রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নবুওয়তের অন্যতম প্রমাণ
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নবুওয়তের অন্যতম প্রমাণ << নবুওয়তের মুজিযা হাদীসের মুল সুচিপত্র দেখুন
তৃতীয় পরিচ্ছেদ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তের ব্যাপারে পূর্ববর্তীদের সুসংবাদের মধ্যে নবুওয়তের প্রমাণ
`আয়িশা রাদি. `আনহা হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর প্রতি সর্বপ্রথম যে অহী আসে, তা ছিল ঘুমের মধ্যে সত্য স্বপ্নরূপে। যে স্বপ্নই তিনি দেখতেন তা একেবারে ভোরের আলোর ন্যায় প্রকাশ পেত। তারপর তাহাঁর কাছে নির্জনতা প্রিয় হয়ে পড়ে এবং তিনি `হেরা` গুহায় নির্জনে থাকতেন। আপন পরিবারের কাছে ফিরে আসা এবং কিছু খাদ্যসামগ্রী সঙ্গে নিয়ে যাওয়া, এইভাবে সেখানে তিনি একাধারে বেশ কয়েক রাত ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। তারপর খাদীজা রাদি. `আনহার কাছে ফিরে এসে আবার অনুরূপ সময়ের জন্য কিছু খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যেতেন। এমনিভাবে `হেরা` গুহায় অবস্থানকালে একদিন তাহাঁর কাছে ওহী এলো। তাহাঁর কাছে ফিরিশতা এসে বলিলেন, `পড়ুন`। রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর বলিলেন, “আমি বলিলাম, `আমি পড়িনা`। তিনি বলেনঃ তারপর তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে এমন ভাবে চাপ দিলেন যে, আমার অত্যন্ত কষ্ট হলো। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলিলেন, `পড়ুন`। আমি বলিলাম, আমিতো পড়ি না। তিনি দ্বিতীয়বার আমাকে জড়িয়ে ধরে এমন ভাবে চাপ দিলেন যে, আমার অত্যন্ত কষ্ট হলো। এরপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলিলেন, `পড়ুন`। আমি জবাব দিলাম, `আমিতো পড়ি না`। রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর বলেন, তারপর তৃতীয়বার তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন। এরপর ছেড়ে দিয়ে বলিলেন, “পড়ুন আপনার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে `আলাক [রক্তপিণ্ড] থেকে। পড়ুন আর আপনার রব্ মহামহিমান্বিত।” [কোরআনের সুরা আল্-আলাক: ১-৩]
তারপর এ আয়াত নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর ফিরে এলেন। তাহাঁর অন্তর তখন কাঁপছিল। তিনি খাদীজা বিন্ত খুওয়ালিদের কাছে এসে বলিলেন, `আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও, আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও।` তাঁরা তাঁকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। অবশেষে তাহাঁর ভয় দূর হলো। তখন তিনি খাদীজা রাদি. `আনহার কাছে সকল ঘটনা জানিয়ে তাঁকে বলিলেন, আমি নিজের উপর আশংকা বোধ করছি। খাদীজা রাদি. `আনহা বলিলেন, আল্লাহ্র কসম, কখনো না। আল্লাহ্ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না। আপনিতো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন। এরপর তাঁকে নিয়ে খাদীজা রাদি. `আনহা তাহাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইব্ন নাওফিল ইব্ন `আবদুল আসাদ ইব্ন `আবদুল `উযযার কাছে গেলেন, যিনি জাহিলী যুগে `ঈসা আলাইহিস সালামের` ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইবরানী ভাষা লিখতে জানতেন এবং আল্লাহ্র তওফীক অনুযায়ী ইবরানী ভাষায় ইনজীল থেকে অনুবাদ করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজা রাদি. `আনহা তাঁকে বলিলেন, `হে চাচাতো ভাই! আপনার ভাতিজার কথা শুনুন।` ওয়ারাকা তাঁকে জিজ্ঞেস করিলেন, `ভাতিজা! তুমি কী দেখ?` রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ যা দেখেছিলেন, সবই খুলে বলিলেন। তখন ওয়ারাকা তাঁকে বলিলেন, `ইনি সে দূত যাঁকে আল্লাহ্ মূসা `আলাইহিস সালামের কাছে পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! আমি যদি সেদিন যুবক থাকতাম। আফসোস! আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার জাতি তোমাকে বের করে দেবে।` রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর বলিলেন, তাঁরা কি আমাকে বের করে দিবে? তিনি বলিলেন, `হ্যাঁ, অতীতে যিনিই তোমার মত কিছু নিয়ে এসেছেন তাহাঁর সঙ্গেই শত্রুতা করা হয়েছে। সেদিন যদি আমি থাকি, তবে তোমাকে প্রবলভাবে সাহায্য করব।` এর কিছুদিন পর ওয়ারাকা রাদি. `আনহু মৃত্যুবরণ করেন। আর অহী কিছুদিন স্থগিত থাকে।[1]
আবদুল্লাহ্ ইবনু আব্বাস রাদি. `আনহু বর্ণনা করেন যে, আবূ সুফিয়ান ইবনু হরব তাকে বলিয়াছেন, বাদশাহ হিরাকল একবার তাহাঁর কাছে লোক পাঠালেন। তিনি কুরাইশদের কাফেলায় তখন ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়ায় ছিলেন। সে সময় রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ আবূ সুফিয়ান ও কুরাইশদের সাথে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সন্ধিবদ্ধ ছিলেন। আবূ সুফিয়ান তার সঙ্গীদেরসহ হিরাকলের কাছে এলেন এবং তখন হিরাকল জেরুযালেমে অবস্থান করছিলেন। হিরাকল তাদেরকে তার দরবারে ডাকলেন। দোভাষীকে ডাকলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করিলেন, `এই যে ব্যক্তি নিজেকে নাবী বলে দাবী করেন তোমাদের মধ্যে বংশের দিক দিয়ে তাহাঁর সবচেয়ে নিকটাত্মীয় কে?` আবূ সুফিয়ান বলিলেন, `আমি বলিলাম, বংশের দিক দিয়ে আমিই তাহাঁর নিকটাত্মীয়।` তিনি বলিলেন, `তাঁকে আমার খুব কাছে নিয়ে এসো এবং তাহাঁর সঙ্গীদেরও কাছে এনে পেছনে বসিয়ে দাও।` এরপর তার দোভাষীকে বলিলেন, `তাদের বলে দাও, আমি এর কাছে সে ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করবো, সে যদি আমার কাছে মিথ্যা বলে, তবে সাথে সাথে তোমরা তাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রকাশ করবে।` আবূ সুফিয়ান বলেন, `আল্লাহর কসম! তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রচার করবে এ লজ্জা যদি আমার না থাকত, তবে অবশ্যই আমি তাহাঁর সম্পর্কে মিথ্যা বলতাম।` এরপর তিনি তাহাঁর সম্পর্কে আমাকে প্রথম প্রশ্ন করেন তা হচ্ছে, `তোমাদের মধ্যে তাহাঁর বংশমর্যাদা কেমন?` আমি বলিলাম, `তিনি আমাদের মধ্যে অতি সম্ভ্রান্ত বংশের।` তিনি বলিলেন, `তোমাদের মধ্যে এর আগে আর কখনো কি কেউ একথা বলেছে?` আমি বলিলাম, `না।` তিনি বলিলেন, `তাহাঁর বাপ-দাদাদের মধ্যে কি কেউ বাদশাহ ছিলেন?` আমি বলিলাম, `না।` তিনি বলিলেন, `তারা কি সংখ্যায় বাড়ছে, না কমছে?` আমি বলিলাম, `তারা বেড়েই চলেছে।` তিনি বলিলেন, `তাহাঁর দীন গ্রহণ করার পর কেউ কি নারায হয়ে তা পরিত্যাগ করে?` আমি বলিলাম, `না।` তিনি বলিলেন, `নবুওয়তের দাবীর আগে তোমরা কি কখনো তাঁকে মিথ্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছ?` আমি বলিলাম, `না।` তিনি বলিলেন, `তিনি কি চুক্তি ভঙ্গ করেন?` আমি বলিলাম, `না।` তবে আমরা তাহাঁর সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট সময়ের চুক্তিতে আবদ্ধ আছি। জানি না, এর মধ্যে তিনি কি করবেন।` আবূ সুফিয়ান বলেন, এ কথাটুকু ছাড়া নিজের পক্ষ থেকে আর কোনো কথা সংযোজনের সুযোগই আমি পাইনি।` তিনি বলিলেন, `তোমরা কি তাহাঁর সাথে কখনো যুদ্ধ করেছ?` আমি বলিলাম, হ্যাঁ, তিনি বলিলেন, `তাহাঁর সঙ্গে তোমাদের যুদ্ধ কেমন হয়েছে?` আমি বলিলাম, `তাহাঁর ও আমাদের মধ্যে যুদ্ধের ফলাফল উভয়ের পক্ষে আসে। কখনো তাহাঁর পক্ষে যায়, আবার কখনো আমাদের পক্ষে আসে।` তিনি বলিলেন, `তিনি তোমাদের কিসের আদেশ দেন?` আমি বলিলাম, `তিনি বলেন, তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর, তাহাঁর সঙ্গে কোনো কিছুর শরীক করো না এবং তোমাদের বাপ-দাদার ভ্রান্ত মতবাদ ত্যাগ কর। আর তিনি আমাদের নামায আদায় করার, সত্য কথা বলার, নিষ্কলুষ থাকার এবং আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করার আদেশ দেন।` তারপর তিনি দোভাষীকে বলিলেন, `তুমি তাকে বল, আমি তোমার কাছে তাহাঁর বংশ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। তুমি তার জওয়াবে উল্লেখ করেছ যে, তিনি তোমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশের। প্রকৃতপক্ষে রাসূলগণকে তাহাঁদের কওমের উচ্চ বংশেই প্রেরণ করা হয়ে থাকে। তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, এ কথা তোমাদের মধ্যে ইতোপূর্বে আর কেউ বলেছে কিনা? তুমি বলেছ, `না।` তাই আমি বলছি যে, আগে যদি কেউ এ কথা বলে থাকত, তবে অবশ্যই আমি বলতে পারতাম, এ এমন ব্যক্তি, যে তাহাঁর পূর্বসূরীর কথারই অনুসরণ করছে। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তাহাঁর পূর্বপুরুষের মধ্যে কোনো বাদশাহ ছিলেন কি না? তুমি তার জবাবে বলেছ, `না।` তাই আমি বলছি যে, তাহাঁর পূর্বপুরুষের মধ্যে যদি কোনো বাদশাহ থাকতেন, তবে আমি বলতাম, ইনি এমন এক ব্যক্তি যিনি তাহাঁর বাপ-দাদার বাদশাহী ফিরে পেতে চান। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি- এর আগে কখনো তোমরা তাঁকে মিথ্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছ কি না? তুমি বলেছ, `না।` এতে আমি বুঝলাম, এমনটি হতে পারে না যে, কেউ মানুষের ব্যাপারে মিথ্যা ত্যাগ করবে অথচ আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলবে। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, শরীফ লোক তাহাঁর অনুসরন করে, না সাধারণ লোক? তুমি বলেছ, সাধারণ লোকই তাহাঁর অনুসরণ করে। আর বাস্তবেও এরাই হন রাসূলগণের অনুসারী। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তারা সংখ্যায় বাড়ছে না কমছে? তুমি বলেছ বাড়ছে। প্রকৃতপক্ষে ঈমানে পূর্ণতা লাভ করার পর পর্যন্ত এ রকমই হয়ে থাকে। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তাঁরা দীনে দাখিল হওয়ার পর নারায হয়ে কেউ কি তা ত্যাগ করে? তুমি বলেছ, `না।` ঈমানের স্নিগ্ধতা অন্তরের সাথে মিশে গেলে ঈমান এরূপই হয়। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি তিনি চুক্তি ভঙ্গ করেন কি না? তুমি বলেছ, `না।` প্রকৃতপক্ষে রাসূলগণ এরূপই, চুক্তি ভঙ্গ করেন না। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি তিনি তোমাদের কিসের নির্দেশ দেন। তুমি বলেছ, তিনি তোমাদের এক আল্লাহর ইবাদত করা ও তাহাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরীক না করার নির্দেশ দেন। তিনি তোমাদের নিষেধ করেন মূর্তিপূজা করতে আর তোমাদের আদেশ করেন নামায আদায় করতে, সত্য কথা বলতে ও কলুষমুক্ত থাকতে। তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়, তবে শীঘ্রই তিনি আমার এ দু`পায়ের নীচের জায়গার মালিক হবেন [অর্থাৎ এ সম্রাজ্য জয় করবেন]। আমি নিশ্চিত জানতাম, তাহাঁর আবির্ভাব হবে; কিন্তু তিনি যে তোমাদের মধ্যে থেকে হবেন, এ কথা ভাবিনি। যদি জানতাম, আমি তাহাঁর কাছে পৌঁছাতে পারব, তাহাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আমি যে কোনো কষ্ট স্বীকার করতাম। আর আমি যদি তাহাঁর কাছে থাকতাম তবে অবশ্যই তাহাঁর দু`খানা পা ধুয়ে দিতাম। এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর সেই পত্রখানি আনতে বলিলেন, যা তিনি দিহইয়াতুল কালবীর মাধ্যমে বসরার শাসকের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তিনি তা পাঠ করিলেন। তাতে লেখা ছিল, `বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম [দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহর নামে]। আল্লাহর বান্দা ও তাহাঁর রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর পক্ষ থেকে রোম সম্রাট হিরাকল এর প্রতি। শান্তি [বর্ষিত হোক] তার প্রতি, যে হিদায়াতের অনুসরণ করে। তারপর আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন, নিরাপদে থাকবেন। আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ পুরষ্কার দান করবেন। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তবে সব প্রজার পাপই আপনার উপর বর্তাবে।
“বল, `হে কিতাবীগণ, তোমরা এমন কথার দিকে আস, যেটি আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান যে, আমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত না করি। আর তার সাথে কোনো কিছুকে শরীক না করি এবং আমাদের কেউ কাউকে আল্লাহ ছাড়া রব হিসাবে গ্রহণ না করি`। তারপর যদি তারা বিমুখ হয় তবে বল, `তোমরা সাক্ষী থাক যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম”। [কোরআনের সুরা আলে ইমরান: ৬৪]
আবূ সুফিয়ান বলেন, `হিরাকল যখন তাহাঁর বক্তব্য শেষ করিলেন এবং পত্র পাঠও শেষ করিলেন, তখন সেখানে শোরগোল পড়ে গেল, চীৎকার ও হৈ-হল্লা তুঙ্গে উঠল এবং আমাদের বের করে দেওয়া হল। আমাদের বের করে দিলে আমি আমার সঙ্গীদের বলিলাম, আবূ কাবশার ছেলের বিষয়তো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, বনূ আসফার [রোম]-এর বাদশাহও তাকে ভয় পাচ্ছে। তখন থেকে আমি বিশ্বাস করতে লাগলাম, তিনি শীঘ্রই জয়ী হবেন। অবশেষে আল্লাহ তা`আলা আমাকে ইসলাম গ্রহণের তওফীক দান করিলেন।
ইবনু নাতূর ছিলেন জেরুযালেমের শাসনকর্তা এবং হিরাকলের বন্ধু ও সিরিয়ার খৃষ্টানদের পাদ্রী। তিনি বলেন, `হিরাকল যখন জেরুযালেম আসেন, তখন একদিন তাঁকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তাহাঁর একজন বিশিষ্ট সহচর বলল, `আমরা আপনার চেহারা আজ বিবর্ণ দেখতে পাচ্ছি,` ইবনু নাতূর বলেন, হিরাকল ছিলেন জ্যোতিষী, জ্যোতির্বিদ্যায় তাহাঁর দক্ষতা ছিল। তারা জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাদের বলিলেন, `আজ রাতে আমি তারকারাজির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, খতনাকারীদের বাদশাহ আবির্ভূত হয়েছেন। বর্তমান যুগে কোনো জাতি খতনা করে?` তারা বলল, `ইহুদী ছাড়া কেউ খতনা করে না। কিন্তু তাদের ব্যাপার যেন আপনাকে মোটেই চিন্তিত না করে। আপনার রাজ্যের শহরগুলোতে লিখে পাঠান, তারা যেন সেখানকার সকল ইহুদীকে হত্যা করে ফেলে।` তারা যখন এ ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত ছিল, তখন হিরাকলের কাছে এক ব্যক্তিকে উপস্থিত করা হলো, যাকে গাসসানের শাসনকর্তা পাঠিয়েছিল। সে রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর সম্পর্কে খবর দিচ্ছিল। হিরাকল তার কাছ থেকে খবর জেনে নিয়ে বলিলেন, `তোমরা একে নিয়ে গিয়ে দেখ, তার খতনা হয়েছে কি-না।` তারা তাকে নিয়ে দেখে এসে সংবাদ দিল, তার খতনা হয়েছে। হিরাকল তাকে আরবদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলেন। সে জওয়াব দিল, `তারা খতনা করে।` তারপর হিরাকল তাদের বলিলেন, `ইনি রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ! এ উম্মতের বাদশাহ। তিনি আবির্ভূত হয়েছেন।` এরপর হিরাকল রোমে তাহাঁর বন্ধুর কাছে লিখলেন। তিনি জ্ঞানে তার সমকক্ষ ছিলেন। পরে হিরাকল হিমস চলে গেলেন। হিমসে থাকতেই তার কাছে তার বন্ধুর চিঠি এলো, যা রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর আবির্ভাব এবং তিনিই যে প্রকৃত নাবী, এ ব্যাপারে হিরাকলের মতকে সমর্থন করছিল। তারপর হিরাকল তাহাঁর হিমসের প্রাসাদে রোমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ডাকলেন এবং প্রাসাদের সব দরজা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দলেন। দরজা বন্ধ করা হলো। তারপর তিনি সামনে এসে বলিলেন, `হে রোমবাসী! তোমরা কি কল্যাণ, হিদায়ত এবং তোমাদের রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব চাও? তাহলে এই নাবীর বাই`আত গ্রহণ কর।` এ কথা শুনে তারা জংলী গাধার মত ঊর্ধ্বশ্বাসে দরজার দিকে ছুটল, কিন্তু তারা তা বন্ধ অবস্থায় পেল। হিরাকল যখন তাদের অনীহা লক্ষ্য করিলেন এবং তাদের ঈমান থেকে নিরাশ হয়ে গেলেন, তখন বলিলেন, `ওদের আমার কাছে ফিরিয়ে আন।` তিনি বলিলেন, `আমি একটু আগে যে কথা বলেছি, তা দিয়ে তোমরা তোমাদের দীনের উপর কতটুকু অটল, কেবল তার পরীক্ষা করেছিলাম। এখন আমি তা দেখে নিলাম।` একথা শুনে তারা তাঁকে সিজদা করল এবং তাহাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হলো। এই ছিল হিরাকল এর শেষ অবস্থা। [2]
আমর ইবনু `আস রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত যে, কুরআনের এ আয়াত, “আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে”। [কোরআনের সুরা আল-আহযাব : ৪৫] তাওরাতে আল্লাহ্ এভাবে বলিয়াছেন, হে নাবী আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদবাদা ও উম্মী লোকদের মুক্তি দাতারূপে। তুমি আমার বান্দা ও রাসূল। আমি তোমার নাম নির্ভরকারী [মুতাওয়াক্কিল] রেখেছি যে রূঢ় ও কঠোর চিত্ত নয়, বাজারে শোরগোলকারী নয় এবং মন্দকে মন্দ দ্বারা প্রতিহতকারীও নয়; বরং তিনি ক্ষমা করবেন এবং উপেক্ষা করবেন। বক্র জাতিকে সোজা না করা পর্যন্ত আল্লাহ তার জান কবয করবেন না। তা এভাবে যে, তারা বলবে, আল্লাহ ছাড়া ইলাহ নেই। ফলে খুলে যাবে অন্ধ চোখ, বধির কান এবং পর্দায় ঢাকা অন্তরসমূহ। [3]
[এখানে সালমান ফারেসীর ইসলামগ্রহণের কাহিনী রয়েছে, যা যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। সম্পাদক]।
[1] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৩।
[2] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৭, সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ১৭৭৩।
[3] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৪৮৩৮।
Leave a Reply