নামাজের পূর্ববর্তী শর্তসমূহ – আল হিদায়া কেতাব
নামাজের পূর্ববর্তী শর্তসমূহ – আল হিদায়া কেতাব >> আল হিদায়া ফিকহ এর মুল সুচিপত্র দেখুন
কিতাবঃ আল হিদায়া, তৃতীয় অনুচ্ছেদ : নামাজের পূর্ববর্তী শর্তসমূহ
মুসল্লীর জন্য যাবতীয় হাদাছ ও নাজাসাত থেকে প্রাক-পবিত্রতা অর্জন ওয়াজিব। সে পদ্ধতিতে, যা ইতোপূর্বে আমরা বলে এসেছি। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন- তুমি তোমার কাপড় পাক রাখো।
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেছেন- যদি তোমরা জুনুবী হও তাহলে উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করো।
আর ছতর ঢাকবে। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেছেন- অর্থাত্ প্রত্যেক নামাজের সময় তোমরা এমন পোশাক পরিধান করো, যাতে তোমাদের সতর ঢাকে। এবং রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) বলেছেন- পুরুষের সতর হলো নাভি থেকে হাঁটুর মধ্যবর্তী অংশ। অন্য বর্ণনায় আছে- তার নাভির নীচ থেকে তার হাঁটু অতিক্রম করে যাওয়া পর্যন্ত । এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নাভি সতরের অন্তর্ভূক্ত নয়। ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) ভিন্নমত পোষণ করেন।
হাটু সতরের অন্তর্ভূক্ত। এ সম্পর্কেও ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) ভিন্নমত পোষণ করেন। হাদিসের কে আমরা সহ এর অর্থে গ্রহণ করেছি। দ্বিতীয় হাদিসের শব্দের উপর আমল করার প্রেক্ষিতে এবং রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) নিম্নোক্ত হাদিসের উপর আমল করার উদ্দেশ্যে-হাটু সতরের অন্তর্ভূক্ত।
স্বাধীন নারীর মুখমন্ডল ও হাতের কবজি ছাড়া সমস্ত শরীর সতর। কেননা রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ)বলেছেন- স্ত্রীলোক আওরত, যা ঢেকে রাখা কর্তব্য। দুটি অংগকে ব্যতিক্রম করার কারণ হলো তা প্রকাশ করা অনিবার্য।
হিদায়া গ্রন্থকার বলেন, এ ব্যতিক্রম স্পষ্ট নির্দেশ করে যে, পায়ের পাতা সতর আর এক বর্ণনায় আছে যে, তা সতর নয়। এ-ই বিশুদ্ধ মত।
যদি কোন স্ত্রীলোক পায়ের গোছার এক-চতুর্থাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ খোলা অবস্থায় নামাজ আদায় করে তাহলে সে তার নামাজ দোহরাবে। এ হল ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর মত। আর যদি তা এক-চতুর্থাংশের কম হয়, তাহলে নামাজ দোহরাবে না। নামাজের পূর্ববর্তী শর্তসমূহ
ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) বলেন, অর্ধেকের কম হলে দোহরাবে না। যেহেতু কোন কিছুকে তখনই অধিক বলে আখ্যায়িত করা হয়, যখন তার বিপরীত বস্তুটি পরিমাণে তার চেয়ে কম হয়। কেননা, কম ও বেশী শব্দ দুটি তুলনামূলক।
‘অর্ধেক সম্পর্কে তার পক্ষ হতে দুটি বর্ণনা রহিয়াছে- এক বর্ণনায় ‘কম এর গণ্ডি বহির্ভূত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করেছেন। অপর বর্ণনায় ‘বেশী এর গণ্ডিভূক্ত না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করেছেন।
ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর যুক্তি এই যে, চতুর্থাংশে সম্পূর্ণের স্থলবর্তী হয়ে থাকে। যেমন ‘মাথা মাসহের ক্ষেত্রে এবং ইহরামে ‘মাথা মুড়ানোর ক্ষেত্রে। এবং যে ব্যক্তি কারো চেহারা দেখে সে ঐ ব্যক্তিকে দেখেছে বলে খবর দেয়। যদিও সে উক্ত ব্যক্তির চারপাশের একপাশ মাত্র দেখেছে।
চুল, পেট ও উরুও অনুরূপ অর্থাত্ এতেও উক্ত মতভেদ রহিয়াছে। কেননা প্রতিটাই আলাদা অংগ।
চুল দ্বারা এখানে মাথা থেকে ঝুলে থাকা অংশ উদ্দেশ্য। এ-ই বিশুদ্ধ মত। তবে জানাবাতের গোসলে এটা ধোয়া মাফ হওয়ার কারণ হল কষ্ট আরোপ হওয়া।
লজ্জাস্থান দুটিতেও অংশ সতর, দাসীরও তাই সতর। আর তার পেট ও পিঠও সতর। এছাড়া তার শরীরের অন্যান্য অংগ সতর নয়। কেননা, উমর (রাঃআঃ) (জনৈকা দাসীকে লক্ষ করে) বলেছিলেন, এই ছেমড়ি! মাথা থেকে ওড়না সরিয়ে নে, স্বাধীন স্ত্রী লোকদের মত হতে চাস বুঝি!
তাছাড়া তাকে তার মনিবের প্রয়োজনে কাজের পোশাকে বাইরে বের হতে হয়। সুতরাং অসুবিধা লাঘবের উদ্দেশ্যে অন্যান্য পুরুষের ক্ষেত্রে তাকে মাহরেমের ন্যায় গণ্য করা হবে।
যদি নাজাসাত দূর করার মতো কিছু না পায়, তাহলে তা সহই নামাজ আদায় করবে। এবং নামাজ দোহরাতে হবে না। এর দুই সুরত। যদি কাপড়ের এক-চতুথাংশ বা তার চাইতে বেশী অংশ পাক হয়, তাহলে ঐ কাপড় পরেই নামাজ আদায় করবে যদি বিবস্ত্র হয়ে নামাজ আদায় করে, তাহলে জাইয হবে না। কেননা এক-চতুর্থাংশ সম্পূর্ণের স্থলবর্তী হয়। যদি এক-চতুর্থাংশ কম পাক হয় তাহলে ইমাম মুহাম্মাদ (রঃআঃ) এর মতে একই হুকুম। আর এটা ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) ও দুটি মতের একটি। কেননা ঐ কাপড়ে নামাজ আদায়ে একটি ফরয তরক হয়। পক্ষান্তরে উলংগ হয়ে নামাজ আদায়ে একাধিক ফরয তরক হয়।
ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃআঃ) এর মতে সে ইচ্ছাধীন। ইচ্ছা হলে উলংগ হয়ে নামাজ আদায় করুক, কিংবা নাপাক কাপড়ে নামাজ আদায় করুক। তবে দ্বিতীয়টাই উত্তম। কেননা, সক্ষম অবস্থায় প্রতিটি নামাজের প্রতিবন্ধক। এবং (মাফ হওয়ার) পরিমাণের ক্ষেত্রে দুটোই সমান। সুতরাং নামাজের হুকুম ও দুটোই সমান হবে।
তাছাড়া কোন কিছুকে তার স্থলবর্তী রেখে তরক করায় গণ্য হয় না।
(কাপড়ে পরে নামাজ আদায়) উত্তম হওয়ার কারণ এই যে, সতর নামাজের সাথে খাস নয়। পক্ষান্তরে তাহারাত নামাজের সাথে খাস।
কেউ যদি সতর ঢাকার কাপড় না পায় তাহলে উলংগ অবস্থায় বসে ইশারায় রুকু সাজদা করে নামাজ আদায় করে, তাহলেও তার জন্য জাইয হবে। কেননা বসার মধ্যে লজ্জাস্থানের সতর হয়। আর দাড়িয়ে পড়লে উল্লেখিত রকনগুলো আদায় হয়। সুতরাং দুটোর যে কোন একটি সে গ্রহণ করিতে পারে।
তবে প্রথমটিই উত্তম। কেননা, সতর ঢাকা ফরয হইয়াছে নামাজের হক হিসাবে এবং মানুষের হক হিসাবে। তাছাড়া এর কোন স্থলবর্তী নেই। আর ইশারা হইয়াছে রকনের স্থলবর্তী।
ইমাম কুদূরী (রঃআঃ) বলেন, যে নামাজ শুরু করিতে যাচ্ছে, সে এমনভাবে নিয়্যত করবে যে, নিয়্যত ও তাহরীমার মাঝে কোন কম দ্বারা ব্যবধানে সৃষ্টি করবে না। নামাজের পূর্ববর্তী শর্তসমূহ
এ শর্তটির মূল হলো রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) এর হাদিস (যাবতীয় আমল নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল)।
তাছাড়া নামাজের শুরু হয় কিয়াম বা দাড়ানো অবস্থা দ্বারা। আরা তা অভ্যাস ও ইবাদত উভয়ের মধ্যে দোদুল্যমান। সুতরাং নিয়্যত ছাড়া এতে পার্থক্য সৃষ্টি হবে না।
আর যে নিয়্যত তাকবীরের পূর্বে করা হয়, তা তাকবীরের সময়ও বিদ্যমান আছে বলে গণ্য। যদি তাকে বিচ্ছিন্নকারী কোন কিছু না পাওয়া যায়। অর্থাত্ এমন কোন কাজ, যা নামাজের উপযোগী নয়। আর তাকবীরের পরবর্তী নিয়্যত গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা নিয়্যতের পূর্বে যা বিগত হইয়াছে, তা নিয়্যতহীনতার কারণে ইবাদত হবে না। সিয়ামের ক্ষেত্রে অবশ্য প্রয়োজনের কারণে তা কায়েম রাখা হইয়াছে।
নিয়্যত অর্থ ইচ্ছা, তবে শর্ত এই যে, নিজে অন্তরে জ্ঞাত হতে হবে যে, কোন নামাজ সে আদায় করছে। মুখে উচ্চারণ করা ধর্তব্য নয়। তবে উচ্চারণ করা উত্তম। কেননা, তা ইচ্ছাকে সংহত করে।
উল্লেখ্য যে, নামাজ যদি নফল হয় তাহলে সাধারণ নিয়্যতই যথেষ্ট। বিশুদ্ধ। বিশুদ্ধ মতে সুন্নাত নামাজেরও এ হুকুম। আর যদি ফরয নামাজ হয় তবে ফরয নির্ধারিত হওয়া জরুরী। উদাহরণ স্বরূপ, যেমন, যুহর। কেননা ফরয বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে।
আর যদি অন্য কারো মুকতাদী হয়, তাহলে নামাজের এবং ইমামের অনুগমনের নিয়্যত করবে। কেননা, ইমামের দিক থেকে তার নামাজে ফাসাদ আরোপিত হয়ে থাকে। সুতরাং তার পক্ষ থেকে এই বাধ্যবাধকতা গ্রহণ আবশ্যক।
গ্রন্থকার বলেন- আর কিবলামুখী হবে। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেছেন- তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল মুসজিদুল হারাম অভিমুখী কর। তবে যে ব্যক্তি মক্কায় অবস্থান করছে, তার জন্য স্বয়ং কাবামুখী হওয়া ফরয। আর মক্কায় অনুপস্থিত ব্যক্তির জন্য ফরয হলো কাবার দিকের প্রতি মুখ করা। এ-ই বিশুদ্ধমত। কেননা, দায়িত্ব অর্পিত হয় সাধ্য অনুসারে।
যে ব্যক্তি ভীতিগ্রস্ত হয়, সে যে দিকেই সক্ষম হয় সেদিকেই মুখ করে নামাজ আদায় করবে। কেননা, ওযর বিদ্যমান থাকার কারণে। সুতরাং কিবলা অজ্ঞাত হওয়ার অনুরূপ হবে। যদি কারো জন্য কিবলা অজ্ঞাত (ও সন্দেহপূর্ণ) হয়ে পড়ে এবং তার কাছে এমন কেউ না থাকে, যাকে কেবলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিতে পারে। তাহলে সাধ্যানুযায়ী চিন্তা করে কিবলা স্থির করে নেবে। কেননা সাহাবায়ে কিরাম চিন্তা করে (কিবলা নির্ধারণ পূর্বক) নামাজ আদায় করেছেন। আর রসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) তাদেঁর কাজ প্রত্যাখ্যান করেননি।
তাছাড়া অধিকতর শক্তিশালী দলীলের অবর্তমানে প্রকাশ্য প্রমাণের উপর আমল করাই ওয়াজিব। আর সংবাদ জিজ্ঞাসা চিন্তা-ভাবনার চেয়ে অগ্রাধিকার রাখে।
নামাজ আদায়ের পর যদি সে জানতে পারে যে, সে ভুল করেছিলো, তাহলে নামাজ দোহরাতে হবে না।
ইমাম শাফিঈ (রঃআঃ) বলেন, যদি কিবলার দিকে পিঠ দিয়ে থাকে, তাহলে ভুল নিশ্চিত হওয়ার কারণে নামাজ দোহরাবে।
আর আমাদের দলিল হল, চিন্তা-ভাবনা দ্বারা নির্ধারিত দিকের অভিমুখী হওয়া ছাড়া অন্য কিছু তার সাধ্যে ছিল না। আর দায়িত্ব অর্পন সাধ্যের উপর নির্ভরশীল।
আর যদি সে নামাজের মধ্যেই তা জানতে পারে, তাহলে কিবলার দিকে ঘুরে যাবে। কেননা, কুবাবাসীরা যখন কিবলা পরিবর্তনের খবর শুনতে পেলেন তখন তাঁরা নামাজের অবস্থাতেই ঘুরে গেলেন এবং নাবী করীম (সাঃআঃ) তা পসন্দ করেছিলেন। তদ্রূপ যদি তার সিদ্ধান্ত অন্যদিকে পরিবর্তিত হয়ে যায় তাহলে সে সেদিকের অভিমুখী হবে। কেননা, পরবর্তী ক্ষেত্রে নতুন ইজতিহাদের উপর আমল করা আবশ্যক; তবে তাতে ইতোপূর্বে আদায়কৃত অংশ ভংগ হবে না।
যে ব্যক্তি অন্ধকার রাতে কোন জামাআতের ইমামতি করল এবং চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে কিবলা নির্ধারণ করে পূর্বমুখী হয়ে নামাজ আদায় করল, আর তার পিছনে যারা রহিয়াছে তাহারাও চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে প্রত্যেক একেক দিকে নামাজ আদায় করল, এমন অবস্থায় যে, প্রত্যেক ইমামের পশ্চাতে আছে এবং ইমাম কী করছেন তা তাহাদের জানা নেই, তাহলে তা সবার জন্য জাইয হবে। কেননা, চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে নির্ধারিত দিকে অভিমুখী হওয়া তো পাওয়া গেছে। আর ইমামের সাথে এই বিরোধ বাধা সৃষ্টি করে না। যেমন কাবার অভ্যন্তরের মাসআলা। নামাজের পূর্ববর্তী শর্তসমূহ
Leave a Reply