মক্কা বিজয়
মক্কা বিজয় >> সহীহ মুসলিম শরীফ এর মুল সুচিপত্র দেখুন >> নিম্নে মুসলিম শরীফ এর একটি অধ্যায়ের হাদিস পড়ুন
৩১. অধ্যায়ঃ মক্কা বিজয়
৪৫১৪. আবু হুরাইরাহ [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
আবদুল্লাহ ইবনি আবু রাবাহ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বলেন, আমি একটি প্রতিনিধি দলের সাথে {যার মধ্যে আবু হুরায়রা [রাদি.] –ও ছিলেন} রমাযান মাসে মুআবিয়াহ [রাদি.] –এর কাছে গেলাম। তখন তাঁরা একে অন্যের জন্য খানা পাকাতেন। আবু হুরায়রা [রাদি.] অধিকাংশ সময় আমাদেরকে তাহাঁর বাসস্থানে দাওয়াত করিতেন। সুতরাং একদিন আমি তাঁকে বললাম, আমিও খানা তৈরী করবো এবং সকলকেই আমার বাসস্থানে দাওয়াত করবো। আমি খানা তৈরীর নির্দেশ দিলাম। এরপর আবু হুরায়রা [রাদি.]–এর সঙ্গে আমি বিকালে দেখা করলাম এবং বললাম, আজ রাত আমার বাসায় আপনার দাওয়াত। আবু হুরায়রা [রাদি.] বলিলেন, আপনি আজ আমার পূর্বেই দাওয়াত দিয়ে দিলেন, আমি বললাম, হ্যাঁ। আমি সকলকেই দাওয়াত করলাম। তখন আবু হুরায়রা [রাদি.] বলিলেন, হে আনসার সম্প্রদায়! আমি কি তোমাদের সম্পর্কে একটি হাদীস বর্ণনা করবো না?
তারপর তিনি মক্কা বিজয়ের ঘটনার বিবরণ দিতে শুরু করিলেন। তিনি বলিলেন, রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] মাক্কার দিকে অগ্রসর হলেন এবং পরিশেষে তিনি তথায় উপনীত হলেন। এরপর যুবায়রকে মাক্কার একদিকে এবং খালিদ ইবনি ওয়ালীদকে অপর দিকে প্রেরণ করিলেন। আর আবু উবাইদাহ [রাদি.] –কে সেসব লোকদের উপর নেতা বানিয়ে পাঠালেন যাদের কাছে লৌহ বর্ম ছিলনা। তাঁরা উপত্যকার ভিতরের পথ অবলম্বন করে চললেন। আর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] ছিলেন একটি ছোট সেনাদলের মধ্যে। তিনি তাকালেন এবং আমাকে দেখে বলিলেন, হে আবু হুরায়রা! আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল [সাঃআঃ]! আমি উপস্থিত। এরপর তিনি বললেনঃ আমার নিকট আনসার ছাড়া আর কেউ যেন না আসে। শাইবান ব্যতীত অন্য বর্ণনাকারী অতিরিক্ত বর্ণনা করিয়াছেন যে, তারপর তিনি বললেনঃ আনসারদেরকে আহ্বান করো। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর আনসারগণ তাহাঁর চারপাশে জমায়েত হলেন। এদিকে কুরায়শগণও তাদের বিভিন্ন গোত্রের লোক এবং অনুগতদেরকে একত্রিত করলো। এরপর তারা বলিল, আমরা তাদেরকে আগে প্রেরণ করব। যদি তাদের ভাগে কিছু জুটে, তবে আমরাও তো তাদের সঙ্গেই আছি। আর যদি তারা বিপদের সম্মুখীন হয় তবে তারা আমাদের কাছে যা চাইবে, তাই দিয়ে দেব। এরপর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] সাহাবীগণকে বলিলেন, তোমরা কি কুরায়শের বিভিন্ন গোত্রের লোক এবং তাদের অনুগতদেরকে দেখিতে পাচ্ছ? এরপর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] তাহাঁর একহাত অপর হাতের উপর রেখে ইঙ্গিত করিলেন, [মাক্কার পথে যারা তোমাদের বাধা দেয় তোমরা তাদের খতম করে দিবে।] এরপর বলিলেন, অবশেষে সাফা পাহাড়ে তোমরা আমার সঙ্গে মিলিত হইবে। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা অগ্রসর হইতে লাগলাম। আমাদের মধ্য হইতে কেউ যাকে হত্যা করিতে চেয়েছে তাকে হত্যা করেছে। তাই তাদের মধ্য হইতে কেউই আমাদের উপর আক্রমণ করিতে সাহস পায়নি। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আবু সুফইয়ান এসে বলিলেন, হে আল্লাহর রসূল [সাঃআঃ]! আজ কুরায়শ সম্প্রদায়ের রক্ত হালাল করে দেয়া হয়েছে। আজকের পরে আর কোন কুরায়শের অস্তিত্ব থাকিবে না। তখন রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] ঘোষণা দিলেন, যে ব্যক্তি আবু সুফইয়ানের ঘরে প্রবেশ করিবে সে নিরাপদ। সুতরাং আনসারগণ একে অপরের সাথে বলাবলি করত লাগলো যে, লোকটিকে [রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] –কে] স্বদেশের অনুরাগ এবং আত্মীয়-স্বজনের প্রেমে পেয়ে বসেছে। আবু হুরায়রা [রাদি.] বলেন যে, তখনই ওয়াহী অবতীর্ণ হলো। যখন ওয়াহী অবতীর্ণ হতো তখন তা আমাদের নিকট গোপন থাকত না। ঐ সময় কারো সাধ্য হতো না যে, রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] –এর দিকে চোখ তুলে দেখে যতক্ষণ না ওয়াহী শেষ হতো। এরপর যখন ওয়াহী শেষ হলো, তখন রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] বলিলেন, হে আনসার সম্প্রদায়! তাঁরা বলিলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমরা আপনার কাছে হাজির। তখন তিনি বললেনঃ তোমরা কি বলেছ যে, “লোকটিকে স্বদেশের অনুপ্রেরণায় পেয়ে বসেছে”। তখন তারা বলিলেন, এ রকম কিছু হয়েছে। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] বললেনঃ কখনও না। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর বান্দা এবং তাহাঁর প্রেরিত রসূল। আমি আল্লাহর উদ্দেশে স্বদেশ ত্যাগ করে তোমাদের কাছে গিয়েছি। আমার জীবন ও মরণ তোমাদের সাথে। তারা কাঁদতে কাঁদতে নবী [সাঃআঃ] –এর দিকে অগ্রসর হলেন এবং বলিতে লাগলেন, আল্লাহর শপথ! আমরা যা বলেছিলাম, তা ছিল আল্লাহ্ ও তাহাঁর রসূলের প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও দুর্বলতার কারণে। এরপর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] বলিলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ও তাহাঁর রসূল তোমাদের বক্তব্য বিশ্বাস করেন এবং তোমাদের ওজর গ্রহণ করিয়াছেন। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর মাক্কার জনগণ আবু সুফইয়ানের বাড়ীর দিকে চলে গেল [জীবন রক্ষার জন্যে] আর অন্যান্য মানুষ আপন ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে রইল। এরপর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] হাজর আসওয়াদ–এর নিকটবর্তী হয়ে তাকে চুম্বন করিলেন এবং বাইতুল্লাহ শারীফের তাওয়াফ করিলেন। এরপর তিনি বাইতুল্লাহর কাছে থাকা একটি মূর্তির নিকটবর্তী হলেন, যাকে তারা উপাসনা করতো। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]–এর হাতে তখন একটি ধনুক ছিল, তিনি এর এক প্রান্ত ধরে রেখেছিলেন। যখন তিনি মূর্তিটির নিকটবর্তী হলেন তখন তিনি তা দ্বারা এর চোখে খুঁচাতে লাগলেন এবং বলিলেন, “সত্য আগমন করেছে এবং বাতিল [মিথ্যা] চলে গেছে।” এরপর বাইতুল্লাহর তাওয়াফ শেষে তিনি সাফা পাহাড়ের দিকে গেলেন। এরপর তাতে আরোহণ করে বায়তুল্লাহর দিকে চেয়ে দেখলেন এবং দুহাত উঁচু করে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিলেন এবং তাহাঁর যা প্রার্থনা করার ছিল তাই প্রার্থনা করিলেন।
[ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৪৭১, ইসলামিক সেন্টার- ৪৪৭৩]
৪৫১৫. সুলাইমান ইবনি মুগীরাহ [রাদি.] থেকে উক্ত সানাদ হইতে বর্ণীতঃ
তবে তার হাদীসে অতিরিক্ত এ কথা উল্লেখ রয়েছে যে, তারপর তিনি তার এক হাত অপর হাতের উপর রেখে ইঙ্গিত করে বলিলেন, তোমরা তাদেরকে শেষ করে দাও। এতে আরো উল্লেখ রয়েছে যে, তখন তারা বলিলেন, হে আল্লাহর রসূল [সাঃআঃ]! আমরা এ রকম কিছু বলেছি। তখন তিনি বলিলেন, তাহলে আমার নামের কী আর থাকিবে। সুতরাং এমনটি কখনো হইবে না। আমিতো আল্লাহর বান্দা ও রসূল।
[ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৪৭২, ইসলামিক সেন্টার- ৪৪৭৪]
৪৫১৬. আবদুল্লাহ ইবনি রাবাহ [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, আমরা ভ্রমণ করে মুআবিয়াহ ইবনি আবু সুফইয়ান [রাদি.]–এর নিকট গেলাম। আমাদের মধ্যে তখন আবু হুরায়রা [রাদি.] –ও ছিলেন। প্রত্যেকেই একদিন তাহাঁর সাথীর জন্য খানা তৈরী করিতেন। একদিন আমার পালা আসল। তখন আমি বললাম, হে আবু হুরায়রা! আজতো আমার পালা। অতএব সকলেই আমার বাসস্থানে এলেন, তখনও খানা রান্না করা শেষ হয়নি। তখন আমি বললাম, হে আবু হুরায়রা! আপনি যদি আমাদেরকে খানা তৈরীর পূর্ব পর্যন্ত রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]–এর কোন হাদীস বর্ণনা করিতেন! [তবে ভাল হতো] অতএব তিনি বলিলেন, আমরা মক্কা বিজয়ের দিন রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] –এর সঙ্গে ছিলাম। তখন খালিদ ইবনি ওয়ালীদ [রাদি.]–কে ডানদিকের বাহিনীর এবং যুবায়র [রাদি.]–কে বাম দিকের বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করিলেন। আবু উবাইদাহ [রাদি.]–কে পদাতিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করিলেন প্রান্তর অতিক্রম করার জন্য। এরপর তিনি বলিলেন, হে আবু হুরায়রা! আনসারদেরকে আমার কাছে আসার জন্য আহ্বান কর। অতএব আমি তাদেরকে আহ্বান করলাম। এরপর তাঁরা দ্রুত আসলেন। তখন তিনি বলিলেন, হে আনসার সম্প্রদায়! তোমরা কুরায়শদের বিভিন্ন গোত্রের বিরাট জমায়েত কি দেখিতে পাচ্ছ, তারা সবাই বলিল হ্যাঁ। অতএব তিনি বলিলেন, আগামীকাল যখন তোমরা [যুদ্ধক্ষেত্রে] তাদের মুকাবিলা করিবে তখন তাদেরকে সম্পূর্ণ নির্মূল করে দেবে। তারপর তাহাঁর ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে ইঙ্গিতে বললেনঃ তাদেরকে সমূলে বিনষ্ট করে দেবে। তারপর বললেনঃ আমার সাথে তোমাদের একসাথে হওয়ার জায়গা সাফা পাহাড়। বর্ণনাকারী বলেন, সেদিন যে কোন বিধর্মী আনসারদের লক্ষ্যস্থলে পড়েছে, তাকেই তারা নির্মূল করেছে। এরপরে রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] সাফা পাহাড়ের উপর আরোহণ করিলেন। তখন আনসারগণ তথায় উপনীত হয়ে সাফা পাহাড় ঘিরে ফেললো। ইত্যবসরে আবু সুফইয়ান এলেন এবং বলিলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! কুরায়শদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আজ থেকে আর কোন কুরায়শের অস্তিত্ব থাকিবে না। এরপর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] বলিলেন, যে ব্যক্তি আবু সুফইয়ানের বাড়িতে প্রবেশ করিবে সে নিরাপত্তা পাবে। যে অস্ত্র ফেলে দিবে সেও নিরাপদ এবং যে স্বীয় গৃহের দরজা বন্ধ করে রাখবে সেও নিরাপত্তা পাবে। তখন আনসারগণ বলাবলি করছিল যে, এ লোকটিকে [রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]-কে] স্বীয় গোত্রের ভালোবাসা এবং স্বদেশের অনুরাগে পেয়ে বসেছে। এমতাবস্থায় রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]–এর উপর ওয়াহী নাযিল হলো। এরপর তিনি জিজ্ঞেস করিলেন, তোমরাই কি বলেছিলে যে, “এ লোকটিকে [মুহাম্মাদ [সাঃআঃ] -কে] স্বীয় গোত্রের ভালোবাসা এবং স্বদেশের অনুরাগে পেয়ে বসেছে।” সাবধান! তোমরা কি জান আমার নাম কী? এ কথাটি তিনি তিনবার বলেছেন। আমি হলাম মুহাম্মাদ, আল্লাহর বান্দা এবং তাহাঁর রসূল। আমি আল্লাহর নির্দেশেই তোমাদের কাছে হিজরত করেছি। আমার জীবন ও মরণ তোমাদের জীবন ও মরণের সাথে সম্পৃক্ত। তখন তাঁরা বলিল, আল্লাহর শপথ! আমরা এ কথা বলেছিলাম আল্লাহ্ ও তাহাঁর রসূলের প্রতি দুর্বলতার কারণে। [যেন তিনি আমাদেরকে ছেড়ে না যান।] নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ও তাহাঁর রসূল তোমাদের সত্য বলে গ্রহণ করিয়াছেন এবং তোমাদের ওজর কবুল করিয়াছেন।
[ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৪৭৩, ইসলামিক সেন্টার- ৪৪৭৫]
Leave a Reply