলামের পক্ষ হইতে সাদকাতুল ফিতর আদায় করিতে হইবে।
যুহরী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, (বাণিজ্য পণ্য হিসেবে) ব্যবসায়ের জন্য ক্রয় করা গোলামের যাকাত [৪৯] দিতে হইবে এবং তাদের সাদকাতুল ফিতরও দিতে হইবে।
১৫১১. ইবনু উমর (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নাবী (সাঃআঃ) প্রত্যেক পুরুষ, মহিলা, আযাদ ও গোলামের পক্ষ হইতে সাদকাতুল ফিতর অথবা (বলেছেন) সাদকা-ই রমযান হিসেবে এক সা খেজুর বা এক এক সা যব আদায় করা ফরজ করিয়াছেন। অতঃপর লোকেরা অর্ধ সা গমকে এক সা খেজুরের সমমান দিতে লাগল। (রাবী নাফি বলেন) ইবনু উমর (রাদি.) খেজুর (সাদকাতুল ফিতর হিসেবে) দিতেন। এক সময় মদীনায় খেজুর দুর্লভ হলে যব দিয়ে তা আদায় করেন। ইবনু উমর (রাদি.) প্রাপ্ত বয়স্ক ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক সকলের পক্ষ হইতেই সাদকাতুল ফিতর আদায় করিতেন, এমনকি আমার সন্তানদের পক্ষ হইতেও সাদকার দ্রব্য গ্রহীতাদেরকে দিয়ে দিতেন এবং ঈদের এক-দু দিন পূর্বেই আদায় করে দিতেন।
২৪/৭৮. অধ্যায়ঃ অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও প্রাপ্ত বয়স্কদের পক্ষ হইতে সাদকাতুল ফিতর আদায় করা কর্তব্য
১৫১২. ইবনু উমর (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সাঃআঃ) অপ্রাপ্ত বয়স্ক, প্রাপ্ত বয়স্ক, আযাদ ও গোলাম প্রত্যেকের পক্ষ হইতে এক সা যব অথবা এক সা খেজুর সাদকাতুল ফিতর হিসেবে আদায় করা ফরজ করে দিয়েছেন।
Leave a Reply