কুরআন সংকলন প্রসঙ্গে ও কিরাতের ভিন্নতা
কুরআন সংকলন প্রসঙ্গে ও কিরাতের ভিন্নতা >> মিশকাতুল মাসাবীহ এর মুল সুচিপত্র দেখুন
পর্বঃ ৮, অধ্যায়ঃ ২
- অধ্যায়ঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ
- অধ্যায়ঃ ২. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ
- অধ্যায়ঃ ২. তৃতীয় অনুচ্ছেদ
অধ্যায়ঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ
২২১১. উমার ইবনুল খাত্ত্বাব [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, আমি হিশাম ইবনি হাকীম ইবনি হিযামকে সূরা আল ফুরকান পাঠ করিতে শুনলাম। আমি যেভাবে [কুরআন] পড়ি, তা হইতে [তার পড়া] ভিন্ন ধরনের, অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে আমাকে এ সূরা পড়িয়েছেন। তাই আমি এর কারণে ব্যস্ত হইতে উদ্যত হলাম। কিন্তু নামাজ শেষ করা পর্যন্ত তাকে সুযোগ দিলাম। নামাজ শেষ হবার পরই তার চাদর তার গলায় পেঁচিয়ে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে নিয়ে বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমাকে যেভাবে সূরা আল ফুরকান পড়িয়েছেন তার থেকে ভিন্নরূপে আমি হিশামকে সূরা আল ফুরকান পড়তে শুনলাম।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমারকে বললেন, তাকে ছেড়ে দাও। হিশামকে বললেন, হিশাম! তুমি সূরা আল ফুরকান পড়ো তো দেখি। হিশাম এ সূরাটি সেভাবেই পড়ল আমি তাকে যেভাবে পড়তে শুনিয়াছি। তার পড়া শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এভাবেও এ সূরা নাযিল হয়েছে। এরপর তিনি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আমাকে বললেন, এখন তুমিও পড়ো দেখি! আমিও সূরাটি পড়লাম। আমার পড়া শুনে তিনি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বললেন, এ সূরাটি এভাবেও নাযিল হয়েছে। বস্ত্তত এ কুরআন সাত রীতিতে নাযিল করা হয়েছে। তাই তোমাদের যার জন্য যে কিরাআত সহজ হয় সেভাবেই তোমরা পড়বে।
[বোখারী, মুসলিম; কিন্তু পাঠ {শব্দ] মুসলিমের]{১} {১} সহীহ : বোখারী ৭৫৫০, মুসলিম ৮১৮, আবু দাউদ ১৪৭৫, নাসায়ী ৯৩৭, মুয়াত্ত্বা মালিক ৬৮৯, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ২৮৪৫, ইবনি হিববান ৭৪১। কুরআন সংকলন -এই হাদিসটির তাহকীকঃ সহীহ হাদিস
২২১২. আবদুল্লাহ ইবনি মাস্ঊদ [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, আমি এক লোককে কুরআন পড়তে শুনলাম। অথচ আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অন্যভাবে তা পড়তে শুনিয়াছি। আমি তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে নিয়ে গেলাম। তাঁকে এ খবর জানালাম। আমি তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারায় বিরক্তির ভাব লক্ষ্য করলাম। তিনি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বললেন, তোমরা দুজনই শুদ্ধ পড়েছ। এ নিয়ে তোমরা কলহ বিবাদ করো না। তোমাদের আগের লোকেরা কলহ-বিবাদে লিপ্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছেন
। [বোখারী]{১}, {১} সহীহ : বোখারী ৩৪৭৬, ২৪১০। কুরআন সংকলন -এই হাদিসটির তাহকীকঃ সহীহ হাদিস
২২১৩,উবাই ইবনি কাব [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, আমি মাসজিদে আছি, এমন সময় এক লোক মাসজিদে এসে নামাজ আদায় করিতে শুরু করিল। সে এমন পদ্ধতিতে কিরাআত পড়ল যা আমার জানা ছিল না। এরপর আর একজন লোক এলো। সে প্রথম ব্যক্তির কিরাআতের ভিন্ন ধরনে পড়ল। নামাজ শেষে আমরা সকলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গেলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! এ ব্যক্তি সলাতে এভাবে কিরাআত পড়েছে, যা আমার জানা নেই। আবার দ্বিতীয় ব্যক্তি এসে ওর চেয়ে ভিন্নভাবে কিরাআত পড়ল। এসব কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে হুকুম দিলেন, আবার কুরআন পড়তে। তারা আবার পড়ল। পড়া শুনে তিনি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] উভয়ের পাঠকেই ঠিক বললেন। এ কথা শুনে আমার মনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি এমন এক সন্দেহের জন্ম দিলো যা জাহিলিয়্যাতের সময়েও আমার মধ্যে ছিল না। সন্দেহের ছায়া আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে লক্ষ্য করে তিনি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আমার সিনার উপর হাত মারলেন। এতে আমি ঘামে ভিজে গেলাম।
আমি এতই ভীত হলাম, যেন আমি আল্লাহকে দেখছি। এ সময় তিনি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আমাকে বললেন, হে উবাই! আমার কাছে ওহী পাঠানো হয়েছিল এক রীতিতে কুরআন পাঠের। কিন্তু আমি আল্লাহর নিকট আবেদন করলাম। [হে আল্লাহ!] আপনি আমার উম্মাতের জন্য কুরআন পাঠ পদ্ধতি সহজ করে দিন। আল্লাহ দ্বিতীয়বার বললেন, তবে দু রীতিতে কুরআন পড়ো। আমি আবার নিবেদন করলাম, [হে আল্লাহ!] আপনি আমার উম্মাতের জন্য কুরআন পাঠ আরো সহজ করে দিন। তিনি তৃতীয়বার আমাকে বলে দিলেন, তাহলে সাত রীতিতে কুরআন পড়ো। কিন্তু তোমার প্রতিটি নিবেদনের পরিবর্তে আমি তোমাকে যা দিয়েছি এর বাইরেও আরো নিবেদন অধিকার তোমার রইল। তুমি তা চাইতে পারো। তিনি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলেন, তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মাতকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মাতকে ক্ষমা করুন। আর তৃতীয় আবেদনটি আমি এমন এক দিনের জন্য পিছিয়ে রাখলাম যেদিন সব সৃষ্টি আমার সুপারিশের দিকে চেয়ে থাকিবে। এমনকি ইব্রাহীম [আঃ]-ও।
[মুসলিম]{১}, {১} সহীহ : মুসলিম ৮২০, আহমাদ ২১১৭১, সহীহ ইবনি হিববান ৭৪০, বাগাবী ১২২৭, সহীহ আল জামি ২০৭১। কুরআন সংকলন -এই হাদিসটির তাহকীকঃ সহীহ হাদিস
২২১৪. আবদুল্লাহ ইবনি আব্বাস [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জিবরীল [আঃ] আমাকে এক রীতিতে কুরআন পড়ালেন। আমি তাকে এর পাঠ রীতির সংখ্যা বৃদ্ধি করে আনতে আল্লাহর নিকট ফেরত পাঠালাম। আল্লাহ আমার জন্য এ রীতি বৃদ্ধি করিতে লাগলেন। অতঃপর এ পাঠ সাত রীতিতে গিয়ে পৌঁছল।
বর্ণনাকারী ইবনি শিহাব যুহরী বলেন, বিশ্বস্ত সূত্রে আমার নিকট খবর পৌঁছেছে যে, এ সাত রীতি অর্থের দিক দিয়ে একই। এর দ্বারা হালাল হারামে কোন পার্থক্য পড়েনি।
[বোখারী, মুসলিম]{১}, {১} সহীহ : বোখারী ৪৯৯১, মুসলিম ৮১৯, আহমাদ ২৩৭৫, মুজামুস সগীর লিত্ব ত্ববারানী ৮৮, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৩৯৯০, সহীহ আল জামি ১১৬২। কুরআন সংকলন -এই হাদিসটির তাহকীকঃ সহীহ হাদিস
অধ্যায়ঃ ২. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ
২২১৫. উবাই ইবনি কাব [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরীলের সাথে দেখা করিলেন। তিনি বললেন, হে জিবরীল! আমি এক নিরক্ষর উম্মাতের কাছে প্রেরিত হয়েছি। এদের মধ্যে আছে প্রবীণা বৃদ্ধা, প্রবীণ বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরী। এমন ব্যক্তিও আছে যে কখনো লেখাপড়া করেনি। জিবরীল বললেন, হে মুহাম্মাদ! [এতে ভয় নেই] কুরআন সাত রীতিতে [পড়ার অনুমতি নিয়ে] নাযিল হয়েছে। [তিরমিজি।]
আহমদ ও আবু দাঊদের এক বর্ণনায় আরো আছে, এদের প্রত্যেক পাঠই [অন্তর রোগের জন্য] নিরাময় দানকারী ও যথেষ্ট। কিন্তু নাসায়ীর এক বর্ণনায় আছে, তিনি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলেন, জিবরীল ও মীকাঈল আমার নিকট এলেন। জিবরীল আমার ডানদিকে ও মীকাঈল বাম দিকে বসলেন। জিবরীল বললেন, আপনি আমার কাছ থেকে কুরআন পড়ার রীতি শিখে নিন। তখন মীকাঈল বললেন, আপনি তার নিকট কুরআন পড়ার রীতি বৃদ্ধির আবেদন করুন। আমি তা করলাম। অতঃপর এ রীতি সাত পর্যন্ত পৌঁছল। তাই এ সাত রীতির প্রত্যেকটাই আরোগ্য দানকারী ও যথেষ্ট।{১}
{১} হাসান সহীহ : তিরমিজি ২৯৪৪, সহীহ ইবনি হিববান ৭৩৯, আহমাদ ২১২০৪, ২১১৩২, নাসায়ী ৯৪১, আবু দাউদ ১৪৭৭, সহীহ আল জামি ৭৮। এই হাদিসটির তাহকীকঃ হাসান সহীহ
২২১৬. ইমরান ইবনি হুসায়ন [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, একবার তিনি এক গল্পকারের নিকট গেলেন। তিনি দেখলেন, সে গল্পকার কুরআন পড়ছে। আর মানুষের কাছে ভিক্ষা চাইছে। [এ দৃশ্য দেখে] তিনি দুঃখে ইন্না- লিল্লা-হি পড়লেন। এরপর বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলিতে শুনিয়াছি, যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে সে যেন বিনিময়ে আল্লাহর কাছে কিছু চায়। খুব তাড়াতাড়ি এমন কিছু লোকের আগমন ঘটবে যারা কুরআন পড়ে বিনিময়ে মানুষের কাছে হাত পাতবে।
[আহমদ ও তিরমিজি]{১}, 1] সহীহ লিগয়রিহী : তিরমিজি ২৯১৭, ইবনি আবী শায়বাহ্ ৩০০০২, আহমাদ ১৯৮৮৫, মুজামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৩৭১, শুআবুল ঈমান ২৩৮৭, সহীহাহ্ ২৫৭, সহীহ আত তারগীব ১৪৩৩, সহীহ আল জামি ৬৪৬৭। তবে শুআয়ব আরনাঊত আহমাদ-এর সানাদটিকে জইফ বলেছেন। এই হাদিসটির তাহকীকঃ সহীহ লিগাইরিহি
অধ্যায়ঃ ২. তৃতীয় অনুচ্ছেদ
২২১৭. বুরায়দাহ্ আল আসলামী [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে মানুষের কাছে খাবার চাইবে কিয়ামাতের দিন সে এমন এক অবস্থায় উপনীত হবে যে তার চেহারায় হাড় থাকিবে, কিন্তু গোশ্ত [গোসত/গোশত] থাকিবে না
। [বায়হাক্বী- শুআবুল ঈমান]{১} {১} মাওযূ : শুআবুল ঈমান ২৩৮৪, যঈফাহ্ ১৩৫৬, জইফ আল জামি ৫৭৬৩। কারণ এর সানাদে আহমাদ ইবনি মায়সাম আলী ইবনি কদিম থেকে অনেক মুনকার হাদিস বর্ণনা করিয়াছেন। ঈমাম সুয়ূত্বী হাদিসটিকে তার মাওযূআত-এ নিয়ে এসেছেন। এই হাদিসটির তাহকীকঃ জাল হাদিস
২২১৮. আবদুল্লাহ ইবনি আব্বাস [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম নাযিল না হওয়া পর্যন্ত সূরাগুলোর মধ্যে পার্থক্য বুঝে উঠতে পারতেন না
। [আবু দাউদ]{১}, {১} সহীহ : আবু দাউদ ৭৮৮, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ২৩৭৭, শুআবুল ঈমান ২১২৫, সহীহ আল জামি ৪৮৬৪। কুরআন সংকলন -এই হাদিসটির তাহকীকঃ সহীহ হাদিস
২২১৯. আলকামাহ্ [রাহিমাহুল্লাহ] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, আমরা হিম্স শহরে ছিলাম। ওই সময় একবার আবদুল্লাহ ইবনি মাস্ঊদ [রাদি.] সূরা ইউসুফ পড়লেন। তখন এক লোক বলে উঠল, এ সূরা এভাবে নাযিল হয়নি। [এ কথা শুনে] আবদুল্লাহ ইবনি মাস্ঊদ [রাদি.] বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়ে এ সূরা পড়েছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুনে বলেছেন, বেশ ভাল পড়েছ। আলকামাহ্ বলেন, সে তাহাঁর সাথে কথা বলছিল এ সময় তার মুখ থেকে মদের গন্ধ পাওয়া গেল। আবদুল্লাহ ইবনি মাস্ঊদ [রাদি.] তখন বললেন, মদ খাও আর আল্লাহর কিতাবকে মিথ্যা বানাও। এরপর আবদুল্লাহ ইবনি মাস্ঊদ [রাদি.] মদপানের অপরাধে তাকে শাস্তি প্রদান করিলেন।
[বোখারী, মুসলিম]{১} {১} সহীহ : বোখারী ৫০০১, মুসলিম ৮০১। কুরআন সংকলন -এই হাদিসটির তাহকীকঃ সহীহ হাদিস
২২২০. যায়দ ইবনি সাবিত [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, ইয়ামামার যুদ্ধের পর পর খলীফাতুর রসূল আবু বাকর [রাদি.] আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি গেলাম। দেখলাম উমার ইবনুল খাত্ত্বাব [রাদি.] তাহাঁর কাছে উপবিষ্ট। আবু বাকর [রাদি.] বললেন, উমার আমার কাছে এসে খবর দিলেন, ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক কুরআনের হাফেয শহীদ হয়ে গেছেন। আমার আশংকা হয়, বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে এভাবে হাফেয শহীদ হইতে থাকলে কুরআনের অনেক অংশ লোপ পেয়ে যাবে। তাই আমি সঙ্গত মনে করি যে, আপনি কুরআনকে মাসহাফ বা কিতাব আকারে একত্রিত করিতে হুকুম দেবেন। আবু বাকর [রাদি.] বলেন, আমি উমারকে বললাম, এমন কাজ কিভাবে আপনি করিবেন, যে কাজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেননি? উমার [রাদি.] উত্তরে বললেন, আল্লাহর শপথ। এটা হবে একটা উত্তম কাজ। উমার [রাদি.] এভাবে আমাকে বার বার বলিতে লাগলেন। অতঃপর আল্লাহ এ কাজের গুরুত্ব বুঝার জন্য আমার হৃদয় খুলে দিলেন এবং আমিও এ কাজ করা সঙ্গত মনে করলাম।
যায়দ [রাদি.] বলেন, আবু বাকর [রাদি.] আমাকে বললেন, তুমি একজন বুদ্ধিমান যুবক যার ব্যাপারে আমাদের কোন সন্দেহ সংশয় নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওহীও তুমি লিখতে। তাই তুমিই কুরআনের আয়াতগুলো খোঁজ করো এবং এগুলো গ্রন্থাকারে [মাসহাফ] একত্র করো। যায়দ [রাদি.] বলেন, তারা যদি আমাকে পাহাড়সমূহের কোন একটিকে স্থানান্তরের দায়িত্ব অর্পণ করিতেন তা-ও আমার জন্য কুরআন একত্র করার দায়িত্ব অপেক্ষা অধিক দুঃসাধ্য হত না। যায়দ [রাদি.] বলেন, আমি বললাম, যে কাজ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেননি, এমন কাজ আপনারা কী করে করিবেন? আবু বাকর [রাদি.] বললেন, আল্লাহর কসম! এটা বড়ই উত্তম কাজ। মোটকথা, এভাবে আবু বাকর [রাদি.] আমাকে বার বার বলিতে লাগলেন।
সর্বশেষ আল্লাহ তাআলা আমার হৃদয়কেও এ গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্য খুলে দিলেন, যে কাজের জন্য আবু বাকর ও উমারের হৃদয়কে খুলে দিয়েছিলেন। অতএব খেজুরের ডালা, সাদা পাথর, পশুর হাড়, মানুষের [হাফেযদের] অন্তর ও স্মৃতি হইতে আমি কুরআনের আয়াত সংগ্রহ করিতে লাগলাম। সর্বশেষ আমি সূরা আত তাওবার শেষাংশ, লাকদ জা-আকুম রসূলুম মিন আনফুসিকুম হইতে সূরার শেষ পর্যন্ত সংগ্রহ করলাম আবু খুযায়মাহ্ আনসারীর কাছ থেকে। এ অংশ আমি তার ছাড়া আর কারো কাছে পাইনি। যায়দ [রাদি.] বলেন, এ লিখিত সহীফাহগুলো আবু বাকর [রাদি.] এর কাছে ছিল যে পর্যন্ত আল্লাহ তাকে মৃত্যু দেননি। তারপর ছিল উমার [রাদি.]-এর কাছে তাহাঁর জীবনকাল পর্যন্ত। তারপর তাহাঁর কন্যা হাফসা [রাদি.]-এর কাছে ছিল।
[বোখারী]{১}, {১} সহীহ : বোখারী ৪৯৮৬, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ২৩৭২, সহীহ ইবনি হিববান ৪৫০৬। কুরআন সংকলন -এই হাদিসটির তাহকীকঃ সহীহ হাদিস
২২২১. আনাস ইবনি মালিক [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, হুযায়ফাহ্ ইবনি ইয়ামান, খলীফা উসমান [রাদি.]-এর কাছে মাদীনায় এলেন। তখন হুযায়ফাহ্ ইরাক্বীদের সাথে থেকে আরমীনিয়্যাহ্ [আরমেনিয়া] ও আযরাবীজান [আযারবাইজান] জয় করার জন্য শামবাসীদের [সিরিয়াবাসীদের] বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন। এখানে তাদের অমিল কুরআন তিলাওয়াত তাকে উদ্বিগ্ন করে তুলল। তিনি উসমান [রাদি.]-কে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! ইয়াহূদী-খৃষ্টানদের মতো আল্লাহর কিতাবে ভিন্নতা আসার আগে আপনি এ জাতিকে রক্ষা করুন। তাই উসমান [রাদি.] উম্মুল মুমিনীন হাফসাহ্র নিকট রক্ষিত মাসহাফ [কুরআন মাজীদ] তার নিকট পাঠিয়ে দেবার জন্য খবর পাঠালেন। তিনি বললেন, আমরা সেটাকে বিভিন্ন মাসহাফে অনুলিপি করে আবার আপনার নিকট তা পাঠিয়ে দিব। হাফসাহ্ [রাদি.] সে সহীফাহ্ উসমানের নিকট পাঠিয়ে দিলেন। উসমান [রাদি.] সাহাবী যায়দ ইবনি সাবিত, আবদুল্লাহ ইবনি যুবায়র, সাঈদ ইবনি আস ও আবদুল্লাহ ইবনি হারিস ইবনি হিশামকে এ সহীফা কপি করার নির্দেশ দিলেন।
হুকুম মতো তারা এ সহীফার অনেক কপি করে নিলেন। সে সময় উসমান কুরায়শী তিন ব্যক্তিকে বলে দিয়েছিলেন, কুরআনের কোন স্থানে যায়দ-এর সাথে আপনাদের মতভেদ হলে তা কুরায়শদের রীতিতে লিখে নিবেন। কারণ কুরআন মূলত তাদের রীতিতেই নাযিল হয়েছে। তারা নির্দেশ মতো কাজ করিলেন। সর্বশেষ সমস্ত সহীফাহ্ বিভিন্ন মাসহাফে কপি করে নেবার পর উসমান মূল সহীফাহ্ হাফসাহ্র নিকট ফেরত পাঠালেন। তাদের কপি করা সহীফাহসমূহের এক এক কপি রাজ্যের এক এক এলাকায় পাঠিয়ে দিলেন। এ কপি ছাড়া অন্য সব আগের সহীফায় লিখিত কুরআনকে জ্বালিয়ে ফেলতে নির্দেশ জারী করেছিলেন।
ইবনি শিহাব যুহরী বলেন, যায়দ ইবনি সাবিত [রাদি.] এর ছেলে খারিজাহ্ আমাকে জানিয়েছেন, তিনি তাহাঁর পিতা যায়দ ইবনি সাবিত [রাদি.]-কে বলিতে শুনেছেন, আমরা যখন কুরআন নকল করি, সূরা আল আহযাব-এর একটি আয়াত খুঁজে পেলাম না। এ আয়াতটি আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পড়তে শুনিয়াছি। তাই আমরা তা খোঁজ করিতে লাগলাম। খুযায়মাহ্ ইবনি সাবিত আল আনসারী-এর নিকট অবশেষে আমরা তা পেলাম। এরপর আমরা তা মাসহাফে সংযোজন করে দিলাম। আর সে আয়াতটি হলো, মিনাল মুমিনীনা রিজা-লুন সদাকূ মা- আ-হাদুল্ল-হা আলায়হি [অর্থাৎ- মুমিনদের মধ্যে কতক লোক আল্লাহর সঙ্গে কৃত তাদের অঙ্গীকার সত্যে পরিণত করেছে]- [সূরা আল আহযাব ৩৩ : ২৩]।
[বোখারী]{১}, {১} সহীহ : বোখারী ৪৯৮৭, তিরমিজি ৩১০৪, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ২৩৭৪, সহীহ ইবনি হিব্বান ৪৫০৬। কুরআন সংকলন -এই হাদিসটির তাহকীকঃ সহীহ হাদিস
২২২২.আবদুল্লাহ ইবনি আব্বাস [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, আমি একবার খলীফা উসমানকে বললাম, কোন্ জিনিস আপনাদেরকে উদ্বুদ্ধ করিল যে সূরা আনফাল, যা সূরা মাসানীর অন্তর্ভুক্ত, সূরা বারাআত [আত তাওবাহ্] যা মাঈন-এর অন্তর্ভুক্ত? এ উভয় সূরাকে এক স্থানে একত্র করে দিলেন? এ দু সূরার মাঝে আবার বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম লাইনও লিখলেন না? আর এগুলোকে জায়গা দিলেন সাব্ইত্ব তুওয়াল-এর মধ্যে [অর্থাৎ- ৭টি দীর্ঘ সূরা]। কোন্ বিষয়ে আপনাদেরকে এ কাজ করিতে উজ্জীবিত করিল? উসমান জবাবে বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর ওহী নাযিল হবার অবস্থা ছিল এমন যে, কোন কোন সময় দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হত [তাহাঁর ওপর কোন সূরা নাযিল হত না] আবার কোন কোন সময় তাহাঁর ওপর বিভিন্ন সূরা [একত্রে] নাযিল হত। তাহাঁর ওপর কুরআনের কিছু নাযিল হলে তিনি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাহাঁর কোন না কোন সাহাবী ওহী লেখককে [কাতিবে ওহী] ডেকে বলিতেন, এ আয়াতগুলোকে অমুক সূরার অন্তর্ভুক্ত করো। যেসব আয়াতে অমুক অমুক বর্ণনা রয়েছে এর, আর অন্য কোন আয়াত নাযিল হলে তিনি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলিতেন, এ আয়াতকে অমুক সূরায় স্থান দাও।
মাদীনায় প্রথম নাযিল হওয়া সূরাহসমূহের মধ্যে সূরা আল আনফাল অন্তর্ভুক্ত। আর সূরা বারাআত মাদীনায় অবতীর্ণ হবার দিক দিয়ে শেষ সূরাগুলোর অন্তর্গত। অথচ ও দুটি সূরার বিষয়বস্ত্ত প্রায় এক। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকালের কারণে আমাদেরকে বলে যেতে পারেননি সূরা বারাআত, সূরা আনফাল-এর অন্তর্ভুক্ত কিনা। তাই [অর্থাৎ- উভয় সূরা মাদানী ও বিষয়বস্ত্তর মিল থাকার কারণে] আমি এ দু সূরাকে একত্রে মিলিয়ে দিয়েছি। বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম লাইনও [এ দু সূরার মধ্যে] লিখিনি এবং এ কারণেই এটাকে সাব্ইত্ব তুওয়াল-এর অন্তর্গত করে নিয়েছি।
[আহমদ, তিরমিজি ও আবু দাউদ]{১}, {১} জইফ : তিরমিজি ৩০৮৬, আবু দাউদ ৭৮৬, আহমাদ ৩৯৯, মুসতাদারাক লিল হাকিম ২৮৭৫, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ২৩৭৬। কারণ এর সানাদে ইয়াযীদ আল ফারিসী একজন মাজহূল রাবী। এই হাদিসটির তাহকীকঃ দুর্বল হাদিস
Leave a Reply