সম্পদের যাকাতের হিসাব এর মাসায়েল
সম্পদের যাকাতের হিসাব এর মাসায়েল >> আল হিদায়া ফিকহ এর মুল সুচিপত্র দেখুন
কিতাবঃ আল হিদায়া, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ – হেদায়া কিতাব বাংলা – সম্পদের জাকাত
- পরিচ্ছেদ : রূপার জাকাত
- পরিচ্ছেদ: স্বর্ণের জাকাত
- পরিচ্ছেদ পণ্যদ্রব্যের জাকাত
পরিচ্ছেদ : রূপার জাকাত { সম্পদের যাকাতের হিসাব }
দুশ দিরহামের নীচে কোন জাকাত নেই। কেননা রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন, পাচ আওকিয়ার নীচে কোন জাকাত নেই। আর এক আওকিয়ার পরিমাণ হলো চল্লিশ দিরহাম(বুখারী)।
দিরহাম যখন দুশ হবে এবং তার উপর বর্ষপূর্তি হবে তখন তাতে পাচ দিরহাম ওয়াজিব হবে।। কেননা রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) মুআয (রাঃআঃ) এর নামে এই মর্মে পত্র প্রেরণ করেছিলেন যে, প্রতি দুশ দিরহাম হতে পাচ দিরহাম গ্রহণ করো এবং প্রতি বিশ মিছকাল স্বর্ণ হতে অর্ধ মিছকাল গ্রহণ কর। (দারা কুতনী)।
গ্রন্থকার বলেন, নিসাবের অতিরিক্তের ক্ষেত্রে চল্লিশ দিরহাম না হওয়া পর্যন্ত কিছু ওয়াজিব হবে না। চল্লিশে গিয়ে এক দিরহাম ওয়াজিব হবে। এরপর প্রতি চল্লিশে এক দিরহাম। এটি ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মত।
সাহেবাইন বলেন, দুশর বেশী যা হবে, তার যাকাতেও সেই হিসাবে হবে।
এটি ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) এর মত। কেননা আলী (রাঃআঃ) বর্ণীত হাদিসে রহিয়াছে দুশর উপর যা অতিরিক্ত হবে, তার জাকাত সেই হিসাবে হবে।
তাছাড়া জাকাত তো ওয়াজিব হয়েছে নিআমতের মালের শোকর হিসাবে। তবে প্রারম্ভে নিসাব পরিমাণ হওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়েছে, অভাব মুক্ত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য। আর গবাদি পশুর ক্ষেত্রে (প্রারম্ভিক) নিসাবের পরেও বিশেষ স্তরে পৌছার শর্ত আরোপ করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড করার অসুবিধা পরিহার করার জন্য।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর দলিল হলো হাদিসে মুআয (রাঃআঃ) এর বর্ণীত নিম্নোক্ত বাক্যটি-
নিসাবের ভগ্নাংশ থেকে কিছু গ্রহণ করো না (দারা-কুতনী)। তদ্রূপ আমর ইব্নে হাযম (রাঃআঃ)বর্ণীত হাদিসে রহিয়াছে চল্লিশ দিরহামের নীচে কোন জাকাত নেই। তাছাড়া অসুবিধার অবস্থা শরীআতে পরিহার্য। আর ভগ্নাংশের জাকাত ওয়াজিব করার মধ্যে অসুবিধা রহিয়াছে। কেননা, ভগ্নাংশের হিসাব কঠিন।
দিরহামের ক্ষেত্রে ওজনে সাবআ গ্রহণযোগ্য।অর্থাত্ প্রতি দশ দিরহামের ওজন হবে সাত মিছকাল। উমর(রাঃআঃ) এর অর্থ দফতরের হিসাবে এই পরিমাণই প্রচলিত ছিলো এবং পরবর্তীতে এটিই স্থায়ী রূপ লাভ করে।
কোন রৌপ্য্ বস্তুতে রূপার পরিমাণ যদি বেশী হয় তবে সবটুকুই রূপা হিসাবেই গন্য হবে। আর খাদ যদি বেশী হয় তবে তা পণ্যদ্রব্য রূপে গণ্য হবে। তার মূল্য নিসাব পরিমাণ হওয়ার বিষয়টি বিবেচিত।
কারণ দিরহামে সামান্য খাদ থাকেই। কেননা তা খাদ ছাড়া জমাট বাধে না। তবে অধিক পরিমাণ খাদ থেকে (সাধারনত) মুক্ত থাকে। তাই পরিমাণের অধিক্যকে আমরা পার্থক্য রূপে গণ্য করেছি। আর আধিক্যের অর্থ হলো অর্ধেক থেকে বেশী হওয়া। বাস্তবের প্রতি দৃষ্টি রেখে ছারফ অধ্যায়ে এ প্রসংগ ইনশাল্লাহ্ আমরা আলোচনা করবো। তবে খাদ অধিক হওয়ার ক্ষেত্রে (জাকাত ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে) ব্যবসায়ের নিয়্যত থাকা অপরিহার্য, যেমন অন্যান্য বাণিজ্য-পণ্যের ক্ষেত্রে। তবে যদি তা থেকে রূপা পৃথক করে নেয়া হয় আর তা নিসাব পরিমাণ হয় (তবে ব্যবসায়ের নিয়্যত করা জরুরী নয়)।
কেননা, শুধু রূপার ক্ষেত্রে মূল্য কিংবা ব্যবসায়ের নিয়্যত ধর্তব্য নয়। আল্লাহ্ই অধিক জানেন।
পরিচ্ছেদ: স্বর্ণের জাকাত { সম্পদের যাকাতের হিসাব }
বিশ মিছকাল স্বর্ণের নীচে জাকাত ওয়াজিব নয়। যখন বিশ মিছকাল হবে তখন তাতে অর্ধ মিসকাল ওয়াজিব।
প্রমাণ হলো ইতোপূর্বে আমাদের বর্ণীত হাদিস। মিসকালের (দীনারের) পরিমাণ হল এর সাতটির ওজন দশ দিরহামের সমান হবে। এ-ই প্রচলিত।
এরপর প্রতি চার মিছকালে দুই কীরাত ওয়াজিব হবে। কেননা দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ (বা চল্লিশভাগের একভাগ) হলো যাকাতের ওয়াজিব পরিমাণ। আর তাহলো আমরা যা বলেছি(অর্থাত্ ২ কীরাত)। কারণ, প্রতি মিছকালের ওজন বিশ কীরাত।
বর্ধিত অংশ চার মিছকালের কম হলে জাকাত নেই।
এ হল ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মত। সাহেবাইনদের মতে সেই অনুপাতে জাকাত ওয়াজিব হবে। এটা মূলত ভগ্নাংশের মাসআলা।
আর শরীআতের দৃষ্টিতে প্রতি দীনার দশ দিরহামের সমমান। সুতরাং এ ক্ষেত্রে চার মিছকাল চল্লিশ দিরহামের সমমান হবে।
ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) বলেন, স্বর্ণ ও রৌপ্যের খন্ড, অলংকার ও বর্তন এসবে জাকাত ওয়াজিব।
ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) বলেন, স্ত্রীলোকের অলংকার এবং পুরুষের রূপার আংটিতে জাকাত ওয়াজিব হবে না। কেননা তা মুবাহ হিসাবে ব্যবহৃত। সুতরাং তা ব্যবহার্য কাপড়ের সদৃশ।
আমাদের দলিল এই যে, জাকাত ওয়াজিব হওয়ার সবাব (উপাদান) হলো বর্ধন সম্পন্ন সম্পদ। এখানে বর্ধনের প্রমাণ বিদ্যমান আর তা হলো সৃষ্টিগত ভাবেই এগুলো ব্যবসায়ের জন্য প্রস্তুতকৃত। আর এ ক্ষেত্রে প্রমাণের বিদ্যমানতাই বিবেচ্য। ব্যবহার্য বস্ত্রের বিষয়টি এর বিপরীত।
পরিচ্ছেদ পণ্যদ্রব্যের জাকাত { সম্পদের যাকাতের হিসাব }
যেকোন ধরণের ব্যবসায়িক পণ্যদ্রব্য হোক তাতে জাকাত ওয়াজিব হবে যদি তার মূল্য রূপার কিংবা স্বর্ণের নিসাব পরিমাণে পৌছে। কেননা পণ্যদ্রব্য সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন: পণ্যদ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করা হবে। এবং প্রতি দুশ দিরহাম হতে পাচ দিরহাম আদায় করা হবে। কারণ এগুলো বান্দার পক্ষ থেকে বর্ধনের জন্য প্রস্তুতকৃত। সুতরাং তা শরীআতের পক্ষ থেকে প্রস্তুতকৃতের সদৃশ।
ব্যবসায়ের নিয়্যতের শর্ত আরোপ করা হয়েছে যাতে বান্দার পক্ষ থেকে প্রস্তুতকরণ সাব্যস্ত হয়।
অত:পর ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) বলেন, দরিদ্রদের জন্য অধিকতর লাভজনক যা তা দ্বারাই পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করিতে হবে। এর উদ্দেশ্য হলো দরিদ্রদের হক এর ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন।
হিদায়া গ্রন্থকার বলেন, এটা ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) হতে বর্ণীত একটি রিওয়ায়াত। কিন্তু মাবসূতের বর্ণনা মতে ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) মালিকের ইখতিয়ারের উপর ন্যস্ত করেছেন। কেননা বস্তুসমূহের মূল্য নিরূপনের ক্ষেত্রে উভয় (স্বর্ণ ও রৌপ্য) মুদ্রাই সমান।
অধিকতর লাভজনক হওয়ার ব্যাখ্যা এই যে, ঐ মুদ্রার দ্বারা মূল্য নিরূপণ করিতে হবে, যা দ্বারা নিসাব অর্জিত হয়।
ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) হতে বর্ণীত আছে যে, পণ্যদ্রব্য যদি মুদ্রার দ্বারা খরিদ করা হয়ে থাকে তাহলে যে ধরনের মুদ্রা খরিদ করা হয়ে থাকে তাহলে যে ধরণের মুদ্রা দ্বারা খরিদ করা হয়েছে, তা দ্বারাই মূল্য নিরূপণ করা হবে। কেননা, মূল্যমান পরিচয়ের ক্ষেত্রে এটাই স্পষ্টতর।
পক্ষান্ততরে যদি মুদ্রা ছাড়া অন্য কোন দ্রব্য দ্বারা খরিদ করে থাকে তবে দেশে প্রচলিত প্রধান মুদ্রা দ্বারা মূল্য নিরূপণ করা হবে।
ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) হতে বর্ণীত আছে যে, সর্বাবস্থায় প্রচলিত প্রধান মুদ্রা দ্বারাই পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করিতে হবে, যেমন গসবকৃত ও ধ্বংসকৃত মালের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।
বছরের উভয় প্রান্তে যদি নিসাব পূর্ণ থাকে, তবে মধ্যবর্তী সময়ে নিসাবের হ্রাস জাকাতকে রহিত করবে না। কেননা, মধ্যবর্তী সময়ের পূর্ণতার সমীক্ষণ কঠিন। তবে শুরুতে নিসাবের পূর্ণতা আবশ্যকীয় হয়েছে, যাতে জাকাত সংঘটিত হয় এবং অভাবমুক্ত সাব্যস্ত হয়। তদ্রুপ বছরের শেষ প্রান্তেও (নিসাবের পূর্ণতা জরুরী) হলো জাকাত ওয়াজিব হওয়ার হুকুমের জন্য। মধ্যবর্তী সময়টি অনুরূপ নয়। কেননা, সেটা হচ্ছে নিছক বিদ্যমান থাকার অবস্থা।
পক্ষান্তরে সমস্ত মাল হালাক হয়ে গেলে যাকাতের বছর পূর্তির হুকুমটি বাতিল হয়ে যাবে। অর্থাত্ সার্বিক ভাবে নিসাব বিলুপ্ত হওয়ার কারণে জাকাত ওয়াজিব হবে না। কিন্তু প্রথম মাসআলাটি এরূপ নয়। কেননা নিসাবের কিছু অংশ এখনও বিদ্যমান রহিয়াছে। সুতরাং যাকাতের উপাদানের সংঘটন অব্যাহত থাকবে।
ইমাম কুদূরী বলেন, নিসাব পূর্ণ হওয়ার জন্য পণ্যদ্রব্যের মূল্য স্বর্ণ ও রৌপ্যের সংগে যুক্ত করা হবে। কেননা পণ্যদ্রব্য ও স্বর্ণ-রৌপ্য সকলের ক্ষেত্রেই বাণিজ্য সম্ভার হিসাবেই জাকাত ওয়াজিব হয়ে থাকে। যদিও ব্যবসায়ের জন্য প্রস্তুত করণের বিষয়টি ভিন্ন।
স্বর্ণকে রৌপ্যের সংগে যুক্ত করা হবে। কেননা মুদ্রা হওয়ার দিকে থেকে উভয়ের মাঝে সাদৃশ্য রহিয়াছে। আর মূল্য হওয়ার দিক থেকেই তা যাকাতের সবব (পণ্য রূপে) গণ্য হয়েছে।
তবে ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মতে এ সংযুক্তি থেকে মূল্যের মাধ্যমে, আর সাহেবাইনের মতে অংশ হিসাবে। এবং ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) থেকেও এরূপ এক মত বর্ণীত আছে।
সুতরাং কারো নিকট যদি একশ দিরহাম এবং পাচ মিছকাল স্বর্ণ থাকে, যার মূল্য একশ দিরহাম পরিমাণ হয়, তবে ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর মতে তার উপর জাকাত ওয়াজিব হবে। সাহেবাইনের মতে ওয়াজিব হবে না।
তাহাদের বক্তব্য এই যে, স্বর্ণ ও রৌপ্যের ক্ষেত্রে পরিমাণই বিবেচ্য, মূল্য বিবেচ্য নয়। তাইতো যে স্বর্ণ বা রৌপ্য পাত্রের ওজন দুশ দিরহামের কম অথচ তার মূল্য দুম দিরহামের বেশী, তাতে (সর্ব সম্মতিক্রমে) জাকাত ওয়াজিব হয় না।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃআঃ) এর যুক্তি এই যে, সাদৃশ্যের কারণেই একটাকে অন্যটার সংগে যুক্ত করা হয়। আর তা মূল্যের বিবেচনায়ই বাস্তবায়িত হয়, বস্তু আকৃতির দিক থেকে নয়। সুতরাং মূল্যের দ্বারাই মিলান হবে। আল্লাহই অধিক অবগত।
Leave a Reply