কুরাইশদের বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা – ইয়ামানবাসীর সম্পর্ক ইসমাঈল আঃ এর সঙ্গে

কুরাইশদের বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা – ইয়ামানবাসীর সম্পর্ক ইসমাঈল আঃ এর সঙ্গে

কুরাইশদের বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা – ইয়ামানবাসীর সম্পর্ক ইসমাঈল আঃ এর সঙ্গে >> বুখারী শরীফ এর মুল সুচিপত্র পড়ুন

পর্বঃ ৬১, মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য, অধ্যায়ঃ (১-৫)=৬টি

৬১/১. অধ্যায়ঃ আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
৬১/২. অধ্যায়ঃ কুরাইশদের মর্যাদা ও গুণাবলী
৬১/৩. অধ্যায়ঃ কুরআন কুরাইশদের ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে।
৬১/৪. অধ্যায়ঃ ইয়ামানবাসীর সম্পর্ক ইসমাঈল (আঃ) -এর সঙ্গে;
615

৬১/১. অধ্যায়ঃ আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

আল্লাহ তাআলার বাণীঃ হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোক থেকে এবং তোমাদেরকে পরিণত করেছি বিভিন্ন জাতিতে ও বিভিন্ন গোত্রে। (আল – হুজুরাত ১৩)

আল্লাহর বাণীঃ তোমরা ভয় কর আল্লাহকে যাঁর নামে তোমরা একে অপরের কাছে প্রার্থনা করে থাক এবং আত্মীয় – জ্ঞাতিদের সম্পর্কে সতর্ক থাক। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখেন – (আন্ – নিসা ১)। এবং জাহিলীয়্যাত আমলের কথা – বার্তা নিষিদ্ধ হওয়া সম্পর্কে। (আরবী) পূর্বতন বড় বংশ এবং (আরবী) এর চেয়ে ছোট বংশ।

৩৪৮৯. ইব্ন আব্বাস (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আয়াতে বর্ণিত (আরবী) অর্থ বড় গোত্র এবং (আরবী) অর্থ ছোট গোত্র।

৩৪৯০. আবু হুরায়রা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, নাবী (সাঃআঃ) -কে জিজ্ঞেস করা হল, হে আল্লাহর রাসুল! মানুষের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান কে? নাবী (সাঃআঃ) বলেন, যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু, সে-ই অধিক সম্মানিত। সাহাবীগণ বলিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা এ ধরনের কথা জিজ্ঞেস করিনি। নাবী (সাঃআঃ) বলিলেন, তাহলে আল্লাহর নাবী ইউসূফ (আ)।

৩৪৯১. কুলায়েব ইব্ন ওয়ায়িল (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) হইতে বর্ণিতঃ

নাবী (সাঃআঃ) -এর তত্ত্বাবধানে পালিতা আবু সালমার কন্যা যায়নাবকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি বলুন, নাবী (সাঃআঃ) কি মুযার গোত্রের ছিলেন? তিনি বলিলেন, বনু নযর ইবন কিনানা উদ্ভূত গোত্র মুযার ব্যতীত আর কোন গোত্র হইতে হইবেন? এবং মুযার গোত্র নাযর ইবন কিনানা গোত্রের একটি শাখা ছিল।

৩৪৯২. কুলায়ব হইতে বর্ণিতঃ

নাবী (সাঃআঃ) -এর তত্ত্বাবধানে পালিতা কন্যা বলেনঃ আর আমার ধারণা তিনি হলেন যায়নাব। তিনি বলেন, নাবী (সাঃআঃ) কদুর বাওশ, সবুজ মাটির পাত্র মুকাইয়ার ও মুযাফ্ফাত (আলকাতরা লাগানো পাত্র বিশেষ) ব্যবহার করিতে নিষেধ করিয়াছেন। কুলায়ব বলেন, আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বলেন তো দেখি নাবী (সাঃআঃ) কোন গোত্রের ছিলেন? তিনি কি মুযার গোত্রের অন্তর্গত ছিলেন? তিনি জবাব দিলেন, নাবী (সাঃআঃ) মুযার গোত্র ব্যতীত আর কোন গোত্রের হইবেন? আর মুযার নাযর ইবন কিনানার বংশধর ছিল।

৩৪৯৩. আবু হুরায়রা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সাঃআঃ) বলেছেন, তোমরা মানুষকে খণির মত পাবে। আইয়্যামে জাহিলীয়্যাতের উত্তম ব্যক্তিগণ ইসলাম গ্রহণের পরও তারা উত্তম। যখন তারা দ্বীনী জ্ঞান অর্জন করে আর তোমরা শাসন ও কর্তৃত্বের ব্যাপারে লোকদের মধ্যে উত্তম ঐ ব্যক্তিকে পাবে যে এই ব্যাপারে তাদের মধ্যে সবচেয়ে অধিক অনাসক্ত।

৩৪৯৪. আবু হুরায়রা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

আর মানুষের মধ্যে সব থেকে নিকৃষ্ট ঐ দুমুখী ব্যক্তি যে একদলের সঙ্গে এক ভাবে কথা বলে, অপর দলের সঙ্গে আরেকভাবে কথা বলে।

৩৪৯৫. আবু হুরায়রা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, নাবী (সাঃআঃ) বলেছেন, খিলাফত ও নেতৃত্বের ব্যাপারে সকলেই কুরাইশদের অনুগত থাকবে। মুসলিমগণ তাদের মুসলিমদের এবং কাফিররা তাদের কাফিরদের অনুগত।

৩৪৯৬. আবু হুরায়রা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

আর মানব সমাজ খণির মত। জাহিলী যুগের উত্তম ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণের পরও উত্তম যদি তারা দ্বীনী ইল্ম অর্জন করে। তোমরা নেতৃত্ব ও শাসনের ব্যাপারে ঐ লোককেই সবচেয়ে উত্তম পাবে যে এর প্রতি অনাসক্ত, যে পর্যন্ত না সে তা গ্রহণ করে।

৩৪৯৭. ইবনু আব্বাস (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

(আরবী) এ আয়াতের প্রসঙ্গে রাবী তাউস (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন যে, সায়িদ ইবন জুবায়র (রাদি.) বলেন, কুরবা শব্দ দ্বারা মুহাম্মাদ (সাঃআঃ) -এর নিকট আত্মীয়কে বুঝান হয়েছে। তখন ইবন আব্বাস (রাদি.) বলেন, কুরাইশের এমন কোন শাখা – গোত্র নেই যাঁদের সঙ্গে নাবী (সাঃআঃ) -এর আত্মীয়তার বন্ধন ছিল না। আয়াতটি তখনই নাযিল হয়। অর্থাৎ তোমরা আমার ও তোমাদের মধ্যকার আত্মীয়তার প্রতি খেয়াল রাখ।

৩৪৯৮. আবু মাসউদ (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

নাবী (সাঃআঃ) বলেন, এই পূর্বদিক হইতে ফিতনা-ফাসাদের উৎপত্তি হইবে। নির্মমতা ও অন্তরের কাঠিন্য উট ও গরু নিয়ে ব্যস্ত লোকদের মধ্যে। পশমী তাঁবুর অধিবাসীরা রাবীআ ও মুযার গোত্রের যারা উট ও গরুর পিছনে চিৎকার করে (হাঁকায়), তাদের মধ্যেই রহিয়াছে নির্মমতা ও কঠোরতা।

৩৪৯৯. আবু হুরায়রা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সাঃআঃ)-কে আমি বলিতে শুনিয়াছি যে, গর্ব-অহংকার পশমের তৈরি তাঁবুতে বসবাসকারী যারা (উট-গরু হাঁকানোর সময় চিৎকার করে) তাদের মধ্যে (আরবী) অর্থ বাম দিক, বাম হাতকে (আরবী) এবং বাম দিককে (আরবী) বলা হয়। আর শান্তভাব রহিয়াছে বকরী পালকদের মধ্যে। ঈমানের দৃশ্যতা ও হিক্মাত ইয়ামানবাসীদের মধ্যে রহিয়াছে। ইমাম বুখারী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, ইয়ামান নাম দেয়া হয়েছে যেহেতু তা কাবা ঘরের ডানদিকে (দক্ষিণ) অবস্থিত এবং শাম (সিরিয়া) কাবা ঘরের বাম (উত্তর) দিকে অবস্থিত বিধায় তার শাম নাম দেয়া হয়েছে।

৬১/২. অধ্যায়ঃ কুরাইশদের মর্যাদা ও গুণাবলী

৩৫০০. মুহাম্মাদ ইব্ন জুবায়ের ইব্ন মুত্ঈম (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) হইতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, মুআবিয়া (রাদি.) -এর নিকট কুরাইশ প্রতিনিধিদের সাথে তার উপস্থিতিতে সংবাদ পৌঁছলো যে, আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস (রাদি.) বর্ণনা করেন, শীঘ্রই কাহতান বংশীয় জনৈক বাদশাহর আগমন ঘটবে। এতদশ্রবণে মুআবিয়া (রাদি.) ক্রুদ্ধ হয়ে খুতবাহ দেয়ার উদ্দেশে দাঁড়িয়ে আল্লাহর যথাযোগ্য হামদ ও সানার পর তিনি বলিলেন, আমি জানতে পেরেছি, তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোক এমন সব কথাবার্তা বলিতে শুরু করেছে যা আল্লাহর কিতাবে নেই এবং আল্লাহর রাসুল (সাঃআঃ) হইতেও বর্ণিত হয়নি। এরাই মূর্খ, এদের হইতে সাবধান থাক এবং এমন কাল্পনিক ধারণা হইতে সতর্ক থাক যা ধারণাকারীকে বিপথগামী করে। আল্লাহর রাসুল (সাঃআঃ) -কে আমি বলিতে শুনিয়াছি যে, যত দিন তারা দ্বীন কায়েমে লেগে থাকবে ততদিন খিলাফত ও শাসন ক্ষমতা কুরাইশদের হাতেই থাকবে। এ বিষয়ে যে – ই তাদের সাথে শত্রুতা করিবে আল্লাহ তাকে অধোঃমুখে নিক্ষেপ করবেন।

৩৫০১. ইব্ন উমর (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

নাবী (সাঃআঃ) বলেন, এ বিষয় (খিলাফত ও শাসন ক্ষমতা) সর্বদাই কুরাইশদের হাতে থাকবে, যতদিন তাদের দুজন লোকও বেঁচে থাকবে।

৩৫০২. জুবায়র ইব্ন মুতঈম (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আমি এবং উসমান ইবন আফ্ফান (রাদি.) আল্লাহর রাসুল (সাঃআঃ) -এর দরবারে হাযির হলাম। উসমান (রাদি.) বলিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি মুত্তালিবের সন্তানদেরকে দান করিলেন এবং আমাদেরকে বাদ দিলেন। অথচ তারা ও আমরা আপনার বংশগতভাবে সম স্তরের। নাবী (সাঃআঃ) বলিলেন, বনূ হাশিম ও বনূ মুত্তালিব এক ও অভিন্ন।

৩৫০৩. উরওয়া ইবনু যুবায়র (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) হইতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবন জুবায়র (রাদি.) বনূ যুহরার কতিপয় লোকের সঙ্গে আয়িশা (রাদি.)-এর নিকটে হাযির হলেন। আয়িশা (রাদি.) তাদের প্রতি অত্যন্ত নম্র ও দয়ার্দ্র ছিলেন। কেননা, আল্লাহর রাসুল (সাঃআঃ)-এর সঙ্গে তাঁদের আত্মীয়তা ছিল।

৩৫০৪. আবু হুরায়রা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেছেন, আল্লাহর রাসুল (সাঃআঃ) বলেন, কুরাইশ, আনসার, জুহায়না, মুযায়না, আসলাম, আশজা ও গিফার গোত্রগুলো আমার সাহায্যকারী। আল্লাহ ও তাহাঁর রাসুল ছাড়া তাঁদের সাহায্যকারী আর কেউ নেই।

৩৫০৫. উরওয়া ইব্ন যুবায়র (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) হইতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) নাবী (সাঃআঃ) ও আবু বকর (রাদি.) -এর পর আয়িশা (রাদি.) -এর নিকট সকল লোকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং তিনি সকল লোকদের মধ্যে আয়িশা (রাদি.) -এর প্রতি সবচেয়ে অধিক সদাচারী ছিলেন। আয়িশা (রাদি.) -এর নিকট আল্লাহর পক্ষ হইতে রিজিক হিসেবে যা কিছু আসত তা জমা না রেখে সদাকাহ করে দিতেন। এতে আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রাদি.) বলিলেন, অধিক দান খয়রাত করা হইতে তাকে বারণ করা উচিত। তখন আয়িশা (রাদি.) বলিলেন, আমাকে দান করা হইতে বারণ করা হইবে? আমি যদি তার সঙ্গে কথা বলি, তাহলে আমাকে কাফ্ফারা দিতে হইবে এবং আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রাদি.) তাহাঁর নিকট কুরাইশের কিছু লোক, বিশেষভাবে নাবী (সাঃআঃ) -এর মাতৃবংশের কিছু লোক দ্বারা সুপারিশ করালেন। তবুও তিনি তাহাঁর সঙ্গে কথা বলা হইতে বিরত থাকলেন। নাবী (সাঃআঃ) -এর মাতৃবংশ বনী যুহরার কতক বিশিষ্ট লোক যাদের মধ্যে আবদুর রহমান ইবন আস্ওয়াদ এবং মিসওয়ার ইবন মাখরামাহ (রাদি.) ছিলেন তারা বলিলেন, আমরা যখন আয়িশা (রাদি.) -এর গৃহে প্রবেশের অনুমতি চাইব তখন তুমি পর্দার ভিতরে ঢুকে পড়বে। তিনি তাই করিলেন। পরে ইবন যুবায়র (রাদি.) কাফ্ফারা আদায়ের জন্য তার নিকট দশটি ক্রীতদাস পাঠিয়ে দিলেন। আয়িশা (রাদি.) তাদের সবাইকে আযাদ করে দিলেন। অতঃপর তিনি বরাবর আযাদ করিতে থাকলেন। এমন কি তা সংখ্যা চল্লিশে পৌঁছে। আয়িশা (রাদি.) বলিলেন, আমি যখন কোন কাজ করার কসম করি, তখন এরাদা থাকে যে আমি যেন সে কাজটা করে দায়িত্ব মুক্ত হয়ে যাই এবং তিনি আরো বলেন, আমি যখন কোন কাজ করার কসম করি তা যথাযথ পূরণের ইচ্ছা রাখি।

৬১/৩. অধ্যায়ঃ কুরআন কুরাইশদের ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে।

৩৫০৬. আনাস (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

উসমান (রাদি.), যায়দ ইবন সাবিত (রাদি.), আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রাদি.), সাঈদ ইবনুল আস (রাদি.) আবদুর রাহমান ইবন হারিস (রাদি.) -কে ডেকে পাঠালেন। তাঁরা সংরক্ষিত কুরআনকে সমবেতভাবে লিপিবদ্ধ করিলেন। উসমান (রাদি.) কুরাইশ বংশীয় তিনজনকে বলিলেন, যদি যায়দ ইবন সাবিত (রাদি.) এবং তোমাদের মধ্যে কোন শব্দে মতবিরোধ দেখা দেয় তবে কুরাইশের ভাষায় তা লিপিবদ্ধ কর। যেহেতু কুরআন শরীফ তাদের ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। অতঃপর তাঁরা তা-ই করিলেন।

৬১/৪. অধ্যায়ঃ ইয়ামানবাসীর সম্পর্ক ইসমাঈল (আঃ) -এর সঙ্গে;

তার মধ্যে আসলাম ইব্ন আফসা ইব্ন হারিসাহ ইব্ন আমর ইব্ন আমির ও খুযাআহ গোত্রের অন্তর্গত।

৩৫০৭. সালামা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, একবার আসলাম গোত্রের কিছু লোক বাজারের নিকটে প্রতিযোগিতামূলক তীর নিক্ষেপের চর্চা করছিল। এমন সময় নাবী (সাঃআঃ) বের হলেন এবং তাদেরকে দেখে বলিলেন, হে ইসমাঈল (আরবী) -এর বংশধর। তোমরা তীর নিক্ষেপ কর। কেননা তোমাদের পিতাও তীর নিক্ষেপে অভিজ্ঞ ছিলেন এবং আমি তোমাদের অমুক দলের পক্ষে রয়েছি। তখন একটি পক্ষ তাদের হাত গুটিয়ে নিল। বর্ণনাকারী বলিলেন, নাবী (সাঃআঃ) বলিলেন, তোমাদের কী হল? তারা বলিল, আপনি অমুক পক্ষে থাকলে আমরা কী করে তীর নিক্ষেপ করিতে পারি? নাবী (সাঃআঃ) বলিলেন, তোমরা তীর নিক্ষেপ কর। আমি তোমাদের উভয় দলের সাথে আছি।

৬১/৫. অধ্যায়ঃ

৩৫০৮. আবু যার (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

নাবী (সাঃআঃ) -কে বলিতে শুনেছেন, কোন লোক যদি নিজ পিতা সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও অন্য কাকে তার পিতা বলে দাবী করে তবে সে আল্লাহর কুফরী করিল এবং যে ব্যক্তি নিজেকে এমন বংশের সঙ্গে বংশ সম্পর্কিত দাবী করিল যে বংশের সঙ্গে তার কোন বংশ সম্পর্ক নেই, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নেয়।

৩৫০৯. ওয়ায়িলাহ ইব্ন আসকা (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

নাবী (সাঃআঃ) বলেছেন, কোন লোকের এমন লোককে পিতা বলে দাবি করা তার পিতা নয় এবং প্রকৃতই যা দেখেনি তা দেখার দাবি করা এবং আল্লাহর রাসুল (সাঃআঃ) যা বলেননি তা তাহাঁর প্রতি মিথ্যারোপ করা নিঃসন্দেহে বড় মিথ্যা।

৩৫১০. ইব্ন আব্বাস (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, যখন আবদুল কায়স গোত্রের এক প্রতিনিধি দল আল্লাহর রাসুল (সাঃআঃ) -এর দরবারে হাজির হয়ে আরয করিল, হে আল্লাহর রাসুল! এ গোত্রটি রাবীআহ বংশের। আমাদের এবং আপনার মধ্যে মূযার গোত্রের কাফিররা বাধা সৃষ্টি করে রেখেছে। আমরা সম্মানিত চার মাস ছাড়া অন্য সময় আপনার নিকট হাযির হইতে পারি না। খুবই ভালো হতো যদি আপনি আমাদেরকে এমন কিছু আদেশ দিয়ে দিতেন যা আপনার নিকট হইতে গ্রহণ করে আমাদের পিছনে অবস্থিত লোকদের পৌঁছে দিতাম। নাবী (সাঃআঃ) বলিলেন, আমি তোমাদেরকে চারটি কাজের আদেশ দিচ্ছি এবং চারটি কাজের নিষেধাজ্ঞা প্রদান করছি। (এক) আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং এ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন প্রকৃত ইলাহ নেই, (দুই) সালাত কায়িম করা, (তিন) যাকাত আদায় করা, (চার) গনীমতের যে মাল তোমরা লাভ কর তার পঞ্চমাংশ আল্লাহর জন্য বায়তুল মালে দান করা। আর আমি তোমাদেরকে দুব্বা (কদু পাত্র), হান্তম (সবুজ রং এর ঘড়া), নাকীর (খেজুর বৃক্ষের মূল খোদাই করে তৈরি পাত্র), মযাফ্ফাত (আলকাতরা লাগানো মাটির পাত্র, এই চারটি পাত্রের) ব্যবহার করিতে নিষেধ করছি।

৩৫১১. আবদুল্লাহ ইব্ন উমর (রাদি.) হইতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সাঃআঃ) কে মিম্বরের উপর উপবিষ্ট অবস্থায় পূর্ব দিকে [১] ইঙ্গিত করে বলিতে শুনিয়াছি, সাবধান! ফিতনা ফাসাদের উদ্ভব ঐদিক থেকেই হইবে এবং ঐদিক থেকেই শয়তানের শিং উদিত হইবে।

[১] এখানে আবদুল্লাহ বিন উমর (রাদি.) হইতে বর্ণিত হাদীসে দেখা যায় যে, নাবী (সাঃআঃ) পূর্বদিকে ইশারা করে এক সাবধান বাণী বা ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করিলেন। এখানে নাবী (সাঃআঃ) বলছেন, পৃথিবীর পূর্বদিক হইতেই সমস্ত ফিতনাহ্র উদ্ভব হইবে। ইসলামের ইতিহাস তথা বিশ্ব ইসলাম ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ইসলাম বিনাশী বড় বড় ফিত্না ফাসাদ ও প্রলয়কারী বিদআতসমূহ পৃথিবীর পূর্বপ্রান্ত থেকেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।

সর্বপ্রথম আলী ও মুআবিয়া (রাদি.)র খিলাফাত সম্পর্কিত গৃহযুদ্ধকে কেন্দ্র করে মুসলিমদের মধ্যে খারিজী ও শীআ দলের উদ্ভব হয়। যা পূর্বদেশ থেকেই ঘটেছিল। অতঃপর যুগে যুগে মুতাজিলা, ক্বাদারিয়াহ, জাবারিয়াহ, জাহমিয়াহ, চিশতিয়া, মুজাদ্দেদীয়া, সাহরাওয়ার্দিয়াহ, আজমেরী রেযাখানী (রেজা আহমদ খান ব্রেলভী যিনি আজমিরের কবর পূজার প্রবর্তক), বাহাই, কাদিয়ানী, ইলিয়াসী ইত্যাদি যাবতীয় ফিতনার উদ্ভব পূর্ব দিক থেকেই ঘটেছে যার কয়েকটির অতি সংক্ষিপ্ত পরিচিত তুলে ধরা হলোঃ

খারিজী: ইসলামের সর্বপ্রথম ধর্মীয় সম্প্রদায়। খিলাফাত এবং বিশ্বাস বা কর্মের যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে তারা নিজেদেরকে আলাদা করে ফেলে। রাজনীতি ক্ষেত্রে তারা যে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল তা ছিল পুনঃ পুনঃ বিদ্রোহ সংগঠন এবং সাময়িকভাবে কোন অঞ্চল দখল করতঃ গন্ডগোল সৃষ্টি করা। আলী (রাদি.) -এর খিলাফাতের শেষ দুই বৎসর এবং উমায়্যাহ আমলে তারা মুসলিম সাম্রাজ্যের পূর্বাংশে অশান্তি সৃষ্টি করেছিল এবং পরোক্ষ আলী (রাদি.) -এর বিরুদ্ধে মুআবিয়াকে এবং উমায়্যাহদের বিরুদ্ধে আব্বাসীয়গণকে যুদ্ধে জয়লাভ করিতে সাহায্য করেছিল।

শীআ: রাসুল (সাঃআঃ) -এর মৃত্যুর পর আলী (রাদি.) ন্যায়তঃ খালীফাহ হওয়ার দাবীদার ছিলেন। এই মতবাদের ভিত্তিতে শীআ দলের উদ্ভব হয়। শীআগণ খিলাফত বনাম গণসমর্থনের ভিত্তিতে নির্বাচিত খালীফাহ্র আনুগত্য স্বীকার করিতে রাজী নয় – এমনকি কুরাইশ হলেও না। তাদের মত হল, আহলি বায়ত (নাবীর পরিবার) অর্থাৎ আলী ও ফাতিমাহ (রাদি.) -এর বংশোদ্ভূতগণই ইমামাত (খিলাফাত নয়) এর অধিকারী। পূর্ববর্তী ইমাম তাহাঁর উত্তরাধিকারী পরবর্তী ইমামের মনোনয়ন দিবেন। শীআ ধর্ম – পুস্তকে দেখা যায় যে, যে ব্যক্তি তার সময়ের প্রকৃত ইমাম কে (?) তা না জেনে মারা যায়, সে কাফিররূপে মারা যায় (আরবী) “আলীর দল কথাটি হইতে সংক্ষেপে শীআ নামের প্রচলন হয়েছিল।

মুতাযিলা: যে ধর্মতাত্ত্বিক দল ইসলামী ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপারে যুক্তিমূলক মতবাদকে সর্বপ্রধান সূত্র হিসেবে গ্রহণ করে তার নাম।

কাদারিয়্যাহ: তাকদীরের সঠিক ব্যাখ্যা সম্পর্কে তাত্ত্বিক আলোচনার ফলে বসরাতে এই দলের উদ্ভব হয়। কাদারিয়্যা দলের মত হল মন্দ ইচ্ছা ও কর্মের সম্পর্ক আল্লাহর প্রতি প্রযোজ্য হইতে পারে না। এর সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে।

জাবারিয়্যাহ: জাবারিয়্যাহ মতে মানুষের ইচ্ছা বা কর্ম – স্বাধীনতা নাই। আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি যা ইচ্ছে তাই করেন।

জাহমিয়্যাহ: জাহম ইব্ন সাফওয়ান (মৃত্যু ৭৪৬ খ্রীঃ) ধর্মতত্ত্ববিদ হিসেবে কিছুটা স্বাধীন মত পোষণ করিতেন। ঈমানকে তিনি অন্তরের ব্যাপার বলে জানতেন, জান্নাত ও জাহান্নামকে চিরস্থায়ী মনে করিতেন না। তার অনুসারীরা জাহমিয়্যাহ নামে পরিচিত।

চিশতিয়্যা: ভারত উপমহাদেশের একটি সূফী তারীকা। খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী দ্বাদশ শতাব্দীতে সূফীবাদের এই সিলসিলাঃ ভারত উপমহাদেশে নিয়ে আসেন এবং আজমীরে এর প্রথম কেন্দ্র স্থাপন করেন।

নাকশ্বন্দী: মুহাম্মাদ ইব্ন মুহাম্মাদ বাহাউদ্দীন আল – বুখারী (৭১৭ – ৭৯১/১৩১৭ – ১৩৮৯) নাকশ্বন্দী প্রতিষ্ঠিত সূফী সম্প্রদায়।

কাদিরিয়্যাহ: আব্দুল কাদির জীলানী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) নামানুসারে একটি সূফী তারীকার নাম কাদিরিয়্যাহ।

বাহাঈ: বাহাউল্লাহ ও আব্দুল বাহা কর্তৃক ইরান থেকে প্রচারিত ধর্মমত। সময়কাল ১৮১৭ – ১৮৯২ খ্রীঃ।

কাদিয়ানী: ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের গুরুদাসপুর জেলার কাদিয়ান উপশহরে ১৮৩৫ সালে জন্মগ্রহণকারী ভন্ড নাবী মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর প্রচারিত ধর্মমত।

কবরপূজা, দরগাহপূজা, ইসলামের বিকৃত অবস্থা, বিকৃতিকরণ, তথা উক্ত প্রক্রিয়ার উৎসস্থল নাবী (সাঃআঃ) -এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী পৃথিবীর পূর্ব প্রান্ত বটে। এখান থেকেই শয়তানের শিং গজিয়ে উঠবে এবং উক্ত শিং সঠিক ইসলামকে গূতা দিতে দিতে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলবে। যার বাস্তব চিত্র অনেকটা প্রকাশ পেতে চলেছে। যেমন ঈদে মিলাদুন্নবীর মিছিলকারী বিদআতীদের রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পদচারণা ও তৎপরতায় মনে হয় এ দেশের ইসলাম ও দ্বীন দরদী একমাত্র এরাই। নাবী (সাঃআঃ) সারা জীবনে পূর্ববর্তী কোন নাবীদের জন্ম দিবস পালন করে যাননি। নিজের জন্মদিনও পালন করেননি। তদ্বীয় সাহাবায়ে কেরাম (রাদি.) তাঁদের প্রাণাধিক প্রিয় নাবী (সাঃআঃ) -এর জন্মদিবস, মৃত্যুদিবস পালন করেননি। অথচ পূর্বদেশীয় উক্ত বিভ্রান্ত লোকেদের ধারণা মতে যারা নাবী (সাঃআঃ) -এর জন্ম ও ওফাত দিবস পালন না করিবে তারা ফাসেক, গোমরাহ ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হলো, নাবীর যুগে, সাহাবাদের যুগে, তাবিঈনদের যুগে তথা ইসলামের মহামতি ইমাম চতুষ্টয়ের যুগে এভাবে ঘটা করে বিশাল আয়োজনের সাথে নাবী (সাঃআঃ) -এর জন্ম দিবস ও ওফাত দিবস পালন না করায় তাদের কি কোন অন্যায় বা ক্ষতি হয়েছে? নিশ্চয় বলবেন, তাঁদের কোন অন্যায় হয়নি। বরং তাঁরা এবম্বিধ কার্যাদি পালন হইতে বিরত থেকেই সঠিক কাজ করিয়াছেন। সুতরাং ইত্যাকার কাজে যারা জড়িত তাদের কাজ যে সঠিক নয় তা আর যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই।

অতঃপর চিল্লাধারী বন্ধুদের চিল্লার পর চিল্লার মাধ্যমে স্বীয় পরিবার – পরিজনের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে অবজ্ঞা প্রদর্শন করা, আল্লাহর নির্দেশ- (আরবী) (তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে ও পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও)র প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে দেশ – দেশান্তরে গমন করা, (আরবী) (তোমাদের কাছে দুটো জিনিস ছেড়ে গেলাম (আরবী) আল্লাহর কিতাব ও তাহাঁর নাবীর সুন্নাহ) রাসূলুল্লাহ (সাঃআঃ) -এর এ অন্তিম বাণীকে উপেক্ষা করে বানোয়াট, জাল, উদ্ভট ও আজগুবি কথায় পরিপূর্ণ নিজেদের সিলেবাসের কিতাব পড়তে বাধ্য করা, হাজারো অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, সুদ, ঘুষ, জুয়া ইত্যাদির ব্যাপারে মুখ – চোখ – কান বন্ধ করে রেখে (আরবী) এর ফারযকে দূরে নিক্ষেপ করে মুসলমানদের খাসি করণের অভিযান পরিচালনা করা, দাওয়াত দেয়ার নামে মুমিন মুসল্লীদেরকে মসজিদের গেটে যখন তখন বিরক্ত করা ও বিভিন্ন বিদআতী তৎপরতা, অন্যায়ের প্রতিবাদী ইসলামের জিহাদী রূপকে ম্লান করিতে চলেছে বটে।

পাক – ভারত উপমহাদেশ তথা ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ পূর্বাঞ্চলীয় মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত তাবলীগের মাধ্যমে যে ধর্মনিরপেক্ষ তথাকথিত এক প্রকারের ইসলামী চেতনা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা যদি যুল্ম, নির্যাতন, হত্যা, শোষণ, লুন্ঠন, অত্যাচার, অবিচার, অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদী না হয়, শিরক, বিদআতের বিরুদ্ধে আপোষহীন না হয়, সর্বশ্রেণীকে ম্যানেজ করে চলার সুবিধাবাদী নীতি পরিহারকারী না হয়, তাহলে রাসুল (সাঃআঃ) -এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী উক্ত প্রচলিত তাবলীগ জামাআতকেও পূর্বাঞ্চলীয় বিভেদ সৃষ্টিকারী, ফিতনা ও ফাসাদ সৃষ্টিকারী দ্বীন বিকৃতিকারী একটি দল বলে নিঃসন্দেহে সনাক্ত করা যাবে। কেননা উক্ত দলটির তথাকথিত নাবীওয়ালা কাজের ফাঁকা বুলি পূর্ববর্তী দ্বীনদার মুসলিমদের কাজের সহিত সামঞ্জস্যশীল নয় বলেই তখন গণ্য হইবে।

Comments

Leave a Reply