আল কুরআনের মুজিযা এবং মুহাম্মদ সাঃ এর নবুওয়তের প্রমাণ
আল কুরআনের মুজিযা এবং মুহাম্মদ সাঃ এর নবুওয়তের প্রমাণ << নবুওয়তের মুজিযা হাদীসের মুল সুচিপত্র দেখুন
প্রথম পরিচ্ছেদ: আল কুরআনের বিস্ময় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তের প্রমাণ
ইমাম বুখারী রহ. বলেন,
আবু হুরাইরা রাদি. আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী রাঃসাঃ বলিয়াছেন, “প্রত্যেক নাবীকে তার যুগের চাহিদা মুতাবিক কিছু মুজিযা দান করতে হয়েছে, যা দেখে লোকেরা তাহাঁর প্রতি ঈমান এনেছে। আমাকে যে মুজিযা দেওয়া হয়েছে তা হচ্ছে, অহী- যা আল্লাহ আমার প্রতি অবতীর্ণ করেছেন। সুতরাং আমি আশা করি, কিয়ামতের দিন তাদের অনুসারীদের তুলনায় আমার অনুসারীদের সংখ্যা অনেক বেশি হবে”। [1]
অতঃএব, আল কুরআন হলো রাঃসাঃ এর সর্বশ্রেষ্ঠ মু`জিযা। এখানে কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত অন্যান্য মু`জিযাকে অস্বীকার করা উদ্দেশ্য নয়। আল্লাহ তা`আলা আরবের বিশুদ্ধ সাহিত্যিক ও জ্ঞানীদেরকে কুরআনের অনুরূপ একটি কিতাব রচনা করতে চ্যালেঞ্জ করেন। আল্লাহ বলিয়াছেন,
“বল, `যদি মানুষ ও জিন এ কুরআনের অনুরূপ হাযির করার জন্য একত্রিত হয়, তবুও তারা এর অনুরূপ হাযির করতে পারবে না যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয়”। [কোরআনের সুরা আল-ইসরা: ৮৮]
আল্লাহ আরো বলিয়াছেন,
“তারা কি বলে, `সে এটা বানিয়ে বলছে?` বরং তারা ঈমান আনে না। অতএব, তারা যদি সত্যবাদী হয় তবে তার অনুরূপ বাণী নিয়ে আসুক”। [কোরআনের সুরা আত্-তূর: ৩৩-৩৪]
তাদেরকে কুরআনের অনুরূপ মাত্র দশটি আয়াত আনতে চ্যালেঞ্জ করেন। আল্লাহ বলেন,
“নাকি তারা বলে, `সে এটা রটনা করেছে`? বল, `তাহলে তোমরা এর অনুরূপ দশটি কোরআনের সুরা বানিয়ে নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পার ডেকে আন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও`। অতঃপর তারা যদি তোমাদের আহবানে সাড়া না দেয়, তাহলে জেনে রাখ, এটা আল্লাহর জ্ঞান অনুসারেই নাযিল করা হয়েছে এবং তিনি ছাড়া কোনো [সত্য] ইলাহ্ নেই। অতঃপর তোমরা কি অনুগত হবে?” [কোরআনের সুরা: হূদ: ১৩-১৪]
তাদেরকে কুরআনের অনুরূপ একটি কোরআনের সুরা আনতে চ্যালেঞ্জ করেন। আল্লাহ বলেন,
“এ কুরআন তো এমন নয় যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ তা রচনা করতে পারবে; বরং এটি যা তার সামনে রয়েছে, তার সত্যায়ন এবং কিতাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, যাতে কোনো সন্দেহ নেই, যা সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে। নাকি তারা বলে, `সে তা বানিয়েছে`? বল, `তবে তোমরা তার মত একটি কোরআনের সুরা [বানিয়ে] নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পারো ডাক, যদি তোমরা সত্যবাদী হও`। বরং তারা যে ব্যাপারে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করেনি, তা তারা অস্বীকার করেছে এবং এখনও তার পরিণতি তাদের কাছে আসেনি। এভাবেই তারা অস্বীকার করেছিল, যারা ছিল তাদের পূর্বে। সুতরাং তুমি লক্ষ্য কর, কেমন ছিল যালিমদের পরিণাম”। [কোরআনের সুরা ইউনুস: ৩৭-৩৯]
আল্লাহ আরো বলেন,
“আর আমি আমার বান্দার উপর যা নাযিল করেছি, যদি তোমরা সে সম্পর্কে সন্দেহে থাক, তবে তোমরা তার মত একটি কোরআনের সুরা নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষীসমূহকে ডাক; যদি তোমরা সত্যবাদী হও। অতএব যদি তোমরা তা না কর- আর কখনো তোমরা তা করবে না- তাহলে আগুনকে ভয় কর যার জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর, যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফিরদের জন্য”। [কোরআনের সুরা আল-বাকারা: ২৩-২৪]
আল্লাহ তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, কিন্তু তারা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে, ফলে তারা সীমালঙ্ঘন ও একগুঁয়েমীর আশ্রয় নিল। তাদের কেউ কেউ বলত:
“আর কাফিররা বলে, `তোমরা এ কুরআনের নির্দেশ শুন না এবং এর আবৃত্তি কালে শোরগোল সৃষ্টি কর, যেন তোমরা জয়ী হতে পার”। [কোরআনের সুরা ফুস্-সিলাত: ২৬]
তারা আরো বলত,
“আর তারা বলে, `তুমি আমাদেরকে যার প্রতি আহবান করছ সে বিষয়ে আমাদের অন্তরসমূহ আচ্ছাদিত, আমাদের কানের মধ্যে রয়েছে বধিরতা আর তোমার ও আমাদের মধ্যে রয়েছে অন্তরায়”। [কোরআনের সুরা ফুস্-সিলাত: ৫]
অন্যদিকে আল্লাহ তাদের কারো কারো যে সব কথা বর্ণনা করেছেন তা তাদের অবাধ্যতা, অহংকার ও তাদের দুর্বল জ্ঞানের অধিকারী অনুসারীদেরকে সংশয় ও ধোঁকায় ফেলানোর উদ্দেশ্য। যেমন আল্লাহ তাদের কথা উল্লেখ করে বলিয়াছেন,
“আর তাদের উপর যখন আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তারা বলে, শুনলাম তো। যদি আমরা চাই, তাহলে এর অনুরূপ আমরাও বলতে পারি। এতো পিতৃ-পুরুষদের কল্প-কাহিনী ছাড়া কিছু না”। [কোরআনের সুরা আল- আনফাল: ৩১]
এমনিভাবে তাদের কথা:
“তারা বলে, `এটি প্রাচীনকালের উপকথা যা সে লিখিয়ে নিয়েছে; এগুলো সকাল-সন্ধ্যায় তার কাছে পাঠ করা হয়”। [কোরআনের সুরা আল-ফুরকান: ৫]
পরিচ্ছেদ
- কুরআনের মু`জিযার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,
কুরআনের বিস্ময়ের মধ্যে আরেকটি হলো পূর্ববর্তী উম্মত সম্পর্কে একজন নিরক্ষর নাবী কর্তৃক সংবাদ দেওয়া যিনি আক্ষরিক লেখা পড়া জানতেন না। যেমন আল্লাহ তা`আলা বলিয়াছেন,
“আর যখন আমি [মূসাকে] ডেকেছিলাম তখন তুমি তূর পর্বতের পাশে উপস্থিত ছিলে না। কিন্তু তোমার রবের পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ জানানো হয়েছে, যাতে তুমি এমন কওমকে সতর্ক করতে পার, যাদের কাছে তোমার পূর্বে কোনো সতর্ককারী আসেনি। সম্ভবত তারা উপদেশ গ্রহণ করবে”। [কোরআনের সুরা আল্-কাসাস: ৪৬]
আল্লাহ আরো তা`আলা বলিয়াছেন,
“আর তুমি তাদের নিকট ছিলে না, যখন তারা তাদের কলম নিক্ষেপ করছিল, তাদের মধ্যে কে মারইয়ামের দায়িত্ব নেবে? আর তুমি তাদের নিকট ছিলে না, যখন তারা বিতর্ক করছিল”। [আলে ইমরান: ৪৪]
আল্লাহ আরো তা`আলা বলিয়াছেন,
“এগুলো গায়েবের সংবাদ, যা আমি তোমার কাছে ওহী করছি। তুমি তো তাদের নিকট ছিলে না যখন তারা তাদের সিদ্ধান্তে একমত হয়েছিল অথচ তারা ষড়যন্ত্র করছিল”। [কোরআনের সুরা: ইউসুফ: ১০২]
আল্লাহ আরো তা`আলা বলিয়াছেন,
“তাদের এ কাহিনীগুলোতে অবশ্যই বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে শিক্ষা”। [কোরআনের সুরা: ইউসুফ: ১১১]
এমনিভাবে আদম আলাইহিস সালামের সৃষ্টি, শয়তানের সাথে তার ঘটনা, স্বজাতির সাথে নাবীগণের ঘটনা, মূসা আলাইহিস সালামের ঘটনা, খিজির, আসহাবে কাহাফ, জুল ক্বারনাইন, লুকমান আলাইহিস সালাম ও তার ছেলের ঘটনা ও তাওরাতের নানা বিধিবিধান সম্পর্কে সংবাদ দেওয়া ইত্যাদি সম্পর্কে আল্লাহ তা`আলা তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। আল্লাহ বলিয়াছেন,
“বলুন, `তাহলে তোমরা তাওরাত নিয়ে আস, অতঃপর তা তিলাওয়াত কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও”। [আলে ইমরান: ৯৩]
আল্লাহ আরো বলিয়াছেন,
“হে কিতাবীগণ, তোমাদের নিকট আমার রাসূল এসেছে, কিতাব থেকে যা তোমরা গোপন করতে, তার অনেক কিছু তোমাদের নিকট সে প্রকাশ করছে এবং অনেক কিছু ছেড়ে দিয়েছে”। [আল-মায়েদা: ১৫]
বরং আহলে কিতাবদের মধ্যে যাদেরকে আল্লাহ হিদায়েত দিয়েছেন তাদের সম্পর্কে তিনি বলিয়াছেন,
“অথচ বনী ইসরাঈলের একজন সাক্ষী এ ব্যাপারে অনুরূপ সাক্ষ্য দিল। অতঃপর সে ঈমান আনল আর তোমরা অহঙ্কার করলে”। [কোরআনের সুরা আল্-আহকাফ: ১০]
এ উম্মী নাবী তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন, কিন্তু তারা এর জবাব দিতে পারে নি। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা`আলা বলিয়াছেন,
“আর তুমি তো এর পূর্বে কোনো কিতাব তিলাওয়াত করনি এবং তোমার নিজের হাতে তা লিখনি যে, বাতিলপন্থীরা এতে সন্দেহ পোষণ করবে”। [কোরআনের সুরা আল্-আনকাবূত: ৪৮]
আল্লাহ আরো বলিয়াছেন,
“যারা অনুসরণ করে রাসূলের, যে উম্মী নাবী; যার গুণাবলী তারা নিজদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়, যে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেয় ও বারণ করে অসৎ কাজ থেকে এবং তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র বস্তু হারাম করে। আর তাদের থেকে বোঝা ও শৃংখল- যা তাদের উপরে ছিল- অপসারণ করে। সুতরাং যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং তার সাথে যে নূর নাযিল করা হয়েছে তা অনুসরণ করে তারাই সফলকাম। বল, `হে মানুষ, আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসূল, যার রয়েছে আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব। তিনি ছাড়া কোনো [সত্য] ইলাহ নেই। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু দেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আন ও তাহাঁর প্রেরিত উম্মী নাবীর প্রতি, যে আল্লাহ ও তাহাঁর বাণীসমূহের প্রতি ঈমান রাখে। আর তোমরা তার অনুসরণ কর, আশা করা যায়, তোমরা হিদায়াত লাভ করবে”। [কোরআনের সুরা আল-আ`রাফ: ১৫৭-১৫৮]
- কুরআনের মু`জিযার মধ্যে আরেকটি হলো ভবিষ্যৎকালের নানা বিষয়ে সংবাদ দিয়েছে এবং আল্লাহ যেভাবে বলিয়াছেন তা সেভাবেই সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা`আলা বলিয়াছেন,
“তোমরা ইনশাআল্লাহ নিরাপদে নির্ভয়ে আল-মাসজিদুল হারামে অবশ্যই প্রবেশ করবে”। [কোরআনের সুরা আল-ফাতহ: ২৭]
“তিনি জানেন তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে। আর কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে পৃথিবীতে ভ্রমণ করবে, আর কেউ কেউ আল্লাহর পথে লড়াই করবে”। [কোরআনের সুরা আল্-মুয্যাম্মিল: ২০]
এটা ছিল জিহাদ ফরয হওয়ার আগে। কেননা এটি মক্কী কোরআনের সুরা। আল্লাহ তা`আলা বলিয়াছেন,
“সংঘবদ্ধ দলটি শীঘ্রই পরাজিত হবে এবং পিঠ দেখিয়ে পালাবে”। [কোরআনের সুরা আল্-কামার: ৪৫]
কাফিররা বদরের দিনে পরাজিত হয়েছিল।
“নিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি, আর আমিই তার হেফাযতকারী”। [কোরআনের সুরা: আল-হিজর: ৯]
কত নাস্তিকেরা কুরআনকে পরিবর্তন করতে চেষ্টা করেছে কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। তারা কখনও সফল হবে না। কেননা স্বয়ং মহান আল্লাহ কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। কুরআনের সম্মুখ ও পশ্চাৎ দিয়ে বাতিল আসতে পারবে না, এটা প্রজ্ঞাময় ও প্রশংসিত মহান আল্লাহর তরফ থেকে নাযিলকৃত।
- কুরআনের আরেক মু`জিযা হলো শ্রবণকারীর মধ্যে প্রভাব ফেলা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা`আলা বলিয়াছেন,
“এ কুরআনকে যদি আমি পাহাড়ের ওপর নাযিল করতাম তবে তুমি অবশ্যই তাকে দেখতে, আল্লাহর ভয়ে বিনীত ও বিদীর্ণ”। [কোরআনের সুরা আল্-হাশর: ২১]
আল্লাহ আরো বলিয়াছেন,
“যারা তাদের রবকে ভয় করে, তাদের গা এতে শিহরিত হয়, তারপর তাদের দেহ ও মন আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়ে যায়”। [কোরআনের সুরা আয্-যুমার: ২৩]
কুরআন শ্রবণ জিনজাতির মাঝে যে প্রভাব ফেলে সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
“বল, `আমার প্রতি ওহী করা হয়েছে যে, নিশ্চয় জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শুনেছে। অতঃপর বলেছে, `আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি, যা সত্যের দিকে হিদায়াত করে; অতঃপর আমরা তাতে ঈমান এনেছি। আর আমরা কখনো আমাদের রবের সাথে কাউকে শরীক করব না”। [কোরআনের সুরা আল্-জিন: ১-২]
বুখারী রহ. বলিয়াছেন,
ইবনু আব্বাস রাদি. আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “নাবী রাঃসাঃ কয়েকজন সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে উকায বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। আর দুষ্ট জিনদের উর্ধলোকের সংবাদ সংগ্রহের পথে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয় এবং তাদের দিকে অগ্নিপিন্ড নিক্ষিপ্ত হয়। কাজেই শয়তানরা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে আসে। তারা জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের কি হয়েছে? তারা বলল, আমাদের এবং আকাশের সংবাদ সংগ্রহের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে এবং আমাদের দিকে অগ্নিপিন্ড ছুঁড়ে মারা হয়েছে। তখন তারা বলল, নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু ঘটছে বলেই তোমাদের এবং আকাশের সংবাদ সংগ্রহের মধ্যে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই, পৃথিবীর পূর্ব এবং পশ্চিম অঞ্চল পর্যন্ত বিচরণ করে দেখ, কি কারণে তোমাদের ও আকাশের সংবাদ সংগ্রহরে মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে? তাই তাদের যে দলটি তিহামার দিকে গিয়েছিল, তারা রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর দিকে অগ্রসর হল। তিনি তখন উকায বাজারের পথে `নাখলা` নামক স্থানে সাহাবীগণকে নিয়ে ফজরের নামায আদায় করছিলেন। তারা যখন কুরআন শুনতে পেল, তখন সেদিকে মনোনিবেশ করল। তারপর তারা বলে উঠল, আল্লাহর শপথ! এটিই তোমাদের ও আকাশের সংবাদ সংগ্রহের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। এমন সময় যখন তারা সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে আসল এবং বলল যে,
“বল, `আমার প্রতি ওহী করা হয়েছে যে, নিশ্চয় জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শুনেছে। অতঃপর বলেছে, `আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি, যা সত্যের দিকে হিদায়াত করে; অতঃপর আমরা তাতে ঈমান এনেছি। আর আমরা কখনো আমাদের রবের সাথে কাউকে শরীক করব না”। [কোরআনের সুরা আল্-জিন: ১-২] এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা`আলা তাহাঁর নাবী রাঃসাঃ এর প্রতি কোরআনের সুরা নাযিল করেন,
“বল, `আমার প্রতি ওহী করা হয়েছে যে, নিশ্চয় জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শুনেছে”।[কোরআনের সুরা আল্-জিন: ১] মূলত তাহাঁর নিকট জিনদের বক্তব্যই ওহীরূপে নাযিল করা হয়েছে”।[2]
আল্লাহ তা`আলা বলিয়াছেন,
“আর স্মরণ কর, যখন আমি জিনদের একটি দলকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। তারা কুরআন পাঠ শুনছিল। যখন তারা তার কাছে উপস্থিত হল, তখণ তারা বলল, `চুপ করে শোন। তারপর যখন পাঠ শেষ হল তখন তারা তাদের কওমের কাছে সতর্ককারী হিসেবে ফিরে গেল। তারা বলল, `হে আমাদের কওম, আমরা তো এক কিতাবের বাণী শুনেছি, যা মূসার পরে নাযিল করা হয়েছে। যা পূর্ববর্তী কিতাবকে সত্যায়ন করে আর সত্য ও সরল পথের প্রতি হিদায়াত করে`। হে আমাদের কওম, আল্লাহর দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তার প্রতি ঈমান আন, আল্লাহ তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। আর তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাব থেকে রক্ষা করবেন`। আর যে আল্লাহর দিকে আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেবে না সে যমীনে তাকে অপারগকারী নয়। আর আল্লাহ ছাড়া তার কোনো অভিভাবক নেই। এরাই স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে”। [কোরআনের সুরা আল্-আহকাফ: ২৯-৩২]
ইমাম হাকিম রহ. বলেন,
আব্দুল্লাহ রাদি. আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “জিনেরা রাঃসাঃ এর নিকট আসল, তখন তিনি `নাখলা` নামক স্থানে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। তারা যখন কুরআন শ্রবণ করল তখন বলল, তোমরা চুপ করো, মনোযোগ সহকারে শোন। তারা নয়জন ছিল। তাদের একজন ছিল `ঝাওবা`আহ` বা ঘূর্ণিঝড়। তখন মহান আল্লাহ নাযিল করেন,
“আর স্মরণ কর, যখন আমি জিনদের একটি দলকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। তারা কুরআন পাঠ শুনছিল। যখন তারা তার কাছে উপস্থিত হল, তখণ তারা বলল, `চুপ করে শোন”। থেকে ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ পর্যন্ত নাযিল হয়”। [কোরআনের সুরা আল্-আহকাফ: ২৯-৩২][3]
অনুরূপভাবে নাসারাদেরকে আল-কুরআন প্রভাবান্বিত করেছে। এর উদাহরণ হলো আল্লাহর বাণী:
“আর রাসূলের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে যখন তারা তা শুনে, তুমি দেখবে তাদের চক্ষু অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে, কারণ তারা সত্য হতে জেনেছে। তারা বলে, `হে আমাদের রব, আমরা ঈমান এনেছি। সুতরাং আপনি আমাদেরকে সাক্ষ্য দানকারীদের সঙ্গে লিপিবদ্ধ করুন`। আর আমাদের কী হয়েছে যে, আমরা আল্লাহর প্রতি এবং যে সত্য আমাদের কাছে এসেছে তার প্রতি ঈমান আনব না? আর আমরা আশা করব না যে, আমাদের রব আমাদেরকে প্রবেশ করাবেন নেককার সম্প্রদায়ের সাথে`। সুতরাং তারা যা বলেছে এর কারণে আল্লাহ তাদেরকে পুরস্কার দেবেন জান্নাতসমূহ, যার নীচে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়, তারা সেখানে স্থায়ী হবে। আর এটা হল সৎকর্মপরায়ণদের প্রতিদান”। [আল-মায়েদা: ৮৩-৮৫]
তদ্রূপ কুরাইশ কাফিরদেরকে কুরআন যে প্রভাবান্বিত করেছে এর উদাহরণ হলো, বুখারীতে আছে,
জুবায়র ইবনু মুত`ইম রহ. তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি নাবী রাঃসাঃকে মাগরিবে কোরআনের সুরা তূর পাঠ করতে শুনেছি। যখন তিনি এ আয়াত পর্যন্ত পৌছেন:
“তারা কি স্রষ্টা ব্যতীত সৃষ্টি হয়েছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা ? আসমান-যমীন কি তারাই সৃষ্টি করেছে? আসলে তারা অবিশ্বাসী। আমার প্রতিপালকের ধনভাণ্ডার কি তাদের কাছে রয়েছে, না তারাই এ সমুদয়ের নিয়ন্ত্রা?” [কোরআনের সুরা আত্বতূর : ৩৫-৩৭] তখন আমার অন্তর প্রায় উড়ে যাবার অবস্থা হয়েছিল। সুফিয়ান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বলেন, আমি যুহরীকে মুহাম্মদ ইবনু জুবায়ির ইবনু মুত`ইমকে তার পিতার বর্ণনা করতে শুনেছি, যা আমি নাবী রাঃসাঃকে মাগরিবে কোরআনের সুরা তূর পাঠ করতে শুনেছি। কিন্তু এর অতিরিক্ত আমি শুনেনি, যা তাঁরা আমার কাছে বর্ণনা করেছেন। [4]
ইমাম বুখারী আল-মাগাযী অধ্যয়ে বদরের যুদ্ধ সম্পর্কে মা`মার হতে ঝুহরী রহ. এর সনদে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। বা এতে আরো আছে “আর তা-ই আমার অন্তরে প্রথম ঈমানের সঞ্চার করলো“।
- অনুরূপভাবে কুরআনের আরও মু`জিযা হচ্ছে, আল্লাহর নিন্মোক্ত বাণীতে:
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে এ মর্মে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি নিশ্চিতভাবে তাদেরকে যমীনের প্রতিনিধিত্ব প্রদান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব প্রদান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য শক্তিশালী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দীনকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তিনি তাদের ভয়-ভীতি শান্তি-নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা আমারই ইবাদাত করবে, আমার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করবে না। আর এরপর যারা কুফরী করবে তারাই ফাসিক”। [কোরআনের সুরা আন্-নূর: ৫৫]
কারণ উম্মতের অবস্থা ততক্ষণ সঠিক ছিল যতক্ষণ তাদের মধ্যে শির্ক, মৃত ব্যক্তির কবরে গম্বুজ তৈরি, কবরকে সজ্জিত করা ও পাকা করা, গম্বুজ তৈরী করা ইত্যাদির প্রসার না ঘটেছিল; বস্তুত এর মাধ্যমে শির্ককে সহযোগিতা করা হয়েছিল। এমনকি এমন কিছু গনক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে যারা মনে করে যে, তারা গায়েব সম্পর্কে অবগত। পূর্বের অনেক রাজা বাদশাহরা গনকদের উপর নির্ভর করত।
এসব কুসংস্কার অনেকের কাছে পুরাতন হলেও বর্তমানে এক নতুন শির্কের আবিস্কার হয়েছে, আর তা হলো গণতন্ত্র, যার অর্থ হলো জনগণের দ্বারা জনগনের শাসন। অর্থাৎ জনগণ নিজেরাই নিজেদের শাসন করবে। এমনিভাবে ইসলামের শত্রুদের থেকে কুরআন হাদীস বিরোধী আইন আমদানি করা। এ সব আইনের দ্বারা শাসন কার্য পরিচালনা করা শির্ক। আল্লাহ বলেন,
“তাদের জন্য কি এমন কিছু শরীক আছে, যারা তাদের জন্য দীনের বিধান দিয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি?” [কোরআনের সুরা আশ্-শূরা: ২১]
এর চেয়েও মারাত্মক হলো বর্তমানের মুসলিমগণ দুটি শিবিরে বিভক্ত, একভাগ রাশিয়ার অনুসারী, আরেকভাগ আমেরিকার অনুসারী।
বরং এর চেয়েও মারাত্মক অবস্থা হলো মুসলিম শাসকেরা আমেরিকা ও রাশিয়ার তাবেদার হয়ে তাদের মিশন বাস্তবায়ন করেন। কিন্তু আল্লহর রহমতে কিছু মুসলিম শাসক ও সাধারণ মুসলিম এ সব ভয়ঙ্কর মিশন সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। মুসলিম যুবকেরা উপকারী ইলম ও ঈমানী শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। তারা কুরআন ও সুন্নহের দিকে ফিরে আসছে। তারা তাদের সে সব শাসকদেরকে ইসলামের শত্রুদের সাথে সম্পর্কে ছিন্ন করতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যারা মনে করেন তাদের ভাগ্য আমেরিকা ও রাশিয়ার হাতে, অথচ তারা নিজেরাই ব্যর্থ ও নানা সমস্যায় জর্জরিত, যেমনটি ছিল সমাজতন্ত্রের অবস্থা। আলহামদু লিল্লাহ রাব্বিল `আলামিন।
পরিচ্ছেদ
নবুওয়তের পূর্বাভাষ
আয়েশা রাদি. `আনহা হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, বু`আস যুদ্ধ[5] এমন একটি যুদ্ধ ছিল, যা আল্লাহ তা`আলা [মদীনার পরিবেশকে] তাহাঁর [রাসূলের অনুকূল করার জন্য] মদীনা আগমনের পূর্বেই ঘটিয়েছিলেন। রাঃসাঃ যখন মদীনায় আগমন করিলেন তখন সেখানকার সম্ভ্রান্ত ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ নানা দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ এ যুদ্ধে নিহত ও আহত হয়েছিল। তাদের ইসলাম গ্রহণকে আল্লাহ্ তা`আলা তাহাঁর রাঃসাঃ এর জন্য অনুকূল করে দিয়েছিলেন।[6]
আনাস ইবনু মালিক রাদি. `আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাঃসাঃ এর কাছে জিবরীল আলাইহিস সালাম এলেন, তখন তিনি শিশুদের সাথে খেলছিলেন। তিনি তাঁকে ধরে শোয়ালেন এবং বক্ষ বিদীর্ণ করে তাহাঁর হৎপিশুটি বের করে আনলেন। তারপর তিনি তাহাঁর বক্ষ থেকে একটি রক্তপিশু বের করিলেন এবং বলিলেন এ অংশটি শয়তানের। এরপর হৎপিশুটিকে একটি স্বর্ণের পাত্রে রেখে যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করিলেন এবং তার অংশগুলো জড়ো করে আবার তা যথাস্থানে পূনঃস্থাপন করিলেন। তখন ঐ শিশুরা দৌড়ে তাহাঁর দুধমায়ের কাছে গেল এবং বলল, মুহাম্মাদ রাঃসাঃকে হত্যা করা হয়েছে। কথাটি শুনে সবাই সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখল তিনি ভয়ে বিবর্ণ হয়ে আছেন! আনাস রাদি. `আনহু বলেন, আমি রাঃসাঃ এর বক্ষে সে সেলাই-এর চিহ্ন দেখেছি।[7]
পরিচ্ছেদ
অহী নাযিলের ধরণ ও প্রকার
আবূ সাঈদ রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাঃসাঃ বলিয়াছেন, আল্লাহ তা`আলা তোমাদের জন্যে যমীনের বরকতসমূহ প্রকাশিত করে দেবেন, আমি তোমাদের জন্যে এ ব্যাপারেই সর্বাধিক আশংকা করছি। জিজ্ঞাসা করা হলো, যমীনের বরকতসমূহ কি? তিনি বলিলেন, দুনিয়ার ঝাঁকজমক। তখন এক ব্যক্তি তার কাছে বলিলেন, ভালো কি মন্দ নিয়ে আসবে? তখন নাবী রাঃসাঃ কিছুক্ষন নীরব থাকলেন, যদ্দরুন আমরা ধারণা করলাম যে, এখন তার উপর অহী নাযিল হচ্ছে। এরপর তিনি তার কপাল থেকে ঘাম মুছে জিজ্ঞাসা করিলেন, প্রশ্নকারী কোথায়? সে বলল, আমি এখানে। -আবূ সাঈদ রাদি. `আনহু বলেন, যখন এটি প্রকাশ পেল, তখন আমরা প্রশ্নকারীর প্রশংসা করলাম-। রাঃসাঃ বলিলেন, ভালো একমাত্র ভালোকেই বয়ে আনে। নিশ্চয়ই এ ধন-দৌলত সবুজ শ্যামল সুমিষ্ট। অবশ্য বসন্ত যে সবজি উৎপাদন করে, তা ভক্ষনকারী পশুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় অথবা মৃত্যুর নিকটে করে দেয়, তবে যে প্রাণী পেট ভরে খেয়ে সূর্য মুখী হয়ে জাবর কাটে [চর্বণ করে], মল-মূত্র ত্যাগ করে এবং পুনরায় খায় [এর অবস্থা ভিন্ন]। এ পৃথিবীর ধন-দৌলত তদ্রুপ সুমিষ্ট। যে ব্যক্তি তা সৎভাবে গ্রহণ করবে এবং সৎকাজে ব্যয় করবে, তা তার খুবই সাহায্যকারী হবে, আর যে তা অন্যায়ভাবে গ্রহন করবে, তার অবস্থা হবে ঔ ব্যক্তির মত যে খেতে থাকে আর পরিতৃপ্ত হয় না।[8]
`আয়িশা রাদি. `আনহা হইতে বর্ণিত, হারিস ইবনু হিশাম রাদি. `আনহু রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃকে জিজ্ঞাসা করিলেন, `ইয়া রাসূলুল্লাহ্! রাঃসাঃ আপনার প্রতি অহী কিভাবে আসে? রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ বলিলেন, কোনো সময় তা ঘন্টাধ্বনির ন্যায় আমার নিকট অহী আসে, আর এটিই আমার উপর সবচাইতে কষ্টদায়ক হয় এবং তা সমাপ্ত হতেই ফিরিশতা যা বলেন আমি তা মুখস্থ করে নেই। আবার কখনো ফিরিশতা মানুষের আকৃতিতে আমার সঙ্গে কথা বলে। তিনি যা বলেন আমি তা মুখস্থ করে ফেলি। আয়িশা রাদি. `আনহা বলেন, আমি প্রচণ্ড শীতের দিনে ওহী নাযিলরত অবস্থায় তাঁকে দেখেছি। অহী শেষ হলেই তাহাঁর কপাল থেকে ঘাম ঝরে পড়ত।[9]
`আয়িশা রাদি. `আনহা হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর প্রতি সর্বপ্রথম যে অহী আসে, তা ছিল ঘুমের মধ্যে সত্য স্বপ্নরূপে। যে স্বপ্নই তিনি দেখতেন তা একেবারে ভোরের আলোর ন্যায় প্রকাশ পেত। তারপর তাহাঁর কাছে নির্জনতা প্রিয় হয়ে পড়ে এবং তিনি `হেরা` গুহায় নির্জনে থাকতেন। আপন পরিবারের কাছে ফিরে আসা এবং কিছু খাদ্যসামগ্রী সঙ্গে নিয়ে যাওয়া, এইভাবে সেখানে তিনি একাধারে বেশ কয়েক রাত ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। তারপর খাদীজা রাদি. `আনহার কাছে ফিরে এসে আবার অনুরূপ সময়ের জন্য কিছু খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যেতেন। এমনিভাবে `হেরা` গুহায় অবস্থানকালে একদিন তাহাঁর কাছে ওহী এলো। তাহাঁর কাছে ফিরিশতা এসে বলিলেন, `পড়ুন`। রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর বলিলেন, “আমি বলিলাম, `আমি পড়িনা`। তিনি বলেনঃ তারপর তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে এমন ভাবে চাপ দিলেন যে, আমার অত্যন্ত কষ্ট হলো। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলিলেন, `পড়ুন`। আমি বলিলাম, আমিতো পড়ি না। তিনি দ্বিতীয়বার আমাকে জড়িয়ে ধরে এমন ভাবে চাপ দিলেন যে, আমার অত্যন্ত কষ্ট হলো। এরপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলিলেন, `পড়ুন`। আমি জবাব দিলাম, `আমিতো পড়ি না`। রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর বলেন, তারপর তৃতীয়বার তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন। এরপর ছেড়ে দিয়ে বলিলেন, “পড়ুন আপনার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে `আলাক [রক্তপিণ্ড] থেকে। পড়ুন আর আপনার রব্ মহামহিমান্বিত।” [কোরআনের সুরা আল্-আলাক: ১-৩]
তারপর এ আয়াত নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর ফিরে এলেন। তাহাঁর অন্তর তখন কাঁপছিল। তিনি খাদীজা বিন্ত খুওয়ালিদের কাছে এসে বলিলেন, `আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও, আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও।` তাঁরা তাঁকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। অবশেষে তাহাঁর ভয় দূর হলো। তখন তিনি খাদীজা রাদি. `আনহার কাছে সকল ঘটনা জানিয়ে তাঁকে বলিলেন, আমি নিজের উপর আশংকা বোধ করছি। খাদীজা রাদি. `আনহা বলিলেন, আল্লাহ্র কসম, কখনো না। আল্লাহ্ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না। আপনিতো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন। এরপর তাঁকে নিয়ে খাদীজা রাদি. `আনহা তাহাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইব্ন নাওফিল ইব্ন `আবদুল আসাদ ইব্ন `আবদুল `উযযার কাছে গেলেন, যিনি জাহিলী যুগে `ঈসা আলাইহিস সালামের` ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইবরানী ভাষা লিখতে জানতেন এবং আল্লাহ্র তওফীক অনুযায়ী ইবরানী ভাষায় ইনজীল থেকে অনুবাদ করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজা রাদি. `আনহা তাঁকে বলিলেন, `হে চাচাতো ভাই! আপনার ভাতিজার কথা শুনুন।` ওয়ারাকা তাঁকে জিজ্ঞেস করিলেন, `ভাতিজা! তুমি কী দেখ?` রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ যা দেখেছিলেন, সবই খুলে বলিলেন। তখন ওয়ারাকা তাঁকে বলিলেন, `ইনি সে দূত যাঁকে আল্লাহ্ মূসা `আলাইহিস সালামের কাছে পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! আমি যদি সেদিন যুবক থাকতাম। আফসোস! আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার জাতি তোমাকে বের করে দেবে।` রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর বলিলেন, তাঁরা কি আমাকে বের করে দিবে? তিনি বলিলেন, `হ্যাঁ, অতীতে যিনিই তোমার মত কিছু নিয়ে এসেছেন তাহাঁর সঙ্গেই শত্রুতা করা হয়েছে। সেদিন যদি আমি থাকি, তবে তোমাকে প্রবলভাবে সাহায্য করব।` এর কিছুদিন পর ওয়ারাকা রাদি. `আনহু মৃত্যুবরণ করেন। আর অহী কিছুদিন স্থগিত থাকে।[10]
ইব্ন `আব্বাস রাদি. `আনহুমা হইতে বর্ণিত, মহান আল্লাহর বাণী: `তাড়াতাড়ি অহী আয়ত্ত করার জন্য আপনার জিহ্বা তার সাথে নাড়বেন না` [কোরআনের সুরা আল-কিয়ামাহ : ১৬] এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ অহী নাযিলের সময় তা আয়ত্ত করতে বেশ কষ্ট স্বীকার করতেন এবং প্রায়ই তিনি তাহাঁর উভয় ঠোঁট নাড়তেন। ইব্ন আব্বাস রাদি. `আনহুমা বলেন, `আমি তোমাকে দেখানোর জন্য ঠোঁট দুটি নাড়ছি যেভাবে রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর নাড়তেন।` সা`ঈদ রহ. [তাহাঁর শাগরিদদের] বলিলেন, `আমি ইব্ন `আব্বাস রাদি. `আনহুমাকে যেভাবে তাহাঁর ঠোঁট দুটি নাড়তে দেখেছি, সেভাবেই আমার ঠোঁট দুটি নড়াচ্ছি।` এই বলে তিনি তাহাঁর ঠোঁট দুটি নাড়ালেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা`আলা নাযিল করিলেন, “তাড়াতাড়ি অহী আয়ত্ত করার জন্য আপনি আপনার জিহবা তার সাথে নাড়বেন না। এর সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমারই।” [কোরআনের সুরা আল-কিয়ামাহ : ১৬-১৭] ইব্ন `আব্বাস রাদি. `আনহুমা বলেন অর্থাৎ মনোযোগ সহকারে শুনুন এবং চুপ থাকুন। “এরপর এর বিশদ ব্যাখ্যার দায়িত্ব আমারই” [কোরআনের সুরা আল-কিয়ামাহ : ১৯] ।` অর্থাৎ আপনি তা পাঠ করবেন এটাও আমার দায়িত্ব। তারপর যখন রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর কাছে জিবরীল আলাইহিস সালাম আসতেন, তখন তিনি মনোযোগ সহকারে কেবল শুনতেন। জিবরীল আলাইহিস সালাম চলে গেলে তিনি যেমন পড়েছিলেন, রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ ও ঠিক তেমনি পড়তেন।[11]
ইব্ন `আব্বাস রাদি. `আনহুমা হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। রমাদানে তিনি আরো বেশী দানশীল হতেন, যখন জিবরীল আলাইহিস সালাম তাহাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। আর রমাদানের প্রতি রাতেই জিবরীল আলাইহিস সালাম তাহাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁরা পরস্পর কুরআন তেলওয়াত করে শোনাতেন। নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ রহমতের বাতাস থেকেও অধিক দানশীল ছিলেন”। [12]
উবাদা ইবনু সামিত রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, তিনি বলেন: নাবী রাঃসাঃ এর উপর যখন অহী আসতো তখন তাতে তাহাঁর খুব কষ্ট হতো এবং তার চেহারা মুবারক মলিন হয়ে যেতো ।[13]
উবাদা ইবনু সামিত রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন: নাবী রাঃসাঃ এর উপর যখন অহী নাযিল হতো তখন তিনি মাথা নিচু করে ফেলতেন এবং তাহাঁর সাহাবীরাও মাথা নিচু করতেন। তারপর যখন অহী শেষ হয়ে যেতো, তিনি তাহাঁর মাথা তুলতেন।[14]
আবু উসমান রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাকে জানানো হল যে, একবার জিবরীল আলাইহিস সালাম নাবী রাঃসাঃ এর নিকট আসলেন। তখন উম্মে সালামা রাদি. `আনহা তার নিকট ছিলেন। তিনি এসে তাহাঁর সঙ্গে আলোচনা করিলেন। তারপর উঠে গেলেন। নাবী রাঃসাঃ উম্মে সালামাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, লোকটিকে চিনতে পেরেছ কি? তিনি বলিলেন, এইতো দেহইয়া। উম্মে সালামা রাদি. `আনহা বলেন, আল্লাহ্র কসম। আমি `দেহইয়া` বলেই বিশ্বাস করছিলাম, কিন্তু নাবী রাঃসাঃকে তাহাঁর খুতবায় জিবরীল আলাইহিস সালামের আগমনের কথা বলতে শুনলাম। [সুলায়মান [রাবী] বলেন] আমি আবু উসমানকে জিজ্ঞাসা করলাম এ হাদীসটি আপনি কার কাছে শুনেছেন? তিনি বলিলেন, উসামা ইবনু যায়েদ রাদি. `আনহু এর নিকট শুনেছি।[15]
জুনদুব রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত। তিনি বলিয়াছেন, একবার রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ফলে এক কি দু`রাত তিনি উঠতে পারেননি। জনৈকা মহিলা তাহাঁর কাছে এস বলল, হে মুহাম্মদ! আমার মনে হয়, তোমার শয়তান তোমাকে পরিত্যাগ করেছেন। তখন আল্লাহ নাযিল করিলেন,
“শপথ পূর্বাহ্নের, শপথ রজনীর, যখন তা হয় নিঝুম। তোমার প্রতিপালক তোমাকে পরিত্যাগ করেননি এবং তোমার প্রতি বিরূপও হননি”। [কোরআনের সুরা দোহা: ১-৩] [16]
সাফওয়ান ইবনু ইয়া`লা ইবনু উমাইয়া রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত যে, ইয়া`লা রাদি. `আনহু [অনেক সময়] বলতেন যে, আহা! রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর উপর অহী অবতীর্ণ হওয়ার মুহূর্তে যদি তাঁকে দেখতে পেতাম। ইয়া`লা রাদি. `আনহু বলেন, এরই মধ্যে একদা নাবী রাঃসাঃ জা`রানা নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন। তাহাঁর [মাথার] উপর একটি কাপড় টানিয়ে ছায়া করে দেওয়া হয়েছিল। আর সেখানে তাহাঁর সঙ্গে সাহাবীদের কয়েকজনও উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় তাহাঁর কাছে এক বেদুঈন আসলো। তার গায়ে খুশবূ মাখানো ছিলো এবং পরনে ছিলো একটি জুব্বা। সে বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে আপনি কী মনে করেন যে গায়ে খুশবু মাখানোর পর জুব্বা পরিধান করা অবস্থায `উমরা আদায়ের জন্য ইহরাম বেঁধেছে? তখন রাঃসাঃ তার দিকে কিছুক্ষণ তাকালেন আর তখনই তাহাঁর কাছে ওহী আসলো [প্রশ্নকারীর জবাব দেওয়ার পূর্বেই `উমর রাদি. `আনহু দেখলেন রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর চেহারায় অহী অবতীর্ণ হওয়ার চিহৃ দেখা যাচ্ছে] তাই `উমর রাদি. `আনহু হাত দিয়ে ইশারা করে ইয়া`লা রাদি. `আনহুকে আসতে বলিলেন। ইয়া`লা রাদি. `আনহু এলে `উমর রাদি. `আনহু তাহাঁর মাথাটি [ছায়ার নিচে] ঢুকিয়ে দিলেন। তখন তিনি [ইয়া`লা রাদি. `আনহু] দেখতে পেলেন যে, নাবী রাঃসাঃ এর চেহারা লাল বর্ণ হয়ে রয়েছে। আর ভিতরে শ্বাস দ্রুত যাতায়াত করছে। এ অবস্থা কিছুক্ষণ পর্যন্ত ছিল, তারপর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেন। তখন নাবী রাঃসাঃ বলিলেন, সে লোকটি কোথায়, কিছুক্ষণ আগে যে আমাকে `উমরার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল। এরপর লোকটিকে খুঁজে আনা হলে তিনি বলিলেন, তোমার গায়ে যে খুশবু রযেছে তা তুমি তিনবার ধুয়ে ফেল এবং জুব্বাটি খুলে ফেল। তারপর হজ্জ আদায়ে যা কিছু করে থাক `উমরাতেও সেগুলোই পালন কর।[17]
পরিচ্ছেদ
নাবী রাঃসাঃ এর স্বপ্ন সম্পর্কে
নাবীগণের স্বপ্ন অহীর অন্তর্ভুক্ত
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা`আলা বলিয়াছেন,
“অবশ্যই আল্লাহ তাহাঁর রাসূলকে স্বপ্নটি যথাযথভাবে সত্যে পরিণত করে দিয়েছেন। তোমরা ইনশাআল্লাহ নিরাপদে তোমাদের মাথা মুন্ডন করে এবং চুল ছেঁটে নির্ভয়ে আল-মাসজিদুল হারামে অবশ্যই প্রবেশ করবে। অতঃপর আল্লাহ জেনেছেন যা তোমরা জানতে না। সুতরাং এ ছাড়াও তিনি দিলেন এক নিকটবর্তী বিজয়”। [কোরআনের সুরা আল-ফাতহ: ২৭]
আবূ সালামা রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবূ সায়ীদ খুদরী রাদি. `আনহুর নিকট উপস্থিত হয়ে বলিলাম, আমাদের নিয়ে খেজুর বাগানে চলুন, [হাদীস সংক্রান্ত] আলাপ আলোচনা করব। তিনি বেরিয়ে আসলেন। আবূ সালামাহ্ রাদি. `আনহু বলেন, আমি তাকে বলিলাম, `লাইলাতুল কাদর` সম্পর্কে নাবী রাঃসাঃ থেকে যা শুনেছেন তা আমার কাছে বর্ণনা করুন। তিনি বলিলেন, রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ রামাদানের প্রথম দশ দিন ই`তিকাফ করিলেন। আমারও তাহাঁর সঙ্গে ই`তিকাফ করলাম। জিবরীল আলাইহিস সালাম এসে বলিলেন, আপনি যা তালাশ করছেন, তা আপনার সামনে রয়েছে। এরপর তিনি মধ্যবর্তী দশ দিন ই`তিকাফ করিলেন, আমরাও তাহাঁর সঙ্গে ই`তিকাফ করলাম। পুনরায় জিবরীল আলাইহিস সালাম এসে বলিলেন, আপনি যা তালাশ করছেন, তা আপনার সামনে রয়েছে। এরপর রামদানের বিশ তারিখ সকালে নাবী রাঃসাঃ খুতবা দিতে দাঁড়িয়ে বলিলেন, যারা আল্লাহ্ নাবীর সঙ্গে ই`তিকাফ করেছেন, তারা যেন ফিরে আসেন [আবার ই`তিকাফ করেন] কেননা, আমাকে স্বপ্নে `লাইলাতুল কাদর` অবগত করানো হয়েছে। তবে আমাকে তা [নির্ধারিত তারিখটি] ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে তা শেষ দশ দিনের কোনো এক বেজোড় তারিখে। স্বপ্নে দেখলাম যেন আমি কাদা ও পানির উপর সিজদা করছি। তখন মসজিদের ছাদ খেজুরের ডাল দ্বারা নির্মিত ছিল। আমরা আকাশে কোনো কিছুই [মেঘ] দেখিনি, এক খণ্ড হালকা মেঘ আসল এবং আমাদের উপর [বৃষ্টি] বর্ষিত হল। নাবী রাঃসাঃ আমাদের নিয়ে নামায আদায় করিলেন। এমন কি আমি রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ এর কপাল ও নাকের অগ্রভাগে পানি ও কাঁদার চিহ্ন দেখতে পেলাম। এভাবেই তাহাঁর স্বপ্ন সত্যে পরিণত হলো।[18]
আব্দুল্লাহ ইবনু উনায়স রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত যে, রাঃসাঃ বলেন, আমাকে কদরের রাত দেখান হয়েছিল। অতঃপর তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাকে ঐ রাতের ভোর সম্পর্কে স্বপ্নে আরও দেখানো হয়েছে যে, আমি পানি ও কাদার মধ্যে সিজদা করছি। রাবী বলেন, অতএব তেইশতম রাতে বৃষ্টি হল এবং রাঃসাঃ আমাদের সাথে [ফজরের] নামায আদায় করে যখন ফিরলেন, তখন আমরা তাহাঁর কপাল ও নাকের ডগায় কাদা ও পানির চিহ্ন দেখতে পেলাম। রাবী বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনু উনায়স রাদি. `আনহু বলতেন, তা ছিল তেইশতম। [19]
আবু মুসা রাদি. `আনহু সূত্রে নাবী রাঃসাঃ থেকে বর্ণি, তিনি বলেন: আমি স্বপ্লে দেখলাম যে, আমি মক্কা থেকে এমন এক দেশে হিজরত করে যাচ্ছি যেখানে খেজুর গাছ রয়েছে। তাতে আমার কল্পনা এদিকে গেল যে, তা ইয়ামামা কিংবা হাজার [এলাকা] হবে। পরে [বাস্তবে] দেখি যে, তা হল মাদীনা [যার পূর্ব নাম] ইয়াসরিব। আমি আমার এ স্বপ্নে আরও দেখলাম যে, আমি একটি তরবারি নাড়াচাড়া করলাম, ফলে তার মধ্যখানে ভেংগে গেল। তা ছিল উহুদের দিনে, যা মু`মিনগণের উপর আপতিত হয়েছিল। পরে আমি আর একবার সেই তরবারি নাড়া দিলে তা আগের চাইতে উত্তম হয়ে গেল। মুলত তা হল সে বিজয় ও ঈমানদারদের সম্মিলন, যা আল্লাহ সংঘটিত করিলেন [মক্কা বিজয়]। আমি তাতে একটি গরুও দেখলাম। আর আল্লাহ তা`আলাই কল্যাণের অধিকারী। মূলত তা হল উহূদের যুদ্ধে [শাহাদাতপ্রাপ্ত] ঈমানদারগণের দলটি। আর কল্যাণ হল সে কল্যাণ, যা পরবর্তীতে আল্লাহ তা`আলা দান করেছেন এবং সততা ও নিষ্ঠার সে সাওয়াব ও প্রতিদান যা আল্লাহ তা`আলা আমাদের বদর যুদ্ধের পরে দিয়েছেন।[20]
আবূ মূসা রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, নাবী রাঃসাঃ বলেন, আমি স্বপ্নে দেখতে পেলাম, আমি মক্কা থেকে হিজরত করে এমন এক স্থানে যাচ্ছি যেখানে প্রচুর খেজুর গাছ রয়েছে। তখন আমার ধারণা হল, এ স্থানটি ইয়ামামা অথবা হাজার হবে। পরে বুঝতে পেলাম, স্থানটি মদীনা ছিল। যার পূর্বনাম ইয়াসরিব। স্বপ্নে আমি আরো দেখতে পেলাম যে আমি একটি তরবারী হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। হঠাৎ তার অগ্রভাগ ভেঙ্গে গেল। উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল এটা তা-ই। তারপর দ্বিতীয় বার তরবারীটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম তখন তরবারীটি পূর্বাবস্থার চেয়েও অধিক উত্তম হয়ে গেল। এর তাৎপর্য হল যে, আল্লাহ মুসলিমগনকে বিজয়ী ও একত্রিত করে দেবেন। আমি স্বপ্নে আরো দেখতে পেলাম, একটি গরু [যা জবাই করা হচ্ছে] এবং শুনতে পেলাম আল্লাহ যা করেন সবই ভালো। এটাই হল উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের শাহাদাত বরণ। আর খায়ের হল আল্লাহ্র তরফ হতে আগত ঐ সকল কল্যাণই কল্যাণ এবং সত্যবাদিতার পুরষ্কার যা আল্লাহ আমাদেরকে বদর যুদ্ধের পর দান করেছেন।[21]
আবূ হুরাইরা রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, রাঃসাঃ বলিয়াছেন: আমরা সর্বশেষ এবং সর্বপ্রথম। [22]
রাঃসাঃ আরও বলেন, আমি ঘুমন্ত ছিলাম, এমতাবস্থায় আমার কাছে পৃথিবীর ভাণ্ডারসমূহ নিয়ে আসা হল। তখন আমার হাতে দুটি সোনার কংকন রেখে দেওয়া হলে সে দুটি আমার জন্য বড় ভারী মনে হল এবং এগুলো আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলল। তখন আমার কাছে অহীর মাধ্যমে জানালো যে, আমি যেন সে দুটির উপরে ফুঁ দেই। তখন আমি ফু দিলে সে দুটির অন্তর্হিত হয়ে গেল। আমি সে দুটির ব্যাখ্যা করলাম সে হল মিথ্যুক ভণ্ড নবুওয়তের দাবীদারদ্বয় যারা আমার সামনে উত্থিত হয়েছে। [অর্থাৎ] সান`আ অধিবাসী আসওয়াদ আল আনাসী এবং ইয়ামামার অধিবাসী মুসায়লামাতুল কাযযাব।[23]
সালিমের পিতা আবদুল্লাহ রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, নাবী রাঃসাঃ বলিয়াছেন: আমি দেখেছি যেন এলোমেলো কেশ বিশিষ্ট একজন কালো মহিলা মদীনা থেকে বের হয়ে মাহইয়া`আ নামক স্থানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে আর এটিকে `জুহফা` বলা হয়। আমি এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা এরুপ প্রদান করলাম যে, মদীনার মহামারী তথায় স্থানান্তরিত হল।[24]
আনাস ইবনু মালিক রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাঃসাঃ বলিয়াছেন: এক রাতে আমি দেখলাম যেভাবে ঘুমন্ত ব্যক্তি দেখে [অর্থাৎ স্বপ্ন], যেন আমরা উকবা ইবনু রাফি এর বাড়িতে রয়েছি। তখন আমাদের কাছে ইবনু তাব [নামক] খেজুর হতে কিছু রুতাব তথা তাজা খেজুর নিয়ে আসা হল। তখন আমি এর ব্যাখ্যা করলাম, দুনিয়ার বুকে আমাদের জন্য উন্নতি এবং আখিরাতে শুভ পরিণতি। আর আমাদের দীন অবশ্যই উত্তম।[25]
নাফি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] থেকে আব্দুল্লাহ ইবনু `উমর রাদি. `আনহু এ মর্মে বর্ণনা করেছেন যে, রাঃসাঃ বলিয়াছেন, আমি ঘুমের মাঝে আমাকে একটি মিসওয়াক দিয়ে মিসওয়াক করতে দেখলাম। তখন দু`ব্যক্তি আমাকে আকর্ষণ করল যাদের একজন অন্যজনের চাইতে বয়সে বড়। তখন আমি মিসওয়াকটি অল্প বয়স্ককে দিতে গেলে আমাকে বলা হলো, না বড়কে দিন- তাই তা আমি বয়স্ককে দিয়ে দিলাম। [26]
আবূ হুরাইরা রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাঃসাঃ কে বলতে শুনেছি যে, আমাকে সংক্ষিপ্ত অথচ বিশদ অর্থবহ বাণী সহকারে প্রেরণ করা হয়েছে এবং ভীতি উদ্রেককারী প্রভাব দ্বারা আমাকে সাহায্য করা হয়েছে। একদা আমি ঘুমিয়েছিলাম। আমার কাছে ভূ-পৃষ্ঠের ভাণ্ডারসমূহের চাবি পেশ করে আমার সামনে রাখা হল। [আবূ আবদুল্লাহ] মুহাম্মদ বুখারী [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বলেন, আমার কাছে এ কথা পৌছেছে যে, `সংক্ষিপ্ত অথচ বিশদ অর্থবহ বাণী` এর অর্থ হল, আল্লাহর অনেক বিষয় যা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে লেখা হত – একটি অথবা দু`টি বিষয়ে সন্নিবেশিত করে দেন। অথবা এর অর্থ অনুরূপ কিছু। [27]
আবূ হুরাইরা রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ বলিয়াছেন, অল্প শব্দে ব্যাপক অর্থবোধক বাক্য বলার শক্তি সহ আমি প্রেরিত হয়েছি এবং শত্রুর মনে ভীতির সঞ্চারের মাধ্যমে আমাকে সাহায্য করা হয়েছে। একবার আমি নিদ্রায় ছিলাম, এমতাবস্থায় পৃথিবীর ধন-ভাণ্ডারসমূহের চাবি আমার হাতে অর্পণ করা হয়। আবূ হুরাইরা রাদি. `আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ তো চলে গেছেন আর তোমরা তা বের করছ। [28]
আনাস ইবনু মালিক রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাঃসাঃ উম্মে হারাম বিন্ত মিলহান রাদি. `আনহার কাছে যাতায়াত করতেন এবং তিনি রাঃসাঃ কে খেতে দিতেন। উম্মে হারাম রাদি. `আনহা ছিলেন, উবাদা ইবনু সামিত রাদি. `আনহুর স্ত্রী। একদিন রাঃসাঃ তার ঘরে তাশরীফ নিয়ে গেলে তিনি তাঁকে আহার করান এবং তাহাঁর মথার উকুন বাচতে থাকেন। এক সময় রসূলুল্লাহ রাঃসাঃ ঘুমিয়ে পড়েন। তিনি হাসতে হাসতে ঘুম থেকে জাগলেন। উম্মে হারাম রাদি. `আনহা বলেন, আমি তাঁকে জিজ্ঞাস করলাম, `ইয়া রাসূলুল্লাহ! হাসির কারণ কি?` তিনি বলিলেন, `আমার উম্মাতের কিছু লোককে আল্লাহর পথে জিহাদরত অবস্থায় আমার সামনে পেশ করা হয়। তারা এ সমুদ্রের মাঝে এমনভাবে আরোহী যেমন বাদশাহ সিংহাসনের উপর অথবা বলিয়াছেন, বাদশাহর মত সিংহাসনে উপবিষ্ট।` এ শব্দ বর্ণনায় ইসহাক [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] সন্দেহ করেছেন। উম্মে হারাম রাদি. `আনহা বলেন, আমি বলিলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহর কাছে দো`আ করুন যেন আমাকে তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন।` রাঃসাঃ তার জন্য দো`আ করিলেন। এরপর রাঃসাঃ আবার মাথা রাখেন [ঘুমিয়ে পড়েন]। তারপর হাসতে হাসতে জেগে উঠলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, `ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনার হাসার কারণ কি?` তিনি বলিলেন, আমার উম্মাতের মধ্যে থেকে আল্লাহর পথে জিহাদরত কিছু লোককে আমার সামনে পেশ করা হয়।` পরবর্তী অংশ প্রথম উক্তির মত। উম্মে হারাম রাদি. `আনহা বলেন, আমি বলিলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আল্লাহর কাছে দো`আ করুন, যেন আমাকে তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি বলিলেন, তুমি তো প্রথম দলের মধ্যেই আছ। তারপর মু`আবিয়া ইবনু আবূ সুফিয়ান রাদি. `আনহুর সময় উম্মে হারাম রাদি. `আনহা জিহাদের উদ্দেশ্যে সামুদ্রিক সফরে যান এবং সমুদ্র থেকে যখন অবতরণ করেন তখন তিনি তাহাঁর সওয়ারী থেকে ছিটকে পড়েন। আর এতে তিনি শাহাদত বরণ করেন।[29]
[1] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৪৯৮১, সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ১৫২।
[2] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৭৭৩, সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ৪৪৯।
[3] মুসতাদরাক লিলহাকিম, হাদিস নম্বর ৩৭০১। তিনি বলেন, সনদটি সহিহ, ইমাম বুখারী ও মুসলিম উল্লেখ করন নি। ইমাম যাহাবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এটাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। প্রকৃত পক্ষে এটা হাসান হাদীস। কেননা এতে ‘আসিম ইবন আবী নুজুদ আছে, তিনি হাসানুল হাদীস। দেখুন ‘আল-মিজান’ গ্রন্থে।
[4] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৪৮৫৪।
[5] বু‘আস যুদ্ধ আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে সংঘঠিত দীর্ঘ একশ বিশ বছর স্থায়ী একটি যুদ্ধ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমন করার পূর্বপর্যন্ত এ যুদ্ধ চলছিল। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে তাদের উপর অনুগ্রহ করে এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটান। সেদিকে ইঙ্গিত দিয়েই আল্লাহ বলেছেন,
“আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। তারপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালবাসার সঞ্চার করেছেন। অতঃপর তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই-ভাই হয়ে গেল। আর তোমরা ছিলে আগুনের গর্তের কিনারায়, অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন”। [আলে-ইমরান: ১০৩]
[6] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৩৭৭৭।
[7] সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ১৬২।
[8] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৬৪২৭।
[9] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২।
[10] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৩।
[11] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৫, সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ৪৪৮।
[12] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৬, সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ২৩০৮।
[13] সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ২৩৩৪।
[14] সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ২৩৩৫।
[15] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৩৬৩৪, সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ২৪৫১।
[16] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৪৯৮৩।
[17] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৪৩২৯, সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ১১৮০।
[18] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৮১৩, সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ১১৬৭।
[19] সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ১১৬৮।
[20] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৩৬২২, সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ২২৭২।
[21] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৩৬২২।
[22] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৭০৩৬।
[23] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৪৩৭৪, সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ২২৭৪।
[24] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৭০৩৮।
[25] সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ২২৭০।
[26] সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ২২৭১।
[27] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৭০১৩।
[28] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২৯৭৭, সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ৫২৩।
[29] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২৭৮৮, সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ১৯১২।