ঈসা ইবনি মারইয়াম এর অবতরণ ও যখন ঈমান কবূল হবে না
প্রশাসক হিসেবে ঈসা ইবনি মারইয়াম [আ:]-এর অবতরণ >> সহীহ মুসলিম শরীফ এর মুল সুচিপত্র দেখুন >> নিম্নে মুসলিম শরীফ এর একটি অধ্যায়ের হাদিস পড়ুন
৬৯. অধ্যায়ঃ সুস্পষ্ট প্রমাণের দ্বারা হৃদয়ের প্রশান্তি বৃদ্ধি পায়
৭০. অধ্যায়ঃ সকল মানুষের জন্য আমাদের নবি মুহাম্মাদ [সাঃআ:] প্রেরিত হয়েছেন এবং অন্যান্য সকল দ্বীন ও ধর্ম তাহাঁর দ্বীনের মাধ্যমে রহিত হয়ে গেছে এ কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন ওয়াজিব
৭১. অধ্যায়ঃ আমাদের নবি [সাঃআ:]-এর শারীআত অনুসারী প্রশাসক হিসেবে ঈসা ইবনি মারইয়াম [আ:]-এর অবতরণ
৭২. অধ্যায়ঃ যে সময়ে ঈমান কবূল হইবে না
৭৩. অধ্যায়ঃ রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:]-এর প্রতি ওয়াহী এর সূচনা
৬৯. অধ্যায়ঃ সুস্পষ্ট প্রমাণের দ্বারা হৃদয়ের প্রশান্তি বৃদ্ধি পায়
২৭৬. আবু হুরাইরাহ [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] বলেছেনঃ ইবরাহীম [আ:]-এর তুলনায় আমাদের মনে অধিক সন্দেহ জাগতে পারে। {৫৮} তিনি বলেছিলেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! কিভাবে আপনি মৃতকে জীবিত করেন, আমাকে দেখান। আল্লাহ বললেনঃ “তবে কি তুমি বিশ্বাস কর না? তিনি উত্তরে বলিলেন, কেন করব না? তবে এটা কেবল আমার চিত্তের প্রশান্তির জন্য”-[সূরাহ আল বাকারাহ্ ২ : ২৬০]। আল্লাহ তাআলা লূত [আ:]-এর উপর রহমাত বর্ষণ করুন, তিনি কোন শক্তিশালী জনগোষ্ঠীর আশ্রয় গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। {৫৯} ইউসুফের দীর্ঘ কারাবরণের ন্যায় আমাকেও যদি কারাগারে অবস্থান করিতে হত, তবে আমি রাজদূতের আহ্বানে সাড়া দিতাম। {৬০}
[ই.ফা. ২৮০; ই.সে. ২৯০]
{৫৮} “ইবরাহীম [আ:]-এর তুলনায় আমাদের মনে অধিক সন্দেহ জাগতে পারে”- এর অর্থ নিয়ে উলামাদের মাঝে মত বিরোধ রয়েছে। রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:]-এর এই উক্তির অর্থ এই যে, ইবরাহীম [আ:]-এর “পুনরুত্থানের” প্রতি সন্দেহ হওয়া অসম্ভব ছিল। যদি তাহাঁর নবি ও খলীলুল্লাহ হওয়া সত্ত্বেও সন্দেহ হয়, তা হলে অন্যান্য নবিদেরও সন্দেহ হত। আমার অবস্থা তোমরা জান যে, আমার কোন সন্দেহ নেই। অতএব, ইবরাহীম [আ:]-এরও সন্দেহ ছিল না।
রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] উপরোক্ত উক্তি এই জন্য করেছিলেন যে, যখন এ আয়াত অবতীর্ণ হলো, “হে আল্লাহ কিভাবে আপনি মৃতকে জীবিত করেন আমাকে দেখান” তখন কিছু লোক ইবরাহীম [আ:]-এর উপর ভুল সন্দেহ করিল। আল্লাহর রসূল [সাঃআ:] তাহাদের এ সন্দেহ দুর করার জন্য এ হাদীসটি বর্ণনা করেন।
{৫৯} আল্লাহর রসূল [সাঃআ:] বলেন, আল্লাহ লূত [আ:]-এর উপর রহমাত বর্ষণ করুন। তিনি শক্তিশালী জনগোষ্ঠীর আশ্রয় গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। সুন্দর যুবকের অবয়বে আগত মেহমানদের [ফেরেশতা] সম্ভ্রম রক্ষার বেলায় তিনি মেহমানকে খুশি করার জন্য এ উক্তি করেছিলেন। তবে তিনি আল্লাহর সাহায্য থেকে গাফিল ছিলেন এমনটি নয়।
{৬০} আল্লাহর রসূল [সাঃআ:] বলিলেন, “আমি রাজদূতের আহ্বানে সাড়া দিতাম” এখানে তিনি ইউসুফ [আ:]-এর মর্যাদা বর্ণনা করিয়াছেন যে, তাহাঁর কত ধৈর্য্ ছিল যা অন্যের মধ্যে পাওয়া খুব মুশকিল ব্যাপার। কেননা, দীর্ঘ কারাভোগ করেও বাদশার স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য রাজদূতের আহ্বানে সাড়া দিলেন না। অর্থাৎ যুলাইখার মিথ্যা অপবাদের সঠিক তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত বের হলেন না। তদন্তের পর যুলাইখার মিথ্যা অপবাদ সাব্যস্ত হলে তিনি জেলখানা হতে বের হয়ে আসেন ও বাদশাহ্র স্বপ্নের তাবীর করেন। [সংক্ষিপ্ত নাবাবী]
২৭৭. সাঈদ ইবনি মুসাইয়্যাব ও আবু উবায়দ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] উভয়ে আবু হুরাইরাহ [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] হতে উপরের হাদীসের অবিকল বর্ণনা করিয়াছেন। যেরূপ বর্ণনা করিয়াছেন ইউনুস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] যুহরী [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] হতে। তবে মালিক [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তাহাঁর হাদীসে কথাটির পর উল্লেখ করেন যে, “বরং আমার অন্তরের প্রশান্তির জন্যে”। এরপর রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] আয়াতটি শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত করেন।
আব্দ ইবনি হুমায়দ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ….. যুহরী [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] থেকে মালিক-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসের অনুরূপ বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলেন, এরপর রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] আয়াতটি শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত করেন।
[ই.ফা. ২৮০, ২৮১; ই.সে. ২৯১, ২৯২]
৭০. অধ্যায়ঃ সকল মানুষের জন্য আমাদের নবি মুহাম্মাদ [সাঃআ:] প্রেরিত হয়েছেন এবং অন্যান্য সকল দ্বীন ও ধর্ম তাহাঁর দ্বীনের মাধ্যমে রহিত হয়ে গেছে এ কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন ওয়াজিব
২৭৮. আবু হুরাইরাহ [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] বলেন, প্রত্যেক নবিকে সে পরিমাণ মুজিযা দেয়া হয়েছে, যে পরিমাণ মুজিযার প্রতি মানুষ ঈমান এনেছে। পক্ষান্তরে আমাকে যে মুজিযা প্রদান করা হয়েছে, তা হচ্ছে আল্লাহ প্রেরিত ওয়াহী। {৬১} সুতরাং কিয়ামাতের দিন আমার অনুসারীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী হইবে বলে আশা রাখি।
[ই.ফা. ২৮২; ই.সে. ২৯৩]
{৬১} কুরআন [ওয়াহী] এমন মুজিযা যাতে যাদুটোনা ইত্যাদির সন্দেহ নেই। পক্ষান্তরে অন্যান্য মুজিযার মধ্যে সন্দেহের অবকাশ আছে। এজন্য আমার অনুসারী বেশী হইবে। অথবা অন্যান্য নবিগণের মুজিযা অতীত হয়ে গেছে, তাহাদের যুগ অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে। পক্ষান্তরে আমার মুজিযা আল কুরআন কিয়ামাত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকিবে। অতএব আমার অনুসারী বেশি হইবে। [সংক্ষিপ্ত নাবাবী]
২৭৯. আবু হুরাইরাহ [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] বলেন, সে সত্তার কসম, যাঁহার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! ইয়াহুদী হোক আর খৃস্টান হোক, যে ব্যক্তিই আমার এ রিসালাতের খবর শুনেছে অথচ আমার রিসালাতের উপর ঈমান না এনে মৃত্যুবরণ করিবে, অবশ্যই সে জাহান্নামী হইবে।
[ই.ফা. ২৮৩; ই.সে. ২৯৪]
২৮০. সালিহ্ আল হামদানী [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] হইতে বর্ণিতঃ
ইমাম শাবীর নিকট এসে জনৈক খুরাসানী ব্যক্তিকে প্রশ্ন করিতে দেখলাম। সে বলিল, হে আবু আমর! আমাদের অঞ্চলে কতিপয় খুরাসানীর মতামত হলো, যে ব্যক্তি নিজের দাসীকে আযাদ করে দিয়ে তাকে বিয়ে করিল সে যেন নিজে কুরবানীর উটের উপর সওয়ার হলো [অর্থাৎ তা নিন্দনীয় কাজ মনে করে।] শাবী উত্তরে বলিলেন, আমাকে আবু বুরদাহ [রাঃআ:] তাহাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেন যে, রসুলুল্লাহ বলেনঃ তিন ধরণের লোককে দ্বিগুণ সাওয়াব দান করা হইবে। [তারা হলো] [১] যে আহলে কিতাব তার নবির প্রতি ঈমান এনেছে এবং পরে আমার প্রতি ঈমান এনেছে এবং সত্য বলে মেনে নিয়েছে এবং আমার অনুসরণ করেছে সে দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে। [২] যে দাস আল্লাহ তাআলার হাক্ আদায় করেছে এবং তার মালিকের হাক্ও আদায় করেছে, সেও দ্বিগুণ সাওয়াব লাভ করিবে। [৩] যে ব্যক্তি তার দাসীকে উত্তম খাবার দিয়েছে, উত্তমরূপে আদব-কায়দা শিখিয়েছে, তারপর তাকে আযাদ করে বিয়ে করেছে; সেও দ্বিগুণ সাওয়াবের অধিকারী হইবে। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর শাবী উক্ত খোরাসানীকে বলিলেন, কোন বিনিময় ছাড়াই তুমি এ হাদীস নিয়ে যাও। অথচ এর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হাদীসের জন্যও এক সময় মাদীনাহ্ পর্যন্ত লোকেরা সফর করত।
আবু বাক্র ইবনি আবু শাইবাহ্ ও ইবনি আবু উমার ও উবাইদুল্লাহ ইবনি মুআয [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] … সালিহ্ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] থেকে পূর্বোল্লিখিত সানাদে অনুরূপ বর্ণনা করিয়াছেন।
[ই.ফা. ২৮৪, ২৮৫;; ই.সে. ২৯৫, ২৯৬]
৭১. অধ্যায়ঃ আমাদের নবি [সাঃআ:]-এর শারীআত অনুসারী প্রশাসক হিসেবে ঈসা ইবনি মারইয়াম [আ:]-এর অবতরণ
২৮১. আবু হুরাইরাহ [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] বলেনঃ সে সত্তার শপথ, যাঁহার হাতে আমার প্রাণ। শীঘ্রই তোমাদের মাঝে ঈসা ইবনি মারইয়াম [আ:]-কে একজন ন্যায়পরায়ণ প্রশাসক হিসেবে অবতীর্ণ করা হইবে। {৬২} তখন তিনি ক্রুশ [চিহ্ন] ধ্বংস করবেন, শুকর হত্যা করবেন, জিয্য়াহ্ কর রহিত করবেন। {৬৩} তখন সম্পদ এত বেশী হইবে যে তা গ্রহণ করার কেউ থাকিবে না।
আবদুল আলা ইবনি হাম্মাদ, আবু বাক্র ইবনি আবু শাইবাহ্, যুহায়র ইবনি হার্ব, হারমালাহ্ ইবনি ইয়াহ্ইয়া, হাসান আল হুলওয়ানী ও আব্দ ইবনি হুমায়দ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ….. যুহরী [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] থেকে পূর্ব বর্ণিত সানাদের অনুরূপ বর্ণনা করিয়াছেন। [তবে প্রত্যেক রিওয়ায়াতে কিছু ব্যবধান যেমন] ইবনি উয়াইনাহ্ তার রিওয়ায়াতে [আরবী] কথাটির উল্লেখ করেন। ইউনুস তাহাঁর রিওয়ায়াতে [আরবী] এর উল্লেখ করিয়াছেন [আরবী] উল্লেখ করেননি। সালিহ তাহাঁর রিওয়ায়াতে লায়স বর্ণিত হাদীসের অনুরূপ [আরবী] বর্ণনা করিয়াছেন। তাহাঁর বর্ণনায় আরও রয়েছে, সে সময় এক একটি সাজদাহ পৃথিবী ও পৃথিবীর সমুদয় সম্পদ অপেক্ষা অধিক শ্রেয় বলে বিবেচিত হইবে। তারপর আবু হুরাইরা [রাঃআ:] বলেনঃ ইচ্ছা করলে তোমরা এ আয়াতটি পড়তে পার :
وَإِنْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ إِلاَّ لَيُؤْمِنَنَّ بِهِ قَبْلَ مَوْتِهِ
“কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তার মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে {ঈসা [আ.-কে]} বিশ্বাস করিবেই এবং কিয়ামাতের দিন তিনি তাহাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবেন”-[সূরাহ আন্ নিসা ৪ : ১৫৯]।
[ই.ফা. ২৮৬, ২৮৭; ই.সে. ২৯৭, ২৯৮]
{৬২} ইমাম নাবাবী [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বলেন, ঈসা [আ:]-কে শেষ যুগে ন্যায়পরায়ন প্রশাসক হিসেবে অবতীর্ণ করা হইবে। তখন তিনি ক্রুশ চিহ্ন ধ্বংস করবেন, খৃস্টানেরা যার সম্মান করে থাকে। এটা থেকে প্রমাণিত হয় যে, সমস্ত বর্জনীয় জিনিস যেমন : বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, অবৈধ খেলাধূলার যন্ত্রপাতি, মূর্তি, ছবি ইত্যাদি সব ভেঙ্গে ফেলা উচিত। শুকর হত্যাও এর মধ্যে শামিল। কুরআন মাজীদে মহান আল্লাহ-এর গোশ্তকে হারাম বলে ঘোষণা করিয়াছেন। কারণ এর গোশ্ত মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আল্লামা কারযাভী [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বলেন শুকরের অতি লোভনীয় খাদ্য সব রকমের পায়খানা ও ময়লা আবর্জনা। আধুনিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তা খাওয়া বিশেষ করে গ্রীষ্ম প্রধান দেশে খুবই ক্ষতিকর। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা থেকেও প্রমাণিত হয়েছে যে, শুকরের গোশ্ত আহার করা হলে দেহে এমন এক প্রাকরের পোকার সৃষ্টি হয় যা স্বাস্থ্যকে কুরে কুরে খায়। [অনুবাদক-ইসলামের হালাল হারামের বিধান, পৃষ্ঠা ৬৭]
{৬৩} জিযয়াহ্ রহিত করা তো মুহাম্মাদী শারীআতের পরিপন্থী। এর সঠিক উত্তর এই যে, এ নির্দেশ শারীআতে মুহাম্মাদীর পরিপন্থী নয়। এজন্য যে, জিয্য়াহ্ বা কর গ্রহণ করার হুকুম ঈসা [আ:] আসার পূর্ব পর্যন্ত থাকিবে। যখন ঈসা [আ:] এসে যাবেন তখন জিয্য়াহ্ রহিত হয়ে যাবে। যা হাদীসে প্রকাশ্যে বলা হয়েছে। আর সম্পদ বেশি হওয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ আদল ও ইনসাফের কারণে খুব বারাকাত হইবে ও মাল বেশি হইবে। ভূগর্ভের খনিজ সম্পদ উত্তোলন করা হইবে। অন্য হাদীসে এসেছে : কিয়ামাত নিকটবর্তী হওয়ার কারণে অর্থ-সম্পদের দিকে মানুষের লোভ-লালসা থাকিবে না। কাজেই কেউ মাল দিতে চাইলে তা গ্রহণ করিতে রাজি হইবে না। [সংক্ষিপ্ত নাবাবী]
২৮২. আবু হুরাইরাহ [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] বলেন, আল্লাহর কসম! ঈসা ইবনি মারইয়াম [আ:] অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ প্রশাসকরূপে আসবেন এবং ক্রুশ চূর্ণ করবেন, শুকর হত্যা করবেন, জিয্য়াহ তথা কর রহিত করবেন। মোটা তাজা উটগুলো বন্ধনমুক্ত করে দেয়া হইবে কিন্তু তা নেয়ার জন্য কেউ চেষ্ট করিবে না। পরস্পর শত্রুতা, হিংসা-বিদ্বেষ থাকিবে না এবং সম্পদ গ্রহণের জন্য মানুষকে ডাকা হইবে কিন্তু তা কেউ গ্রহণ করিবে না।
[ই.ফা. ২৮৮; ই.সে. ২৯৯]
২৮৩. আবু হুরাইরাহ [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] বলেনঃ তোমাদের জীবন কতই না ধন্য হইবে, যখন ঈসা ইবনি মারইয়াম [আ:] তোমাদের মাঝে অবতরণ করবেন এবং তোমাদেরই একজন তোমাদের ইমাম হইবেন।
[ই.ফা. ২৮৯; ই.সে. ৩০০]
২৮৪. আবু হুরাইরাহ [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] বলেন, তোমাদের জীবন কতই না ধন্য হইবে, যে সময়ে ঈসা ইবনি মারইয়াম [আ:]-কে তোমাদের মাঝে পাঠানো হইবে আর তিনি তোমাদের নেতৃত্ব দিবেন।
[ই.ফা. ২৯০; ই.সে. ৩০১]
২৮৫. আবু হুরাইরাহ [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] বলেন, তোমরা কতই না ধন্য হইবে, যে সময় ঈসা ইবনি মারইয়াম [আ:] আসবেন এবং তোমাদেরই একজন তোমাদের নেতৃত্ব প্রদান করবেন। {৬৪} ওয়ালীদ ইবনি মুসলিম বলেন, আমি ইবনি আবু যিবকে জিজ্ঞেস করলাম, আওযাঈ আমাদেরকে যুহরীর সূত্রে, তিনি নাফি হতে, তিনি আবু হুরাইরা [রাঃআ:] হতে বর্ণনা করিয়াছেন : [আরবী] “আর তোমাদের থেকেই তোমাদের ইমাম হইবে” কথাটির মর্ম জান কি? আমি বললাম, বলুন। তিনি বলিলেন অর্থাৎ তোমাদের প্রতিপালক প্রেরিত কিতাব ও তোমাদের নবি [সাঃআ:]-এর অনুসৃত আদর্শের অবলম্বনে তিনি তোমাদের নেতৃত্ব প্রদান করবেন।
[ই.ফা. ২৯১; ই.সে. ৩০২]
{৬৪} অর্থাৎ ঈসা [আ:] শারীআতে মুহাম্মাদীর অনুসারী হইবেন। ঈসা [আ:] যদিও নবি ছিলেন, কিন্তু তাহাঁর নুবূওয়াতী যুগ প্রথম দুনিয়া এসে নবি হিসেবে প্রকাশ পাওয়ার পর শেষ হয়ে গেছে। কিয়ামাতের পূর্বে যখন তিনি আসবেন, আমাদের নবির উম্মাত হিসেবে এসে কুরআন ও হাদীসের প্রতি আমাল করবেন। [সংক্ষিপ্ত নাবাবী]
২৮৬. জাবির ইবনি আবদুল্লাহ [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
আমি নবি [সাঃআ:]-কে বলিতে শুনিয়াছি, কিয়ামাত পর্যন্ত আমার উম্মাতের একদল সত্য দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে বাতিলের বিরুদ্ধে লড়তে থাকিবে এবং অবশেষে ঈসা [আ:] অবতরণ করবেন। মুসলিমদের আমীর বলবেন, আসুন সালাতে আমাদের ইমামাতি করুন। তিনি বলবেন না, আপনাদেরই একজন অন্যদের জন্য ইমাম নিযুক্ত হইবে। এ হলো আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত এ উম্মাতের সম্মান।
[ই.ফা. ২৯২; ই.সে. ৩০৩]
৭২. অধ্যায়ঃ যে সময়ে ঈমান কবূল হইবে না
২৮৭. আবু হুরাইরাহ্ [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] বলেনঃ পশ্চিম দিকে সূর্যোদয়ের পূর্বে কিয়ামাত সংঘটিত হইবে না, আর যখন পশ্চিমাকাশে সূর্য উঠবে তখন সকল মানুষ একত্রে ঈমান আনবে। কিন্তু যে ইতঃপূর্বে ঈমান আনেনি অথবা যে ঈমান অনুযায়ী নেক কাজ করেনি সে সময়ে ঈমান আনায় তার কোন কল্যাণ সাধিত হইবে না।
আবু বাক্র ইবনি শাইবাহ্, ইবনি নুমায়র, আবু কুরায়ব, যুহায়র ইবনি হার্ব ও মুহাম্মাদ ইবনি রাফি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ….. আবু হুরাইরা [রাঃআ:] নবি [সাঃআ:]-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসের অবিকল বর্ণনা করিয়াছেন।
[ই.ফা. ২৯৩, ২৯৪; ই.সে. ৩০৪, ৩০৫]
২৮৮. আবু হুরাইরাহ্ [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
নবি [সাঃআ:] বলেনঃ এ তিনটি বিষয় প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে যারা ঈমান আনেনি বা ঈমান অনুযায়ী নেক কাজ করেনি, এগুলো প্রকাশ পাওয়ার পর তাহাদের ঈমানে কোন উপকার হইবে না। [১] পশ্চিমাকাশ থেকে সূর্যোদয়, [২] দাজ্জাল [এর আবির্ভাব] ও [৩] দাব্বাতুল আর্য [ভূখণ্ড হতে এক প্রকার প্রাণীর আবির্ভাব]। {৬৫}
[ই.ফা. ২৯৫; ই.সে. ৩০৬]
{৬৫} দাব্বাতুল আর্য মাটি হতে একটি প্রাণী বের হইবে। মানুষের সাথে কথা বলবে এবং মুমিন ও কাফিরদের মধ্যে পার্থক্য করে দিবে। [নাবাবী]
২৮৯. আবু যার [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
একদিন নবি [সাঃআ:] বলেন, তোমরা কি জান, এ সূর্য কোথায় যায়? সহাবাগণ বলিলেন, আল্লাহ ও তাহাঁর রসূলই ভাল জানেন। তিনি বলিলেন, এ সূর্য চলতে থাকে এবং [আল্লাহ তাআলার] আর্শের নীচে অবস্থিত তার অবস্থান স্থলে যায়। সেখানে সে সাজদাবনত হয়ে পড়ে থাকে। শেষে যখন তাকে বলা হয়, উঠ এবং যেখান থেকে এসেছিলে সেখানে ফিরে যাও! অনন্তর সে ফিরে আসে এবং নির্ধারিত উদয়স্থল দিয়েই উদিত হয়। তা আবার চলতে থাকে এবং আর্শের নীচে অবস্থিত তার অবস্থান স্থলে যায়। সেখানে সে সাজদাবনত অবস্থায় পড়ে থাকে। শেষে যখন তাকে বলা হয় উঠ এবং যেখান থেকে এসেছিলে সেখানে ফিরে যাও। তখন সে ফিরে আসে এবং নির্ধারিত উদয়স্থল হয়েই সে উদিত হয়। এমনিভাবে চলতে থাকিবে; মানুষ তার থেকে অস্বাভাবিক কিছু হতে দেখবে না। শেষে একদিন সূর্য যথারীতি আর্শের নীচে তার অবস্থানে যাবে। তাকে বলা হইবে, উঠ এবং অস্তাচল থেকে উদিত হও। অনন্তর সেদিন সূর্য পশ্চিমাকাশে উদিত হইবে। রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] বলেন, [কুরআনের বাণী] “কোন দিন সে অবস্থা হইবে তোমরা জান? সেদিন ঐ ব্যক্তির ঈমান কোন কাজে আসবে না, যে ব্যক্তি পূর্বে ঈমান আনেনি কিংবা যে ব্যক্তি ঈমানের মাধ্যমে কল্যাণ অর্জন করেনি”-[সূরাহ আল-আনআম ৬ : ১৫৮]। {৬৬}
[ই.ফা. ২৯৬; ই.সে. ৩০৭] arbi
{৬৬} প্রত্যহ সূর্যের আর্শের নীচে যাওয়া এবং সাজদায় পড়ে থাকার প্রকৃত তাৎপর্য আল্লাহ ও তাহাঁর রসূলই ভাল জানেন। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোকে ইহা আমাদের জ্ঞানের অগম্য মনে হলেও ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান হয়ত এর তাৎপর্য বুঝতে সক্ষম হইবে। সাজদার দ্বারা আমরা যদি আনুগত্য অর্থ গ্রহণ করি তবে বলা যায় চন্দ্র-সূর্যসহ সৃষ্টির সব কিছুই আল্লাহ তাআলার নির্দেশ মেনে চলে। সূর্যও তার নির্দিষ্ট কার্যক্রমে সর্বক্ষণ আল্লাহর নির্দেশ প্রার্থনা করে। [নাবাবী]
২৯০. আবু যার [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
নবি [সাঃআ:] একদা আমাদেরকে লক্ষ্য করে বলিলেন, তোমরা কি জান এ সূর্য কোথায় গমন করে? ….. এরপর রাবী ইবনি উলাইয়্যাহ্ বর্ণিত হাদীসের অনুরূপ বর্ণনা করেন।
[ই.ফা. ২৯৭; ই.সে. ৩০৮]
২৯১. আবু যার [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
একদা আমি মাসজিদে নাবাবীতে প্রবেশ করলাম। রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] তথায় উপবিষ্ট ছিলেন। সূর্য ঢলে পড়লে তিনি [সাঃআ:] বলিলেন, হে আবু যার! জান এ সূর্য কোথায় যায়? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাহাঁর রসূলই ভাল জানেন। রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] বলিলেন, সে তার গন্তব্যে যায় এবং আল্লাহর নিকট সাজদার অনুমতি চায়। তখন তাকে অনুমতি দেয়া হয়। পরে একদিন যখন তাকে বলা হইবে যেদিক থেকে এসেছো সেদিকে ফিরে যাও। তখন সে পশ্চিম দিক থেকে উঠবে।
এরপর তিনি আবদুল্লাহ ইবনি মাসউদের কিরাআত অনুসারে তিলাওয়াত করেঃ এ তার গন্তব্যস্থল।
[ই.ফা. ২৯৮; ই.সে. ৩০৯]
২৯২. আবু যার [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
আমি রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:]-কে
وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا
“এবং সূর্য ভ্রমণ করে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে”-[সূরাহ ইয়া-সীন ৩৬ : ৩৮]। এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বললেনঃ আর্শের নীচে হলো তার গন্তব্যস্থল।
[ই.ফা. ২৯৯; ই.সে. ৩১০]
৭৩. অধ্যায়ঃ রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:]-এর প্রতি ওয়াহী এর সূচনা
২৯৩. আয়িশাহ্ [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:]-এর নিকট ওয়াহীর সূচনা হয়েছিল সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। আর তিনি যে স্বপ্নই দেখিতেন তা সকালের সূর্যের মতই সুস্পষ্টরূপে সত্যে পরিণত হত। অতঃপর তাহাঁর কাছে একাকী থাকা প্রিয় হয়ে পড়ে এবং তারপর তিনি হেরা গুহায় নির্জনে কাটাতে থাকেন। আপন পরিবারের কাছে ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত সেখানে তিনি একাধারে বেশ কয়েক রাত ইবাদাতে মগ্ন থাকতেন এবং এর জন্য কিছু খাদ্য সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তারপর তিনি খাদীজার কাছে ফিরে যেতেন এবং আরো কয়েক দিনের জন্য অনুরূপভাবে খাদ্য সামগ্রী নিয়ে আসতেন। তিনি হেরা গুহায় যখন ধ্যানে রত ছিলেন, তখন তাহাঁর নিকট ফেরেশ্তা আসলেন, এরপর বলিলেন, পড়ুন! তিনি [সাঃআ:] বলিলেন, আমি তো পড়তে জানি না। রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] বলেন, তখন ফেরেশ্তা আমাকে জড়িয়ে ধরে এমন চাপ দিলেন যে, আমার খুবই কষ্ট হলো। তারপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলিলেন, পড়ুন! আমি বললাম, আমি তো পড়তে সক্ষম নই। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং দ্বিতীয়বারও এমন জোরে চাপ দিলেন যে, আমার খুবই কষ্ট হলো। পরে ছেড়ে দিয়ে বলিলেন, পড়ুন! আমি বললাম, আমি তো পড়তে সক্ষম নই। এরপর আবার আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং তৃতীয়বারও এমন জোরে চাপ দিলেন যে আমার খুবই কষ্ট হলো। এরপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলিলেন,
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ * خَلَقَ الإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ * اقْرَأْ وَرَبُّكَ الأَكْرَمُ * الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ * عَلَّمَ الإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ
“পাঠ করুন! আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করিয়াছেন; সৃষ্টি করিয়াছেন মানুষকে আলাক্ হতে। পাঠ করুন! আর আপনার প্রতিপালক মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না” – [সূরাহ আলাক্ ৯৬ : ১-৫]। এরপর রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] এ ওয়াহী নিয়ে ফিরে এলেন। তাহাঁর স্কন্ধের পেশীগুলো কাঁপছিল। খাদীজাহ্ [রাঃআ:]-এর নিকট এসে বলিলেন, তোমরা আমাকে চাদর দ্বারা ঢেকে দাও, তোমরা আমাকে চাদর দ্বারা ঢেকে দাও। তাঁরা রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] কে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। অবশেষে তাহাঁর ভীতি দূর হলো। এরপর খাদীজাহ [রাঃআ:]-কে সকল ঘটনা উল্লেখ করে বলিলেন, খাদীজাহ্ আমার কি হলো? আমি আমার নিজের উপর আশঙ্কা করছি। খাদীজাহ্ [রাঃআ:] বললেনঃ না, কখনো তা হইবে না। বরং সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহর কসম! তিনি কখনো আপনাকে অপমানিত করবেন না। আল্লাহর কসম! আপনি স্বজনদের খোঁজ-খবর রাখেন, সত্য কথা বলেন, দুঃখীদের দুঃখ নিবারণ করেন, দরিদ্রদের বাঁচার ব্যবস্থা করেন, অতিথি সেবা করেন এবং প্রকৃত দুর্দশাগ্রস্তদের সাহায্য করেন। এরপর খাদীজাহ [রাঃআ:] রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:]-কে ওয়ারাকাহ্ ইবনি নাওফাল ইবনি আসাদ ইবনি আবদুল উয্যা এর নিকট নিয়ে আসেন। ওয়ারাকাহ্ ছিলেন খাদীজাহ্ [রাঃআ:]-এর চাচাত ভাই; ইনি জাহিলিয়্যাতের যুগে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আরবী লিখতে জানতেন এবং ইন্জীল কিতাবের আরবী অনুবাদ করিতেন। তিনি ছিলেন বৃদ্ধ এবং তিনি দৃষ্টিশক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন। খাদীজাহ্ [রাঃআ:] তাঁকে বললেনঃ চাচা, [সম্মানার্থে চাচা বলে সম্বোধন করেছিলেন। অন্য রিওয়ায়াতে “হে চাচাত ভাই” এ কথা উল্লেখ রয়েছে] আপনার ভাতিজা কি বলছে শুনুন তো! ওয়ারাকাহ্ ইবনি নাওফাল বলিলেন, হে ভাতিজা! কি দেখেছিলেন? রসূল [সাঃআ:] যা দেখেছিলেন সব কিছু বিবৃত করিলেন। ওয়ারাকাহ্ বলিলেন, এ তো সে সংবাদবাহক যাকে আল্লাহ মূসা [আ:]-এর নিকট প্রেরণ করেছিলেন। হায়! আমি যদি সে সময় যুবক থাকতাম, হায়! আমি যদি সে সময় জীবিত থাকতাম, যখন আপনার জাতিগোষ্ঠী আপনাকে দেশ থেকে বের করে দিবে। রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] বললেনঃ সত্যি কি আমাকে তারা বের করে দিবে? ওয়ারাকাহ্ বলিলেন, হ্যাঁ। যে ব্যক্তিই আপনার মত কিছু [নুবূওয়াত ও রিসালাত] নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেছে, তাহাঁর সঙ্গেই এরূপ দুশমনী করা হয়েছে। আর আমি যদি আপনার সে যুগ পাই তবে অবশ্যই আপনাকে পূর্ণ সহযোগিতা করব। {৬৭}
[ই.ফা. ৩০০; ই.সে. ৩১১]
{৬৭} নবি [সাঃআ:]-এর নিকট ওয়াহীর সূচনা হয়েছিল সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। তাহাঁর স্বপ্ন সূর্যের মতই স্পষ্টরূপে সত্যে পরিণত হত।
ইমাম নাবাবী [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বলেন, আলিমদের মত যে, নুবূওয়াতের পূর্বে এ অবস্থা ছয় মাস ছিল। তারপর জিবরীল [আ:] ওয়াহী নিয়ে আসেন। সম্ভবতঃ এ প্রক্রিয়াই ওয়াহীর সূচনা এভাবে করা হয়েছে এজন্য যে, প্রথম হতেই জিবরীল [আ:] ওয়াহী নিয়ে আসলে, তিনি হতবুদ্ধি বা কর্তব্য বিমূঢ় হয়ে যেতেন। মানুষ হিসেবে হঠাৎ করে নুবূওয়াতের বোঝা উঠাতে সক্ষম হতেন না। ওয়াহীর বিস্তারিত বর্ণনা আয়িশাহ্ সিদ্দীকাহ্ [রাঃআ:]-এর মুরসাল হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
তারপর আল্লাহ তাআলা সূরাহ আল মুদ্দাস্সিরের প্রথম কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ করেন। এরপর হতেই ঘন ঘন ওয়াহী নাযিল হতে থাকে।
ইমাম নাবাবী [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বলেনঃ কেউ কেউ বলেছেন যে, সূরাহ আল মুদ্দাস্সির সর্বপ্রথম নাযিল হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলেন যে, সূরাহ ফা-তিহাহ্ সর্বপ্রথম নাযিল হয়েছিল। এসব কথার কোন ভিত্তি নেই।
ওয়াহী স্থগিত থাকার কারণ কি? ইবনি হাজার [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ফাতহুল বারীর ১ম খণ্ডের ২৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, নবি [সাঃআ:] ভয় পেয়েছিলেন। সে ভয় যেন কেটে যায় এবং পুনরায় ওয়াহী প্রাপ্তির আগ্রহ এবং প্রতিক্ষা যেন তাহাঁর মনে জাগ্রত হয়। [আর রাহীকুল মাখতুম, অনুবাদ-খাদীজা আখতার রেজায়ী ৯৩-৯৪ পৃষ্ঠা]
২৯৪. আয়িশাহ্ [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, প্রথম অবস্থায় রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:]-এর নিকট যে ওয়াহীর সূচনা হয় ….. । অতঃপর হাদীসের অবশিষ্টাংশ ইউনুসের বর্ণিত হাদীসের অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। তবে এখানে কিছুটা শব্দগত পার্থক্য রয়েছে। যেমন-খাদীজাহ্ [রাঃআ:] বলেন, আল্লাহর শপথ! আল্লাহ আপনাকে কখনো দুশ্চিন্তায় নিক্ষেপ করবেন না। খাদীজহ্ [রাঃআ:] ওয়ারাকাকে সম্বোধন করে বলিলেন, হে আমার চাচাতো ভাই! আপনার ভাতিজা কি বলে তা শুনেন।
[ই.ফা. ৩০১; ই.সে. ৩১২]
২৯৫. নবি [সাঃআ:]-এর স্ত্রী আয়িশাহ্ [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
অতঃপর নবি [সাঃআ:] হেরা গুহা থেকে এমন অবস্থায় খাদিজাহ্ [রাঃআ:]-এর নিকট [বাড়ি] ফিরলেন যে, ভয়ে তাহাঁর অন্তর কাঁপছিল। এরপর হাদীসের অবশিষ্ট ঘটনা ইউনুস ও মামারের হাদীসের অনুরূপ বর্ণনা করেন। কিন্তু তাহাদের উভয়ের বর্ণিত হাদীসের প্রথম অংশে আয়িশা [রাঃআ:]-এর বক্তব্য “রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:]-এর কাছে ওয়াহী আসার প্রথম অবস্থা ছিল সত্য-স্বপ্ন”-এ বাক্যটির উল্লেখ নেই। তবে মামার “আল্লাহর শপথ! আল্লাহ কখনো আপনাকে অপমান করবেন না”-এ বাক্য বর্ণনায় ইউনুসের অনুসরণ করিয়াছেন এবং এ কথাও বর্ণনা করিয়াছেন যে, “খাদীজাহ্ ওয়ারাকাকে বলিলেন, হে আমার চাচাত ভাই! আপনার ভাতিজা কি বলেন, তা শুনেন।”
[ই.ফা. ৩০২; ই.সে. ৩১৩]
২৯৬. জাবির ইবনি আবদুল্লাহ আল আনসারী [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:]-এর সহাবাগণ ওয়াহীর বিরতি প্রসঙ্গে পরস্পর কথাবার্তা বলছিলেন। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] ওয়াহীর বিরতি বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন যে, আমি পথ চলছিলাম সে মুহূর্তে আকাশ হতে একটি শব্দ শুনে মাথা তুলে তাকালাম, দেখি সে হিরা গুহায় যে ফেরেশতা আমার কাছে এসেছিলেন সে ফেরেশতা জমিন ও আসমানের মধ্যস্থলে কুরসীর উপর বসে আছেন। রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] বলেন, এ দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আর দ্রুত বাড়ি ফিরে এসে বলিতে লাগলাম, আমাকে কম্বল দ্বারা ঢেকে দাও, আমাকে কম্বল দ্বারা ঢেকে দাও। তারা আমায় কম্বল দ্বারা ঢেকে দিল। এরপর এ আয়াত অবতীর্ণ হলঃ
يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ * قُمْ فَأَنْذِرْ * وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ * وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ * وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ
“অর্থাৎ “হে কম্বল জড়ানো ব্যক্তি! উঠুন, সতর্কবাণী প্রচার করুন। আপনার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন! আপনার পরিচ্ছেদ পবিত্র রাখুন এবং অপবিত্রতা হতে দূরে থাকুন-[সূরাহ আল মুদ্দাস্সির ৭৪ : ১-৫] এখানে অপবিত্রতা বলে প্রতিমাকে বুঝানো হয়েছে। তিনি আরো বলেন, তারপর ধারাবাহিকভাবে ওয়াহী অবতরণ আরম্ভ হয়।
[ই.ফা. ৩০৩; ই.সে. ৩১৪]
২৯৭. জাবির ইবনি আবদুল্লাহ [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:]-কে বলিতে শুনেছেন, অতঃপর আমার কাছে ওয়াহী আসা বন্ধ থাকল, একদিন আমি পথ চলছিলাম। হাদীসের বাকী অংশ ইউনুসের হাদীসের অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। তবে এতে আরো বলেছেনঃ “তাঁকে [জিবরীল] দেখে আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে জমিনে পড়ে গেলাম।” ইবনি শিহাব বলেন, আবু সালামাহ্ বলেছেন, আর্ রুজ্য অর্থ হচ্ছে মূর্তি, প্রতিমা। তিনি আরো বলেন, তারপর ধারাবাহিকভাবে ওয়াহী আসতে লাগলো।
মুহাম্মাদ ইবনি রাফি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ….. যুহরী [রাঃআ:] থেকে ইউনুস [রাঃআ:]-এর বর্ণিত হাদীসের অনুরূপ বর্ণনা করিয়াছেন। তবে বর্ণনাকারী এ হাদীসে উল্লেখ করেন যে, রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] ইরশাদ করিয়াছেন, এরপর আল্লাহ তাআলা এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেনঃ “হে বস্ত্রাচ্ছাদিত! ….. এবং অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকুন”-[সূরাহ আল মুদ্দাস্সির ৭৪ : ১-৫] এ আয়াতটি সলাত ফারয হবার পূর্বেই নাযিল হয়। অর্থ প্রতিমা এবং মামার এ হাদীসে উকায়লের ন্যায় বর্ণনা করেন।
[ই.ফা. ৩০৪, ৩০৫; ই.সে. ৩১৫, ৩১৬] arbi
২৯৮. ইয়াহ্ইয়া [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] হইতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি আবু সালামাহ্কে জিজ্ঞেস করলাম, কুরআনের কোন্ আয়াতটি সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে? তিনি বলিলেন, يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ [সূরাহ আল মুদ্দাস্সির ৭৪ : ১-৫]। আমি বললাম, اقْرَأْ [সূরাহ আল আলাক ৯৬ : ১-৫]। তিনি বলিলেন, আমিও জাবির ইবনি আবদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কুরআনের কোন্ আয়াতটি প্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি বলেছেন, আমি বললাম, জাবির [রাঃআ:] বলিলেন, আমি তোমাদেরই তা-ই বর্ণনা করছি। রসূলুল্লাহ্ [সাঃআ:] আমাদের যা বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলেছেন, আমি একমাস হিরা গুহায় অবস্থান করি। অবস্থান শেষে আমি নিচে নেমে এলাম। উপত্যকায় মাঝখানে যখন পৌঁছলাম তখন আমাকে ডাকা হলো। আমি সামনে-পেছনে, ডানে-বায়ে তাকালাম, কাউকে দেখলাম না। তারপর আমাকে ডাকা হলো, তখনো কাউকে দেখিতে পেলাম না। পুনঃ আমাকে ডাকা হলো। আমি তাকালাম, দেখি সে ফেরেশতা অর্থাৎ জিবরীল [আ:] শূন্যে একটি কুরসীর উপর উপবিষ্ট। আবার প্রবল কম্পন শুরু হলো। অনন্তর খাদীজার নিকট আসলাম। বললাম, তোমরা আমার গায়ে কম্বল জড়িয়ে দাও, তোমরা আমার গায়ে কম্বল জড়িয়ে দাও। তারা আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিল। আমার উপর পানি ঢাললো। অনন্তর আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাযিল করেনঃ “হে কম্বল জড়ানো ব্যক্তি! উঠুন সতর্কবাণী প্রচার করুন, আপনার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন, আপনার পরিচ্ছেদ পবিত্র রাখুন”-[সূরাহ আল মুদ্দাস্সির ৭৪ : ১-৪]।
[ই.ফা. ৩০৬; ই.সে. ৩১৭]
২৯৯. ইয়াহ্ইয়া ইবনি কাসীর [রাঃআ:] হইতে বর্ণিতঃ
পূর্ব বর্ণিত সানাদে বর্ণনা করিয়াছেন। তবে তিনি এ কথা উল্লেখ করেছেনঃ সে ফেরেশতা আসমান জমিনের সাথে একটি কুরসীর উপর উপবিষ্ট।
[ই.ফা. ৩০৭; ই.সে. ৩১৮]
Leave a Reply