হাদীস নবুওয়তের মুজিযা
হাদীস নবুওয়তের মুজিযা << নবুওয়তের মুজিযা হাদীসের মুল সুচিপত্র দেখুন
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
হাদীস নবুওয়তের মুজিযা – ভূমিকা
“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি তাহাঁর বান্দার উপর কিতাব নাযিল করেছেন এবং তাতে রাখেন নি কোনো বক্রতা। সরলরূপে, যাতে সে তাহাঁর পক্ষ থেকে কঠিন আযাব সম্পর্কে সতর্ক করে এবং সুসংবাদ দেয়, সেসব মুমিনকে, যারা সৎকর্ম করে, নিশ্চয় তাদের জন্য রয়েছে উত্তম প্রতিদান”। [কোরআনের সুরা আল-কাহফ: ২]
“সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও যমীন এবং সৃষ্টি করেছেন অন্ধকার ও আলো। তারপর কাফিররা তাদের রবের সমতুল্য স্থির করে”। [কোরআনের সুরা আল-আন`আম: ১]
হে আল্লাহ আপনি আপনার নাবী মুহাম্মদ রাঃসাঃ এর উপর নামায ও সালাম নাযিল করুন, যাকে আপনি সৃষ্টিকুলের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। তাহাঁর পরিবার পরিজন ও সাহাবীদের উপর রহমত বর্ষণ করুন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, তাহাঁর কোনো শরিক নেই। তিনি তাহাঁর ওয়াদা পূরণ করেছেন, তাহাঁর বান্দাহ মুহাম্মাদ রাঃসাঃকে সাহায্য করেছেন এবং শত্রুদলকে পরাজিত করেছেন। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ রাঃসাঃ তাহাঁর বান্দাহ ও রাসূল। আল্লাহ তাকে মু`জিযা দিয়ে সাহায্য করেছেন।
“আর তোমার রবের বাণী সত্য ও ন্যায়পরায়ণতার দিক থেকে পরিপূর্ণ হয়েছে। তাহাঁর বাণীসমূহের কোনো পরিবর্তনকারী নেই”। [কোরআনের সুরা আল-আন`আম: ১১৫]
ফলে তিনি মুহাম্মদ রাঃসাঃকে তাহাঁর রাসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন।
“আল্লাহ ভালো জানেন, তিনি কোথায় তাহাঁর রিনামায অর্পণ করবেন”। [কোরআনের সুরা আল-আন`আম: ১২৪]
তিনি তাহাঁর সত্যতার প্রমাণে অকাট্য দলিল প্রমাণ দিয়ে সাহায্য করেছেন। যেমন আল্লাহ বলিয়াছেন,
“আর তারা তোমার কাছে যে কোনো বিষয়ই নিয়ে আসুক না কেন, আমি এর সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা তোমার কাছে নিয়ে এসেছি”। [কোরআনের সুরা আল-ফুরকান: ৩২]
অতঃপর কথা হচ্ছে, দালায়েলুন নুবুওয়্যাহ তথা নবুওয়তের দলিল প্রমাণ নিয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা করলে মু`মিনদের ঈমান বৃদ্ধি পায়, আল্লাহ যার কল্যাণ চান তার জন্য কখনও তা ইসলাম গ্রহণের কারণ হয়।
নাস্তিক ও অবাধ্যদের ক্ষেত্রে: তাদেরকে সব ধরণের দলিল প্রমাণ ও নিদর্শন পেশ করার পরে তাদের জন্য তা অন্ধত্ব ও ভ্রষ্টতাই বৃদ্ধি করবে। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা`আলা বলিয়াছেন,
﴿وَلَوۡ فَتَحۡنَا عَلَيۡهِم بَابٗا مِّنَ ٱلسَّمَآءِ فَظَلُّواْ فِيهِ يَعۡرُجُونَ ١٤ لَقَالُوٓاْ إِنَّمَا سُكِّرَتۡ أَبۡصَٰرُنَا بَلۡ نَحۡنُ قَوۡمٞ مَّسۡحُورُونَ ١٥ ﴾ [الحجر: ١٤، ١٥]
“আর যদি আমি তাদের জন্য আসমানের কোনো দরজা খুলে দিতাম, অতঃপর তারা তাতে আরোহণ করতে থাকত, তবুও তারা বলত, নিশ্চয় আমাদের দৃষ্টি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, বরং আমরা তো জাদুগ্রস্ত সম্প্রদায়”। [কোরআনের সুরা: আল-হিজর: ১৪-১৫]
মূসা আলাইহিস সালামের নবুওয়ত অস্বীকারকারীদের সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা`আলা বলিয়াছেন,
“আর তারা বলল, `তুমি আমাদেরকে জাদু করার জন্য যে কোনো নিদর্শন আমাদের কাছে নিয়ে আস না কেন আমরা তো তোমার প্রতি ঈমান আনব না”। [কোরআনের সুরা আল-আ`রাফ: ১৩২]
অনুরূপভাবে আল্লাহ তা`আলা কুরাইশদের সম্পর্কে বলিয়াছেন,
“আর তারা বলে, `আমরা তোমার প্রতি কখনো ঈমান আনব না, যতক্ষণ না তুমি আমাদের জন্য যমীন থেকে একটি ঝর্ণাধারা উৎসারিত করবে`। `অথবা তোমার জন্য খেজুর ও আঙ্গুরের একটি বাগান হবে, অতঃপর তুমি তার মধ্যে প্রবাহিত করবে নদী-নালা`। অথবা তুমি যেমনটি ধারণা কর, সে অনুযায়ী আসমানকে খণ্ড খণ্ড করে আমাদের উপরে ফেলবে, অথবা আল্লাহ ও ফেরেশ্তাদেরকে আমাদের মুখোমুখি নিয়ে আসবে`। অথবা তোমার জন্য স্বর্ণের একটি ঘর হবে অথবা তুমি আসমানে উঠবে, কিন্তু তোমার উঠাতেও আমরা ঈমান আনব না, যতক্ষণ না তুমি আমাদের প্রতি এক কিতাব নাযিল করবে যা আমরা পাঠ করব। বল, পবিত্র মহান আমার রব! আমি তো একজন মানব-রাসূল ছাড়া কিছু নই?” [কোরআনের সুরা আল-ইসরা : ৯০-৯৩]
আল্লাহ তা`আলা তাদের সম্পর্কে আরো বলিয়াছেন,
“আর তারা আল্লাহর নামে কঠিন কসম করেছে, যদি তাদের কাছে কোনো নিদর্শন আসে, তবে তারা অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে। বল, `সমস্ত নিদর্শন তো কেবল আল্লাহর কাছে। আর কিসে তোমাদের উপলব্ধি ঘটাবে যে, যখন তা এসে যাবে, তারা ঈমান আনবে না? আর আমি তাদের অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ পালটে দেব যেমন তারা কুরআনের প্রতি প্রথমবার ঈমান আনে নি এবং আমি তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় ঘুরপাক খাওয়া অবস্থায় ছেড়ে দেব। আর যদি আমি তাদের নিকট ফেরেশ্তা নাযিল করতাম এবং মৃতরা তাদের সাথে কথা বলত, আর সবকিছু সরাসরি তাদের সামনে সমবেত করতাম, তাহলেও তারা ঈমান আনত না, যদি না আল্লাহ চাইতেন; কিন্তু তাদের অধিকাংশই মূর্খ”। [কোরআনের সুরা আল-আন`আম: ১০৯-১১১]
আল্লাহ তা`আলা আরো বলিয়াছেন,
“আর যদি আমি কাগজে লিখিত কিতাব তোমার উপর নাযিল করতাম অতঃপর তারা তা হাত দিয়ে স্পর্শ করত তবুও যারা কুফরী করেছে তারা বলত, `এ তো প্রকাশ্য জাদু ছাড়া কিছু না”। [কোরআনের সুরা আল-আন`আম: ৭]
এ সব মু`জিযা মুহাম্মদ রাঃসাঃ আল্লাহর নাবী হওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ। কেননা আল্লাহ মিথ্যাবাদীকে সাহায্য করেন না।
যেমন আল্লাহ তা`আলা বলিয়াছেন,
“অতএব তোমরা যা দেখছ, আমি তার কসম করছি। আর যা তোমরা দেখছ না তারও, নিশ্চয়ই এটি এক সম্মানিত রাসূলের বাণী। আর এটি কোনো কবির কথা নয়। তোমরা কমই বিশ্বাস কর। আর কোনো গণকের কথাও নয়। তোমরা কমই উপদেশ গ্রহণ কর। এটি সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত। যদি সে আমার নামে কোনো মিথ্যা রচনা করত, তবে আমি তার ডান হাত পাকড়াও করতাম। তারপর অবশ্যই আমি তার হৃদপিন্ডের শিরা কেটে ফেলতাম। অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউই তাকে রক্ষা করার থাকত না”। [কোরআনের সুরা আল্-হাক্কাহ: ৩৮-৪৭]
আল্লাহ তা`আলা আরো বলিয়াছেন,
“আর তাদের অবস্থা এমন ছিল যে, আমি তোমাকে যে ওহী দিয়েছি, তা থেকে তারা তোমাকে প্রায় ফিতনায় ফেলে দিয়েছিল, যাতে তুমি আমার নামে এর বিপরীত মিথ্যা রটাতে পার এবং তখন তারা অবশ্যই তোমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত। আর আমি যদি তোমাকে অবিচল না রাখতাম, তবে অবশ্যই তুমি তাদের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়তে, তখন আমি অবশ্যই তোমাকে আস্বাদন করাতাম জীবনের দ্বিগুণ ও মরণের দ্বিগুণ আযাব।[1] তারপর তুমি তোমার জন্য আমার বিরুদ্ধে কোনো সাহায্যকারী পাবে না”। [কোরআনের সুরা আল-ইসরা: ৭৩-৭৫]
আল্লাহ তা`আলা আরও বলেন,
“তারা কি একথা বলে যে, সে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে? অথচ যদি আল্লাহ চাইতেন তোমার হৃদয়ে মোহর মেরে দিতেন। আর আল্লাহ মিথ্যাকে মুছে দেন এবং নিজ বাণী দ্বারা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। নিশ্চয় তিনি অন্তরসমূহে যা আছে, সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত”। [কোরআনের সুরা আশ্-শূরা: ২৪]
“আর তার চেয়ে বড় যালিম কে, যে আল্লাহর উপর মিথ্যা রটনা করে, অথবা বলে, `আমার উপর ওহী প্রেরণ করা হয়েছে`, অথচ তার প্রতি কোনো কিছুই প্রেরণ করা হয়নি? এবং যে বলে `আমি অচিরেই নাযিল করব, যেরূপ আল্লাহ নাযিল করেছেন”। [কোরআনের সুরা আল-আন`আম: ৯৩]
এজন্যই যারা নবুওয়তের মিথ্যাদাবীদার তারা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়, যেমন মুসাইলামাতুল কাযযাব, আল-আসওয়াদ আল-`আনসী, এদের পরবর্তীতে মুখতার ইবনু আবী উবাইদ আস-সাকাফী প্রভৃতি যারা নবুওয়তের মিথ্যাদাবী করেছিল।
মু`জিযার উপর ঈমান না আনলে দুনিয়া ও আখিরাতে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে:
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা`আলা বলিয়াছেন,
“যখন হাওয়ারীগণ বলেছিল, `হে মারইয়ামের পুত্র ঈসা, তোমার রব কি পারে আমাদের উপর আসমান থেকে খাবারপূর্ণ দস্তরখান নাযিল করতে?` সে বলেছিল, `আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যদি তোমরা মুমিন হও`। তারা বলল, `আমরা তা থেকে খেতে চাই। আর আমাদের হৃদয় প্রশান্ত হবে এবং আমরা জানব যে, তুমি আমাদেরকে সত্যই বলেছ, আর আমরা এ ব্যাপারে সাক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত হব।` মারইয়ামের পুত্র ঈসা বলল, `হে আল্লাহ, হে আমাদের রব, আসমান থেকে আমাদের প্রতি খাবারপূর্ণ দস্তরখান নাযিল করুন; এটা আমাদের জন্য ঈদ হবে। আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের জন্য। আর আপনার পক্ষ থেকে এক নিদর্শন হবে। আর আমাদেরকে রিযিক দান করুন, আপনিই শ্রেষ্ঠ রিযিকদাতা`। আল্লাহ বলিলেন, `নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতি তা নাযিল করব; কিন্তু এরপর তোমাদের মধ্যে যে কুফরী করবে তাকে নিশ্চয় আমি এমন আযাব দেব, যে আযাব সৃষ্টিকুলের কাউকে দেব না”। [আল-মায়েদা: ১১২-১১৫]
রাঃসাঃকে যে উত্তম আখলাক দান করা হয়েছে তা স্বত্বেও নবুওয়তের প্রমাণসমুহ তাহাঁর নাবী হওয়ার সত্যতার উপর অকাট্য দলিল। কেননা রাঃসাঃ এর নবুওয়তের স্পষ্ট নিদর্শন ও দলিল প্রমাণ দেখে অনেকের অন্তর ঈমান না আনার কারণে সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। যেমন আল্লাহ তা`আলা তাদের সম্পর্কে বলিয়াছেন,
“কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে। আর তারা কোনো নিদর্শন দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, `চলমান জাদু`। আর তারা অস্বীকার করে এবং নিজ নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। অথচ প্রতিটি বিষয় [শেষ সীমায়] স্থির হবে”। [কোরআনের সুরা আল্-কামার: ১-৩] এটা মক্কার কুরাইশ কাফিরদের অবস্থা ছিল।
অন্যদিকে রাঃসাঃ এর যুগে মুসলিমগণ:
তারা শরি`য়তের সব বিধিবিধানই আমাদের নাবী মুহাম্মদ রাঃসাঃ এর নবুওয়তের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে মনে করতেন, কেননা এতে অনেক আর্শ্চয্যজনক রহস্য ও পূর্ণ প্রজ্ঞা রয়েছে। এমনিভাবে সাহাবীদেরকে একনিষ্ঠার সাথে অনুসরণকারী তাবে`য়ীগণও শরি`য়তের সব বিধিবিধানকে মুহাম্মদ রাঃসাঃ এর নবুওয়তের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে মনে করতেন। এরপরে মু`তাযিলার দল এলো, তারা কুরআন ও হাদীসকে ছেড়ে তাদের ভ্রান্ত খাম-খেয়ালীপনার অনুসরণ করতে লাগল। তারা মনে করত যে, তারা তাদের আক্বলের উপর নির্ভর করছে কিন্তু বাস্তবে তারা তাদের ভ্রান্ত খাম-খেয়ালীপনার অনুসরণ করত। কেননা সঠিক আক্বল কখনও কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসের বিরোধী হয় না। ফলে কিছু মু`জিযা তাদের অন্তরকে সংকুচিত করে ফলে তারা সেগুলোর তা`বীল তথা অপব্যাখ্যা দিতে লাগল। এতে তারা সেগুলোকে দুর্বল মনে করল। কিন্তু আল্লাহ তা`আলা হককে বাস্তবায়ন ও মিথ্যাকে ধ্বংস করতে চান। বর্তমানে মু`তাযিলাদের মাযহাব লুপ্ত প্রায়।
পরবর্তী যমানায় একদল প্রবৃত্তির অনুসারীদের আগমন ঘটে: তারা মুতাযিলাদের পক্ষ্যে মোকাবিলা করতে চাইল, ফলে তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে যেমনিভাবে তাদের পূর্বসূরীরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এ সব ধ্বংসপ্রাপ্তরা কেউ কেউ দিশেহারা, কেউ আবার মুতাযিলাদের পক্ষ্যে বদলাগ্রহণকারী, এমনকি তাদের কেউ কেউ নাস্তিকতার বিপ্লবী।[2]
১- জামালুদ্দীন আল-আফগানী আশ-শিয়া আর-রাফেদী আল-ইরানী।
২- মুহাম্মদ আব্দুহ আল-মিসরী।
৩- মুহাম্মদ রশীদ রিদা। তবে তিনি ভ্রষ্টতার বিচারে পূর্ববর্তীদের মত নন।
৪- মাহমুদ শালতুত।[3]
৫- ত্বহা হুসাইন।
৬- আহমদ আমীন, ফাজরুল ইসলাম, দ্বুহাল ইসলাম ও যুহরুল ইসলাম কিতাবের প্রণেতা।
৭- আবু রাইয়্যাহ।
৮- মুহাম্মদ আল-গাযালী। তার অধিকাংশ কিতাবে আহলে সুন্নত ওয়াল জামা`আতকে অবজ্ঞা ও সুন্নতের উপর আমলকে হেয় করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:
“দসতুরুল ওয়াহদাতিস সাক্বাফিয়া বাইনাল মুসলিমিন”, “হুমুমু দাঈয়াহ”। মুহাম্মদ আল-গাযালী একজন মন গলানো মানুষ। যদিও তিনি ভ্রষ্টতার দিক দিয়ে পূর্বল্লিখিতদের মত নন।
তাদের অন্যান্যরা সুন্নতের উপর আক্রমণ করেছেন এবং মু`তাযিলাদেরকে বিজয়ী করেছেন। তাদের কেউ কেউ রাফেদীদেরকে বিজয়ী করেছেন। মিসরে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে মানুষের মাঝে একধরণের খেলা চলছিল। আল্লাহ যথার্থই বলিয়াছেন,
“হে ঈমানদারগণ, নিশ্চয় পণ্ডিত ও সংসার বিরাগীদের অনেকেই মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে, আর তারা আল্লাহর পথে বাধা দেয়”। [আত্-তাওবা: ৩৪]
“আর তুমি তাদের উপর সে ব্যক্তির সংবাদ পাঠ কর, যাকে আমি আমার আয়াতসমূহ দিয়েছিলাম। অতঃপর সে তা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং শয়তান তার পেছনে লেগেছিল। ফলে সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল। আর আমি ইচ্ছা করলে উক্ত নিদর্শনাবলীর মাধ্যমে তাকে অবশ্যই উচ্চ মর্যাদা দিতাম, কিন্তু সে পৃথিবীর প্রতি ঝুঁকে পড়েছে এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে কুকুরের মত। যদি তার উপর বোঝা চাপিয়ে দাও তাহলে সে জিহবা বের করে হাঁপাবে অথবা যদি তাকে ছেড়ে দাও তাহলেও সে জিহবা বের করে হাঁপাবে। এটি হচ্ছে সে কওমের দৃষ্টান্ত যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে”। [কোরআনের সুরা আল-আ`রাফ: ১৭৫-১৭৬]
রাঃসাঃ যথার্থই বলিয়াছেন,
“`উমর ইবনু খাত্তাব রাদি. আনহু হইতে বর্ণিত, রাঃসাঃ বলিয়াছেন, আমার উম্মতের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর হলো বাকপটু বিজ্ঞ মুনাফিক”। [4]
“সাওবান রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, রাঃসাঃ বলিয়াছেন, আমার উম্মতের জন্য ভয়ঙ্কর হলো পথভ্রষ্ট ইমামগণ”। [5]
এদের অধিকাংশই শিয়া-রাফেদী, তারা সুন্নতের শত্রু।[6] কিন্তু আল্লাহ তা`আলা তাদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে সুন্নতকে বিজয়ী করেছেন। আল্লাহদ্রোহীরা অপছন্দ করলেও আল্লাহ তাহাঁর দীনকে বিজয়ী করবেন। ইসলামী বিশ্বে সর্বত্র মুসলিম যুবকগণ জাগ্রত হয়েছে। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে `আল্লাহ বলিয়াছেন`, `রাঃসাঃ বলিয়াছেন` ইত্যাদি ধ্বনি। সুতরাং সুন্নতের শত্রুদের জন্য চির লাঞ্ছনা ও অপমান।
ইতোপূর্বে জামালুদ্দীন আফগানী ও মুহাম্মদ আব্দুহ সংস্কারক ইমাম হিসেবে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু বর্তমানে তারা `মাসূণী` হিসেবে খ্যাত।
“হে আমাদের রব, আপনি হিদায়াত দেওয়ার পর আমাদের অন্তরসমূহ বক্র করবেন না এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহাদাতা”। [আলে ইমরান: ৮]
এরা দিকভ্রান্ত পথভ্রষ্ট:
এদের মধ্যে কেউ কুরআনের কাহিনীর ব্যাপারে অপবাদ দেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছে।
কেউ আবার নাবী আলাইহিমুস সালামদের মু`জিযার ব্যাপারে অপবাদ দিয়েছে।
কেউ কেউ আমাদের নিকট দীন বর্ণনাকারী সাহাবীদেরকে অপবাদ দিয়েছে।
কেউ আবার দীনের কিছু বিধানকে খারাপ বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। তারা নতুন কিছু বিধান ও জঘন্য কিছু নিয়ম-পদ্ধতি তাদের গ্রন্থে প্রচলন করেছে, যা শিয়া-রাফেদী ও নাস্তিকদের দ্বারা স্বীকৃত হতে দেখা যায়।
আল্লাহর শুকরিয়া, এ সব ভ্রান্ত মতবাদের জবাবে আহলে সুন্নত ওয়ালজামা`আতের ভাইয়েরা এমন দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন যা তাদের চোখ জুড়িয়ে দিয়েছে। যারা এর মুকাবিলা করার জন্য নিজেদের শক্তি ও শ্রম ব্যয় করেছেন আল্লাহ তাদেরকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন। আমীন।
পূর্ববর্তী ও পরবর্তী এসব বিভ্রান্ত মু`তাযিলাদের বিপরীতে কতিপয় কিচ্ছা কাহিনীকারদের আবির্ভাব ঘটেছে, যারা মানুষের মাঝে ভালো-মন্দ, হক বাতিলের কোনো পার্থক্য ছাড়াই খামখেয়ালীমত হাদীস বর্ণনা করেন। এদের কাউকে আবার জাল হাদীস রচনায় অন্ধ গোড়ামী পেয়ে বসেছে। যেমন, আমি `আলী আল-`ইজরী` রচিত `নসীহাত আওলাদিস সিবত্বাইন ওয়ামান তাবি`আহুম মিনাল মু`মিনীনা ফিত তামাসসুকি বিমাযহাবিল হাদী ইলাল হাক্কি ইয়াহিয়া ইবনু আল হুসাইন` কিতাবে দেখেছি লেখক যায়েদ ইবনু আলী ও আলহাদীর মর্যাদা বর্ণনায় অসংখ্য মিথ্যা ও জাল হাদীস বর্ণনা করেছেন। লেখক হয়ত নিজে এ সব মিথ্যা অপবাদ দেননি, তবে তিনি হাদীসের ইলম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকায় ও তাহাঁর পূর্বপুরুষদের ব্যাপারে গোড়া পক্ষপাতিত্ব থাকায় এ সব জাল হাদীস বর্ণনা করেছেন। এমনিভাবে কতিপয় আব্বাসী খলিফাদের মর্যাদায় অনেক জাল হাদীস রচিত হয়েছে, যেমন ইবনু আল-জাওযী রচিত `আল-`ইলাল আল-মুতানাহিয়া` কিতাবে দৃশ্যমান হয়।
অন্য আরেক দল আছে যারা রাঃসাঃ এর নবুওয়তের প্রমাণসমূহকে এমনসব অর্থে ব্যবহার করেছেন যা কখনও তার অর্থ নয়। এ সব ভ্রান্ত কিতাবের মধ্যে একটি হলো, `মুতাবাকাতুল ইখতিরা`আতিল `আসরিয়া লিমা আখবারা বিহি সাইয়্যেদুল বারিয়্যাহ`। এ কিতাবে লেখক অনেক দলীল প্রমাণকে বিকৃত করেছেন এবং নিজের ইচ্ছামত অন্যান্য দলীল দিয়ে অপাত্রে দলিল দিয়েছেন। `শাইখ হুমুদ আত-তুয়াইজিরী` তার `ইদাহুল মুহাজ্জাহ ফির রদ্দি `আলা সাহিবি ত্বনযাহ` গ্রন্থে এ সব অপবাদের জবাব দিয়েছেন।
- এসব কারণে আল্লাহর সাহায্য সহযোগিতায় আমার জন্য যা সহজ হয়েছে তা নিয়ে নবুওয়তের সহীহ প্রমাণাদি একত্রিত করতে ইচ্ছা করেছি এবং এর নামরকণ করেছি
`আস-সহীহ আল-মুসনাদ মিন দালায়েলুন নবুওয়াহ` বা `সহীহ হাদীসের আলোকে রাঃসাঃ এর নবুওয়তের প্রমাণ`।
বিশুদ্ধ হাদীসের কিতাব থেকে এগুলো জমা করেছি।
- এতে নাবীগণের কিচ্ছা নামে একটি অধ্যায় উল্লেখ করেছি। কারণ নাবী রাঃসাঃ এসব কাহিনী বর্ণনা করেছেন এবং আহলে কিতাবরা এগুলো অস্বীকার করে নি। এতে প্রমাণ হয় যে, এ ঘটনাবলী ঘটেছে এবং তা যথাযথ সত্য।
এছাড়াও এসব ঘটনা গায়েবের সংবাদের অন্তর্ভুক্ত। যেমন, আল্লাহ তা`আলা ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করে বলেন,
“এগুলো গায়েবের সংবাদ, যা আমরা তোমার কাছে ওহী করছি। তুমি তো তাদের নিকট ছিলে না যখন তারা তাদের সিদ্ধান্তে একমত হয়েছিল অথচ তারা ষড়যন্ত্র করছিল”। [কোরআনের সুরা ইউসুফ: ১০২]
তাছাড়া নাবীগণের ঘটনাবলীর ব্যাপারে মানুষ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত, কেউ কেউ ইসরাইলী[7] রেওয়ায়েতের উপর নির্ভর করেছেন। আবার কেউ কেউ নাবীগণের ঘটনাবলীর উপর অন্যায় হস্তক্ষেপ করে সেগুলোকে বিকৃত করেছে। নাজ্জার রচিত `কাসাসুল আম্বিয়া` কিতাবখানা আমি পড়েছি। এতে নাবীগণের কোনো মু`জিযাকে বিকৃতি ও অস্বীকার করা হয়েছে[8]। তন্মধ্যে তারাই এ ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন যারা কুরআন ও সহীহ হাদীসে উল্লেখিত যে সব ঘটনাবলী এসেছে সেগুলোর প্রতি ঈমান এনেছেন।
- আর এ কিতাবে আমি নাবী রাঃসাঃ হতে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে সব হাদীস এসেছে তা উল্লেখ করেছি। তবে এতে আমি দলিল প্রমাণগুলো উল্লেখ করার পর সেগুলোকে যথাযথ অবস্থায় রেখে দিয়েছি, সেগুলো দ্বারা কোনো ব্যক্তি বিশেষ তথা অমুক বা অমুক উদ্দেশ্য এমন কথা বলিনি। কারণ আমার আশঙ্কা হয় যে হয়তো আমি এগুলো দ্বারা কোনো কিছুকে উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে বলে দেব, আর ভবিষ্যতে তার থেকেও স্পষ্ট কোনো কিছুর উপর সেগুলো প্রমাণবহ হবে। তন্মধ্যে আবার এমন কিছু হাদীসও আছে যা ঘটে গেছে, আর তা-ই অত্যধিক। যেগুলো এখনো ঘটেনি তা সাধারণত আমি উল্লেখ করি নি, যদি না কোনো হাদীসের বাক্যে তার উল্লেখ চলে আসে, এমতাবস্থায় আমি সে হাদীসকে কর্তন করে কিছু অংশ উল্লেখ করা ভালো মনে করিনি। যদিও ইলমে হাদীসের পরিভাষা নিয়ে লেখা গ্রন্থসমূহে শর্ত অনুযায়ী হলে এ ধরনের কর্তন জায়েয বলা হয়েছে। আর আমি শুধু সহীহ হাদীসই উল্লেখ করেছি। কখনো কখনো আমি সহীহ হাদীস ছাড়াও অন্য হাদীসও উল্লেখ করেছি, তবে সে ক্ষেত্রে আমি গবেষণার পরে তাতে দোষ অনুসন্ধান করে পাওয়ার হয়তো তা মুছে ফেলেছি নতুবা ইল্লত বর্ণনাসহকারে হাদীসটি রেখে দিয়েছি, কেননা এতে পাঠকের জন্য বাড়তি কিছু ফায়েদা রয়েছে।
- আর আমি হাদীসের তাখরীজ তথা তথ্যসূত্র বর্ণনায় বেশি করিনি, এমনকি দেখা গেছে হাদীসটি মুত্তাফাকুন আলাইহি, তথা বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, অথচ আমি কখনো কখনো শুধু মুসলিম আবার কখনো শুধু বুখারী থেকে উল্লেখ করেছি। কেননা আমি হাদীসটি সনদসহকারে নির্ভরযোগ্য হাদীসের কিতাব থেকে উল্লেখ করেছি। সর্বাবস্থায় আলহামদু লিল্লাহ। আল্লাহর কাছে দো`আ করছি তিনি যেন আমার এ কাজটি কবুল করেন এবং এটি যেন একমাত্র তাহাঁর সন্তুষ্ট অর্জনের উদ্দেশ্যেই হয় এবং এর লেখকের দ্বারা ইসলাম ও মুসলমানের উপকারে সাধন হয়। আমীন।
হাদীস নবুওয়তের মুজিযা সতর্কতা: আল্লাহ তা`আলা নাবীগণের দ্বারা যে সব মু`জিযা সংঘটিত করান তা তাদের ইচ্ছায় হয় না এবং এগুলো তাদের সাধ্যের মধ্যেও নয়। কিন্তু তাদের নবুওয়তের সত্যতায় আল্লাহ তাদের দ্বারা এগুলো সংঘটিত করান। এব্যাপারে এজন্য সতর্ক করলাম যেহেতু কতিপয় সীমালঙ্ঘনকারী এগুলোকে নাবীগণের ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত মনে করে বসে।
আরেকটি সতর্কতা: নাবী রাঃসাঃ এর উত্তম চরিত্র, তাহাঁর জাওয়ামেউল কালেম [তথা পূর্ণ অর্থবহ সংক্ষিপ্ত বাক্য] এবং তাহাঁর দ্বারা প্রচারিত শরী`আতের বিধি-বিধান অত্যন্ত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ন বিষয় ও তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার সংবলিত হওয়া রাঃসাঃ এর নবুওয়তের প্রমাণসমূহের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ যাকে ঈমান, অন্তর্দৃষ্টি ও দীনের সঠিক বুঝ দিয়েছেন তারা বুঝতে পারেন যে এগুলো রাঃসাঃ এর নবুওয়তের প্রমাণ তথা [দালায়েলুন নবুওয়াহ] এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ বলিয়াছেন,
বল, `এটি মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও প্রতিষেধক। আর যারা ঈমান আনে না তাদের কানে রয়েছে বধিরতা আর কুরআন তাদের জন্য হবে অন্ধত্ব। তাদেরকেই ডাকা হবে দূরবর্তী স্থান থেকে”। [কোরআনের সুরা ফুস্-সিলাত: ৪৪]
আরেকটি সতর্কতা: আগের ও বর্তমান কিছু ভ্রান্ত লোকেরা দালায়েলুন নুবুওয়াহ ও কারামাতুল আওলিয়ার ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, এ কারণে যে জাদুকর ও গণকদের দ্বারাও কিছু আশ্চর্যজনক ঘটনা প্রকাশিত হয়।
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রহ. দালায়েলুন নুবুওয়াহ ও জাদুকর ও গণকদের কর্তৃক আশ্চর্যকর ঘটনার মধ্যেকর পার্থক্য বর্ণনা করেছেন। ফলে আমি শাইখুল ইসলামের কিতাব `আন-নুবুওয়াত` থেকে যতটুকু সহজ হয় চয়ন করব; যাতে এদুয়ের মাঝে পার্থক্য স্পষ্ট হয় এবং ব্যাপারটি এমন হয় যেমনটি আল্লাহ বলিয়াছেন,
“যে ধ্বংস হওয়ার সে যাতে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পর ধ্বংস হয়, আর যে জীবিত থাকার সে যাতে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পর বেঁচে থাকে”। [কোরআনের সুরা আল- আনফাল: ৪২]
ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, [পৃ. ১৬] অলৌকিক ঘটনা তিন প্রকার:
প্রথম প্রকার: ব্যক্তিকে এসব অলৌকিক ঘটনা দ্বারা ভালো ও আল্লাহর তাকওয়ার কাজে সাহায্য করা হবে। এটা আমাদের নাবী ও তাহাঁর অনুসারীদের অবস্থা। তাদের অলৌকিক ঘটনা দীনের পক্ষে প্রমাণ পেশের জন্য অথবা মুসলিমদের প্রয়োজন পূরণের জন্য হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় প্রকার: এ সব অলৌকিক ঘটনা দ্বারা বৈধ কাজে সাহায্য নেওয়া, যেমন প্রয়োজনীয় জায়েয কাজে জিনদের দ্বারা সাহায্য নেওয়া। এটা মধ্যম ধরণের অলৌকিক ঘটনা। এ অলৌকিকতা দ্বারা ব্যক্তির মর্যাদা বাড়ে বা কমে না। এটা নাবী সুলাইমান আলাইহিস সালাম কর্তৃক জিন জাতিকে কাজে লাগানোর সাদৃশ।
প্রথম প্রকারের উদাহরণের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, আমাদের নাবীকে জিনদের কাছে প্রেরণ তাদের নিকট ঈমানের দাওয়াত দেওয়ার জন্য। এটা জায়েয কাজে জিনদেরকে ব্যবহার করার চেয়েও উত্তম। যেমন জায়েয কাজে ব্যবহার করেছিলেন সুলাইমান আলাইহিস সালাম। তিনি জিনদেরকে প্রাসাদ, ভাস্কর্য, সুবিশাল হাউযের মত বড় পাত্র ও স্থির হাড়ি ইত্যাদি তৈরি করায় ব্যবহার করতেন। আল্লাহ বলেন,
“তারা তৈরী করত সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী তার জন্য প্রাসাদ, ভাস্কর্য, সুবিশাল হাউযের মত বড় পাত্র ও স্থির হাড়ি। `হে দাঊদ পরিবার, তোমরা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমল করে যাও এবং আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই কৃতজ্ঞ“। [কোরআনের সুরা সাবা : ১৩]
আল্লাহ আরো বলিয়াছেন,
“তাদের মধ্যে যে আমার নির্দেশ থেকে বিচ্যুত হয় তাকে আমরা জ্বলন্ত আগুনের আযাব আস্বাদন করাব”। [কোরআনের সুরা সাবা : ১২]
আমাদের নাবীকে জিনদের নিকট ঈমান ও আল্লাহর ইবাদাতের দাওয়াত সহকারে প্রেরণ করা হয়েছিল, যেমনিভাবে তিনি মানুষের কাছে প্রেরিত হয়েছিলেন। অতঃপর যারাই তাহাঁর অনুসরণ করেছে তারাই সুখী ও সৌভাগ্যবান হয়েছেন। এটা সুলাইমান আলাইহিস সালামের চেয়েও মুহাম্মাদ রাঃসাঃ এর পূর্ণাঙ্গতার উপর প্রমাণ। যেমনিভাবে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল গুণ নাবী ও বাদশাহ গুণের চেয়ে বেশি পূর্ণাঙ্গ। ইউসুফ, দাউদ ও সুলাইমান আলাইহিমুস সালামগণ নাবী ও বাদশাহ ছিলেন, আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল ছিলেন, যেমন ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা আলাইহিমুস সালামগণ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল ছিলেন। বান্দাহ ও রাসূল হওয়ার এগুণ বেশি মর্যাদাবান এবং তাদের উম্মতগণও বেশি মর্যাদাবান।
তৃতীয় প্রকার হলো: হারাম কাজ যেমন, অশ্লীল কর্মকাণ্ড, যুলুম, শির্ক, মিথ্যাকথা ইত্যাদি কাজে অলৌকিক কর্মকাণ্ড ব্যবহার করা। এগুলো জাদুকর, গণক, কাফের ও পাপাচারীদের কাজের সমগোত্রীয় কাজ। যেমন বিদ`আতী রেফা`ঈ সম্প্রদায়, তারা মানুষকে শির্ক, অন্যায়ভাবে হত্যা ও পাপাচারের কাজে কিছু অলৌকিক ঘটনার সাহায্য নিয়ে থাকে। আর এ তিনটি কাজই আল্লাহ তা`আলা হারাম ঘোষণা করেছেন তাহাঁর নিম্নোক্ত বাণীতে,
“আর যারা আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহকে ডাকে না এবং যারা আল্লাহ যে নফসকে হত্যা করা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না। আর যারা ব্যভিচার করে না। আর যে তা করবে সে আযাবপ্রাপ্ত হবে”। [কোরআনের সুরা আল-ফুরকান: ৬৭]
আর এজন্যই তাদের এসব কাজ গণক, কবি ও পাগলের কর্মপদ্ধতির সমগোত্রীয়। আর আল্লাহ তাহাঁর নাবীকে পাগল, কবি ও গণক হওয়া থেকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন। কারণ তারা যে সব গায়েবী বিষয়ের সংবাদ প্রদান করে তা তো কেবল তাদের উপর সওয়ার হওয়া শয়তানদের মাধ্যমেই প্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে যারা শয়তানদেরকে মা`বুদ হিসেবে গ্রহণ করে তারা শয়তানদের থেকে আরও বেশি শক্তিশালী অলৌকিক অবস্থা পেতে সক্ষম হয়। বস্তুত তারা পাগলদের অন্তর্ভুক্ত। তাই তো তাদের এক শাইখ বলিয়াছেন, তাদের সঙ্গী সাথী যারা এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা ঘটায় তারা বেঈমান হয়ে মারা যায়। আর তাদের সামা তথা ভক্তিমূলক গান ও তাদের ওয়াজদ তথা আবেগ-উচ্ছাস তা তো কবিদের কবিতার মতই। এজন্যই তাদেরকে যারা দেখেছেন তারা তাদেরকে ভারতের মূর্তিপূজারী মুশরিকদের সাথে তুলনা করেছেন।
অলৌকিক ঘটনার ব্যাপারে মু`তাযিলাদের মতামত বিশ্লেষণ
ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রহ. বলিয়াছেন, [আন-নুবূওয়াত: ১৫০]
তাদের [আশায়েরা-মাতুরিদিয়াদের] পূর্বে মু`তাযিলারা বলত, স্বাভাবিক ঘটনার বিপরীত অলৌকিক কোনো কিছু ঘটা রাসূলদের নবুওয়তের প্রমাণ। অতঃএব, নাবী ছাড়া কারো থেকে অলৌকিক কিছু ঘটা জায়েয নয়। তাদের এ মতামতের কারণে তারা জাদুর দ্বারা অস্বাভাবিক কিছু ঘটানোকে অস্বীকার করত। যেমন, কোনো কিছুর সাহায্য ছাড়া কারো মৃত্যু ও রোগমুক্তি দান করা। তাদের এ মতের কারণে তারা গণকবাজিকেও অস্বীকার করত। আরও অস্বীকার করতো জিনদের দ্বারা কিছু গায়েবের সংবাদ প্রদান করাকে। অনুরূপভাবে তারা অলীদের কারামতকেও অস্বীকার করত। অতঃপর এরা [আশায়েরা ও মাতুরিদিয়ারা] আসলো এবং ফুকাহা ও হাদীসবিদগণের মত তারাও জাদু, গণনাবিদ্যা ও কারামতের ব্যাপারসমূহের বাস্তবতা স্বীকার করে নিলো।
কিন্তু তাদেরকে [আশায়েরা-মাতুরিদিয়াদেরকে] প্রশ্ন করে বলা হলো, তোমরা এ অলৌকিক কর্মকাণ্ড এবং মু`জিযার মধ্যে কীভাবে পার্থক্য কর?
তখন তারা বললো, মু`জিযা ও অলৌকিক ঘটনার মাঝে ধরণগত কোনো পার্থক্য নেই। তারা আরও বলল, আল্লাহ নাবীগণকে এমন বিশেষ কোনো অলৌকিক শক্তি দান করেন না যা অন্যদের সাধ্য নেই বরং সব অলৌকিক শক্তিই একই ধরণের। এ অলৌকিক ঘটনা শুধু অলৌকিকতার কারণে দলিল নয়, বরং যখন তা নবুওয়তের দাবীর সাথে যুক্ত হবে এবং রাসূল যখন সেটার অনুরূপ কিছু নিয়ে আসার আহ্বান জানানোর পর তাদের পক্ষ থেকে তা মোকাবিলা করা থেকে নিরাপদ হবে কেবল তখনই তা দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে। সুতরাং অলৌকিক কর্ম সংঘটিত করা স্বয়ং সেটা বা সে ধরনের কিছু দলীল হিসেবে ধর্তব্য হবে না। যতক্ষণ না তখনই তা দলীল হিসেবে ধর্তব্য হবে যখন নবুওয়তের দাবীদার সেটাকে দলীল হিসেবে পেশ করবে। অন্যথায় তা নবুওয়তের দলীল হবে না। তাই নবুওয়তের দলীল-প্রমাণ হওয়ার জন্য তাদের নিকট শর্ত হচ্ছে এ অলৌকিকতার মুকাবিলা করা থেকে নিরাপদ থাকা। অর্থাৎ তারা সেরূপ আনতে ব্যর্থ হবে। তাই আশায়েরা ও মাতুরিদিয়াদের নিকট এটাই হচ্ছে নাবীদের মু`জিযা ও অন্যান্যদের অলৌকিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে পার্থক্য করার সর্বশেষ সীমা। সুতরাং যখন নবওয়তের দাবীদার ব্যক্তি বলবে যে তোমরা এ নিদর্শনের মত কিছু নিয়ে আস, ফলে তারা তা আনয়ন করতে অপারগ হয়ে যাবে তখন তা সেটা উক্ত নাবীর বিশেষ মু`জিযা হিসেবে বিবেচিত হবে। নতুবা তাদের মতে জাদুকর ও গণকদের দ্বারা সংঘটিত কোনো অলৌকিক কর্মকাণ্ডের অনুরূপ কর্মকাণ্ড নাবীর মু`জিযা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, যদি নাবী অনুরূপ কিছুকে তার নবুওয়তের সত্যতার উপর দলীল হিসেবে পেশ করে।
সুতরাং তাদের [আশায়েরা ও মাতুরিদিয়াদের] নিকট নবুওয়তের দলীল হচ্ছে নবুওয়তের দাবী এবং অলৌকিকতা এ দু`টির সমন্বিত রূপ। শুধু অলৌকিকতা নবুওয়তের প্রমাণ নয়। আর সেটা গ্রহণযোগ্য তখনই হবে যখন সেটা মুকাবিলা করা থেকে নিরাপদ হবে অর্থাৎ সেটার মুকাবিলা করা কারও পক্ষে সম্ভব না হবে। বরং কখনও কখনও তারা অলৌকিকতাও শর্ত করেন না বরং শর্ত করেন যে এটার অনুরূপ আনার চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করা থেকে মুক্ত হতে হবে এবং সেটার বিপরীত কিছু নিয়ে আসা মানুষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠবে যদিও সেটা মানুষের মধ্যে সচরাচর ঘটে থাকে অলৌকিক নয়। সুতরাং বুঝা গেল যে, তাদের [আশায়েরা ও মাতুরিদিয়াদের] নিকট নবুওয়তের প্রমাণ তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন তা দু`টি বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হবে: নবুওয়তের দাবীর সাথে সম্পৃক্ততা এবং যাদেরকে অনুরূপ আনার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়েছে তাদের পক্ষে অনুরূপ কিছু আনতে অক্ষম হওয়া।
তারা [আশায়েরা ও মাতুরিদিয়ারা] আরও বলে থাকেন যে, নাবীদের অলৌকিক ঘটনা জাদুকর, গনক এবং নেককার বান্দাদের দ্বারা সংঘটিত হওয়া সম্ভব তবে তা তাদের নবুওয়তের উপর প্রমাণবহ হবে না কারণ তারা তো নবুওয়তের দাবী করে তা পেশ করে নি।
তারা [আশায়েরা ও মাতুরিদিয়ারা] আরও বলে থাকেন যে, কেউ এসব অলৌকিক ঘটনার সাথে নবুওয়তের মিথ্যাদাবীদার হলে আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে যায় তাকে অক্ষম করে দেওয়া এবং এ অলৌকিক কাজকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য এমন কাউকে নিয়োজিত করা যার মাধ্যমে নবুওয়তের মিথ্যাদাবীদারের দাবীর সপক্ষে পেশ করা দলীল-প্রমাণাদি বাতিল ও অসার হয়ে যাবে।
আর যখন তাদেরকে বলা হলো, আল্লাহর এমন এমন করা উচিত` কেন? অথচ তোমাদের মতে, আল্লাহর জন্য সব কাজ করা জায়েয, কোনো কাজ করা তার উপর ওয়াজিব নয়। তখন তারা বলে, কেননা আল্লাহ যদি এরূপ না করেন, বা কাউকে এর মোকাবিলা করতে নিয়োজিত না করেন তবে নাবীগণের মু`জিযা বাতিল হয়ে যাবে।
আবার যখন তাদেরকে বলা হলো, তোমাদের নীতি অনুযায়ী তো এটা বৈধ যে আল্লাহ সেটার দলিল হওয়াই বাতিল করে দিবেন; কারণ তোমাদের মতে, আল্লাহর জন্য সব কাজ করা জায়েয। তখন তারা তাদের পূর্ববর্তী দু`টি উত্তর প্রদান করে থাকে, হয় তাদেরকে এটা মেনে নিতে হয় আল্লাহ এর উপর ক্ষমতাবান নয়, নতুবা এটা বলতে হয় যে দলীল হওয়ার বিষয়টি অত্যাবশ্যকভাবে জানা বিষয়। অথচ এ উভয় উত্তরই যে দুর্বল এটা সর্বজন বিদিত।
এখানে আরেকটি বিষয় তাদের [আশায়েরা ও মাতুরিদিয়াদের] উপর এসে পড়ে, তা হচ্ছে, তোমরা কেন একথা বলো যে, নাবীগণের সত্যতা প্রমাণে পেশ করা তাদের মু`জিযাকে অবশ্যই নবুওয়তের দাবীসহকারে অলৌকিক হতে হবে এবং এর মোকাবিলা করতে অক্ষম হওয়া হতে হবে। কারণ তোমাদের এ কথাটি নিন্মোক্ত কারণে বাতিল বলে গণ্য হবে:
প্রথম কারণ: নাবী যা নিয়ে আসেন তা যদি জাদুকর ও গণকও নিয়ে আসেন তাহলে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, জাদুকর ও গণকের মুকাবিলা করা যাবে কিন্তু নাবীর মুকাবিলা করা যাবে না। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, এ ব্যাপারে [নাবী ও জাদুকর-গণকের মধ্যে] পার্থক্য নির্ণয়কারী বিষয় হচ্ছে মুকাবিলা করতে সক্ষম না হওয়া।
সুতরাং তোমরা এটা বলো যে: যে কেউ নবুওয়তের দাবী করবে এবং বলবে, আমার মু`জিযা হলো অনুরূপ দাবী কেউ করবে না তাহলে সে সত্যবাদী, অথবা কেউ এর অনুরূপ দাবী করতে সক্ষম হবে না তাহলে সে সত্যবাদী। অথবা তিনি [নাবী] স্বাভাবিক কোনো কাজই যেমন খাওয়া, পান করা ও পোশাক পরিধান করা ইত্যাদি করবেন এবং বলবেন, আমার মু`জিযা হলো অনুরূপ কাজ কেউ করবে না বা কেউ অনুরূপ কাজ করতে পারবে না, তাহলে সে সত্যবাদী। ফলে তারা এভাবে অত্যাবশ্যকীয় করে নিল। আর তারা বিবেচিত হবেন। বস্তুত আশায়েরাগণ এটা নিজেদের উপর আবশ্যকও করে নিয়েছেন এবং তারা এ কারণে [নাবীর পক্ষ থেকে দাবী করা] অস্বাভাবিক কাজ নিয়ে আসা অন্যদের থেকে অসম্ভব বলে থাকে তেমনিভাবে [নাবীর পক্ষ থেকে দাবী করা] স্বাভাবিক কাজও অন্যদের থেকে নিয়ে আসা অসম্ভব মনে করে থাকে। এর উপর ভিত্তি করে বলা যায় [আশায়েরা-মাতুরিদিয়াদের মতে] কোনো রাসূল যদি বলেন, আমার মু`জিযা হলো আমি গাধায় বা ঘোড়ায় আরোহণ করতে পারি বা এ খাদ্য খেতে পারি বা এ পোশাক পরিধান করতে পারি বা ঐ স্থানে যেতে পারি বা অনুরূপ কিছু করতে পারি কিন্তু অন্যরা এসব করতে পারে না। তাহলে এগুলো তার দাবীর সত্যতার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে ধর্তব্য হবে।
বস্তুত এভাবে বলার কোনো নির্দিষ্ট নিয়মকানুন নেই। কেননা কোনো সম্প্রদায় যা করতে পারে আর কোনো সম্প্রদায় যা করতে পারে না তা নির্দিষ্ট কোনো ছকে বাঁধা নয়। তবে এটা ঐ লোকদের দেওয়া মু`জিযার ব্যাখ্যাকে বাদ দেয় যারা মু`জিযা বলতে অলৌকিক কাজ বুঝে। [অর্থাৎ আশায়েরাদের] কেননা লৌকিক বিষয়সমূহ নানা রকম হতে পারে।
অবশ্য তারা [মু`তাযিলা ও আশায়েরাগণ] তা উল্লেখ করেছেন। তারা বলেন, প্রত্যেক জাতির জন্য তা-ই মু`জিযা হবে যা সে জাতির জন্য অলৌকিক তথা অস্বাভাবিক হবে। তারা আরও বলেন, মু`জিযাকে অবশ্যই সে লোকদের কাছে অস্বাভাবিক কাজ হিসেবে বিবেচিত হতে হবে যাদেরকে নাবী তার প্রতি ঈমানের দাওয়াত দিচ্ছেন। যদিও অন্যদের কাছে তা স্বাভাবিক মনে হতে পারে। তারা আরও বলেন, নবওয়াতের দাবীকারী যদি মিথ্যাবাদী হন তবে আল্লাহ তা`আলা সে পেশার অনুরূপ কাউকে নিয়োজিত করবেন যে তার মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন অথবা সে তাকে উক্ত মু`জিযা আনয়ন করতে বাধা দিবেন।
বস্তুত এটাই হচ্ছে দ্বিতীয় কারণ যা তাদের সে মূলনীতি অসার হওয়ার উপর প্রমাণ বহন করে যা আশায়েরা ও মু`তাযিলারা প্রণয়ন করেছিল।
তৃতীয় কারণ: `অনুরূপ কিছু দ্বারা মুকাবিলা` বলতে বুঝায়, নাবী যে দলিল নিয়ে এসেছেন তারাও অনুরূপ দলিল নিয়ে আসবেন। আর তাদের মতে, নাবীর নবুওয়তের দলিল হলো, নবুওয়তের দাবী ও অলৌকিক ঘটনা। সুতরাং তাদের এ কথা দ্বারা এটা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে যে, অনুরূপ কিছু দ্বারা মুকাবিলা করা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, নাবী ছাড়া অন্যরাও নবুওয়তের দাবী করবে ও অলৌকিক কিছু নিয়ে আসবে। তাদের এ কথার উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, [তাদের নিকট] কুরআনের অনুরূপ বা দশ কোরআনের সুরা বা অনুরূপ একটি কোরআনের সুরা আনয়ন করা নাবীর মোকাবিলা বুঝায় না। যেমন তাদের [মুকাবিলাকারীদের] কেউ নবুওয়তের দাবী করবে আর তা [অলৌকিক কর্মকাণ্ড] করতে সক্ষম হবে। তাদের এ কথা স্পষ্ট বিবেক [আকল] ও বিশুদ্ধ বর্ণনা উভয়ের বিপরীত। কারণ রাসূল যদি কুরাইশদেরকে বলতেন, তোমাদের কেউ নাবী হওয়ার দাবী করে কুরআনের অনুরূপ একটি কিতাব আনতে পারবে না, কেবল তখনই সেটা নবুওয়তের আলামত বলে বিবেচিত হবে। কেননা, [তাদের নিকট] শুধু কুরআনের তিলাওয়াত কোনো দলিল-প্রমাণ হতে পারে না; কারণ কেউ তা অন্যের থেকে শিখেও পড়তে পারে। তাই শুধু তিলাওয়াত দলিল হতে পারে না। কেননা সেটার সাথে নবুওয়তের দাবী সংশ্লিষ্ট করা হয় নি। আর যদি সে নবুওয়তের দাবী করেও ফেলত তবে আল্লাহ তাকে অলৌকিক কিছু করতে ভুলিয়ে দিতেন বা অন্য কাউকে নিয়োজিত করতেন যিনি সেটার মুকাবিলা করতে পারে- যেমনটি তোমরা বলে থাকো, তাহলে কুরাইশ ও অন্যান্য আলেমরা জানত যে এটা একটা বাতিল কথা।
চতুর্থ কারণ: কখনো কখনো মিথ্যাবাদীরা নবুওয়তের দাবী করতে পারে এবং তারা জাদু ও গণনার সাহায্যে এমন কিছু নিদর্শন পেশ করতে পারে যার মোকাবিলা কেউ করতে সক্ষম হয় না। অথচ তারা আসলেই মিথ্যাবাদী। এক্ষেত্রে মু`তাযিলাদের দাবী অসার প্রমাণিত হলো। যেমন, ইয়ামেনের আসাদ আল-উনসী রাঃসাঃ এর জীবদ্দশায় নবুওয়তের দাবী করেছিল, সে শয়তানের সাহায্যে কিছু গায়েবের সংবাদও দিয়েছিল, কেউ তার মোকাবিলা করেননি। তার মিথ্যাচার নানা ভাবে জানা গেছে। আল্লাহ বলেন,
`আমি কি তোমাদেরকে সংবাদ দেব, কার নিকট শয়তানরা অবতীর্ণ হয়`? তারা অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক চরম মিথ্যাবাদী ও পাপীর নিকট। [কোরআনের সুরা আশ-শু`আরা: ২২১-২২২]
এমনিভাবে মুসাইলামাতুল কাযযাব, হারিস আল-দামেশকী, মাকহুল আল-হালাবী, বাবা রূমী-আল্লাহ এদের উপর লানত বর্ষণ করুন- এরা সকলেই নবুওয়তের মিথ্যাদাবীদার এবং শয়তানের সাহায্যে কিছু অলৌকিক সংবাদও দিত।
পঞ্চম কারণ: বস্তুত নাবীগণের আলামতের শর্ত এটা নয় যে, এটা দ্বারা নাবী দলিল পেশ করবে এবং এর অনুরূপ কিছু আনতে চ্যালেঞ্জ করবে। বরং এটা নাবীর নবুওয়তের আলামত, যদিও এটা উক্ত দু`শর্ত থেকে খালি থাকে। যেমন, রাঃসাঃ পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে নানা সংবাদ দিয়েছেন, কিন্তু এটা দ্বারা তিনি তার নবুওয়তের দলিল পেশ করেননি। এমনিভাবে আল্লাহ রাঃসাঃ এর দ্বারা অনেক মু`জিযা সংঘটিত করিয়েছেন, যেমন অল্প খাবার ও পানীয় বেশি হওয়া, দু`আঙ্গুলের মাঝ থেকে পানি বের হওয়া, সামান্য খাদ্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সকলের অন্য যথেষ্ট হওয়া ইত্যাদি রাঃসাঃ এর নবুওয়তের প্রমাণ ছিল, কিন্তু তিনি এগুলো দ্বারা দলিল পেশ করেনি এবং এর অনুরূপ কেউ মোকাবিলাও করেননি। বরং এটা মুসলমানের প্রয়োজনে ছিল। এমনিভাবে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নবুওয়ত প্রাপ্তির পরে অগ্নিতে নিক্ষেপিত হয়েছিল এবং এটা দ্বারা তিনি মানুষকে তাওহীদের দিকে আহ্বান করেছিলেন।
ষষ্ঠ কারণ: মু`তাযিলা ও অন্যান্যরা যেমন ইবনু হাযম রহ. যা উল্লেখ করেছেন যে, নাবীগণের আলামত তাদের জন্যই খাস হতে হবে এটা সহীহ কথা। কিন্তু অলীদের কারামতও দালায়েলুন নুবুওয়াহ, যা সত্যিকার নাবীর অনুসারী ছাড়া অন্যদের কাছে পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে জাদুকর ও গণকরা যে সব আশ্চর্যকর জিনিস নিয়ে আসে তা নাবী ও তাদের অনুসারী ছাড়া অন্যদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার মাত্র। বরং এটা মিথ্যা ও পাপাচারের অন্তর্ভুক্ত। এটা ঐ পেশার মানুষ ছাড়া অন্যদের কাছে অস্বাভাবিক ব্যাপার মনে হয়। প্রত্যেক শিল্পই অন্যান্য অদক্ষ লোকের নিকট একটু অস্বাভাবিক ব্যাপারই মনে হয়। কিন্তু এটা নবুওয়তের আলামত হতে পারে না। নাবীগণের আলামত নাবী ছাড়া অন্য সকলের কাছেই অলৌকিক ব্যাপার, যদিও নাবীগণের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার মাত্র।
সপ্তম কারণ: নাবীগণের আলামত তিনি যাদের কাছে প্রেরিত তাদের কাছে অস্বাভাবিক হতে হবে, তারা হলেন মানুষ ও জিন। তাই মানুষ ও জিন কেউ নাবীর আলামতের মত আলামত আনতে পারবে না। যেমন আল্লাহ বলিয়াছেন,
“বলুন, `যদি মানুষ ও জিন এ কুরআনের অনুরূপ হাযির করার জন্য একত্রিত হয়, তবুও তারা এর অনুরূপ হাযির করতে পারবে না যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয়“। [কোরআনের সুরা আল-ইসরা: ৮৮]
অন্যদিকে ফিরিশতারা এর মোকাবিলা করতে সক্ষম হলে এতে কোনো অসুবিধে নেই। কেননা ফিরিশতারা নাবীগণের উপর আল্লাহর আয়াত নাযিল করেন। তারা জাদুকর ও গণকের কাছে নাযিল হন না, যেমনিভাবে শয়তান নাবীগণের কাছে নাযিল হয় না। ফিরিশতারা আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যারোপ করেন না। ফিরিশতাদের কাজ যেমন, আল্লাহর পক্ষ থেকে নাবীর কাছে গায়েবের সংবাদ বহন করে নিয়ে আসা, শত্রুর উপর বিজয় লাভ করা, তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া ইত্যাদি নাবীগণের স্বাভাবিক কাজের বহির্ভূত। বরং এগুলো নাবী ছাড়া অন্যদের দ্বারা সম্ভব নয়। এতে উক্ত কাজটি নকস কমতি হয়ে যায় না। বরং কাজটি অলৌকিকই থেকে যায়। [9]
আল-কুরআন রাঃসাঃ এর উপর অবতীর্ণ হওয়া থেকে সর্বযুগেই রাঃসাঃ এর চিরন্তন মু`জিযা, এর আয়াতসমূহ সকলের জন্যই চ্যালেঞ্জ। যেমন আল্লাহ বলিয়াছেন,
“অতএব, তারা যদি সত্যবাদী হয় তবে তার অনুরূপ বাণী নিয়ে আসুক”। [কোরআনের সুরা আত্-তূর: ৩৪]
আল্লাহ আরো বলিয়াছেন,
“নাকি তারা বলে, `সে এটা রটনা করেছে`? বল, `তাহলে তোমরা এর অনুরূপ দশটি কোরআনের সুরা বানিয়ে নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পার ডেকে আন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও”। [কোরআনের সুরা: হূদ: ১৩]
আল্লাহ আরো বলিয়াছেন,
“নাকি তারা বলে, `সে তা বানিয়েছে`? বল, `তবে তোমরা তার মত একটি কোরআনের সুরা [বানিয়ে] নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পারো ডাক, যদি তোমরা সত্যবাদী হও”। [কোরআনের সুরা ইউনুস: ৩৮]
আল্লাহ আরো বলিয়াছেন,
“বলুন, `যদি মানুষ ও জিন এ কুরআনের অনুরূপ হাযির করার জন্য একত্রিত হয়, তবুও তারা এর অনুরূপ হাযির করতে পারবে না যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয়“। [কোরআনের সুরা আল-ইসরা: ৮৮]
রাঃসাঃ শুরুতে তাদেরকে এ সংবাদ দিয়েছেন। জিন ও ইনসান কেউ এর মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়নি। তারা সকলেই অক্ষম হয়েছিল। তাই এরূপ হওয়া নাবী ছাড়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কালের পরিক্রমায় আরব অনারব, কুরআনের পক্ষের ও বিরোধী বহু জাতি কুরআনের অনুরূপ কিছু আনায়ন করতে আপ্রান চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পরিশেষে তারা ব্যর্থ হয়েছে। একথা সকলেই জানে।
একথা সকলেই জানে যে, কুরআনের আয়াত, ছন্দমালা, গায়েব সম্পর্কে সংবাদ, এর আদেশ, নিষেধ, ধমক, ওয়াদা, মহৎ, মানুষের অন্তরে এর স্থান ইত্যাদি মু`জিযা। কুরআন যখন অন্য ভষায় অনুবাদ করা হয় তখন এর অর্থ মু`জিযা হিসেবে থাকে। কেননা এর অনুরূপ কিছু পৃথিবীতে পাওয়া যায় না।
যখন বলা হবে, তাওরাত, ইঞ্জিল ও যাবুরেরও তো অনুরূপ কোনো গ্রন্থ পৃথিবীতে নেই, তখন আমরা বলব, অন্যান্য নাবীগণের মু`জিযা তাদের জন্যই খাস, যদিও একই ধরণের মু`জিযা পাওয়া যায়। যেমন, গায়েব সম্পর্কে সংবাদ দেওয়া, এগুলো উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। এছাড়াও মৃত্যু ব্যক্তিকে জীবিত করা অনেক নাবীরই মু`জিযা ছিল। যেমন মূসা ও ঈসা আলাইহিস সালাম এটা করেছেন।
এখানে এক নাবীকে অন্য নাবীর উপর প্রধান্য দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়, বরং আমাদের উদ্দেশ্য হলো এক এক নাবী তার মু`জিযা নিয়ে অন্যদের থেকে আলাদা ও বৈশিষ্ট্যময় ছিলেন। তাদের এ সব আলামত নাবী ছাড়া অন্যদের মাঝে ছিল না। তবে একই ধরণের আলামত যদি একাধিক নাবীর মাঝে পাওয়া যায় তবে তা আরো মজবুত করে এবং একথা জোরদার করে যে এগুলো শুধু নাবীগণের মু`জিযা। কেননা এক নাবী অন্য নাবীকে সত্যায়ন করে। এক নাবীর মুজিযা সমস্ত নাবীগণেরই মুজিযার শামিল। এমনিভাবে তাদের অনুসারীদের আলামতও তাদেরই মুজিযা। কেননা তারা একে অন্যের সত্যায়ন করেন। অতএব, জাদুকর, গণক ইত্যাদি লোকের অলৌকিকতা একে অন্যের বিরোধিতা করে।
মুহাম্মদ রাঃসাঃ যা নিয়ে এসেছেন তা তাহাঁর নবুওয়তের প্রমাণ এবং সেগুলো সাধারণভাবে সকল নাবীগণেরও নবুওয়তের প্রমাণ, বিশেষ করে কুরআনে যেসব নাবীর নাম উল্লেখ আছে এবং মুহাম্মদ রাঃসাঃ আল্লাহর পক্ষ থেকে যাদের সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন। অতএব, যখন ধরে নেওয়া হবে যে, তাওরাত, ইঞ্জিল ও যাবুরে যেসব ইলম, গায়েবের সংবাদ, আদেশ, নিষেধ ইত্যাদি রয়েছে এগুলো মুজিযা এতে কোনো অসুবিধে নেই, বরং এটা সেসব নাবীগণের নবুওয়তের প্রমাণ এবং তাদের নবুওয়তের প্রমাণ যাদের সম্পর্কে এসব কিতাব সুসংবাদ দিয়েছে। আর যারা বলেন, এসব কিতাব মুজিযা নয়, তাহলে হয়তো কুরআনের মত শব্দ, ছন্দ ইত্যাদি হিসেবে মুজিযা নয় বলে ধরা হবে। এটা মূলত ভাষাবিদ ও ইবরানী ভাষা বিশেষজ্ঞদের ব্যাপার।
অন্যদিকে অর্থের বিচারে তাওরাত মু`জিযা, কেননা এতে গায়েবের সংবাদ, আদেশ, নিষেধ রয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এতে প্রমাণিত হয় যে, সব নাবীগণের কিতাবসমূহ মুজিযা, কেননা এতে মুহাম্মদ রাঃসাঃ এর আগমনের সুসংবাদ ছিল। তবে একথা গণকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না, কেননা তারা রাঃসাঃ এর আগমনের কিছুদিন পূর্বে শয়তানের মাধ্যমে তাহাঁর আগমনের সংবাদ দিয়েছিল। এমনিভাবে কোনো কিতাবের দ্বিতীয় নাবী যদি প্রথম নাবীর কিতাবের মধ্যে যা আছে তার সংবাদ দেন তবে তা মু`জিযা হিসেবে গণ্য হবে না। কেননা এভাবে আলেমগণ করতে পারেন। তবে দ্বিতীয় নাবী যদি প্রথম নাবীর চেয়ে অতিরিক্ত কোনো সংবাদ দেন তবে তা মুজিযা হিসেবে গণ্য হবে। যেমন আশ`য়াআ ও দাউদ আলাইহিস সালামের কিতাব, এতে মূসা আলাইহিস সালামের তাওতের চেয়ে অতিরিক্ত কিছু সংবাদ ছিল। তাই এ কিতাব উক্ত নাবীগণের মু`জিযা, কেননা এতে গায়েবের এমন কিছু সংবাদ ছিল যা নাবী ছাড়া কেউ জানতেন না। এমনিভাবে এতে আদেশ, নিষেধ, অঙ্গিকার ও ধমক ছিল, যা নাবী ছাড়া অন্য কেউ আনায়ন করতে পারেন না, বা নাবীর অনুসারী ছাড়া কেউ আনায়ন করতে পারেন না। নাবীর অনুসারী নাবীর আদেশের মতই আদেশ নিষেধ, ওয়াদা ও ধমক দিয়ে থাকবেন, এগুলো মূলত নাবীরই বৈশিষ্ট্য। তবে মিথ্যাবাদী নাবীর দাবীদার নাবীর আদেশ নিষেধের মত সব কিছু আদেশ নিষেধ করবে না। কেননা এতে তার উদ্দেশ্য সাধিত হবে না।
এসব মিথ্যাবাদীরা নাবীগণের মত আদেশ নিষেধ করার কল্পনাও করতে পারবে না। কেননা এভাবে করা তাদের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী, বরং যদিও প্রাথমিক দিকে কিছু কিছু ভাল কাজের আদেশ দিয়ে থাকে তবে তা মানুষকে ধোঁকা ও প্রতারণা করার মানসে করে থাকে। অবশেষে তাদের কাজের মধ্যে বৈপরীত্য দেখা দিবেই। কেউ প্রকাশ্যভাবে নাবীর সাদৃশ কাজ করলেও অভ্যন্তরে আসলে সে মুনাফিক, যেমন কিছু নাস্তিক যারা প্রকাশ্যে ইসলাম দেখিয়েছে কিন্তু অন্তরে শির্ক, পাপাচার ও জুলুম পোষণ করেছিল। তারা নামায, সাওম ও শরী`য়াতের অন্যান্য আদেশ সঠিকভাবে পালন করত না। যারা প্রকাশ্যে ইসলাম দেখায় ও গোপনে নাস্তিকতা ও কুফুরী পোষণ করে তাদের কথা ও কাজে বৈপরীত্য দেখা দিবেই।
নাবীগণের সত্যতার উপর প্রমাণবাহী নিদর্শনসমূহ
আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি যে, নাবীগণের সত্যতার উপর প্রমাণবাহী নিদর্শনসমূহের সংখ্যা অনেক। একজন সত্যবাদী নাবী সর্বোত্তম মানুষ, আর আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যাবাদী একজন ভণ্ড সর্বনিকৃষ্ট মানুষ। এদু`য়ের মাঝে এতো বিস্তর পার্থক্য রয়েছে যে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ গণনা করে শেষ করতে পারবে না। সুতরাং নাবীগণের সততার নিদর্শন কিভাবে অন্যান্য জাদুকর ও গণকদের নিদর্শনের সাথে সন্দেহে নিক্ষেপ করবে? আর তাই জাদুকর ও গণকদের মিথ্যা হওয়ার প্রমাণসমূহ এতই অগণিত অসংখ্য যে তা বলে শেষ করা যাবে না। সুতরাং যে কেউ নাবীদের সত্যবাদিতার প্রমাণ কোনো সংখ্যায় নির্ধারণ করবে সে অবশ্যই ভুল করবে। বরং নাবীগণের সত্যতার নিদর্শনসমূহ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা`আলার এমন নিদর্শন যা তাহাঁর আদেশ, নিষেধ, অঙ্গিকার ও ধমক ইত্যাদির উপর প্রমাণ বহন করে। আর আল্লাহ তা`আলার নিদর্শনসমূহ অসংখ্য ও নানা ধরণের, যেমন আল্লাহর অস্তিত্ব, এককত্ব, [ওয়াহদানিয়াত], ইলম, কুদরত, হিকমত ও রহমতের উপর প্রমাণবাহী নিদর্শনসমূহ।
আল-কুরআন আল্লাহর নিদর্শন, এর উদাহরণে ভরপুর। কুরআন সেগুলোকে আয়াত তথা নিদর্শন ও বুরহান তথা দলিল নামে নামকরণ করেছে। …
বস্তুত: জাদুকর, গণক, অসৎ লোক ও নাবীর অনুসারী ছাড়া অন্যান্যরা যেসব আশ্চর্যকর জিনিস নিয়ে আসে তা জিন ও ইনসানের সাধ্যের বাইরে নয়। মানুষ যা করতে পারে তা জিনের সাধ্যের মধ্যে আবার জিন যা করে তা মানুষের সাধ্যের বাইরে নয়। পার্থক্য শুধু পদ্ধতিগত। যেমন একজন জাদুকর জাদুর সাহায্যে কাউকে হত্যা করা, কাউকে অসুস্থ করা, কারো জ্ঞান শূন্য করে দেওয়া বা কারো চলাফেরা বা কথা বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি। এসব কিছুই মানুষের সাধ্যের মধ্যে, অন্য মানুষও এগুলো করতে পারে, তবে অন্য পন্থায় করতে সক্ষম হয়। জিনেরা হাওয়া ও পানিতে ভাসতে পারে এবং অনেক ভারী জিনিস বহন করে নিয়ে আসতে পারে যেমনটি সুলাইমান আলাইহিস সালামের জন্য ইফরিত জিন করেছিল।
“এক শক্তিশালী জিন বলল, `আপনি আপনার স্থান থেকে উঠার পূর্বেই আমি তা এনে দেব। আমি নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে শক্তিমান, বিশ্বস্ত”। [কোরআনের সুরা আন্-নামাল: ৩৯]
এ ধরণের কাজ অন্য জিন ও মানুষ করতে পারে। এজন্যই এ ধরণের কাজ নাবীর মু`জিযা হতে পারে না। অনেক মানুষই জিন হাসিল করে বাতাসে উড়ে, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়। যেমন ইফরিত বিলকিসের সিংহাসন ইয়ামেন থেকে অনেক দূরে নিয়ে যেতো।
আমরা ঐ সব ভণ্ডদের কথা জানি যারা আল্লাহর নেককার বান্দাহ নয় বরং তাদের মধ্যে কাফির, মুনাফিক, ফাসিক ও অজ্ঞ লোক রয়েছে যারা শরি`য়াতের কিছুই জানে না, শয়তান তাদেরকে উড়িয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যায়, তাদেরকে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে যায়, ফলে তারা ইহরাম ও তালবিয়্যাহ ছাড়াই আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হয়। আর এসব কাজ করা হারাম।
অজ্ঞলোকেরা মনে করেন এগুলো অলীদের কারামত। তারা জিন হাসিল করে এসব কাজ করে অজ্ঞলোকদেরকে ধোঁকা দেয়, যদিও তাদের অনেক অধ্যবসায় ও ইবাদত বন্দেগী রয়েছে। এমনিভাবে জিনেরা মানুষের কাছে অন্যের সম্পদ চুরি করে নিয়ে আসে, যেমনিভাবে মানুষ মানুষের সম্পদ চুরি করে, তবে জিনেরা অচেনা স্থান থেকে খাদ্য, পানীয় নিয়ে আসতে পারে। এজন্যই এধরণের কাজ নাবীর সত্যতার নিদর্শন হতে পারে না। নাবী রাঃসাঃ পানির মধ্যে হাত দিলে তাহাঁর আঙ্গুলের মধ্য দিয়ে পানি নির্গত হয়েছিল, এটা তাহাঁর নবুওয়তের সত্যতার নিদর্শন ছিল। এ ধরণের কাজ জিন ইনসান কেউ করতে সক্ষম হয়নি। এমনিভাবে সামান্য খাবার বেশি হয়ে যাওয়া, এ কাজও মানুষ ও জিন কেউ করতে সক্ষম নয়। নাবী রাঃসাঃ গায়েব থেকে কখনও খাদ্য ও পানীয় নিয়ে আসেননি। রাঃসাঃ এর সাহাবী খুবাইব ইবনু আদী রাদি. `আনহুর সাথে এ ধরণের ঘটনা ঘটেছিল, যখন তাকে মক্কায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল তখন তিনি আঙ্গুর প্রাপ্ত হয়েছিলেন। সুতরাং এধরণের কাজ নাবীগণের বৈশিষ্ট্য নয়। যেমন, মারইয়াম আলাইহিস সালাম যদিও নাবী ছিলেন না কিন্তু তাহাঁর জন্য খাবার নিয়ে আসা হতো। যদি তা হালাল খাদ্য থেকে নিয়ে আসা হতো তবে তা কারামত হিসেবে হয়ত কোনো ফিরিশতা বা মুসলিম জিন তা নিয়ে আসত। আবার কখনও তা হারাম খাদ্য থেকেও আসতে পারে। তাই নাবীগণের সব আলামত অলীদের কারামত হতে পারে না। কিন্তু মু`তাযিলা, আশায়েরা ও মাতুরিদিয়ারা এখানে দু`টির মধ্যে পার্থক্য না করে সমান করে দিয়েছে। তারা বলিয়াছেন, নাবীর নিদর্শন ও অন্যান্যদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে পার্থক্য হলো তিনি নবুওয়তের দাবীদার হবেন এবং অনুরূপ আনতে চ্যালেঞ্জ করবেন। এটা মারাত্মক ভুল। কারণ নাবীগণের নবুওয়তের প্রমাণ করে এমন নিদর্শনসমূহ সেসব বিষয় থেকে উর্ধ্বে যাতে নাবী ও তাদের অনুসারীরা অংশীদার। যেমন: কুরআনের অনুরূপ কুরআন নিয়ে আসা, পূর্ববর্তী নাবী ও তাদের উম্মতের সংবাদ দেওয়া, কিয়ামতের দিন যা হবে সে সম্পর্কে সংবাদ দেওয়া, কিয়ামতের আলামত, যমীন থেকে উষ্ট্রী বের করা, লাঠি সাপে পরিণত হওয়া, সমুদ্র দু`ভাগ হয়ে যাওয়া, মাটি দ্বারা পাখি তৈরি করে তা আল্লাহর আদেশে ফুঁৎকার দিয়ে জীবন্ত পাখি সৃষ্টি হওয়া, সুলাইমান আলাইহিস সালাম কর্তৃক জিনদের উপর কর্তৃত্ব বিস্তার ইত্যাদি নাবী ছাড়া অন্যদের মধ্যে ছিল না।
কিন্তু মু`মিন জিন মু`মিনদেরকে সাহায্য করে থাকে এবং কাফির, ফাসিক জিন খারাপ কাজে তাদেরকে সাহায্য করে, যেমনিভাবে মানুষ মানুষকে ভাল ও খারাপ কাজে সাহায্য করে। কিন্তু জিনদের এমন আনুগত্য যা সুলাইমান আলাইহিস সালামের জন্য ছিল তা তিনি ছাড়া অন্য কারোর জন্য ছিল না। মুহাম্মদ রাঃসাঃকে সুলাইমান আলাইহিস সালামকে যা দেওয়া হয়েছে তাহাঁর চেয়েও অধিক দান করা হয়েছে। তিনি জিনদেরকে তাদের সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছিলেন, তাদেরকে আদেশ করেছেন আল্লাহর উপর ঈমান আনতে ও তাহাঁর আনুগত্য করতে। তিনি রাঃসাঃ জিনদেরকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান করেছেন, নিজের কোনো প্রয়োজন বা খিদমতে তাদেরকে কাজে লাগান নি, যেমনটি করেছিলেন নাবী সুলাইমান আলাইহিস সালাম। তিনি রাঃসাঃ তাদেরকে শক্তি দ্বারা জোর করেন নি, যেমনটি সুলাইমান আলাইহিস সালাম জিনদের সাথে করেছিলেন। বরং তিনি রাঃসাঃ জিনদের সাথে মানুষের আচরণের মতই আচরণ করেছিলেন। ফলে মু`মিন জিনেরা রাঃসাঃ এর সাথে জিহাদে শরিক হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে তিনি আল্লাহর বিধানের শাস্তির ব্যবস্থাও করেছিলেন। ফলে তিনি তাদের সাথে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল সুলভ আচরণ করেছিলেন, নাবী ও বাদশাহ সুলভ আচরণ করেন নি, যেমনটি নাবী সুলাইমান আলাইহিস সালাম করেছিলেন। রাঃসাঃ এর সালেহীন উম্মতেরাও তাহাঁরই অনুসরণ করে, তিনি যেভাবে জিন ও ইনসানকে আদেশ দিয়েছেন তারাও সেভাবেই করে থাকেন। তবে কিছু লোকেরা এর বিপরীতও আছেন, যারা কিছু জিনকে হালাল কাজে ব্যবহার করেন, যেমন তারা মানুষকে ব্যবহার করেন। এতে করে এ ধরণের লোকদের দীনদারীতার কমতি দেখা দেয়, বিশেষ করে তারা যখন জিনদেরকে অবৈধ কাজে ব্যবহার করেন। আবার কিছু লোক এর চেয়েও খারাপ, তারা জিনদেরকে জুলুম নির্যাতন, অশ্লীল ইত্যাদি হারাম কাজে ব্যবহার করেন। ফলে তারা অন্যায়ভাবে মানুষকে হত্যা করেন এবং অশ্লীল কাজে জিনদের সাহায্য নেয়, যেমন তারা তাদের জন্য নারী বা শিশু হাজির করান বা তাদের চাহিদার জিনিস হাজির করান। আবার আরেকদল তাদেরকে কুফুরী কাজেও ব্যবহার করেন। এ ধরণের কাজ অলীদের কারামত হতে পারে না। কেননা সালেহীনদের কারামত ঈমান ও আল্লাহর তাকওয়ার কারণে হয়ে থাকে, কুফুরী, ফাসেকী ও অবাধ্যতার কারণে নয়। তাছাড়া পূর্ববর্তী সালেহীনগণ আল্লাহ ও তাহাঁর রাসূলের আনুগত্য ছাড়া অন্য কাজে জিনদেরকে ব্যবহার করেন নি। তাদের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের যারা তাদের কেউ কেউ বৈধ কাজে জিনদেরকে ব্যবহার করেছেন। অন্যদিকে জিনদেরকে হারাম কাজে ব্যবহার করা হারাম। তাদেরকে অবৈধ কাজে ব্যবহার করলে ব্যক্তি গুনাহগার হবেন।
এদের অনেকের থেকেই এ নি`আমত উঠিয়ে নিয়ে নেওয়া হয়, অতঃপর তাদের আনুগত্যও উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, ফলে ব্যক্তি ফাসিক হয়ে যায়, অনেক সময় দীন ইসলাম থেকে দূরে সরেও যায় অর্থাৎ মুরতাদ হয়ে যায়। মানুষের আনুগত্যের চেয়ে জিনের আনুগত্য অবশ্যই উত্তম নয়। বরং মানুষ বেশি সম্মানিত, মর্যাদাবান ও উত্তম, তাদের আনুগত্যও বেশি উপকারী ও ফায়েদাবান। মানুষ যখন আল্লাহর আনুগত্য করে তখন সে প্রশংসিত ও সাওয়াবের অধিকারী হয়, আর যখন আল্লাহর অবাধ্য হয় তখন সে নিন্দনীয় ও গুনাহগার হয়।
এমনিভাবে জিনদের আনুগত্য, যারা মানুষের আনুগত্য করে তারা হয়ত ভাল ও দীনের কাজে সহযোগিতা ও আনুগত্য করবে বা মন্দ ও অসৎ কাজে সহযোগিতা ও আনুগত্য করবে। তারা যদি ভাল কাজে আনুগত্য করে তবে তারাও প্রশংসিত ও সাওয়াবের অধিকারী হবেন, আর মন্দ ও খারাপ কাজে সহযোগিতা ও আনুগত্য করলে নিন্দনীয় ও গুনাহের অধিকারী হবেন। জিনদের উপর কেউ জুলুম করলে অনেক সময় তারা সে ব্যক্তিকে হত্যা করে ফেলে। এ সব কিছু আমরা বাস্তবতা থেকে জানি, তাই এখানে বেশি দীর্ঘ করার প্রয়োজন নেই। নাবীগণের আলামত এ ধরণের হতে পারে না।
আমাদের নাবী মুহাম্মদ রাঃসাঃকে যখন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত রাতে ভ্রমণ করানো হয়েছিল তা তাহাঁর রবের নিদর্শন দেখানোর উদ্দেশ্যে ছিল। এটা তাহাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল। আল্লাহ বলিয়াছেন,
“সে যা দেখেছে, সে সম্পর্কে তোমরা কি তার সাথে বিতর্ক করবে? আর সে তো তাকে আরেকবার দেখেছিল। সিদরাতুল মুনতাহার নিকট। যার কাছে জান্নাতুল মা`ওয়া অবস্থিত”। [কোরআনের সুরা আন্-নাজম: ১২-১৫]
আল্লাহ তা`আলা আরো বলিয়াছেন,
“আর যে `দৃশ্য` আমি তোমাকে দেখিয়েছি তা এবং কুরআনে বর্ণিত অভিশপ্ত বৃক্ষ কেবল মানুষের পরীক্ষাস্বরূপ নির্ধারণ করেছি”। [কোরআনের সুরা আল-ইসরা: ৬০]
ইবনু আব্বাস রাদি. `আনহু বলেন, মিরাজের রাতে রাসূলুল্লাল্লাহ রাঃসাঃকে যেসব নিদর্শন দেখানো হয়েছিল সেসব দৃশ্যই এখানে উদ্দেশ্য। এটা ছিল রাঃসাঃ এর বৈশিষ্ট্য ও তাহাঁর নবুওয়তের নিদর্শন। নতুবা শুধু দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা জিনদের মাধ্যমে যারা কাজ আদায় করা তাদের দ্বারাও হাসিল হতে পারে। কারণ ইফরিত জিন সুলাইমান আলাইহিস সালামকে বলেছিল,
“এক শক্তিশালী জিন বলল, `আপনি আপনার স্থান থেকে উঠার পূর্বেই আমি তা এনে দেব। আমি নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে শক্তিমান, বিশ্বস্ত”। [কোরআনের সুরা আন্-নামাল: ৩৯] ইয়ামেনের রাজপ্রসাদ থেকে রানীর সিংহাসন শামে নিয়ে আসা মসজিদুল হারাম থেকে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করার চেয়ে কঠিন কাজ। আর
“যার কাছে কিতাবের এক বিশেষ জ্ঞান ছিল সে বলল, `আমি চোখের পলক পড়ার পূর্বেই তা আপনার কাছে নিয়ে আসব`। অতঃপর যখন সুলাইমান তা তার সামনে স্থির দেখতে পেল, তখন বলল, `এটি আমার রবের অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করেন যে, আমি কি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি না কি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আর যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে তো তার নিজের কল্যাণেই তা করে, আর যে কেউ অকৃতজ্ঞ হবে, তবে নিশ্চয় আমার রব অভাবমুক্ত, অধিক দাতা”। [কোরআনের সুরা আন্-নামাল: ৪০] মসজিদুল হারাম থেকে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করার চেয়ে জিনের এ কাজটি অধিক কঠিন ছিল। [সুতরাং বুঝা গেল যে, শুধু মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসায় ভ্রমন নয় বরং সেখানে ও তৎপরবর্তী বিভিন্ন নিদর্শন দেখাই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু `আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তের প্রমাণ]
যার কাছে কিতাবের এক বিশেষ জ্ঞান ছিল সে ও সুলাইমান আলাইহিস সালামের চেয়ে মুহাম্মদ রাঃসাঃ শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাবান। আর তাই বলা যায় যে, আল্লাহ তা`আলা মুহাম্মদ রাঃসাঃকে যেসব জিনিস দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন তা ঐ সব নেয়ামতের চেয়ে উত্তম। আর তা হলো আল্লাহ তাকে মিরাজের রাতে আল্লাহর নিদর্শন দেখাতে সফর করিয়েছেন। সুতরাং রাসূলের বিশেষত্ব তো এই যে ইসরা ও মিরাজ ছিল তাঁকে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের কিছু নিদর্শন দেখানো। যেমনিভাবে তিনি জিবরীলকে অন্যবার দেখেছেন, সিদরাতুল মুন্তাহার নিকটে, যার কাছে রয়েছে জান্নাতুল মাওয়া, যখন সে গাছটিকে ঢেকে রাখে যা ঢেকে রাখার, তাহাঁর দৃষ্টি বিভ্রমও হয়নি এবং সীমালঙ্ঘনও করে নি।
আর এটি অর্থাৎ উক্তত নিদর্শনসমূহ দেখা সুলাইমান আলাইহিস সালাম ও অন্য কারো অর্জিত হয়নি। জিনেরা যদিও মানুষকে বাতাসে উড়াতে পারে তবে তারা আসমানে আরোহণ করতে পারে না এবং রবের নিদর্শন অবলোকন করতে পারে না। তাই মুহাম্মদ রাঃসাঃকে যা দান করা হয়েছে তা মানুষ ও জিনের ক্ষমতার বাইরে। মিরাজের রজনীতে জিবরীল আলাইহিস সাআলামকে রাঃসাঃ এর সাথী করা হয়েছিল, কেননা আল্লাহ তাকে তাহাঁর রিসালা মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য নির্বাচিত করেছেন, আর আল্লাহ ফিরিশতা ও মানুষের মধ্য থেকে রাসূল নির্বাচিত করেন। ইসরার উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর বড় বড় নিদর্শন অবলোকন করা ও তা মানুষকে সংবাদ দেওয়া।
রাঃসাঃ যখন মানুষকে এ সংবাদ দিয়েছেন তখন মুশরিকেরা মিথ্যারোপ করল আর আবু বকর সিদ্দিক রাদি. আনহু ও অন্যান্য মু`মিনেরা বিশ্বাস করল। এটা মানুষের জন্য পরীক্ষা ছিল। আল্লাহ বলিয়াছেন,
“আর যে `দৃশ্য` আমি তোমাকে দেখিয়েছি তা এবং কুরআনে বর্ণিত অভিশপ্ত বৃক্ষ কেবল মানুষের পরীক্ষাস্বরূপ নির্ধারণ করেছি”। [কোরআনের সুরা আল-ইসরা: ৬০] অর্থাৎ বিপদ ও পরীক্ষা হিসেবে মানুষের জন্য নির্ধারণ করেছি যাতে করে তাদের মধ্যকার কাফের ও ঈমানদারের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ তা`আলা আরো বলিয়াছেন,
“আর স্মরণ কর, যখন আমি তোমাকে বলিলাম, `নিশ্চয় তোমার রব মানুষকে ঘিরে রেখেছেন। আর যে `দৃশ্য` আমি তোমাকে দেখিয়েছি তা এবং কুরআনে বর্ণিত অভিশপ্ত বৃক্ষ[10] কেবল মানুষের পরীক্ষাস্বরূপ নির্ধারণ করেছি`। আমি তাদের ভয় দেখাই; কিন্তু তা কেবল তাদের চরম অবাধ্যতা বাড়িয়ে দেয়”। [কোরআনের সুরা আল-ইসরা: ৬০]
রাঃসাঃ যখন মানুষকে ইসরার সংবাদ দেন তখন তারা তা অস্বীকার করেছিল, কিন্তু যখন তারা মসজিদুল আকসার বর্ণনা জিজ্ঞাসা করেছে তখন রাঃসাঃ তাদেরকে বর্ণনা করেছেন। তারা জানত যে, তিনি মসজিদুল আকসা কখনও দেখেনি, তাই তিনি যখন তার বর্ণনা দিলেন তখন তাদের মধ্যে যারা মসজিদুল আকসা দেখেছে তারা তাঁকে বিশ্বাস করেছিল। এভাবে রাঃসাঃ এর ইসরার দলিল প্রমাণিত হয়েছে। ফলে তারা আর মিথ্যারোপ করতে পারেনি।
আর এটা উল্লেখ করা হয় যে, তিনি তাহাঁর রবের বড় বড় নিদর্শন দেখেছেন। তিনি জিবরীল আলাইহিস সালামকে স্বচক্ষে তাহাঁর আসলী সূরতে দেখেছেন। কেননা জিবরীল আলাইহিস সালামের দর্শন রাঃসাঃ এর নবুওয়তের পূর্ণতা ছিল, এতে স্পষ্ট হয়েছে যে, যে ব্যক্তি তাহাঁর কাছে কুরআন নিয়ে আসেন তিনি একজন ফিরিশতা, সে শয়তান নয়। যেমন আল্লাহ বলিয়াছেন,
“নিশ্চয় এ কুরআন সম্মানিত রাসূলের[11] আনিত বাণী। যে শক্তিশালী, আরশের মালিকের নিকট মর্যাদাসম্পন্ন। মান্যবর, সেখানে সে বিশ্বস্ত”। [কোরআনের সুরা আত্-তাকওয়ীর: ১৯-২১]
“আর তোমাদের সাথী [12] পাগল নয়। আর সে [13] তাকে [14] সুস্পষ্ট দিগন্তে দেখেছে। আর সে তো গায়েব সম্পর্কে কৃপণ নয়। আর তা কোনো অভিশপ্ত শয়তানের উক্তি নয়। সুতরাং তোমরা কোথায় যাচ্ছ? এটাতো সৃষ্টিকুলের জন্য উপদেশমাত্র”। [কোরআনের সুরা আত্-তাকওয়ীর: ২২-২৭]
ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রহ. অন্যত্র বলেন,
নাবীগণের মু`জিযা আর জাদুকর ও গণকদের অলৌকিক ঘটনার মধ্যে পার্থক্য হলো:
প্রথমত: নাবী কিতাব থেকে যা বলেন তা সত্য, কখনও মিথ্যা হতে পারে না। অন্যদিকে জাদুকর ও গণকেরা সে সত্যের বিরুদ্ধে যা বলে তা অবশ্যই মিথ্যা হতে বাধ্য। যেমন আল্লাহ তা`আলা বলিয়াছেন,
`আমি কি তোমাদেরকে সংবাদ দেব, কার নিকট শয়তানরা অবতীর্ণ হয়`? তারা অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক চরম মিথ্যাবাদী ও পাপীর নিকট। [কোরআনের সুরা আশ-শু`আরা: ২২১-২২২]
দ্বিতীয়ত: নাবী যা নির্দেশ দেয় ও করে আর নাবী ব্যতীত অন্যান্যরা যা নির্দেশ দেয় ও করে এর মাধ্যমেও পার্থক্য সূচিত হয়ে যায়; কারণ আদেশ ও কাজের দিক বিবেচনায়, নাবীগণ ন্যায়পরায়নতা, আখেরাতের কামনা, আল্লাহর ইবাদত, কল্যাণ ও তাকওয়ার কাজের আদেশ দেন, পক্ষান্তরে তাদের বিরোধীরা শির্ক, জুলুম, দুনিয়া অর্জন, অসৎ ও অন্যায় কাজের আদেশ দিয়ে থাকে।
তৃতীয়ত: জাদুকর ও গণকদের কাজ হলো সাধারণ কাজ যা সে পেশার বিশেষজ্ঞদের কাছে পরিচিত, সেগুলো আসলে অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, পক্ষান্তরে নাবীগণের সত্যতার নিদর্শন তারা ও তাদের অনুসারী ছাড়া অন্য কারো মধ্যে পাওয়া যায় না।
চতুর্থত: জাদু ও গণকবিদ্যা মানুষ শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করতে পারে। কিন্তু নবুওয়ত কেউ ইচ্ছা করে অর্জন করতে পারে না।
পঞ্চমত: যদি ধরে নেওয়া হয় যে, নবুওয়ত অর্জন করা যায় তবে তা সৎ কাজ, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, তাওহীদ ইত্যাদির মাধ্যমে অর্জিত হতো, এটা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের সাথে মিথ্যাচার তো দূরের কথা স্বয়ং আল্লাহর সাথে মিথ্যাচারের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়। নবুওয়ত যদি অর্জন করা যেতো তবে তা আল্লাহর সাথে সত্যবাদিতার মাধ্যমেই অর্জিত হতো।
ষষ্ঠত: জাদুকর ও গণকেরা যা করে তা মানুষ ও জিনের সাধ্যের বাইরে নয়। আর এরা সকলেই রাসূলের অনুগত্য করতে আদিষ্ট। অন্যদিকে রাসূলগণের নিদর্শনসমূহ মানুষ ও জিনের সাধ্যের বাইরে, বরং রাসূলগণ যাদের কাছে প্রেরিত হয়েছে তাদের কাছে এগুলো অলৌকিক ঘটনা। আল্লাহ বলিয়াছেন,
“বলুন, `যদি মানুষ ও জিন এ কুরআনের অনুরূপ হাযির করার জন্য একত্রিত হয়, তবুও তারা এর অনুরূপ হাযির করতে পারবে না যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয়“। [কোরআনের সুরা আল-ইসরা: ৮৮]
সপ্তমত: জাদুকর ও গণকদের অলৌকিক ঘটনাগুলোকে অন্যরা অন্য কিছু দিয়ে মুকাবিলা করতে সক্ষম, কিন্তু নাবীগণের আলামত কখনও অনুরূপ কিছু দিয়ে মুকাবিলা করা যায় না।
অষ্টমত: জাদুকর ও গণকদের আনা জিনিসগুলো বনী আদমের সাধ্যের বাইরের বিষয় নয়, বরং এগুলো অন্য সাধারণ মানুষের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু নাবীগণের নিদর্শনসমূহ বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী সকলের নিকটই অস্বাভাবিক ও অলৌকিক।
নবমত: নাবীগণের এসব অলৌকিক কাজ সব মাখলুকাতের কাছেই সাধ্যের বাইরে, এমনকি ফিরিশতাদেরও সাধ্যের বাইরে। যেমন: কুরআন নাযিল করা, আল্লাহর সাথে মূসা আলাইহিস সালামের কথা বলা ইত্যাদি। পক্ষান্তরে অন্যান্যদের কর্মকাণ্ড জিন ও শয়তানের সাধ্যের মধ্যেই।
দশমত: যদি কিছু আলামত ফিরিশতাদের সাধ্যের মধ্যেও হয়, তবে সেক্ষেত্রে এটা জানা আবশ্যক যে ফিরিশতারা আল্লাহর ব্যাপারে কখনও মিথ্যা কথা বলে না, তারা মানুষকে কখনও মিথ্যা কথা বলেন না যে আল্লাহ তাঁকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন। মূলত শয়তানরা এ কাজ করে থাকে। আর আমাদের ও আমাদের পূর্বের সৎলোকদের কারামত নানা ধরণের। এগুলো নেককারদের কাছে অলৌকিক নয়, পক্ষান্তরে নাবীগণের নিদর্শন নেককারদের কাছেই অস্বাভাবিক ও অলৌকিক। নেককারদের কারামত দো`আ ও ইবাদতের মাধ্যমে লাভ করা যায়; কিন্তু নাবীগণ তা সেভাবে লাভ করতে পারেন না, যদিও মানুষ নাবীদের কাছে তা চায়, যতক্ষণ না আল্লাহ তা সংঘটিত হওয়ার অনুমতি দেন। যেমন আল্লাহ বলিয়াছেন,
“আর তারা বলে, `তার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে নিদর্শনসমূহ নাযিল হয় না কেন`? বল, `নিদর্শনসমূহ তো আল্লাহর কাছে, আর আমি তো কেবল একজন প্রকাশ্য সতর্ককারী”। [কোরআনের সুরা আল্-আনকাবূত: ৫০]
আল্লাহ আরো বলিয়াছেন,
“আর তারা বলে, `কেন তার উপর তার রবের পক্ষ থেকে কোনো নিদর্শন নাযিল করা হয়নি`? বল, `নিশ্চয় আল্লাহ যে কোনো নিদর্শন নাযিল করতে সক্ষম। কিন্তু তাদের অধিকাংশ জানে না”। [কোরআনের সুরা আল-আন`আম: ৩৭]
একাদশতম: নাবীর পূর্বেও অন্যান্য নাবী অতিবাহিত হয়েছেন, তিনি কেবল এমন জিনিসেরই আদেশ নিষেধ করেন পূর্ববর্তী নাবীগণ সাধারণত সেসব বিষয়ের আদেশ নিষেধ করতেন সুতরাং তাহাঁর অনেক উদাহরণ রয়েছে যাদের থেকে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে [নাবীর সততার ব্যাপারে] সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যেমনিভাবে জাদুকর ও গণকরা তাদেরও অনুরূপ লোক আছে যাদের দেখে লোকেরা শিক্ষা গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
দ্বাদশতম: নাবীগণ মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের আদেশ নিষেধ করে থাকেন। ফলে তারা তাওহীদ, ইখলাস, সততা, ইত্যাদির আদেশ দেন এবং শির্ক, মিথ্যা, জুলুম ইত্যাদি থেকে নিষেধ করেন। তাদের কাজ কর্ম মানুষের আকল ও স্বভাবের সামাঞ্জস্যপূর্ণ। তারা যা নিয়ে আসেন তা সুস্থ বিবেক ও সহীহ রেওয়ায়েত সত্যায়ন করে। আল্লাহই অধিক জ্ঞাত।
হাদীস নবুওয়তের মুজিযা ভূমিকা সমাপ্ত হলো
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রহ. থেকে বেশি উদ্ধৃত করা হয়েছে। কেননা তিনি ইসলামের দুশমনের সংশয় অপনোদন করেছেন। আল্লাহ তাঁকে ইসলামের পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন।
এখন মূল অধ্যয় শুরু করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর কাছে সাহায্য ও তাওফিক কামনা করছি। তিনি আমাদের জন্য যথেষ্ট, উত্তম অকীল। লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ।
[1] এখানে জীবনের দ্বিগুণ ও মরণের দ্বিগুণ আযাব দ্বারা দুনিয়াবী জীবন ও আখিরাতের জীবনের দ্বিগুণ আযাব উদ্দেশ্য।
[2] এখানে যে সব আলিমদের সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে তা শুধুমাত্র লেখকের ব্যক্তিগত মতামত, এর সাথে অনুবাদকের কোনো ধরণের সম্পর্ক নেই।
[3] দেখুন: ‘ইলামুল আনাম বিমুখালিফাতি শাইখুল আযহার শালতুত লিলইসলাম”।
[4] মুসনাদে আহমদ: হাদিস নম্বর ১৪৪।
[5] আবু দাউদ, হাদিস নম্বর ৪২৫২।
[6] তালিবে ইলমদেরকে এদের বই পুস্তক না পড়তে অনুরোধ করছি। আল্লাহ তা‘আলা তালিবে ইলেমদেরকে এসব বই ব্যতীত আহলে সুন্নত ওয়াল জামা‘আতের কিতাবসমূহ দ্বারা অমুখাপেক্ষী করেছেন। আল্লাহ তাদেরকে জাযা খায়ের দান করুন।
[7] এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে তাফসীরে ইবন কাসীরের ভূমিকায় আমি আলোচনা করেছি।
[8] এর চেয়েও মারাত্মক হলো আমীন খাওলী ও ত্বোয়া হুসাইন কর্তৃক ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ সম্পর্কে যা লিখেছেন।
[9] সাধারণ মানুষের চাহিদার প্রতি খেয়াল রেখে সংক্ষেপ করা হয়েছে।
[10] তা হল- যাক্কুম বৃক্ষ যার মূল জাহান্নামে।
[11] জিবরীল (আলাইহিস সালাম)।
[12] মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)।
[13] মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)।
[14] জিবরীল (আলাইহিস সালাম)।