যী-কারাদ ও অন্যান্য যুদ্ধ
যী-কারাদ ও অন্যান্য যুদ্ধ >> সহীহ মুসলিম শরীফ এর মুল সুচিপত্র দেখুন >> নিম্নে মুসলিম শরীফ এর একটি অধ্যায়ের হাদিস পড়ুন
৪৫. অধ্যায়ঃ যী-কারাদ ও অন্যান্য যুদ্ধ
৪৫৬৯. সালামাহ্ ইবনি আকওয়া [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, আমি ফাজ্রের আযানের আগেই বের হয়ে পড়লাম। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] এর দুধের উট্নী তখন যীকারাদের [চারণ ভূমিতে] চরছিল। তখন আবদুর রহমান ইবনি আওফ [রাদি.]-এর গোলাম আমার সাথে সাক্ষাৎ করে বলিল, রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] -এর দুধের উট্নীসমূহকে নিয়ে গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে সেগুলো নিয়ে গেছে? সে বলিল, গাফ্তান গোত্রের লোকেরা। রাবী বলেন, তখন আমি উচ্চৈঃস্বরে তিনবার আওয়াজ দিলাম; সাহায্য চাই, সাহায্য চাই। রাবী [সালামাহ্ ইবনি আক্ওয়া] বলেন, মাদীনার উভয় প্রান্তের মধ্যবর্তী সবাইকে আমি আমার সে আওয়াজ শুনালাম তারপর বের হয়ে গেলাম। যী-কারাদে গিয়ে তাদের [লুটেরাদের]-কে পেলাম। তখন তারা তাদের পশুদেরকে পানি পান করাচ্ছিল। তখন আমি তীর নিক্ষেপ করিতে শুরু করলাম। আমি ছিলাম একজন দক্ষ তীরন্দাজ। আর তখন আমি বীরত্বসূচক কবিতা আবৃত্তি করছিলাম, “আমি আক্ওয়ার পুত্র, আজ দুষ্টদের ধ্বংসের দিন।” [কিংবা আজ তার দিন যে শৈশব থেকে যুদ্ধের স্তন্য পান করেছে]।
আমি আমার তীর নিক্ষেপ ও বীরত্বব্যঞ্জক কবিতা আবৃত্তি করিতে থাকলাম। অবশেষে আমি দুধের উট্নীসমূহ মুক্ত করলাম এমনকি আমি তাদের ত্রিশটি চাদরও ছিনিয়ে নিলাম। এমন সময় রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] ও লোকজন এসে পড়লেন। তখন আমি বললাম, “হে আল্লাহর রসূল [সাঃআঃ] ! আমি তাদের পানির পথ রুদ্ধ করে রেখেছি, তাই তারা পিপাসার্ত। এবার আপনি একটি বাহিনী প্রেরণ করুন। তখন তিনি [রসূলুল্লাহ সাঃআঃ] বললেনঃ আকওয়া, এ সময় যা নেয়ার ছিল তুমি তা নিয়েছ। এবার ছেড়ে দাও। রাবী বলেন, তারপর আমরা ফিরে এলাম। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] আমাকে তাহাঁরই উট্নির পিছনে বসিয়ে নিলেন। তারপর আমরা মাদীনায় পৌঁছলাম।
[ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৫২৬, ইসলামিক সেন্টার- ৪৫২৮]
৪৫৭০. ইয়াস ইবনি সালামাহ্ [রাদি.] তাহাঁর পিতা হইতে বর্ণীতঃ
তিনি বলেন, আমরা রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] -এর সঙ্গে হুদাইবিয়ায় পৌঁছলাম। তখন আমাদের সংখ্যা ছিল চৌদ্দশ। তদুপরি সেখানে ছিল পঞ্চাশটি বকরী, যাদের পানি পানের জন্য পর্যাপ্ত পানি ছিল না। রাবী বলেন, রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] কূয়ার কিনারায় বসলেন এবং দুআ করিলেন অথবা তাতে থুতু দিলেন। রাবী বলেন, আর অমনি পানি উথ্লে উঠলো। তখন আমরাও পানি পান করলাম এবং [পশুদেরকেও] পানি পান করালাম। রাবী বলেন, তারপর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] আমাদের বাইআতের জন্য বৃক্ষমূলে ডাকলেন। রাবী বলেন, তারপর লোকদের মধ্যে আমি সর্বাগ্রে বাইআত হলাম। তারপর একে একে অন্যান্য লোকেরাও বাইআত হলো। তিনি যখন বাইআত গ্রহণ করিতে করিতে লোকজনের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছলেন, তখন বলিলেন, হে সালামাহ্! তুমি বাইআত হও। রাবী বলেন, তখন আমি বললাম, আমি তো, লোকদের মধ্যে প্রথমেই বাইআত হয়েছি, হে আল্লাহর রসূল! তিনি বললেনঃ আবারও হও না? রাবী বলেন, রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] তখন আমাকে ঢাল দিয়ে বাইআত করিতে করিতে লোকদের শেষ প্রান্তে পৌঁছলেন এবং বলিলেন, তুমি কি আমার কাছে বাইআত হইবে না, হে সালামাহ্! রাবী বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমি তো লোকদের মধ্যে প্রথমভাগে এবং মধ্যভাগে [দু দুবার] আপনার কাছে বাইআত হয়েছি। তিনি বললেনঃ আবারও হও না। তখন আমি তৃতীয় বার বাইআত গ্রহণ করলাম। এরপর তিনি আমাকে বলিলেন, হে সালামাহ্! তোমার সে বড় ঢালটি বা ছোট ঢালটি কোথায়, যা আমি তোমাকে দিয়েছিলাম? রাবী [সালামাহ্] বলেন, আমি বললাম : হে আল্লাহর রসূল! আমার চাচা আমির আমার সাথে অস্ত্রবিহীন অবস্থায় দেখা করেছিলেন। তখন আমি তাঁকে তা দিয়ে দিয়েছি। রাবী বলেন, এতে রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] হেসে দিলেন এবং বললেনঃ তুমি দেখছি পূর্ববর্তীযুগের সে লোকের মত, যে বলেছিল, হে আল্লাহ! আমি এমন একজন বন্ধু চাই, যে আমার প্রানের চাইতেও আমার নিকট বেশি প্রিয় হইবে।” এরপরে মুশরিকরা আমাদের কাছে প্রস্তাব পাঠালো। আমাদের একপক্ষের লোকজন অন্যপক্ষের শিবিরে যাতায়াত করিতে লাগলো এবং শেষ পর্যন্ত আমরা উভয়পক্ষ পরস্পরে সন্ধিবদ্ধ হলাম। রাবী [সালামাহ্ [রাদি.] বলেন, আমি তালহাহ্ ইবনি উবাইদুল্লাহর খিদমাতে নিয়োজিত ছিলাম। আমি তার ঘোড়াকে পানি পান করাতাম এবং তার পিঠ মালিশ করতাম এবং তাহাঁর অন্যান্য খিদমাতও করতাম। আমি তাহাঁর ওখানে খাওয়া-দাওয়া করতাম। নিজের পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ পরিত্যাগ করে আল্লাহ তাআলা ও তাহাঁর রসূলের রাহে মুহাজির হয়েছি। রাবী বলেন, তারপর যখন আমরা ও মক্কাবাসীরা সন্ধিতে আবদ্ধ হলাম এবং আমাদের একপক্ষ অপরপক্ষের সাথে মিলেমিশে থাকতে লাগলাম। আমি একটি গাছ তলায় গিয়ে তার নীচের কাঁটা প্রভৃতি পরিষ্কার করে তার গোড়ায় একটু শুয়ে পড়ি। এমন সময় মাক্কাবাসী চারজন মুশরিক এসে রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলিতে লাগলো। আমার কাছে ওদের কথাবার্তা অত্যন্ত খারাপ লাগলো এবং আমি স্থান পরিবর্তন করে আর একটি গাছের তলায় চলে গেলাম। তারা তাদের অস্ত্রাদি গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখে শুয়ে পড়লো।
এমন সময় প্রান্তরের নিম্নাঞ্চল থেকে কে যেন চীৎকার করে বললো, হে মুহাজিরগণ! ইবনি যুনায়মকে কতল কর। আমি তৎক্ষণাৎ আমার তরবারি উঠিয়ে ধরলাম এবং ঐ চারজনের উপর ধাবিত হলাম। তখন তারা ঘুমিয়ে ছিল। আমি তাদের অস্ত্রগুলো হস্তগত করলাম এবং তা আঁটি বেঁধে আমার হাতে নিলাম। তিনি বলেন, এরপর আমি বললাম, যে মহান সত্তা মুহাম্মাদ [সাঃআঃ] -কে সম্মানিত করিয়াছেন তাহাঁর কসম! তোমাদের মধ্যে কেউ যদি মাথা তোলো, তবে তার সে অঙ্গে আঘাত করব যেখানে তার চোখ দুটো রয়েছে। রাবী বলেন, তারপর তাদেরকে আমি হাঁকিয়ে রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] -এর নিকট পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। তিনি বলেন, এমন সময় আমার চাচা আমির আবালাত গোত্রের একজনকে রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] -এর নিকট নিয়ে এসেছে। তাকে বলা হতো মিকরিয। সে ছিল বর্ম সজ্জিত একটি ঘোড়ায় আসীন। আর তার সাথে সত্তর জন মুশরিক। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] তাদের দিকে তাকালেন এবং বললেনঃ “ওদেরকে ছেড়ে দাও, যাতে আক্রমণ ওদের পক্ষ থেকেই হয় এবং দ্বিতীয়বার তারাই অপরাধী প্রতিপন্ন হয়”। এ কথা বলে রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] তাদের ক্ষমা করে দিলেন। তখন আল্লাহ তাআলা নাযিল করিলেন : “সে পবিত্র সত্তা যিনি তাদের হাতকে তোমাদের উপর থেকে এবং তোমাদের হাতকে তাদের উপর থেকে মক্কাপ্রান্তরে তাদের উপর তোমাদের বিজয়ী করার পর বিরত রেখেছেন”-
[সূরা আন্ নূর ২৪ : ৪৮] আয়াতের শেষ পর্যন্ত।
রাবী বলেন, তারপর মাদীনায় প্রত্যাবর্তনের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। পথে এমন একটি মানযিলে আমরা অবতরণ করলাম যেখানে আমাদের ও লেহিয়ান গোত্রের মধ্যে কেবল একটি পাহাড়ের ব্যবধান ছিল। আর তারা ছিল মুশরিক। তখন রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] সে ব্যক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করিলেন, যে ব্যক্তি রাতে নবী [সাঃআঃ] ও তাহাঁর সাহাবীদের পক্ষ থেকে পাহারা দেয়ার জন্য পাহাড়ের উপর আরোহণ করিবে। সালামাহ্ বলেন, সে রাতে আমি দুই কি তিনবার ঐ পাহাড়ে আরোহণ করেছিলাম। তারপর আমরা মাদীনায় এলাম। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] তাহাঁর গোলাম রাবাহ্কে দিয়ে তাহাঁর উটসমূহ পাঠালেন। আর আমিও তালহার ঘোড়ায় চড়ে তাহাঁর সাথে সাথে উটগুলো হাঁকিয়ে চারণ ভূমির দিকে নিয়ে গেলাম। যখন আমাদের ভোর হলো আবদুর রহমান ফাজারী চড়াও হয়ে রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর সমস্ত উট ছিনিয়ে নিয়ে গেল এবং পশুপালের রাখালকে হত্যা করলো। আমি তখন রাবাহ্কে বললাম, হে রাবাহ্! লও এ ঘোড়া নিয়ে তুমি তালহাহ্ ইবনি উবাইদুল্লাহকে পৌঁছে দিও আর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] -কে সংবাদ দাও যে, মুশরিকরা তাহাঁর উটগুলো লুটে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, তখন আমি একটি টিলার উপর দাঁড়ালাম। তারপর মাদীনার দিকে মুখ করে তিনবার চিৎকার দিলাম, ইয়া সাবাহা! তারপর আমি লুটেরাদের পিছু ধাওয়া করলাম ও তাদের উপর তীর নিক্ষেপ করিতে লাগলাম। আর আমি মুখে এ চরণ উচ্চারণ করছিলাম,
“আমি আকওয়ার পুত্র, আজ সেদিন, আজকে মায়ের দুধ [কতখানি খেয়েছো তা] স্মরণের দিন।”
তখন আমি তাদের যে কাউকে পেয়েছি, তার উপর এ রকমভাবে তীর নিক্ষেপ করেছি যে, তীরের অগ্রভাগ তার কাঁধ ছেদ করে বেরিয়েছে। তিনি বলেন, আমি বলিতে লাগলাম,
“এ আঘাত নাও, আমি আকওয়ার পুত্র, আজ দুধপান স্মরণের দিন।”
তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! আমি তীর নিক্ষেপ করিতে থাকলাম এবং ঘায়েল করিতে লাগলাম এবং যখনই কোন ঘোড় সওয়ার আমার দিকে ফিরত তখনই আমি গাছের আড়ালে এসে তার গোড়ায় বসে তার প্রতি তীর নিক্ষেপ করতাম। আর তাকে যখম করে ফেলতাম। অবশেষে যখন তারা পাহাড়ের সংকীর্ণ পথে আসে এবং তারা সে সংকীর্ণ পথে ঢোকে আমি তখন পাহাড়ের উপর উঠে সেখান থেকে অবিরাম তাদের উপর পাথর নিক্ষেপ করিতে থাকলাম। তিনি বলেন, এভাবে আমি তাদের পশ্চাদ্ধাবন করিতে থাকলাম যে পর্যন্ত না আল্লাহর সৃষ্ট উটগুলো যা রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] -এর সাওয়ারী হিসেবে ছিল তা আমার পেছনে রেখে না যাই। তারা এগুলো আমার আওতায় ফেলে চলে গেল। তারপরও আমি তাদের অনুসরণ করে তাদের উপর তীর নিক্ষেপ করিতে থাকলাম। এমনিকি তারা ত্রিশটির বেশী চাদর এবং ত্রিশটি বল্লম নিজের বোঝা হালকা করার উদ্দেশ্যে ফেলে গেল। তারা যেসব বস্তু ফেলে যাচ্ছিল আমি তার প্রত্যেকটিকে পাথর দ্বারা চিহ্নিত করে যাচ্ছিলাম যাতে রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] ও তাহাঁর সাহাবীগণ তা দেখে চিনতে পারেন। অবশেষে তারা পাহাড়ের একটি সংকীর্ণ স্থানে গিয়ে পৌঁছলো। এমন সময় বাদ্র ফাজারীর অমুক পুত্র এসে তাদের সাথে মিলিত হলো। এবার তারা সকলে মিলে সকালের খাবার খেতে বসলো। আমি পাহাড়ের একটি শৃঙ্গে বসে পড়লাম। তখন সে ফাজারী বললো, ঐ যে লোকটিকে দেখছি সে কে? তারা বলিল, লোকটির হাতে আমরা অনেক দুর্ভোগ পোহায়েছি। আল্লাহর কসম! রাতের আধাঁর থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত লোকটি আমাদের পিছন থেকে সরছে না, সে আমাদের প্রতি অবিরত তীর নিক্ষেপ করছে, এমনকি আমাদের যথাসর্বস্ব সে কেড়ে নিয়েছে। তখন সে বলিল, তোমাদের মধ্যকার চারজন উঠে গিয়ে তার উপর চড়াও হও। তখন তাদের চার ব্যক্তি পাহাড়ে উঠে আমার দিকে এগিয়ে এলো। তারপর তারা যখন আমার কথা শোনার মত নিকটবর্তী স্থানে এসে পৌঁছলো, তিনি বলেন, তখন আমি বললাম, তোমরা কি আমাকে চেন? তারা বলিল, না। তিনি বলেন, আমি বললাম, আমি সালামাহ্ ইবনি আকওয়া। কসম সে পবিত্র সত্তার, যিনি মুহাম্মাদ [সাঃআঃ]-কে সম্মানিত করিয়াছেন! আমি তোমাদের যাকেই পাই তাকে ধরে ফেলব। কিন্তু তোমাদের কেউ চাইলেই আমাকে ধরতে পারবে না। তখন তাদের একজন বলিল, আমিও তাই মনে করি। তিনি বলেন, তারপর তারা ফিরে গেল। আর আমি সে স্থানেই বসে রইলাম। অবশেষে আমি রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] -এর অশ্বারোহীদের গাছ-গাছালির মাঝ দিয়ে অগ্রসর হইতে দেখলাম। তিনি বলেন, তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিলেন আখরাম আসাদী। তাহাঁর পিছনে আবু কাতাদাহ্ আনসারী। তাহাঁর পিছনে মিকদাদ ইবনিল আসওয়াদ কিন্দী। তিনি বলেন, আমি তখন আখরামের ঘোড়ার লাগাম ধরলাম। তিনি বলেন, তখন লুটেরা [শত্রুরা] পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালিয়ে গেল। আমি বললাম, হে আখরাম! ওদের থেকে সতর্ক থাকিবে। তারা যেন রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] ও তাহাঁর সাহাবীগণ এসে মিলিত হওয়ার পূর্বেই তোমাদের বিচ্ছিন্ন করে না ফেলে। আখরাম বলিলেন, হে সালামাহ্! তুমি যদি আল্লাহ ও কিয়ামাতের দিনের প্রতি বিশ্বাসী হও এবং জান্নাত ও জাহান্নামকে সত্য মনে কর তবে আমার এবং শাহাদাতের মধ্যে বাধা সৃষ্টি করো না। সালামাহ্ বলেন, তখন আমি তার পথ ছেড়ে দিলাম। তিনি তখন আবদুর রহমানের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। আখরাম আবদুর রহমানের ঘোড়াকে আহত করিলেন। আর আবদুর রহমান বর্শার আঘাতে তাকে কতল করে দিল এবং আখরামের ঘোড়ার উপর চড়ে বসলো। ইতোমধ্যে রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর ঘোড়সাওয়ার আবু কাতাদাহ্ [রাদি.] এসে পৌঁছলেন। তিনি আবদুর রহমানকে বর্শার আঘাতে হত্যা করিলেন। সে পবিত্র সত্তার কসম! যিনি মুহাম্মাদ [সাঃআঃ]-কে মর্যাদামন্ডিত করিয়াছেন, আমি তখন এতই দ্রুতগতিতে তাদের পিছু ধাওয়া করে যাচ্ছিলাম যে, আর পিছনে [অনেক দূর পর্যন্ত] মুহাম্মাদ [সাঃআঃ] -এর কোন সাহাবীকেই দেখিতে পেলাম না, এমনকি তাদের ঘোড়ার খুরের ধূলিও আমার দৃষ্টিগোচর হলো না। এভাবে চলতে চলতে সূর্যাস্তের প্রাক্কালে তারা এমন একটি গিরিপথে উপনীত হল যেখানে যু-কারাদ নামক একটি প্রস্রবণ রয়েছে। অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত অবস্থায় তারা পানি পান করিতে অবতরণ করলো। তখন তারা আমাকে তাদের পিছু ধাওয়া করে দৌড়ে আসতে দেখিতে পেলো। এক জায়গায় পানি পান করার পূর্বেই আমি সেখান থেকে তাদের তাড়িয়ে দিলাম। তখন তারা পাহাড়ের একটি ঢালু উপত্যকার দিকে দৌড়াতে লাগলো আর আমিও তাদের পিছু ধাওয়া করিতে লাগলাম। আমি তাদের যে কোন একজনের নিকটবর্তী হতাম তার কাঁধের অস্থিতে তীর নিক্ষেপ করে বললাম, “আমি আকওয়ার পুত্র, আজ দুধ স্মরণের দিন”। সে তখন বলিল, তার মা তার জন্য কাঁদুক-তুমি কি সে আকওয়া যে আমাদের সেই ভোর থেকে অতিষ্ঠ করে রেখেছ? আমি বললাম, হ্যাঁ, তোমার জানের দুশমন, আমি সেই তোমার ভোরবেলার আকওয়া। তিনি বলেন, অতঃপর তারা দুটি ক্লান্ত ঘোড়া উপত্যকায় ছেড়ে চলে গেল। তিনি বলেন, তখন আমি ঐ দুটোকে হাঁকিয়ে রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] -এর নিকট নিয়ে এলাম। তিনি বলেন, সেখানে একটি “সাতীহা [চামড়ার পাত্র] এবং একটি পানি ভর্তি সাতীহা নিয়ে এসে আমির আমার সাথে মিলিত হলেন। আমি তখন ওযূ করলাম এবং [দুধ] পান করলাম। তারপর এমন অবস্থায় রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] -এর কাছে এলাম, যখন তিনি ঐ পানির কাছে ছিলেন যা থেকে আমি ওদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
এদিকে রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] ঐ সমস্ত উট ও মুশরিকদের নিকট থেকে আমার ছিনিয়ে আনা বর্শা ও চাদর প্রভৃতি হস্তগত করিয়াছেন। তখন বিলাল ঐ লোকদের কাছ থেকে আমার উদ্ধারকৃত একটি উট জবাই করে তার কলিজা এবং কুঁজ রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর জন্য ভুনা করছিলেন। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমাকে সুযোগ দিন, আমি আমাদের লোকদের থেকে একশ জনকে বাছাই করে নিয়ে সে দুশমনের পিছু ধাওয়া করি যাতে তাদের সকলকে এমনিভাবে হত্যা করব যে, তাদের খবর বয়ে নিয়ে যাবার মত একটি লোকও অবশিষ্ট থাকিবে না। তিনি বলেন, তখন রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] এমনভাবে হাসলেন যে, চুলোর আগুনের আভায় তাহাঁর চোয়ালের দাঁতগুলো প্রকাশ পেলো। এরপর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] বললেনঃ হে সালামাহ্! আমি বললাম, হ্যাঁ, পবিত্র সত্তার শপথ! যিনি আপনাকে সম্মানিত করিয়াছেন। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] তখন বললেনঃ এতক্ষণে তো তারা গাত্ফান পল্লীতে আতিথ্য ভোগ করছে। তিনি বলেন, এমন সময় গাত্ফান গোত্রের একটি লোক এল। সে বলিল, অমুক তাদের জন্য একটি উট যাবাহ করেছে। তারা যখন তাহাঁর চামড়া খসাচ্ছিল তখন তাঁরা ধুলো রাশি উড়তে দেখিতে পায়। তখন তার বলে উঠলো ওরা [আকওয়া ও তাহাঁর বাহিনী] তোমাদের নিকট এসে পড়েছে। তখন তারা পালিয়ে যায়। এরপর আমাদের ভোর হলো। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] বললেনঃ আমাদের আজকে সেরা অশ্বারোহী হচ্ছে আবু কাতাদাহ্ আর আমাদের সেরা পদাতিক হচ্ছে সালামাহ্। তিনি বলেন, তারপর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] আমাকে অশ্বারোহী ও পদাতিক হিসেবে গনীমাতের দু অংশ দিলেন। আমাকে তিনি একত্রে দু অংশ দিলেন। তারপর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] আমাদের মাদীনায় ফিরে আসার কালে আমাকে তাহাঁর সাথে তাহাঁর উট্নী আয্বার পিছনে বসিয়ে নিলেন। তিনি বলেন, তারপর যখন আমরা পথ অতিক্রম করছিলাম, এমন সময় আনসারের এমন এক ব্যক্তি-যাকে পদব্রজে চলার ব্যাপারে কেউ পরাজিত করিতে পারতো না-বলিতে লাগলো-কেউ কি আছে যে, মাদীনায় সর্বাগ্রে পৌঁছার ব্যাপারে প্রতিযোগিতা করিবে? এ কথাটি সে বারবার বলছিল। তিনি বলেন, যখন আমি তার এ [চ্যালেঞ্জমূলক] কথাটি শুনলাম তখন বললাম, তুমি কি কোন সম্মানিত লোককে সম্মান দিতে জাননা বা কোন ভদ্রলোককেই পরোয়া করিবে না? সে বলিল, রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] ব্যতীত অন্য কারো নয়। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার উপর কুরবান, আপনি আমায় অনুমতি দিন যেন আমি ওই ব্যক্তির সাথে প্রতিযোগিতা করি। তখন তিনি বললেনঃ তোমার ইচ্ছা হলে। তিনি বলেন, তখন আমি বললাম, ওহে! আমি তোমার দিকে আসছি। তারপর আমি লাফ দিয়ে নিচে দৌড়ালাম। তারপর এক বা দু টিলা অতিক্রম করার দূরত্বে রইলাম তখন পর্যন্ত আমার দম বন্ধ রেখে তার পিছু পিছু দৌড় দিলাম। আরও দু এক টিলা পর্যন্ত ধীরগতিতে চলার পর সজোরে দৌড় দিয়ে তার নিকট পৌঁছে গেলাম। এবং তার দুকাঁধের মধ্যবর্তী স্থানে একটি ঘুষি মেরে বললাম, ওহে! আল্লাহর কসম! তুমি হেরে গেছ। তখন সে বলিল, আমিও তাই মনে করছি। তিনি বলেন, অতএব আমি তার পূর্বেই মাদীনায় পৌঁছে গেলাম। তিনি বলিলেন, আল্লাহর কসম! এরপর আমরা তিনরাতের অধিক মাদীনায় থাকতে পারিনি। এমনি রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] -এর সঙ্গে আমরা খাইবারের দিকে বেড়িয়ে পড়লাম। তিনি বলেন, তখন আমার চাচা আমির [রাদি.] উৎসাহমূলক কবিতা আবৃত্তি করিতে লাগলেন :
“আল্লাহর কসম! আল্লাহর অনুগ্রহ না হলে আমরা হিদায়াত পেতাম না।
সদাকাহ্ও দিতাম না আর নামাজও আদায় করতাম না।
আমরা আপনার অনুগ্রহ থেকে কখনো বেপরওয়া হইতে পারি না,
তাই আপনি আমাদের কদম দৃঢ় রাখুন, যখন আমরা শত্রুদের সম্মুখীন হই
এবং আপনি আমাদের প্রতি প্রশান্তি বর্ষণ করুন।”
তারপর রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] বললেনঃ এ ব্যক্তি কে? তিনি বলিলেন, আমি আমির। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] বলিলেন, “তোমার রব তোমাকে ক্ষমা করুন।” রাবী বলেন, রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] যখন যার জন্য বিশেষভাবে ক্ষমার দুআ করিতেন সে শহীদ হতো। তিনি বলেন, তখন স্বীয় উটের উপর আসীন উমর ইবনিল খাত্তাব [রাদি.] চীৎকার করে বলিলেন, ইয়া নবী আল্লাহ! আমিরকে দিয়ে আমাদের আরো উপকৃত করিলেন না কেন? তিনি বলেন, তারপর যখন আমরা খাইবারে উপস্থিত হলাম, তখন খাইবার অধিপতি মারহাব তরবারি দোলাতে দোলাতে বেরিয়ে এলো এবং বলিল,
“খাইবার জানে যে, আমি মুরাহ্হাব, পূর্ণ অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত, অভিজ্ঞতাপূর্ণ এক বীরপুরুষ
যখন যুদ্ধ বিগ্রহ ঘনীভূত হয় তখন সে তরবারিসমূহ চমকাতে থাকে।”
রাবী বলেন, আমার চাচা আমির [রাদি.] কবিতা আবৃত্তি করিতে করিতে বলিলেন-
“খাইবার জানে যে, আমি আমির অস্ত্রে-শস্ত্রে সুসজ্জিত যুদ্ধে অবতীর্ণ।
এক বীর বাহাদুর ভয়হীন ব্যক্তি।”
রাবী বলেন, তারপর তাদের মধ্যে আঘাত বিনিময় হলো। আমির [রাদি.] নীচে থেকে যখন তাকে আঘাত করিতে চাইলেন, তখন তা ফিরে এসে তাহাঁর নিজের উপরই পতিত হলো, আর তাতে তাহাঁর পায়ের গোছার সংযোগশিরা কেটে গিয়ে মৃত্যু হল।
[রাবী] সালামাহ্ [রাদি.] বলেন, তখন আমি বের হলাম। নবী [সাঃআঃ]-এর কয়েকজন সাহাবীকে বলাবলি করিতে শুনলাম যে, আমিরের আমাল বরবাদ হয়ে গেছে, সে আত্মহত্যা করেছে। তখন আমি কাঁদতে কাঁদতে নবী [সাঃআঃ]-এর নিকটে এসে বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমিরের আমালগুলো বরবাদ হয়ে গেল? তখন রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] বললেনঃ [এ-কথা]-কে বলেছে? রাবী বলেন, আমি বললাম, আপনারই কয়েকজন সাহাবী। তিনি বলিলেন, যারা এরূপ বলেছে তারা মিথ্যা বলেছে এবং তার প্রতিদান সে দুবার পাবে। তারপর তিনি আমাকে আলী [রাদি.] -এর নিকট পাঠালেন। তখন তিনি চক্ষুরোগে আক্রান্ত ছিলেন। তখন রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] বললেনঃ আমি এমন এক ব্যক্তিকে [আজ] পতাকা সমর্পণ করবো, যে আল্লাহ ও তাহাঁর রসূলকে ভালবাসে এবং আল্লাহ ও তাহাঁর রসূলও তাঁকে ভালবাসেন। তিনি বলেন, তারপর আমি আলী [রাদি.] -এর কাছে গেলাম এবং তাকে নিয়ে রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর কাছে আসলাম। আর তখন তাহাঁর চোখ ব্যাথাগ্রস্ত। রসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] তাহাঁর চোখে থুথু দিলেন। আর [তাতেই] তিনি সুস্থ হলেন। তখন তিনি তাহাঁর হাতে পতাকা দিলেন। এবারো মারহাব বেরিয়ে এলো এবং কবিতা আওড়াতে লাগল-
“খাইবার জানে যে, আমি মারহাব, যুদ্ধের অস্ত্রে সজ্জিত এক অভিজ্ঞতাপূর্ণ বীর বাহাদুর ব্যক্তি।“
তখন আলী [রাদি.] বলিলেন-
“আমি সে ব্যক্তি যাকে আমার মা হায়দার নামে ডাকে,
যার দর্শন বন্য সিংহের মত ভীতিপ্রদ, আমি দুশমনের প্রতিদান দেই বিরাট পরিমাণের পাত্র দিয়ে অর্থাৎ- তাদের নির্দ্বিধায় হত্যা করি”।
এরপর তিনি মারহাবের মাথায় তলোয়ার মারলেন এবং তাকে হত্যা করিলেন। তারপর তাহাঁরই হাতে [খাইবার] বিজয় হলো।
[ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৫২৭, ইসলামিক সেন্টার- ৪৫২৯]
৪৫৭১. ইকরামাহ ইবনি আম্মার [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
ইকরামাহ ইবনি আম্মার [রাদি.] -এর সূত্রেও এ হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
[ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৫২৭, ইসলামিক সেন্টার- ৪৫৩০]
৪৫৭২. ইকরামাহ ইবনি আম্মার [রাদি.] হইতে বর্ণীতঃ
ইকরামাহ ইবনি আম্মার [রাদি.] -এর সূত্রে এ হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
[ই.ফা ৪৫২৮, ইসলামিক সেন্টার- ৪৫৩০]
Leave a Reply