বাজ্জার (র)-এর সমসাময়িক অবস্থা
মুসনাদুল বাজ্জার (র)-এর সমসাময়িক অবস্থা
প্রথম অনুচ্ছেদ
রাজনৈতিক অবস্থা
মুসনাদুল বাজ্জার (র) ‘আব্বাসীয় শাসনামলে জন্মগ্রহণ করায় এ যুগের রাজনৈতিক ইতিহাস জানা আবশ্যক। ইতিহাস হলো সমাজ বা রাষ্ট্রের দর্পন। উমাইয়া বংশের ধ্বংসস্তুপে ‘আব্বাসীয় বংশের প্রতিষ্ঠা হয়। এ বংশের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ‘আরব জাতি’ ইসলামের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে। এই বংশের ৩৭ জন খলীফা দীর্ঘ (১৩২- ৬৫৬ হিজরী/৭৫০-১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ) ৫০৮ বছর খিলাফাতের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
তাদের মধ্যে কেউ কেউ মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিশেষ অবদান রেখে অক্ষয় খ্যাতি অর্জন করেছেন; আবার অধিকাংশই সিংহাসন অলঙ্কৃত করে মূলতঃ শক্তিশালী সামাজিক শক্তির μিড়নকের ভূমিকা পালন করেছেন।
অনেকেই খিলাফাতের রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়, কেবল আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ভোগ করেছেন।৩ খলীফা আবুল ‘আব্বাস আস-্ সাফ্ফাহ্৪ (মৃত ১৩২ হিজরী) হতে আল-ওয়াছিক বিল্লাহ (মৃত ২৩২ হিজরী) পর্যন্ত রাজনৈতিক অবস্থা ২.ছিল সুন্দর, সুশৃংখল ও শান্তিপূর্ণ। ২৩২ হিজরীতে ওয়াছিক বিল্লাহ্র ইন্তিকালের মধ্যদিয়েই এ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।৫ শুরু হয়‘আব্বাসীয় শাসনামলের অবনতি ও পতনের যুগ। খলীফা আল-মুতাওয়াক্কিলের যুগ থেকেই এ যুগের সূচনা হয়।৬ আর এ পতনের মূল কারণ ছিল পরবর্তীতে যারা ‘আব্বাসীয় খিলাফাতে
অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তাঁদের দুর্বলতা এবং তাঁদের উপর তুর্কী সেনাবাহিনীর একচ্ছত্র প্রভাব।৭
মুহাম্মাদ ইব্ন ইসহাক ইব্ন খুযায়মাহ্ (র) (২২৩ হিজরী/৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে) অষ্টম খলীফা আল-মু‘তাসিম
বিল্লাহ্৮ (২১৮-২২৮ হিজরী/৮৩৩-৮৪২ খ্রিস্টাব্দ)-এর শাসনামলে জন্মগ্রহণ করেন। ‘আব্বাসীয় খিলাফাতের ৭ম খলীফা মামুর্নু-রশীদের ইন্তিকালের পর ২১৮ হিজরী সনে রজব মাসের ১২/১৯ তারীখ ১০ই আগোষ্ট, ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে বৃহস্পতিবার মু‘তাসিম বিল্লাহ্ ৮ম খলীফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।৯ তিনি মুহাম্মাদ ইব্ন
‘আবদিল-মালিককে উযীরে ‘আযম মনোনীত করেন।১০ তিনি খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হলে পারসিক সৈন্যদের
একটি বিরাট অংশ তাকে খলীফা হিসেবে মেনে না নিয়ে, খলীফা মামুনের পুত্র আল-‘আব্বাসকে খলীফা
নিয়োগ করার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু তৎক্ষনাৎ আল-‘আব্বাস স্বয়ং পিতৃব্যের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করায়,
তাঁদের সে ষড়যন্ত্র বানচাল হয়ে যায়।১১
খলীফা আল-মু‘তাসিম বিল্লাহ্ ছিলেন একজন সামরিক ব্যক্তিত্ব। তাই খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হয়েই তিনি
সামরিক বাহিনীর প্রতি অধিক মনোযোগ দেন। তাঁর পূর্বসূরী ‘আব্বাসীয় খলীফাগণ সাধারণভাবে
খুরাসানীদেরকে বেশী সমাদর করতেন। ‘আরব সৈন্যদের উপর তাঁদের আস্থা খুব কমই ছিল। যদিও
খুরাসানীদের পক্ষ থেকেও তাদের জন্য বারবার সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছে, এতদসত্বেও সামগ্রিকভাবে
‘আরবদের থেকে খুরাসানী ও ‘ইরানীদের উপর তাদের আস্থা বেশী ছিল। এ জন্য সামরিক বাহিনীতে
‘আরদের সংখ্যা হ্রাস পেতে পেতে খুবই অল্পে এসে ঠেকে।১২ তাদের ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য তিনি বুখারা,
সামারকন্দ, তুর্কীস্থান, মারওয়াউন্-নাহার, ফারাগানা ও আশরুসানাহ্ প্রভৃতি এলাকা থেকে তুর্কীদেরও
সেনাবাহিনীতে ভর্তি করান।১৩
اএসব তুর্কী সেনার যুদ্ধপ্রিয়তা এবং তাদের কষ্টসহিষ্ণতার তাঁর কাছে অত্যন্ত পছন্দনীয় ছিল।১৪এ যাবত
সামরিক বাহিনীতে ‘আরবী ও ‘ইরানী এই দুই শ্রেণীর সৈন্যই থাকতো। কিন্তু মু‘তাসিম এতো সংখ্যক তুর্কী
সৈন্য ফৌজে ভর্তি করলেন এবং তাদেরকে এত গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে অধিষ্ঠিত করলেন যে, সংখ্যা ও গুরুত্বের
দিক থেকে তারা রীতিমত ‘ইরানীদের প্ির তদ্ব›দ্ধী হয়ে দাঁড়ায়। ‘আরব সৈন্যরা সংখ্যায় হ্রাস পেতে পেতে
কেবল মিসরীয় এবং ইয়ামানীরাই খলীফার বাহিনীতে অবশিষ্ট থাকে।১৫
খলীফা সমস্ত ‘আরব সৈন্যদেরকে মিলিয়ে একটি স্বতন্ত্র ‘আরব রেজিমেন্ট গঠন করেন ঐ রেজিমেন্টের নাম
দেন ‘মাগরিবা বা পশ্চিমা’ বাহিনী। সামারকন্দ, ফারাগানা ও আশরুসানার তুর্কী সৈন্যদের সমš^ে য় গঠিত সব
চেয়ে দুর্ধর্ষ ও বড় বাহিনীর নামদেন ‘ফারাগানা’।১৬ খুরাসানীরা ফারাগানাদেরকে তাদের প্রতিদ্বন্ধী বলে
ভাবতে থাকে। খলীফা যেহেতু নিজে ইচ্ছা করে এ বাহিনী গঠন করেছিলেন তাই তাদের অশ্ব ছিল উনড়বত
জাতের, তাদের বেতন-ভাতা ছিল অন্যদের তুলনায় বেশী, তাদের ছিল সু-সজ্জিত পোশাক।১৭ এমনকি
খলীফার দেহরক্ষীও তুর্কী ছিল।১৮ এ জন্য খুরাসানীরা বাগদাদে তাদের সাথে ঝগড়া-কলহে প্রবৃত্ত হয়।
মু‘তাসিম বিল্লাহ্ তাদের এ অবাঞ্ছিত ঈর্ষা লক্ষ্য করে বাগদাদ থেকে নব্বই মাইল দূরবর্তী দিজলা নদীর তীরে
এবং কাতূল নদীর নির্গমণ স্থলের নিকটে ফারাগানা বাহিনীর সেনাছাউনি নির্মাণ করেন।১৯ সেখানে তিনি
নিজের বসবাসেরজন্যও একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। সৈন্যদের জন্য ব্যারাক সমূহ নির্মাণ করেন। বাজার,
জামে‘ মসজিদ, ঘর-বাড়ীসহ প্রভৃতি নির্মাণ করিয়ে তুর্কীদের বসতী স্থাপন করেন, এমনটি তিনি নিজেও এ
নবনির্মিত শহরে স্থানান্তরিত হয়ে যান।২০
তিনি শহরটির নাম রাখেন সুররা মান রা’য়া (যে দেখে তার মন জুড়ায়) বহুল ব্যবহারে তা সামাররা রূপ
পরিগ্রহ করে। এ শহরটি ২২০ হিজরী/৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয় এবং তখন থেকেই বাগদাদের পরিবে সামাররা রাজধানীতে পরিণত হয়।২১ রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ায় অল্পদিনের মধ্যেই তার জনসংখ্যা ও
জৌলুস বাগদাদের সমপর্যায়ে চলে আসে। ‘আরব ও খুরাসানীদের পরিবর্তে তুর্কীরাই তখন রাজধানী ও
খলীফার উপর প্রাধান্য বিস্তার করে বসে।২২ তিনি ২২৭ হিজরীর ২০শে রবি‘উল আওয়াল/৮৪২ খ্রিষ্টাব্দের
৯ই জানুয়ারীতে ইন্তিকাল করেন।২৩
তাঁর ইন্তিকালের পর ওয়াছিক বিল্লাহ্২৪ (২২৭-২৩২ হি./৮৪২-৮৪৭ খ্রি.) খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হন।২৫
খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হয়ে তুর্কী গোলাম আশনাসকে তিনি তাঁর সহকারী খলীফা নিয়োগ করে সাম্রাজ্যের সর্বময় ক্ষমতা তার হাতে তুলে দেন।২৬ তিনি একজন পূর্ণ খলীফার মর্যাদা ভোগ করেন। এর মাধ্যমে
মুসলিম জাহানে তুর্কীদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।২৭ খলীফা মু‘তাসিম বিল্লাহ্র মৃত্যু সংবাদ শুনে দামিশকবাসী
বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। খলীফা রিজা ইব্ন আইয়্যূবকে তাদের বিদ্রোহ দমনের জন্য পাঠান।২৮ তখন তিনি
রামাল্লায় আবূ হারবের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধে রত ছিলেন। খলীফার নির্দেশ পাওয়া মাত্র স্বল্পসংখ্যক সৈন্যকে
আবূ হারবের সাথে যুদ্ধের জন্য রেখে অবশিষ্ট বাহিনী নিয়ে দামিশকের দিকে অগ্রসর হন। প্রচন্ডযুদ্ধে
দামিশকবাসীর ১৫০০ সৈন্য এবং রিজা ইব্ন আইয়্যুবের ৩০০ সৈন্য নিহত হয়। যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে
দামিশকবাসী সন্ধির আবেদন জানালে বিদ্রোহের অবসান হয়। আবূ হারবের ২০,০০০ সৈন্য এ যুদ্ধে প্রাণ
হারায়।২৯
মদীনার পার্শ্ববর্তী বেদুঈনরাও খলীফাকে বিপদে ফেলে। বনু সুলাইম হিজাযের হাটবাজারে লুণ্ঠন শুরুকরে,
একথা শুনে খলীফা মদীনার গভর্ণর হাম্মাদ ইব্ন জারীর আত্-তাবারীর অধীনে এক বিরাট বাহিনী তাদের
বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। কিন্তু তিনি পরাস্ত ও নিহত হন।৩০ ফলে খলীফা অভিজ্ঞ সেনাপতি বুগা আল-কাবীরের
শরণাপনড়ব হন। ২৩০ হিজরীর শা‘বান মাসে খলীফা বুগা আল-কাবীরকে সেখানে প্রেরণ করেন। বুগা আল-
কাবীর তাদেরকে পরাজিত করেন। অতপর হজ্জ সম্পাদন শেষে বুগা আল-কাবীর বনূ হিলালের দিকে
মনোনিবেশ করে তাদেরকে পরাজিত করেন।৩১ গুরুতর অপরাধীদের বন্ধী ও অন্যদের ক্ষমা করে দেন। বুগা
আল-কাবীর এরপর বনূ মূররা ও বনূ ফাযারার দিকে মনোনিবেশ করেন। তারা ফাদাক শহর দখল করে
রেখেছিল। তার উপস্থিতির কথা জানতে পেরে ২৩১ হিজরীতে তারা ফাদাক ত্যাগ করে।৩২ ২৩২ হিজরী
সনে বুগা আল-কাবীর ইয়ামামায় বনূ নুমায়েরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তাদরেকেও তিনি পরাভূত করেন।এছাড়া মসূলে খারিজীদের,পারস্যের কূর্দ সম্প্রদায়েরও বিদ্রোহ দমন করেন।৩৩ তিনি ২৪৭ হিজরী সনে
ইন্তিকাল করেন।৩৪
খলীফা আল-ওয়াছিক বিল্লাহ্র ইন্তিকালের পর আল-মুতাওয়াক্কিল ‘আলাল্লাহ্৩৫ (২৩২-২৪৭ হি./৮৪৭-৮৬১
খ্রি.) খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হন।৩৬ খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হয়ে তুর্কীদের প্রভাব থেকে সাম্রাজ্যকে মুক্ত করার
জন্য তিনি মু‘তাসিম বিল্লাহ্র শাসনামল থেকে উযীরে ‘আযমের গুরু দায়িত্ব পালনকারী মুহাম্মাদ ইব্ন
‘আবদুল-মালিক ইব্নুয্-যায়্যাতকে উযীরে ‘আযমের দায়িত্ব থেকে পদচ্যুত ও গ্রেফতার করেন। ২৩৩ হিজরী/৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তাকে হত্যা করা হয়।৩৭ ‘উবায়দুল্লাহ্ ইব্ন খাকানকে ‘উযীরে ‘আযমের দায়িত্ব দেয়া
হয়।৩৮ ২৩৩ হিজরী সনে খলীফার নির্দেশμমে ইসহাক ইব্ন ইব্রাহীম আইতাখকে গ্রেফতার করেন। ২৩৫
হিজরী/৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হন।৩৯ ২৩৫ হিজরী সনে আযারবাইজানে মুহাম্মাদ ইব্ন
বা‘ঈছ ইব্ন জালীস বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করলে বুগা আস্-সগীর সৈন্য বাহিনী নিয়ে সে বিদ্রোহ দমন
করেন।৪০ আহমাদ ইব্ন আবী দুওয়াদকে ২৩৭ হিজরী/৮৫১-৫২ খ্রিষ্টাব্দে প্রধান বিচারপতি পদ থেকে
অপসারণ করেন এবং তার স্থলে ইয়াহ্ইয়া ইব্ন আকছামকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন। তার সঙ্গীদের
গ্রেফতার করেন।৪১ তিনি পুরাতন শাসনতন্ত্র বাতিল করেন। তিনি তাদের স্থলে নতুন মন্ত্রীবর্গ নিয়োগ দেন।
তিনি সামরিক শক্তিতে তুর্কীদের এক চেটিয়া অধিকার বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে একটি নতুন সেনাবাহিনী গঠন
করার কাজেও মনোনিবেশ করেন। ‘উবায়দুল্লাহ্ ইব্ন খাকান সিরিয়ার ক্বায়সী, ‘আরব ও বাগদাদের
আশরুসানাদের মধ্য হতে এবং আরমের্নীয়া হতে সৈন্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন। তাদের প্রতি আনুকুল্য
প্রদর্শন করেন। এ নতুন জনগোষ্ঠীর প্রতি প্রদর্শিত আনুকুল্য তুর্কীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।৪২
মু‘তাসিম নিজেকে প্রতিষ্ঠিা এবং তুর্কী সেনাবাহিনীর অবস্থানের জন্য সার্মারাতে নতুন রাজধানী স্থাপন
করেছিলেন। খলীফা মুতাওয়াক্কিলও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি নতুন রাজধানীর অনুসন্ধান
করেছিলেন। ২৪৪ হি./৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে দামিশকে রাজধানী স্থাপনের জন্য সংক্ষিপ্ত চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি
প্লেগ-মহামারী দ্বারা বাঁধাগ্রস্থ এবং সম্ভবত ‘ইরাক ও পারস্যের সম্পর্কের দন্দ্ব ও ক্ষমতার কেন্দ্র হতে অনেক
দূরবর্তী হওয়ার কারণেও সেখানে রাজধানী স্থাপন করা হতে নিবৃর্ত্ত হন বলে কথিত আছে।৪৩
২৪৫ হিজরী/৮৫৯-৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সার্মারার সামান্য কয়েক মাইল উত্তরে অবস্থিত একটি স্থানকে
নির্বাচিত করেন, যাকে তিনি জাফারিয়াহ্ নামে অভিহিত করেন।৪৪ এ শহর নির্মানে দু’লক্ষ দীনার ব্যয় হয়। তিনি শহরের কেন্দ্রস্থলে লুলুয়া নামক একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এ শহরটিকে কেউ কেউ জাফারিয়াহ্
আবার কেউ কেউ মুতাওয়াক্কিলিয়াহ্ বলে অভিহিত করেন।৪৫
খলীফা মুতাওয়াক্কিল বুগা আল-কাবীর, ওয়াসীফ আল-কাবীর, ওয়াসীফ আস্-সগীর, দাওয়াজীন
আশরুসানাহ্ প্রমুখ তুর্কী সিফাহ্সালারের বিভিনড়বকর্মতৎপরতার প্রতি চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি
করো কারো জায়গীর বাজেয়াপ্ত করেন। এ জন্য তুর্কীরা তাঁর প্রতি অত্যন্ত অপ্রসনড়ব হয়।৪৬ অপরদিকে খলীফা
মুতাওয়াক্কিল তাঁর পুত্র মুনতাসিরকে তাঁর প্র ম উত্তরাধিকারী বলে মনোনয়ন দান করেন। কিন্তু পরবর্তীতে
ধর্মীয় ‘আকীদার পার্থক্যের কারণে মু‘তাজুকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। এতে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক চরম
খারাপ আকার ধারণ করে।৪৭ এর কিছুদিন পরে খলীফার পুত্র মুনতাসিরের যোগসাজসে বুগা আস্-সগীর
তাঁর চার পুত্র ও তুর্কীদের একটি ছোট দলকে খলীফাকে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে। একরাতে খলীফার
সকল সভাসদ চলে গেলে খলীফা তার চার সঙ্গীসহ ফাতেহ ইব্ন খাকানের সাথে তার দরবারে অবশিষ্ট
ছিলেন। ঘাতকরা খলীফা ও খাকানকে হত্যা করে।৪৮
খলীফা মুতাওয়াক্কিলের ইন্তিকালের পর মুনতাসির বিল্লাহ্৪৯ (২৪৭-২৪৮ হিজরী/৮৬১-৮৬২ খ্রিস্টাব্দ)
খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হন।৫০ খলীফা পদে আসীন হয়ে তিনি আহ্মাদ ইব্ন খুসায়বকে মন্ত্রীত্ব ও বুগা আল- কাবীরকে প্রধান সেনাপতি মনোনীত করেন। তিনি তার পিতা কর্তৃক সিংহাসনে মনোনীত অপর
দু’উত্তরাধিকারী ভ্রাতৃদ্বয় মু‘তাজু ও মুওয়াইয়াদের উত্তরাধিকারী পদ বাতিল করেন।৫১
মুনতাসির যেহেতু তুর্কীদের সহায়তায় খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হন, তাই তুর্কীরা তাঁর খিলাফাতের উপর জেঁকে
বসেছিল। দিন দিন তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেয়ে চলছিল। তাদের এই μমবর্ধমান ক্ষমতা দৃষ্টে
মুনতাসির প্রমাদ গুনলেন। তিনি ভাবলেন যে, তাদের এ μমবর্ধমান প্রভাব প্রতিপত্তি এক সময় তার জন্য
কাল হয়ে দাড়াঁতে পারে। তাই তিনি তাদের ক্ষমতা খর্ব করতে মনস্থ করলেন। তাই তিনি তাঁর ছয় মাসের
খিলাফাত ‘আমলে শী‘আদের প্রতি অনেক আনুগত্য প্রদর্শন করেন। ইমাম হুসাইন (রা)-এর মাযার যিয়ারত
করার পুনঃঅনুমতি প্রদান করেন।৫২ তিনি ‘আলী পন্থীদেরকে তাদের সমুদয় অনুষ্ঠান স্বাধীনভাবে করার
অনুমতি প্রদান করেন। তিনি যখন তুর্কীদের ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টারত হলেন, তখন তুর্কীরা তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও
তাঁর চিকিৎসক ইব্ন তাইফুরকে ৩০ হাজার দীনার উৎকোচ দিয়ে বিষ প্রয়োগে তাঁকে হত্যা করায়। উক্ত
চিকিৎসক রক্তমোক্ষণের ছলে তার উপর বিষ প্রয়োগ করে।৫৩ ২৪৮ হিজরীর ৫ই রবী‘উল-আওয়াল/৮৬২
খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে তিনি ইন্তিকাল করেন।৫৪
মুনতাসির বিল্লাহ্র ইন্তিকালের পর আল-মুসতা‘ঈন বিল্লাহ্৫৫ (২৪৮-২৫২ হিজরী/৮৬২-৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ) ৬
রবি‘উল-আখির সিংহাসনে আরোহন করেন।৫৬ মুহাম্মাদ ইব্ন ‘আবদুল্লাহ্ ইব্ন ত্বাহির ও প্রজাসাধারণ গোলযোগ ও হৈহুল্লো করে তাঁর খিলাফাতের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে ও মু‘তাজুর খিলাফাতের স্বপক্ষে ধ্বনি
তোলে। তুর্কীরা মুসতা‘ঈনকে খিলাফাতে বসায়। অবশেষে মুহাম্মাদ ইব্ন ‘আবদুল্লাহ্ ইব্ন ত্বাহির তাঁর হাতে
বায়‘আত গ্রহণ করেন।৫৭
খলীফা জনৈক তুর্কী সর্দার উতামিশকে উযীর ও আহমাদ ইব্ন খুসাইবকে নায়িবে উযীরসহ রার্ষ্টের সকল বড়
বড় পদে তুর্কীদের আসীন করেন।৫৮ ২৪৯ হিজরী সনে রোমানদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের উপর হামলা
হলে, তাদের হামলা প্রতিহত করতে গিয়ে ‘আমর ইব্ন ‘আবদুল্লাহ্ ও ‘আলী ইব্ন ইয়াহ্ইয়া নামক দু’জন
বিখ্যাত সর্দারসহ অনেক মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। উক্ত সর্দারদ্বয়ের মৃত্যুর সংবাদে বাগদাদে শোকের
কালো ছায়া নেমে আসে। বাগদাদে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা রাজধানী সার্মারায় পৌঁছে চরম
অসন্তোষ প্রদর্শন করে।৫৯তুর্কী সর্দার বুগা আস্-সগীর, বুগা আল-কাবীর, ওয়াসীফ ও উতামিশ তুর্কী বাহিনী
নিয়ে মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে মুসলমানরা পরাজীত হয়।৬০ এমনি অবস্থায় ইয়াহ্ইয়া ইব্ন উমার ইব্ন ইয়াহ্ইয়া ইব্ন হুসাইন ইব্ন যায়দ শহীদ যার উপনাম ছিল আবুল-হুসাইন, তিনি কূফায় বিদ্রোহ
ঘোষণা করে। তুর্কীরা তাকে কূফা থেকে বের করে দিয়ে কূফার পুনর্দখল প্রতিষ্ঠা করে।৬১
২৫০ হিজরী সনে রজব মাসে আবুল-হুসাইন আবার বিজয়ী বেশে কুফায় ফিরে আসে। বাগদাদ বাসীরা তার
সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। হুসাইন ইব্ন ইসমা‘ঈল আবার আবুল-হুসাইন ইয়াহ্ইয়ার উপর আμমণ
চালিয়ে তাকে হত্যা করে। তার শির কেটে সার্মারায় খলীফার দরবারে প্রেরণ করলে, তিনি এটিকে একটি
সিন্দুকে পুরে অস্ত্রাগারে রেখে দেন। তাকে হত্যার জন্য পুরস্কার স্বরূপ ‘আবদুল্লাহ্ ইব্ন ত্বাহিরকে
তাবারিস্তানে বেশ কয়েকটি জায়গীর প্রদান করেন। ইতোমধ্যে খলীফা দলীল ইব্ন ই‘আকূব নাসরানীকে তার
উযীর মনোনীত করেন। যার সাথে বাগর নামক জনৈক তুর্কী সর্দারের বিরোধ দেখা দেয়। এ ব্যাপারে বুগা
আছ্-ছগীর ও ওয়াসিফ দু’জনই বাগরকে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে হত্যা করিয়ে ফেলে। এতে গোটা
সার্মারাবাসী বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ৬২
২৫১ হিজরীর মুর্হারাম মাসে খলীফা বুগা, ওয়াসিফ শাবেক ও আহমাদ ইব্ন সালিহ্ শিরজাকে সাথে নিয়ে
সার্মারা ত্যাগ করে বাগদাদে এসে মুহাম্মাদ ইব্ন ‘আবদুল্লাহ্ ইব্ন ত্বাহিরের ঘরে উঠেন। খলীফার বাগদাদ
আগমনে সমস্ত অফিস ‘আদালতও বাগদাদে স্থানান্তরিত হয়।৬৩ তুর্কীরা তখন সার্মারায় গিয়ে মু‘তাজু ইব্ন
মুতাওয়াক্কিলকে কারাগার থেকে মুক্ত করে, তাঁকে খলীফারূপে বরণ করে নেয়। বুগা আল-কাবীরের পুত্রদ্বয়
মূসা ও ‘আবদুল্লাহ্ মু‘তাজের হাতে বায়‘আত গ্রহণ করে।৬৪ বাগদাদ ও সার্মারায় দু’জন খলীফার শাসন
চলতে থাকে। অবশেষে ২৫১ হিজরী সনের যিল-ক্ব‘দাহ্ মাসে ‘আবদুল্লাহ্ ইব্ন ত্বাহিরের পুত্র মুহাম্মাদ
বাগদাদ অবরোধকারী তুর্কীদের উপর তীব্র আμমণ পরিচালনা করেন।৬৫
বাগদাদে মুসতা‘ঈনের সাথে অবস্থানকারী বুগা ও ওয়াসিফ ছোট ছোট বাহিনী নিয়ে তার সাথে যোগ দেন।
বুগা ও ওয়াসিফযখন তাদের স্বজাতি তুর্কী ভাইদের খুরাসানী ও ‘ইরাকী বাহিনীর মুকাবালায় অসহায়ের মত
পলায়ন করতে দেখলো, তখন তাদের জাত্যাভিমান জেগে উঠলো। তারা ততক্ষণাৎ আনুগত্য পরিবর্তন করে
পরাজীত তুর্কী সেনাদের দলে ভিড়লো। ফলে তুর্কী বাহিনী ছত্রভঙ্গ বাহিনীকে পূণবিন্যস্তকরে পুনরায় বাগদাদ
অবরোধ করলো।৬৬ অবশেষে ২৫২ হিজরীর ৬ মুর্হারাম মাসে মুসতা‘ঈন বিল্লাহ্ একটি লিখিত ইকরারনামা
প্রেরণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে মু‘তাজ বিল্লাহ্র খিলাফাতকে স্বীকৃতি দিয়ে, নিজে খিলাফাতের দাবী থেকে সরে
দাঁড়ান।৬৭ খলীফা মুসতা‘ঈন বিল্লাহ্র খিলাফাতের পর আল-মু‘তায বিল্লাহ্৬৮ (২৫২-২৫৫ হিজরী/৮৬৬-৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ)
খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হন।৬৯ তিনি আহমাদ ইব্ন ইসরা’ঈলকে তার উযীর মনোনীত করেন।৭০ গোপনে
মুসতা‘ঈন বিল্লাহকে হত্যা করান।৭১ ২৫২ হিজরীর রজব (জুলাই ৮৬৬ খ্রি.) মাসে দু’ভাই আহমাদ ও
মুয়াইয়াদকে খিলাফাতের উত্তরাধিকারী পদ থেকে পদচ্যুত করে কারাগারে প্রেরণ করেন এবং সেখানেই হত্যা
করান।৭২
বাগদাদে যে সৈন্য বাহিনী ছিল, তাতে খুরাসানী ও ‘ইরাকী থাকায়, তাদের বেতন ভাতা বন্দ করে দেন।৭৩
ফলে ২৫২ হিজরী রমাযান মাসে বাগদাদে বিদ্রোহ দেখা দেয়। মুহাম্মাদ ইব্ন ‘আবদুল্লাহ্ অতিকষ্টে সে
বিদ্রোহ্ দমন করেন। একই বছরে তুর্কী সৈন্যবাহিনী ও ‘আরব সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়,
তুর্কীরা ‘আরবদের দেশান্তরিত করে।৭৪ এ বছরেই খলীফা হুসাইন ইব্ন আবূ শাওয়ারিরকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেন। খলীফার দাপট ও প্রতিপত্তি যেহেতু প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো, তাই বিভিনড়ব প্রদেশের
সুবাদারগণ নিজেদেরকেই ¯-^ স্ব প্রদেশের মালিক-মুখতার ভাবতে লাগে।৭৫
২৫৩ হিজরীতে (৮৬৭ খ্রি.) তুর্কীরা তাদের সেনাপতি ওয়াসিফ, বুগা ও সীমা তাবীলের কাছে চার মাসের
অগিম্র বেতন ভাতা দাবি করে। খলীফা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে, বিক্ষুদ্ধ তুর্কীরা ওয়াসিফাকে হত্যা
করে।৭৬ খলীফার এসমস্ত কার্যকলাপে আহমাদ ইব্ন তূলূনের নেতৃত্বে ২৫৩ হিজরী সনে মিসর খিলাফাত
হতে বিচ্ছিনড়ব হয়ে পড়ে। অর্থাৎ সেখানে তুলুন৭৭ বংশের রাজত্বের সূত্রপাত্র হয়। সিজিস্তানের শাসনকর্তা
ই‘আকূব স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করে। দায়সের শাসনকর্তা সানীও স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করে। খারিজীগণ
আল-জাযীরা ও মাওসিলে বিদ্রোহ করে। বসরার পার্শ্ববর্তী এলাকায় যানজ বিদ্রোহের প্রাথমিক পর্যায়সমূহ
শুরু হয়। হাসানী ইসমা‘ঈল ইব্ন ইউসূফের নেতৃত্বে হিজাযে এবং যায়দী আল-হাসান ইব্ন যায়দ ইব্ন
মুহাম্মাদের নেতৃত্বে তাবারিস্তানে ‘আলী (রা.)-এর বংশীয় বিদ্রোহ শুরু হয়।৭৮ বাগদাদের পার্শ¦বর্তী এলাকা
থেকে রাজস্ব প্রেরণ বন্ধ হয়ে যায়। এভাবেই মুসলিম সম্রাজ্যের দৃঢ় বন্ধন μমেই শিথিল হতে থাকে। খলীফা
তুর্কী সর্দারদের μীড়নক হওয়ায়, তারা ইচ্ছেমত রাজকোষ লুটে নেয়।৭৯ তুর্কীরা মুহাম্মাদ ইব্ন বুগা আছ্-
ছগীর ও বাইয়ূকবাককে তাদের দলে ভিড়িয়ে, সশস্ত্র হয়ে খলীফার প্রাসাদে বলপূর্বক ঢুকে তাঁর পা ধরে
হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে বাইরে এনে বেদম প্রহার করে, দুপুরের উত্তপ্ত রৌদ্রে খালি মাথায় এক একটি করে
চপেটাঘাত করে তাকে চরম অপদস্থ করে পদত্যাগ পত্র লিখতে বলে। খলীফা তাতে অস্বীকৃতি জানালে,
তারা তাঁকে ভূগর্ভস্থ কামরায় আটক করে রাখে। সেখানেই শাসরুদ্ধ হয়ে তিনি ইন্তিকালে করেন ।৮০
আল-মু‘তায বিল্লাহ্র খিলাফাতের পর মুহ্তাদী বিল্লাহ্৮১ (২৫৫-২৫৬ হিজরী/৮৬৯-৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ) ৩৭ বছর
বয়সে খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হন।৮২ তিনি তুর্কীদের সহযোগিতায় খিলাফাতে আসীন হন। তুর্কী আমলাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রভাব প্রতিপত্তিশীল সালিহ ইব্ন ওয়াসিফ মুহতাদীর অভিষেকের পরই আহমাদ ইব্ন
ইসরা’ঈল যায়দ ইব্ন মু‘তাজু বিল্লাহ্ ও আবূ নূহকে গেফ্র তার করে হত্যা করেন এবং তাদের ধনসম্পদও
বাজেয়াপ্ত করেন। তারপর হাসান ইব্ন মুয়াল্লাদকেও গ্রেফতার করে তাঁর ধনসম্পদও বাজেয়াপ্ত করেন।৮৩
খলীফা তা অবগত হয়ে অত্যন্ত ব্যথিত হন এবং তাকে মৃদু তিরস্কার করে বলেন, এদেরকে গ্রেফতার করাই
কি যথেষ্ট ছিল না! এদেরকে অযথাই হত্যা করার কি প্রয়োজন ছিল ? খলীফা সার্মারা থেকে সমস্ত বায়েজী
নর্তকীদের বহিস্কার এবং শাহী মহল থেকে হিংস্র জন্তুগুলোকে হত্যা ও শখের কুকুর সমূহকে বের করে দেয়ার
নির্দেশ দেন।৮৪ তিনি সুলাইমান ইব্ন ওহাবকে তাঁর উযীরে ‘আযম মনোনীত করেন।৮৫ তিনি খলীফা পদকে
আমীরুল-মু’মিনের উপযুক্ত মহিমায় পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিলেন।
২৫৬ হিজরী সনে কয়েকটি প্রদেশে প্রকৃত বা তথাকথিত ‘আলী পন্থীদের বিদ্রোহ দেখা দেয়। তবে খলীফার
জন্য সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক দুশমন ছিলেন তুর্কী সেনা অধিনায়ক মূসা ইব্ন বুগা, যিনি পারস্যে ‘আলী পন্থী
বিদ্রোহীদের বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি যখন সংবাদ পেলেন যে, সালিহ্ মু‘তাযকে পদচ্যুত করে
মুহতাদীকে খলীফা পদে বসিয়েছে, তখন মু‘তাযের খুনের বদলা নেয়ার ঘোষণা দিয়ে রাজধানী অভিমুখে
রওয়ানা হন। রাজধানীতে উপনীত হয়ে তিনি খলীফার দরবারে হাযির হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলে, সালিহ ইব্ন ওয়াছিক আতড়বগোপন করে। মূসা ইব্ন বুগাকে খলীফার দরবারে উপস্থিত করার অনুমতি প্রদান করলেন। দরবারে উপস্থিত হয়েই মূসা ইব্ন বুগা খলীফাকে বন্দী করে একটি খচ্চরে আরোহণ করিয়ে
বন্দীশালার দিকে নিয়ে যেতে উদ্যত হলো। ২৫৬ হিজরী/৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে সালিহ্ ইব্ন ওয়াছিকের বিচার
করবেন এ মর্মে খলীফাকে প্রতিজ্ঞা করতে বাধ্য করেন। খলীফা চাইতেন যে, কোনμমে মূসা ইব্ন বুগা ও
সালিহ্র মধ্যে সমঝোতা হয়ে যাক। ফলে মূসা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বদ্ধমূল ধারণা হয় যে, খলীফা নিশ্চয়ই
সালিহ্র অবস্থান সম্পর্কে অবগত আছেন এবং তিনিই তাকে গোপন করে রেখেছেন। মূসা ইব্ন বুগার ঘরে
তুর্কী অমাত্যদের গোপন বৈঠক বসে। বৈঠকে স্থির হয় যে, মুহতাদীকে হত্যা অথবা পদচ্যুত করতে হবে।
খলীফা তা জেনে ফেলেন। পরদিনতিনি ‘আম দরবার আহবান করে সশস্ত্র সৈন্য পরিবেষ্টিত অবস্থায় ক্ষুদ্ধ
মূর্তিতে দরবারে উপস্থিত হয়ে, তুর্কীদের সম্বোধন করে বললেন, তোমাদের দূরভীসন্ধির কথা আমি অবগত
আছি, তোমরা আমাকে অন্য খলীফাদের মত ভেবো না। যতক্ষণ আমার হাতে তলোয়ার থাকবে, আমি
তোমাদের কয়েক শো লোককে প্রাণ নিয়ে ছাড়বো। প্রাণ নিতে ও দিতে আমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তোমরা মনে
রাখবে, আমার সাথে বৈরিতা তোমাদের ধ্বংস ডেকে আনবে। আমি শপথ করে বলতে পারি সালিহ্ কোথায়
আছে আমি জানি না। খলীফা তেজদীপ্ত ভাষণে ঐ বিদ্রোহ প্রশমিত হয়।৮৬ মূসার অনুগত এক ব্যক্তি সালিহকে খুঁজে পায়। মূসা ইব্ন বুগা তাকে হত্যা করিয়ে, দেহচ্যুত শির বল্লমের
মাথার উপর রেখে শহর প্রদক্ষিণ করায়।৮৭ খলীফা এতে ভীষণ ব্যথিত হন, কিন্তু তুর্কীদের প্রভাব-প্রতিপত্তির
মুখে খলীফার করার কিছুই ছিল না। শেষ পর্যন্ত খলীফা তুর্কী সর্দার বাকিয়ালের ( بكیال ) নিকট মূসা ইব্ন
বুগাকে হত্যা করার নির্দেশ পাঠালেন। বাকিয়াল এ নির্দেশের কথা মূসা ইব্ন বুগাকে জানিয়ে দেন।
কালবিলম্ব না করে মূসা ইব্ন বুগা স্ব-সৈন্যে খলীফার প্রাসাদে আμমণ করে। এদিকে মাগরিব,
আশরুসানার, ও ফারাগানার সৈন্যরা খলীফার পক্ষে রুখে দাড়াঁলো। বাকিয়াল বন্দী হয়ে খলীফার সম্মুখে
নীত হল। খলীফা তাকে হত্যা করে তার দেহচ্যুত শির তুর্কীদের দিকে ছুঁড়ে মারেন। এতে তুর্কীদের মধ্যে
উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং বাকিয়ালের হত্যাকাণ্ডে বিক্ষুব্ধ ফারাগানা প্রভৃতি স্থানে যে সমস্ত তুর্কীরা এতদিন
খলীফার পক্ষে ছিল তারাও মূসা ইব্ন বুগার বাহিনীতে যোগ দেয়। খলীফা পরাস্ত হন। তুর্কীরা তাঁর
অন্ডকোষদ্বয়ে চাপদিয়ে হত্যা করে।৮৮
খলীফা মুহ্তাদী বিল্লাহ্র ইন্তিকাল (২৫৬ হিজরী সনের ১৪ই রজব/ ৮৭০ খ্রিস্টাব্দের জুন)-এর পর মু‘তামিদ
‘আলাল্লাহ্ (২৫৬-২৭৯ হিজরী/৮৭০-৮৯২ খ্রিস্টাব্দ) ২৫৬ হিজরী সনের ১৬ই রজব খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হন।৮৯ খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হয়ে ‘উবায়দুল্লাহ্ ইব্ন ইয়াহ্ইয়া ইব্ন খাকানকে প্রধান উযীর মনোনীত করেন।
যিনি তাঁর পিতা মুতাওয়াক্কিলের সময় থেকেই উযীর পদে নিযুক্ত ছিলেন। ২৬১ হিজরীর শাওয়াল/৮৭৫
খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে খলীফা মু‘তামিদ একটি ‘আম দরবারে ঘোষণা দেন যে, আমার পরে আমার পুত্র
জা‘ফরই পরবর্তী খলীফা হবেন। তারপর আমার ভাই আহমাদ মুওয়াফ্ফাক হবে খিলাফাতের দ্বিতীয়
দাবিদার। তবে আমার মৃত্যু পর্যন্ত যদি আমার পুত্র জা‘ফর বয়ঃপ্রাপ্ত না হয়, তবে আমার ভাই-ই খলীফা
পদে আসীন হবে এবং এমতাবস্থায় জা‘ফর হবে তার পরবর্তী খলীফা। এ ব্যাপারে সকলের বায়‘আত নেয়া
হয়।৯০ খলীফা হারূর্নু-রশীদের তনয় মু‘তাসিম বিল্লাহ্র শাসনামল থেকেই সার্মিরা ছিল ‘আব্বাসীয়
খলীফাদের রাজধানী। ২৬২ হিজরী সনে খলীফা মু‘তামিদ ‘আলাল্লাহ সার্মিরা থেকে বাগদাদে ফিরে যান।৯১
২৬৩ হিজরী/ ৮৭৬-৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে ‘উবায়দুল্লাহ্ ইব্ন ইয়াহ্ইয়া ইব্ন খাকান অশ্বপৃষ্ঠ থেকে পড়ে গিয়ে
মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁর ইন্তিকালের পর মুহাম্মাদ ইব্ন মুখাল্লাদকে উযীর হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু
তিনি ২৬৩ হিজরী সনের যিল-ক‘দাহ্ মাসের ১১ তারীখ থেকে ২৭ তারীখ পর্যন্ত মাত্র ১৬ দিন উযীর হিসেবে
দায়িত্ব পালণ করেন। তারপর ‘আবদুল্লাহ্ ইব্ন সুলাইমান ইব্ন ওহ্হাব যিনি মুহতাদী বিল্লাহ্র উযীর ছিলেন,
তাকে উযীর নিয়োগ দেয়া হয়।২৬৪ হিজরী সনে সুলাইমান ইব্ন ওহ্হাব বাগদাদ থেকে সার্মারাতে চলে
যান এবং সেখানে গিয়ে নিজেকে খলীফা ঘোষণা করেন। এতে খলীফা মু‘তামিদ ‘আল্লাহ্ তাঁর উপর ক্ষিপ্ত
হয়ে তাঁকে ও তাঁর সন্তান ইব্রাহীমকে গৃহে অšÍি রন করেন। ২৬৪ হিজরী সনের যিল-ক্ব‘দাহ্ মাসের ২৭
তারীখে মুহাম্মাদ ইব্ন মুখাল্লাদকে পুনরায় উযীর হিসেবে নিয়োগ দেন।৯২ ২৭২ হিজরী সনে জেল হাজতেই
সুলাইমান ইব্ন ওহ্হাব ইন্তিকাল করেন। তাঁর ইন্তিকালের পর আবুস্-সকর ইসমা‘ঈল ইব্ন বুলবুল উযীর
পদে আসীন হন।৯৩ খলীফা মু‘তাযিদ বিল্লাহ্ সার্মারা ছেড়ে বাগদাদে বসবাস করার ফলে রাজধানী পুনরায়
বাগদাদে চলে আসে। ফলে খলীফার দরবারে জেঁকে বসা তুর্কী সরদারদের ক্ষমতা লোপ পেয়ে যায়।
রাজধানী পরিবতর্ েনর এ কৃতিত্বও খলীফার ভাই মুওয়াফ্ফাকেরই ছিল। তাঁর দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞাই একাজে উদ্ধুদ্ধ
করেছিল।৯৪
মু‘তামিদ ‘আলাল্লাহ খলীফা হলেও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে তার ভাই আবূ আহ্মাদ খলীফাতুল্লাহ আলমুওয়াফ্
ফাক উপাধি ধারণ করে খিলাফাতের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসেন।৯৫ তার এ কার্যμম পরিচালনার পূর্বে তুর্কীরাই ছিল খিলাফাতের প্রধান চালিকাশক্তি। মুওয়াফ্ফাক ক্ষমতা হাতে নিয়ে তাদের সে
শক্তি খর্ব করে, সে শক্তি নিজ হাতে তুলে নেন।
এতদসত্ত্বেও মু‘তামিদের শাসনামলে রাষ্ট্র ও সরকারের কতৃর্ত ¡ নিতান্তই দুর্বল হয়ে পড়ে। সমগ্র রাজ্যের সর্বত্র
চরম হাঙ্গামা বিরাজ করছিল। যে যেখানে সুযোগ পায় সে সেখানেই রাজ্য দখল করে নেয়। প্রাদেশিক
গভর্ণররা রাজস্ব প্রেরণ বন্দ করে দেয়। যে যে ভূখণ্ড দখল করেছিলো, তারা সেখানেই নিজস্ব আইন কানুন
চালু করে দেয়। সামান বংশীয়রা মাওরাউন্-নাহ্র, সাফার বংশীয়রা সিজিস্তানে, কিরমান খুরাসান ও
পারস্যদেশে, হাসান ইব্ন যায়দ তাবারিস্তানে ও জুর্জানে, হাবশীরা বসরা, আলেপ্পো ওয়াসিতে, খারিজীরা
মসুলে ও জাযীরায়, ইব্ন তুলূন মিসর ও শামে এবং আগলাব আফ্রিকায় নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠা করে নিজ
নিজ রাজত্ব গড়ে তোলে। এছাড়াও অনেক ছোট ছোট সরদাররাও বিভিনড়ব এলাকায় আপন আপন দখল ও
রাজত্ব প্রতিষ্ঠার ¯^ে পড়ব বিভোর হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। খলীফার রাজত্বের নিদর্শন
কেবল এতটুকুই ছিল যে, জুমু‘আর খুতবায় খলীফার নাম উচ্চারিত হতো। রাষ্ট্রীয় কোন কর্মকাণ্ডে খলীফার
নির্দেশ মান্য করা হতো না।৯৬ ২৭৮ হিজরীর ২২ সফর/ ৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুন মুওয়াফ্ফাক ইন্তিকাল করেন। খলীফা মু‘তামিদ তখন
বেঁচে থাকলেও তাঁর মর্যাদা ছিল একজন কয়েদীর ন্যায়। তাঁর মৃত্যু হলে, অমাত্যবর্গ মুওয়াফ্ফাকের পুত্র
আবুল-‘আব্বাস মুতাযিদকে সর্ব সম্মতিμমে যুবরাজ মনোনীত করে। কিন্তু জা‘ফর ইব্ন মু‘তামিদের পর
তার এই যুবরাজ পদ প্রাপ্য ছিলো। জা‘ফর ছিলেন প্র ম যুবরাজ এবং মু‘তাযিদ ছিলেন দ্বিতীয় যুবরাজ
যেমনটি ছিলেন তাঁর পিতা মুওয়াফ্ফাক দ্বিতীয় যুবরাজ। কিন্তু মু‘তাযিদের প্রভাব ও প্রতিপত্তির ভয়ে খলীফা
মু‘তামিদ বিল্লাহ্ নিজ পুত্র জা‘ফরের পরিবর্তে ভ্রাতুষ্পুত্র মু‘তাযিদের যুবরাজত¡ে ক অগ্রগণ্য করে তাকেই প্র ম
যুবরাজরূপে মনোনয়ন দান করেন।
মু‘তামিদের রাজত্বের ২৩ বছর এভাবে অরাজকতা, অস্থিরতা, দূর্ভোগ ও ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই অতিবাহিত
হয়। হাবসী বা জঙ্গিদেরকে উৎখাত করা ছাড়া আর কোন ক্ষেত্রেই সফলতার মুখ দেখা যায়নি।৯৭ তিনি ২৭৯
হিজরী সনে ৫০ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।৯৮
তাঁর ইন্তিকালের পর আল-মু‘তাযিদ বিল্লাহ্৯৯ (২৭৯-২৮৯ হিজরী/৮৯২-৯০৩ খ্রিস্টাব্দ) খিলাফাতে অধিষ্ঠিত
হন।১০০ তিনি তার পূর্ববর্তী খলীফা কর্তৃক নিযুক্ত ‘উবায়দুল্লাহ্ ইব্ন সুলায়মান ইব্ন ওহ্হাবকে আমৃত্যু তার উযীর পদে আসীন রাখেন।১০১ ২৮৮ হিজরীতে তাঁর ইন্তিকালের পর তারই পুত্র আবুল হুসাইন আল-ক্বাসিম
ইব্ন ‘উবায়দুল্লাহ্কে তার স্থলাভিষিক্ত করেন।১০২ তার প্রধান শক্তিছিল তার পিতার নিকট হতে উত্তরাধিকার
সূত্রে প্রাপ্ত সেনাবাহিনীর সাথে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ও বেসামরিক ও সামরিক নেত্রীবৃন্দের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও
সমন্বয়পূর্ণ সম্পর্ক এবং ‘আব্বাসীয় পরিবারের ক্ষমতা দৃঢ়ভাবে পূণঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি এ শক্তিকে
ব্যবহার করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।তিনি স্বয়ং তার সেনাবাহিনী পরিচালনা করেন এবং যুদ্ধাভিযানে তার
রাজত্বকালের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন।১০৩ খলীফা মু‘তাযিদ বিল্লাহ্ মককার দারুন্-নদওয়া নামক
কুরাইশদের সেই ইতিহাস বিখ্যাত মন্ত্রণাগৃহটি ভেঙ্গে দিয়ে বায়তুল-হারাম মসজিদের পার্শ্বে তদস্থলে একটি
মসজিদ নির্মাণ করেন।১০৪
তিনি খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হয়ে বিভিনড়ব এলাকায় বিদ্রোহের সম্মুখিন হন। মুসেলে খারিজীদের দু’টি দল
পরস্পর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলো। তন্মধ্যে একদলের নেতা আবূ জূযা ২৮০ হিজরী সনে বন্দী হয়ে বাগদাদে
নীত হলে তিনি তাকে হত্যা করান। অপর দলের নেতা হারূন শাবী বিদ্রোহী তৎপরতায় লিপ্ত থাকায় খলীফা
নিজেই জাযিরায় অভিযান চালিয়ে বণী শাযরানের গোত্র সমূহকে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি বিধান করে প্রচুর
গণীমতের মাল নিয়ে বাগদাদে প্রত্যাবর্তন করেন।১০৫ ২৮১ হিজরী সনে মারভীন দুর্গ দখলকারী হামদান ইব্ন
হামদুনকে বন্দী করেন, যার সাথে খারিজী নেতা হারুন শাবীর সাথে সখ্যতা ছিল।১০৬ খলীফা এ সময়
মারভীন দুর্গ ধূলিস্সাৎ করে দেন। পারসিক বংশোদ্ভূত লোকদের সংখ্যা বেশী হওয়ায় নওরোজের দিন তারা
বাগদাদে উৎসব পালন ও অগিড়ব প্রজ্জ্বলনের প্র া চালু করেছিল। ২৮২ হিজরী সনে খলীফা এক ফরমান বলে
তা বন্ধ করে দেন।১০৭ ২৮৩ হিজরী সনের রবি‘উল-আওয়াল মাসে খলীফা স্ব-সৈন্যে মসুলে উপস্থিত হয়ে হারুন শাবী খুমারীকে উৎখাত করতে সক্ষম হন। তিনি হারূনকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন ও
পরবর্তীতে হত্যা করেন।১০৮ তিনি মীরাছ সংμান্ত অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন এবং যাবীল-আরহামদের জন্যও
উত্তরাধিকার দানের ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। প্রজাসাধারণ এতে তাঁর প্রতি অত্যন্ত প্রীত হয় এবং তাঁর
জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।১০৯
২৮৫ হিজরী সনে আযারবায়জান আμমণ করে আমুদ কেল্লা অধিকার করেন এবং আহমাদ ইব্ন ‘ঈসা ইব্ন
শায়খকে গ্রেফতার করেন।১১০ ২৮৬ হিজরী সনে তিনি বাগদাদে ফিরে আসেন।১১১ অধিক সঙ্গমজনিত কারণে
অসুস্থ হয়ে ২৮৯ হিজরী সনে তিনি ইন্তিকাল করেন।১১২
খলীফা মু‘তাযিদ বিল্লাহ্র ইন্তিকালের পর আল-মুকতাফী বিল্লাহ্১১৩ (২৮৯-২৯৫ হিজরী/৯০২-৯০৮
খ্রিস্টাব্দ) সিংহাসনে আরোহণ করেন।১১৪ তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে তাঁর পিতা কতৃর্ক নিয়োগ প্রাপ্ত আবুল-হুসাইন আল-ক্বাসিম ইব্ন ‘উবায়দুল্লাহ্ ইব্ন সুলাইমান ইব্ন ওহাবকে আমৃত উযীর হিসেবে বলবত
রাখেন। ২৯১ হিজরী সনে তাঁর ইন্তিকালের পর আল-‘আব্বাস ইব্নুল-হাসানকে উযীর হিসেবে নিয়োগ
দেন।১১৫ উদারনীতির কারণে তিনি জনগণের সমর্থন ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি তার পিতা কতৃর্ক
নির্মিত রাজধানী নগরীর ভূ-গর্ভস্থ বন্দীসালাসমূহের ধ্বংস সাধন, বন্দিদের মুক্তি প্রদান এবং বাজেয়াপ্তকৃত
জমি প্রত্যর্পণ করেন।১১৬ তিনি একজন সাহসী ও নির্ভীক নেতারূপে নিজেকে প্রমাণ করেন। বহুসংখ্যক
খিলাফাতের শত্রুর বিরুদ্ধে সফল সংগ্রাম করেন। কিরমিতা১১৭ সম্প্রদায় সিরিয়া অঞ্চলে প্রচণ্ড তাণ্ডব চালাতে
থাকে, একের পর এক শহর তাদের কবলে পতিত হতে থাকে, এমনকি দামিশক নগরী তাদের দ্বারা লুণ্ঠিত
হয়।১১৮ ২৯০ হিজরী সনে তিনি মুহাম্মাদ ইব্ন সুলাইমানকে একটি বিশাল বাহিনী দিয়ে দামিশকে
কিরমিতীদের দমনের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। মুহাম্মাদ ইব্ন সুলাইমান অত্যন্ত সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার
সাথে কারামিতাদের মুকাবিলা করেন। কিরমিতাদের সর্দার আবুল কাসিম ইয়াহ্ইয়া ইব্ন যাকরাওয়াই ২৯১
হিজরীর ৬ই মুর্হারাম (৯০৩ খ্রি. ৩০ নভেম্বর) গেফতার হয়। তাদের অনেকেই হতাহত ও অনেকে বন্দী
হয়, আবার অনেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।১১৯ ২৯২ হিজরী সনে খলীফা মুহাম্মাদ ইব্ন সুলাইমানকে তূলূন বংশকে ধ্বংস করার জন্য মিসরে পাঠান। যুদ্ধে
হারূনইব্ন খুমারুভিয়া নিহত হন। মিসর মুহাম্মাদ ইব্ন ইসমা‘ঈলের পদানত হয়। তূলূন বংশের প্রত্যেকে
বন্দী অবস্থায় বাগদাদে নীত হয়। তূলূন গোষ্ঠীর শাসনের অবসান হয়। খলীফা দরবার থেকে ঈসা নওশরীকে
মিসরের গভর্নর নিয়োগ করে, তথায় প্রেরণ করেন। মুহাম্মাদ ইব্ন সুলাইমান তাঁর হাতে মিসরের শাসন বুঝিয়ে দিয়ে বাগদাদে ফিরে আসেন।১২০ ২৯৪ হিজরী সনে আবুল-হায়জ ‘আবদুল্লাহ্ ইব্ন হামদান ইব্ন
হামদুন আদভী তাগলবী মুসলের কুর্দীদের পরাভূত করেন।১২১ ২৯৫ হিজরী সনের জমাদিউল-আওয়াল (মার্চ
৯০৮ খ্রি.) মাসে তিনি ইন্তিকাল করেন।১২২ অতপর তুর্কীরা আপন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অল্প
বয়স্কদেরকে খিলাফাতে অধিষ্ঠিত করতে থাকে। তাই মাত্র ১৩ বছর বয়সী আল-মুকতাদির বিল্লাহ্কে১২৩
(২৯৫-৩২০ হিজরী/৯০৮-৯৩২ খ্রিস্টাব্দ) খিলাফাতে অধিষ্ঠিত করে।১২৪ অতি অল্পবয়সের কারণে অনেকেই
খলীফা মু‘তাজের পুত্র আবূ ‘আবদুল্লাহ্ মুহাম্মাদকে সিংহাসনে বসানোর জন্য প্ের রাচনা দিতে লাগলো।
কিছুদিনের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হওয়ায় মুতাওয়াক্কিলের পুত্র আবুল-হুসাইনকে সিংহাসনে বসাবার প্রস্তুতি চলতে
থাকে। ঘটনাμমে তারও মৃত্যু হয়। দু’জন প্রস্তাবিত ব্যক্তির মৃত্যু খলীফা মুকতাদিরের খিলাফাতের ভিত্তি
একরূপ শক্তই হয়ে যায়। কয়েকদিন পর পুনরায় কানাঘুষা শুরু হয় এবং অমাত্যবর্গ ‘আবদুল্লাহ্ ইব্ন
মুতাজ্জকে সিংহাসনে আরোহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু উযীরে ‘আযম ‘আব্বাস ইব্ন হুসাইন তাদের সাথে
যুক্ত ছিলেন না। তাই ২৯৬ হিজরী সনের ২০ শে রবী‘উল-আওয়াল (ডিসেম্বর ৯০৮ খ্রি.) উযীর ‘আযমকে
হত্যা করা হয়। পরদিন ২১ শে রবী‘উল-আওয়াল ২৯৬ হিজরীতে মুকতাদিরকে পদচ্যুত বলে ঘোষণা করা হয় এবং ইব্নুল-মু‘তাজ্জকে খলীফা নির্বাচিত করা হয়।১২৫ ‘আবদুল্লাহ্ ইব্ন মু‘তাজ্জ সিংহাসনে বসে আলমুরতাযা
বিল্লাহ্ উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি মুকতাদিরকে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করতে নির্দেশ দেন। খোজা
সেনাপতি মু’নিস আল-মুজাফ্ফার১২৬ মুকতাদিরকে রক্ষা করার জন্য স্ব-দলবলে এগিয়ে আসেন। ‘আবদুল্লাহ্
ইব্ন মু‘তাজ্জ গ্রেফতার হয়ে নিহত হন। খলীফা আল-মুকতাদির স্ব-পদে বহাল থাকেন।১২৭ তিনি মুনিস
খাদিমকে পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব ও আবুল-হাসান ‘আলী ইব্ন মুহাম্মাদ ইব্নুল-ফুরাতকে উযীরে ‘আযম
মনোনীত করেন।১২৮ খলীফা আল-মুকতাদির স্বাধীনচেতা শাসক ছিলেন না। তিনি অত্যন্ত দুর্বল এবং
বিলাসপ্রিয় থাকায় মন্ত্রীগণই প্রকৃত পক্ষে সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। তিনি কখনো কখনো হারেমবাসিগণ
কর্তৃক এবং কখনো কখনো উযীরগণ কর্তৃক পরিচালিত হতেন।১২৯ তিনি খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর
বিভিনড়ব সময়ে বিভিনড়ব অঞ্চলের বিদ্রোহের সম্মুখিন হন। কিরমিতা সম্প্রদায় একাধিকবার বিদ্রোহ ঘোষণা
করে। ৩০১ হিজরী (৯১৩-১৪ খ্রি.) সনে মুকতাদির তাঁর চার বছরের শিশু সন্তান আবুল-‘আব্বাসকে তাঁর
সিংহাসনের উত্তরাধিকার মনোনীত করেন এবং মিসরের মাগরিবের গভর্ণরী তার নামে প্রদান করে, মুনিস
খাদিমকে মুযাফ্ফার উপাধিতে ভূষিত করে, ‘আমীরুল উমারা’ মনোনীত করে, মিসর অভিমুখে প্রেরণ
করেন।১৩০ ৩০২ হিজরী (৯১৪-১৫ খ্রি.) সনে ‘উবায়দুল্লাহ্ মাহ্দী তাঁর সেনাপতি হাবাসা কাতামীকে
আলেকজান্দ্রিয়া আμমণের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। মিসরে অবস্থানরত মুনিস তাকে পরাভূত করেন।১৩১ ৩০৭ হিজরীতে উবায়দুল্লাহ্ মাহ্দী তাঁর পুত্র আবুল-ক্বাসিমকে একটি বিশাল বাহিনী সাথে দিয়ে মিসর
আμমণের উদ্দেশে প্রেরণ করে। তারাও মুনিস খাদিমের হাতে পরাভূত হয়।১৩২ ৩১১ হিজরী সনে
কিরমিতাদের প্রধান আবূ ত্বাহির সুলায়মান ইব্ন হাসান আল-জানড়বাবী আল-কিরমিতী বসরাতে আμমণ করে
তা অধিকার করে, ১৬/১৭ দিন সেখানে অবস্থান করে লুটপাট চালিয়ে প্রচূর মালপত্র ও বন্দী শিশু ও নারীসহ
হাজরের দিকে যাত্রা করে। খলীফা মুকতাদির এ দুঃসংবাদ অবগত হয়েই মুহাম্মাদ ইব্ন ‘আবদুল্লাহ্
ফারূকীকে গভর্ণরী সনদ দিয়ে স্বসৈন্য বসরা অভিমুখে রওয়ানা হন।১৩৩ ৩১২ হিজরী সনে আবূ ত্বাহির আল- জানড়বাবী তার লোক-লস্কর নিয়ে মককা থেকে প্রত্যাগমনকারী হাজ্জযাত্রীদের কাফেলা লুটপাট করে। যারফলে
৩১৩ হিজরী (৯২৫-২৬ খ্রি.) ও ৩১৪ হিজরী সনে এই দুইবছর কিরমিতাদের ভয়ে কেউ হজ্জ করতে
যায়নি।১৩৪ ৩১৪ (৯২৬-২৭ খ্রি.) ও ৩১৫ (নভেম্বর ৯২৭ খ্রি.) হিজরী সনের রমাযান মাসে কিরমিতাদের
হাতে খলীফা মুকতাদিরের বাহিনী পরাভূত হয়। অবশেষে ৩১৬ হিজরীতে (৯২৮-৯২৯ খ্রি.)‘ঈসা ইব্ন মূসা,
হারূন ইব্ন গরীব, সাফী আল-বাসরী ও ইব্ন ক্বায়স প্রমুখ সর্দারকে কিরমিতাদের নির্মূল করার উদ্দেশ্যে
প্রেরণ করেন। অবশেষে তারা পরাস্ত হয়।১৩৫
৩১৭ হিজরীতে (৯৩০ খ্রি.) মুনিস ইব্ন মুযাফ্ফার মুকতাদিরকে সিংহাসনচ্যুত করে। কারণ খলীফা
মুকতাদির মুনিসের স্থলে হারূন ইব্ন গরীবকে হাজিব পদে অধিষ্ঠিত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। মুনিস তা
অবগত হয়ে খলীফার উপর অনাস্থা প্রকাশ করেন এবং খলীফাকে গ্রেফতার করেন। মু‘তাযিদের পুত্র
মুহাম্মাদকে আল-কাহির বিল্লাহ্ উপাধিতে ভূষিত করে সিংহাসনে বসান। কিন্তু বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর
সদস্যদের বেতন বাড়ানোর দাবী পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় কিছুদিন যেতে না যেতেই মুকতাদির বিল্লাহ্ স্ব-পদে
ফিরে আসেন।১৩৬ ৩১৮ হিজরীর (৯৩১ খ্রি.) হজ্জের মওসূমে আবূ ত্বাহির কিরমিতা সসৈন্যে মক্কা
মু‘আয্যামায় গমণ করে। তখন ছিল হজ্জের মওসুম। বাগদাদ থেকে মানসূর দায়লামী আমীরুল হুজ্জাজ হয়ে
রওয়ানা হয়েছিলেন। তিনি ৮ই যিলহজ্জ মক্কায় উপনীত হন এবং আবূ ত্বাহির ৯ই যিলহজ্জ মক্কায় উপনীত
হয়ে, আবার হাজীদের হত্যাকরে যমযম কূপে তাদের লাশ নিক্ষেপ করতে থাকে, হাজরে আসওয়াদ লৌহ মুদগর দিয়ে টুকরো টুকরো করে এবং এগার দিন পর্যন্ত তা কা‘রা প্রাচীর থেকে বিচ্ছিনড়ব অবস্থায় ফেলে রাখে,
কা‘বা ঘরের দরজা ভেঙ্গে ফেলে, হাজীদের সর্বস্ব লুট সহ বিশৃঙ্খলা করে।১৩৭ ৩২০ হিজরীর সফর
(ফেব্রয়ারী/মার্চ) মাসে মুনিস খাদিম মুসেল দখল করে এবং খলীফা কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত শাসককে তাড়িয়ে
দেয়। মুনিস বাগদাদে আগমণ করে খলীফা মুকতাদিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এতে খলীফা পরাভূত হন।
মুনিসের বাহিনীভূক্ত বার্বার একটি দল খলীফাকে তীর নিক্ষেপে হত্যা করে শির দেহচ্যুত করে এবং শীর
মুনিসের নিকট হাযির করে। ১৩৮
Leave a Reply