রাঃ সাঃ এর নবুওয়তের প্রমাণ: অল্প পানিতে বরকত
রাঃ সাঃ এর নবুওয়তের প্রমাণ: অল্প পানিতে বরকত << নবুওয়তের মুজিযা হাদীসের মুল সুচিপত্র দেখুন
অষ্টম পরিচ্ছেদ: রাঃ সাঃ এর নবুওয়তের প্রমাণ: অল্প পানিতে বরকত
আনাস রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী রাঃসাঃ কোনো এক সফরে বের হয়েছিলেন। তাহাঁর সাথে সাহাবীরাও ছিলেন। তাঁরা চলতে লাগলেন তখন সালাতের সময় হয়ে গেল কিন্তু অজু করার জন্য কোথাও পানি পাওয়া গেল না। কাফিলার এক ব্যক্তি [আনাস রাদি. `আনহু নিজেই] সামান্য পানিসহ একটি পেয়ালা নাবী রাঃসাঃ এর নিকট উপস্থিত করিলেন। তিনি পেয়ালাটি হাতে নিয়ে তার-ই পানি দিয়ে অজু করিলেন এবং তাহাঁর হাতের চারটি আঙ্গুল পেয়ালার মধ্যে সোজা করে ধরে রাখলেন। আর বলিলেন, উঠ তোমরা সকলে অজু কর। সকলেই ইচ্ছামত অজু করে নিল। তাদেঁর সংখ্যা সত্তর বা এর কাছাকাছি ছিল। [1]
আনাস রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, নাবী রাঃসাঃ এর নিকট একটি পানির পাত্র আনা হল, তখন তিনি [মদীনার নিকটবর্তী] যাওরা নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন। নাবী রাঃসাঃ তাহাঁর হাত মোবারক ঐ পাত্রে রেখে দিলেন আর তখনই পানি আঙ্গলির ফাঁক দিয়ে উপচে পড়তে লাগল। ঐ পানি দিয়ে উপস্থিত সকলেই অজু করে নিলেন। কাতাদা [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বলেন, আমি আনাস রাদি. `আনহুকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের লোক সংখ্যা কত ছিল? আমরা তিন`শ অথবা তিন`শ এর কাছাকাছি ছিলাম। [2]
আনাস ইবনু মালিক রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাঃসাঃ কে দেখলাম, তখন আসরের সালাতের সময় হয়ে গিয়েছিল। আর লোকজন অযূর পানি তালশ করতে লাগল কিন্তু পেলনা। তারপর রাঃসাঃ এর কাছে কিছু পানি আনা হল। রাঃসাঃ সে পাত্রে তাহাঁর হাত রাখলেন এবং লোকজনকে সে পাত্র থেকে অযু করতে বলিলেন। আনাস রাদি. `আনহু বলেন, সে সময় আমি দেখলাম, তাহাঁর আঙ্গুলের নীচ থেকে পানি উথলে উঠছে। এমনকি তাহাঁদের শেষ ব্যক্তি পর্যন্ত তা দেয়ে উযূ করল। [3]
আনাস রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার সালাতের সময় উপস্থিত হলে যাঁদের বাড়ী নিকটে ছিল তাঁরা [অযু করার জন্য] বাড়ী চলে গেলেন। আর কিছু লোক রয়ে গেলেন [তাহাঁদের কোনো অযুর ব্যবস্থা ছিল না]। তখন রাঃসাঃ এর জন্য একটি পাথরের পাত্রে পানি আনা হল। পাত্রটি এত ছোট ছিল যে, তার মধ্যে তাহাঁর উভয় হাত মেলে দেওয়া সম্ভব ছিল না। তা থেকেই কওমের সকল লোক অযু করিলেন। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, `আপনারা কতজন ছিলেন?` তিনি বলিলেন, `আশিজন বা আরো বেশী।[4]
আনাস রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ রাঃসাঃ একপাত্র পানি চাইলেন। একটি বড় পাত্র তাহাঁর কাছে আনা হল, তাতে সামান্য পানি ছিল। তারপর তিনি তার মধ্যে তাহাঁর আঙ্গুল রাখলেন। আনাস রাদি. `আনহু বলেন, আমি পানির দিকে তাকাতে লাগলাম। তাহাঁর আঙ্গুলের ভেতর দিয়ে পানি উথলে উঠতে লাগল। আনাস রাদি. `আনহু বলেন, যারা অযু করেছিল, আমি অনুমান করলাম তাদের সংখ্যা ছিল ৭০ থেকে ৮০ জন। [5]
`ইমরান রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নাবী রাঃসাঃ এর সঙ্গে এক সফরে ছিলাম। আমরা রাতে চলতে চলতে শেষরাতে এক স্থনে ঘুমিয়ে পড়লাম। মুসাফিরের জন্য এর চাইতে মধুর ঘুম আর হতে পারে না। [আমরা এমন ঘোর নিদ্রায় নিমগ্ন ছিলাম যে] সূর্যের তাপ ছাড়া অন্য কিছু আমাদের জাগাতে পারেনি। সরবপ্রথম জাগলেন অমুক, তারপর অমুক, তারপর অমুক। [রাবী] আবূ রাজা` [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তাহাঁদের সবাইর নাম নিয়েছিলেন কিন্তু `আওফ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তাহাঁদের নাম মনে রাখতে পারেন নি। চতুর্থবারে জেগে ওঠা ব্যক্তি ছিলেন `উমর ইবনুল খাত্তাব রাদি. `আনহু। নাবী রাঃসাঃ ঘুমালে আমরা কেউ তাঁকে জাগাতাম না, যতখন তা তিনি নিজেই জেগে উঠতেন। কারণ নিদ্রাবস্থায় তাহাঁর উপর কি অবতীর্ণ হচ্ছে তা তো আমাদের জানা নেই। `উমর রাদি. `আনহু জেগে যখন মানুষের অবস্থা দেখলেন, আর তিনি ছিলেন দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তি—উচ্চস্বরে তাকবীর বলতে শুরু করিলেন। তিনি ক্রমাগত উচ্চস্বরে তাকবীর বলতে লাগলেন। এমন কি তাহাঁর শব্দে নাবী রাঃসাঃ জেগে উঠলেন। তখন লোকেরা তাহাঁর কাছে ওজর পেশ করলো। তিনি বলিলেন, কোনো ক্ষতি নেই বা বলিলেন, কোনো ক্ষতি হবে না। এখান থেকে চল। তিনি চলতে লাগলেন। কিছু দূর গিয়ে থামলেন। অযুর পানি আনলেন এবং অযু করিলেন। সালাতের আযান দেওয়া হল। তিনি লোকদের নিয়ে নামায আদায় করিলেন। নামায শেষ করে দেখলেন, এক ব্যক্তি পৃথক দাড়িয়ে আছেন। তিনি লোকদের সাথে নামায আদায় করেননি। নাবী রাঃসাঃ তাঁকে জিজ্ঞাসা করিলেন, হে অমুক! তোমাকে লোকদের সাথে নামায আদায় করতে কিসে বাধা দিল? তিনি বলিলেন, আমার উপর গোসল ফরয হয়েছে। অথচ পানি নেই। তিনি বলিলেন, পবিত্র মাটি নাও [তায়াম্মুম কর], এটাই তোমার জন্য যথেষ্ট। রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ পুনরায় সফর শুরু করিলেন। লোকেরা তাঁকে পিপাসার কষ্ট জানালো। তিনি অবতরণ করিলেন, তারপর অমুক ব্যক্তি কে ডাকলেন। [রাবী] আবূ রাজা` [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তাহাঁর নাম উল্লেখ করেছিলেন কিন্তু `আওফ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তা ভুলে গিয়েছেন। তিনি `আলী রাদি. `আনহুকে ডাকলেন। তারপর উভয়কেই পানি খুঁজে আনতে বলিলেন। তাঁরা পানির খোঁজে বের হলেন। তাঁরা পথে এক মহিলাকে দুই মশক পানি উটের উপর করে নিতে দেখলেন। তাঁরা জিজ্ঞাসা করিলেন, পানি কোথায়? সে বললো, গতকাল এ সময়ে আমি পানির নিকটে ছিলাম। আমার পাত্র পেছনে রয়ে গেছে। তাঁরা বলিলেন, এখন আমাদের সঙ্গে চলো। সে বললো, কোথায়? তাঁরা বলিলেন, রাঃসাঃ এর নিকট। সেই লোকটির কাছে যাকে সাবি` [ধর্ম পরিবর্তনকারী] বলা হয়? তাঁরা বলিলেন, হ্যাঁ, তোমরা যাকে এই বলে থাক। আচ্ছা এখন চল। তাঁরা তাকে নিয়ে রাঃসাঃ এর কাছে এলেন এবং সমস্ত ঘটনা খুলে বলিলেন। `ইমরান রাদি. `আনহু বলেন, লোকেরা স্ত্রীলোকটিকে তাহাঁর উট থেকে নামালেন। তারপর রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ একটি পাত্র আনতে বলিলেন এবং উভয় মশকের মুখ খুলে তাতে পানি ঢাললেন এবং সেগুলোর মুখ বন্ধ করে দিলেন। তারপর সে মশকের নীচের মুখ খুলে দিয়ে লোকদের মধ্যে পানি পান করার ও জন্তু-জানোয়ারকে পানি পান করানোর ঘোষণা দিলেন। তাহাঁদের মধ্যে যার ইচ্ছা পানি পান করিলেন ও জন্তুকে পান করালেন। অবশেষে যে ব্যক্তির গোসলের দরকার ছিল, তাকে এক পাত্র পানি দিয়ে রাসূলুল্লাহ্ রাঃসাঃ বলিলেন, এ পানি নিয়ে যাও এবং গোসল সার। ঐ মহিলা দাঁড়িয়ে দেখছিল যে তাহাঁর পানি নিয়ে কি করা হচ্ছে। আল্লাহর কসম! যখন তাহাঁর থেকে পানি নেওয়া শেষ হলো তখন আমাদের মনে হলো, মশকগুলো পুরবাপেক্ষা অধিক ভর্তি। তারপর নাবী রাঃসাঃ বলিলেন, মহিলার জন্য কিছু একত্র কর। লোকেরা মহিলার জন্য আজওয়া [বিশেষ খেজুর], আটা ও ছাতু এনে একত্র করিলেন। যখন তাঁরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী জমা করিলেন, তখন তা একটা কাপড়ে বেধে মহিলাকে উটের উপর সওয়ার করালেন এবং তাহাঁর সামনে কাপড়ে বাঁধা গাঁটরিটি রেখে দিলেন। রাঃসাঃ বলিলেন, তুমি জান যে, আমরা তোমার পানি মোটেই কম করিনি; বরং আল্লাহ তা`আলাই আমাদের পানি পান করিয়েছেন। এরপর সে তাহাঁর পরিজনের কাছে ফিরে গেল। তাহাঁর বেশ দেরি হয়েছিল। পরিবারের লোকজন তাঁকে জিজ্ঞেসা করল, হে অমুক! তোমার এত দেরি হল কেন? উত্তরে সে বললো একটা আশ্চার্যজনক ঘটনা! দু`জন লোকের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তাঁরা আমাকে সেই লোকটির কাছে নিয়ে গিয়েছিল, যকে সাবি` বলা হয়। আর সেখানে সে এসব করল। এ বলে সে মধ্যমা ও তর্যনী আঙ্গুল দিয়ে আসমান ও যমীনের দিকে ইশারা করে বলল, আল্লাহর কসম! সে এ দু`টির সবচাইতে বড় জাদুকর, নয় তো সে বাস্তবিকই আল্লাহর রাসূল। এ ঘটনার পর মুসলিমরা ওই মহিলার গোত্রের আশেপাশের মুশরিকদের উপর হামলা করতেন কিন্তু মহিলার সাথে সম্পর্কযুক্ত গোত্রের কোনো ক্ষতি করতেন না। এসব দেখে কি তোমরা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে না? তাঁরা সবাই মহিলাটির কথা মেনে নিল এবং ইসলামে দাখিল হয়ে গেল।[6]
মিসওয়ার ইবনু মাখরামা ও মারওয়ান রাদি. `আনহুমা হইতে বর্ণিত, তাদের উভয়ের একজনের বর্ণনা অপরজনের বর্ণনার সমর্থন করে, তারা বলেন, রাঃসাঃ হুদায়বিয়ার সময় বের হলেন। যখন সাহাবীগন রাস্তার এক জায়গায় এসে পৌঁছলেন, তখন নাবী রাঃসাঃ বলিলেন, `খালিদ ইবনু ওয়ালিদ কুরাইশদের অশ্বারোহী অগ্রগামী বাহিনী নিয়ে গামিম নামক স্থানে অবস্থান করছে। তোমরা ডান দিকে চল` আল্লাহর কসম! খালিদ মুসলিমদের উপস্থিতি টেরও পেলো না, এমনকি যখন তারা মুসলিম সেনাবাহিনীর পশ্চাতে ধূলিরাশি দেখতে পেল, তখন সে কুরাইশদের সংবাদ দেওয়ার জন্য ঘোড়া দৌড়িয়ে চলে গেল। এদিকে রাঃসাঃ অগ্রসর হয়ে যখন সেই গিরিপথে পৌঁছলেন, যেখান থেকে মক্কার সোজা পথ চলে গিয়েছে, তখন নাবী রাঃসাঃ উটনী বসে পড়ল। লোকজন তাকে [উঠাবার জন্য] `হাল-হাল` বলল, কাসওয়া ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রাঃসাঃ বলেন, `কাসওয়া ক্লান্ত হয়নি এবং তা তার স্বভাবও নয় বরং তাকে তিনিই আটকিয়েছেন যিনি হাতি বাহিনীকে আটকিয়েছিলেন।` তারপর তিনি বলিলেন, `সেই সত্তার কসম, যাঁর হাততে আমার প্রাণ` কুরাইশরা আল্লাহর সম্মানিত বিষয়সমূহের মধ্যে যে কোনো বিষয়ের সম্মান প্রদর্শনার্থে কিছু চাইলে আমি তা পূরণ করব।` এরপর তিনি তাহাঁর উষ্টিকে ধমক দিলে সে উঠে দাঁড়াল। রাবী বলেন, নাবী রাঃসাঃ তাদের পথ ত্যাগ করে হুদায়বিয়ার শেষ প্রান্তে অল্প পানি বিশিষ্ট কূপের কাছে অবতরণ করেন। লোকজন তা থেকে অল্প-অল্প পানি নিচ্ছিল। এভাবে কিছুক্ষনের মধ্যেই লোকজন পানি শেষ করে ফেলল এবং রাঃসাঃ এর নিকট পিপাসার অভিযোগ করা হলো। রাঃসাঃ তাহাঁর কোষ থেকে একটি তীর বের করিলেন এবং সেই তীরটি সেই কূপে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। আল্লাহর কসম! তখন পানি উপচে উঠতে লাগল, এমনকি সকলেই তৃপ্তি সহকারে পানি পান করিলেন। এমন সময় বুদাইল ইবনু ওয়ারকা আল-খুযাঈ তার খুযা`আ গোত্রের কিছু লোক নিয়ে এলো। তারা তিহামাবাসীদের মধ্যে রাঃসাঃ এর আন্তরিক হিতাকাঙ্খি ছিল। বুদাইল বলল, আমি কাব ইবনু লুওহাই ও আমির ইবনু লুওহাইকে রেখে এসেছি। তারা হুদায়বিয়ার প্রচুর পানির নিকট অবস্থান করছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে সাবকসহ দুগ্ধবতী অনেক উষ্ট্রী। তারা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ও বাইতুল্লাহ যিয়ারতে বাধা প্রদান করতে প্রস্তুত। রাসূরুল্লাহ রাঃসাঃ বলিলেন, `আমি তো কারো সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসিনি; বরং উমরা করতে এসেছি। যুদ্ধ নিঃসন্দেহে কুরাইশদের দূর্বল করে ফেলেছে, ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা যদি চায়, তবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের সঙ্গে সন্ধি করতে পারি আর তারা আমার ও কাফিরদের মধ্যকার বাধা তুলে নিবে। যদি আমি তাদের উপর জয়ী হয় তবে অন্যান্য লোক ইসলামে যেভাবে প্রবেশ করেছে, তারাও চাইলে তা করতে পারবে। আর না হয়, তারা এসময়টুকুতে শান্তিতে থাকবে। কিন্তু তারা যদি আমার প্রস্তাব অস্বীকার করে, তা হলে সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, আমার গর্দান বিচ্ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা এ ব্যাপারে তাদের যুদ্ধ করে যাব। আর নিশ্চয় আল্লাহ তা`আলা তাহাঁর দীনকে প্রতিষ্ঠিত করবেন।` বুদাইল বলল, `আমি আপনার বক্তব্য তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিব। এরপর বুদাইল কুরাইশদের কাছে এসে বলল, `তাহাঁর পক্ষ থেকে আমাদের কাছে তোমার কিছু বলার প্রয়োজন মনে করি না। কিন্তু তাদের বিবেকবান লোকেরা বলল, `তুমি তাঁকে যা বলতে শুনেছ, আমাদেরকে তা বল।` তারপর বুদাইল, রাঃসাঃ যা বলেছিলেন, সব তাদের শুনাল। তারপর উরওয়া ইবনু মাসউদ উটে দাঁড়িয়ে বলল, `হে লোকেরা! আমি কি তোমাদের পিতৃতুল্য নই? তারা বলল, `হ্যাঁ নিশ্চয়ই।` উরওয়া বলল, `তোমরা কি আমার সন্তান তুল্য নও?` তারা বলল, `হ্যাঁ অবশ্যই।` উরওয়া বলল, আমার সম্বন্ধে তোমাদের কি কোনো অভিযোগ আছে? তারা বলল, না। উরওয়া বলল, তোমরা কি জান না যে, আমি তোমদের সাহায্যের জন্য উকাযবাসীদের কাছে আবেদন করেছিলাম এবং তারা আমাদের আহবানে সাড়া দিতে অস্বীকার করলে আমি আমার আত্মীয়-স্বজন, সন্তান-সন্তুতি ও আমার অনুগতদের নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছিলাম? তারা বলল, হ্যাঁ, জানি। উরওয়া বলল, এই লোকটি তোমাদের কাছে একটি ভাল প্রস্তাব পেশ করেছেন। তোমরা তা মেনে নাও এবং আমাকে তাহাঁর কাছে যেতে দাও। তারা বলল, আপনি তাহাঁর কাছে যান। তারপর উরওয়া নাবী রাঃসাঃ এর কাছে এল এবং তাহাঁর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। নাবী রাঃসাঃ তার সঙ্গে কথা বলিলেন, যেমনিভাবে বুদাইলের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। উরওয়া তখন বলল, হে মুহাম্মদ, আপনি কি চান যে, আপনার কওমকে নিশ্চিহৃ করে দিবেন, আপনি আপনার পূর্বের আরববাসীদের এমন কারো কথা শুনেছেন যে, সে নিজ কওমের মুলোৎপাটন করতে উদ্যত হয়েছিল? আর যদি অন্য রকম হয়, [তখন আপনার কি অবস্থা হবে?] আল্লাহর কসম! আমি কিছু চেহারা দেখছি এবং বিভিন্ন ধরণের লোক দেখতে পাচ্ছি যাঁরা পালিয়ে যাবে এবং আপনাকে পরিত্যাগ করবে। তখন আবূ বকর রাদি. `আনহু তাকে বলিলেন, তুমি লাত দেবীর লজ্জাস্থান চেটে খাও। আমরা কি তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে যাব? উরওয়া বলল, সে কে? লোকজন বলিলেন, আবূ বকর। উরওয়া বলিলেন, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, আমি তাহাঁর কসম করে বলছি, আমার যদি আপনার ইহসান না থাকত, যার প্রতিদান আমি দিতে পারিনি, তাহলে নিশ্চই আপনার কথার জবাব দিতাম। রাবী বলিলেন, উরওয়া পুনরায় নাবী রাঃসাঃ এর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করিলেন। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সে রাঃসাঃ এর দাঁড়িতে হাত দিত। তখন মুগীরা ইবনু `শুবা রাদি. `আনহু রাঃসাঃ এর শিয়রে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং তাহাঁর সাথে ছির একটি তরবারী ও মাথায় ছিল লৌহ শিরস্ত্রা। উরওয়া যখনই রাঃসাঃ এর দাঁড়ির দিকে তার হাত বাড়াতো মুগীরা রাদি. `আনহু তাহাঁর তরবারীর হাতল দিয়ে তার হাতে আঘাত করতেন এবং বলতেন, রাঃসাঃ এর দাঁড়ি থেকে তোমার হাত হটাও। উরওয়া মাথা তুলে বলল, এ কে? লোকজন বলিলেন, মুগীরা ইবনু `শুবা। উরওয়া বলল, হে গাদ্দার! আমি কি তোমার গাদ্দারীর পরিণতি থেকে তোমাকে উদ্ধারের চেষ্টা করিনি? মুগীরা রাদি. `আনহু জাহেলী যুগে কিছু লোকদের সা্থে ছিলেন। একদিন তাদের হত্যা করে তাদের সহায় সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। তারপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। নাবী রাঃসাঃ বলিলেন, আমি তোমার ইসলাম মেনে নিলাম, কিন্তু যে মাল তুমি নিয়েছ, তার সাথে আমার কোনো সর্ম্পক নেই। তারপর রউরওয়া চোখের কোনো দিয়ে সাহাবীদের দিকে তাকাতে লাগল। সে বলল, আল্লাহর কসম! রাঃসাঃ কখনো থুথু ফেললে তা সাহাবীদের হাতে পড়তো এবং তা গায়ে মুখে মেখে ফেলতেন। তিনি তাহাঁদের কোনো আদেশ দিলে তা তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে পালন করতেন। তিনি অযু করলে তাহাঁর অযুর পানির জন্য তাহাঁর সাহাবীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হতো। তিনি যখন কথা বলতেন, তখন নিরবে তা শুনতেন এবং তাহাঁর সম্মানার্থে সাহাবীগন তাহাঁর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেন না। তারপর উরওয়া তার সঙ্গীদের কাছে ফিরে গেল এবং বলল, হে আমার কওম, আল্লাহর কসম! আমি অনেক রাজা বাদশাহর দরবারে প্রতিনিধিত্ব করেছি। কায়সার [রোম] কিসরা [পারস্য] ও নাজ্জাশী [আবিসিনিয়ার] সম্রাটের দরবারে দূত হিসেবে গিয়েছি; কিন্তু আমি আল্লাহর কসম করে বলতে পারি যে, কোনো রাজা বাদশাহকেই তার অনুসরীদের ন্যায় এত সম্মান করতে দেখিনি, যেমন মুহাম্মদের অনুসারীরা তাঁকে করে থাকে। আল্লাহর কসম! রাঃসাঃ যদি থুথু ফেলেন, তখন তা কোনো সাহাবীর হাতে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা তা তাদের গায়ে মুখে মেখে ফেলেন। তিনি কোনো আদেশ দিলে তারা তা সঙ্গে সঙ্গে পালন করেন; তিনি অযু করলে তাহাঁর অযুর পানি নিয়ে সাহাবীগণের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়; তিনি কথা বললে, সাহাবীগণ নিশ্চুপ হয়ে শুনেন। এমনকি তাহাঁর সম্মানার্থে তারা তাহাঁর চেহারার দিকেও তাকান না। তিনি তোমাদের কাছে একটি ভালো প্রস্তাব পাঠিয়েছেন, তোমরা তা মেনে নাও। তা শুনে কিনানা গোত্রের এক ব্যক্তি বলল, আমাকে তাহাঁর নিকট যেতে দাও। লোকেরা বলল, যাও। সে যখন রাঃসাঃ ও সাহাবীগণের কাছে এল তখন রাঃসাঃ বলিলেন, এ হলো অমুক ব্যক্তি এবং এমন গোত্রের লোক, যারা কুরবানীর পশুকে সম্মান করে থাকে। তোমরা তার কাছে কুরবাণীর পশু নিয়ে আস। তারপর তার কাছে তা নিয়ে আসা হলো এবং লোকজন তালবিয়া পাঠ করতে করতে তার সামনে এলেন। তা দেখে লোকটি বলল, সুবাহান্নাল্লাহ! এমন সব লোকদেরকে কা`বা যিয়ারত থেকে বাধা দেওয়া সঙ্গত নয়। তারপর সে তার সঙ্গীদের কাছে ফিরে গিয়ে বলল, আমি কুরবাণরি পশু দেখে এসেছি, সেগুলোকে কিলাদা পরানো হয়েছে ও চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই তাদের কা`বা যিয়ারত বাধা প্রদান সঙ্গত মনে করি না। তখন তাদের মধ্যে থেকে মিকরায ইবনু হাফস নামক এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে তাহাঁর কাছে যেতে দাও। তারা বলল, তাহাঁর কাছে যাও। তারপর সে যখন মুসলিমদের নিকটবর্তী হল, নাবী রাঃসাঃ বলিলেন, এ হলো মিরকাজ, দুষ্ট প্রকৃতির লোক`। অতপর সে কথা বলতে লাগল, এমন সময় সুহাইল ইবনু `আমর আসল। মা`মার [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বলেন, সুহাইল ইবনু আমর আসলে রাঃসাঃ বলিলেন, `তোমাদের জন্য তোমাদের কাজ সহজ হয়ে গেল।` মা`মার [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বলেন, যুহরী [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তার বর্ণিত হাদীসে বলিয়াছেন যে, সুহাইল এসে বলল, আমাদের ও আপনার মাঝে চুক্তি লিখুন। নাবী রাঃসাঃ তখন একজন লিখক ডাকলেন। নাবী রাঃসাঃ বলিলেন, লিখুন: `বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম`। তখন সুহাইল বলল, আল্লাহর কসম! রহমান কে-? আমরা তা জানিনা, বরং পূর্বে আপনি যেমন লিখতেন `বিসমিআল্লাহুম্মা` সেভাবে লিখুন। মুসলিমগন বলিলেন, আল্লাহর কসম! আমরা `বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম` ছাড়া আর কিছু লিখব না। তখন নাবী রাঃসাঃ বলিলেন, `বিসমিআল্লাহুম্মা` লিখ। তারপর বলিলেন, এটা যার উপর চুক্তিবদ্ধ হয়েছে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ রাঃসাঃ। তখন সুহাইল বলল, আল্লাহর কসম! আমরা যদি আপনাকে আল্লাহর রাসূল বলেই বিশ্বাস করতাম, তাহলে আপনাকে কা`বা যিয়ারত দেখে বাধা দিতাম না এবং আপনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে উদ্যত হতাম না। বরং আপনি লিখুন, আব্দুল্লাহ পুত্র মুহাম্মদ [এর পুত্র থেকে]। তখন নাবী রাঃসাঃ বলিলেন, `নিশ্চুই আমি আল্লাহর রাসূল; কিন্তু তোমরা যদি আমাকে অস্বীকার কর তবে লিখ, আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ।` যুহরী [র] বলেন, এটি এ জন্য যে, তিনি বলেছিলেন, তারা যদি আল্লাহর পবিত্র বস্তুগুলোর সম্মান করার কোনো কথা দাবী করে তাহলে আমি তাদের সে দাবী মেনে নিব। তারপর নাবী রাঃসাঃ বলিলেন, এ চুক্তি কর যে, তারা আমাদের ও কা`বা শরীফের মধ্যে কোনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে না, যাতে আমরা [নির্বিঘ্নে] তাওয়াফ করতে পারি। সুহাইল বলল, আল্লাহর কসম! আরববাসীরা যেন এ কথা বলার সুযোগ না পায় যে, এ প্রস্তাব গ্রহণে আমাদের বাধ্য করা হয়েছে। বরং আগামী বছর তা হতে পারে। তারপর লেখা হলো। সুহাইল বলল, এ-ও লিখা হোক যে, আমাদের কোনো লোক যদি আপনার কাছে চলে আসে এবং সে যদিও আপনার দীন গ্রহণ করে থাকে, তবুও তাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিবেন। মুসলিমগণ বলিলেন, সুবাহান্নাল্লাহ! যে ইসলাম গ্রহন করে আমাদের কাছে এসেছে, তাকে কেমন করে মুশরিকদের কাছে ফেরত দেওয়া যেতে পারে? এমন সময় আবূ জানদাল ইবনু সুহাইল ইবনু `আমর সেখানে এসে উপস্থি হলেন। তিনি বেরি পরিহিত অবস্থায় ধীরে ধীরে চলছিলেন। তিনি মক্কার নিম্নচল থেকে বের হয়ে এসে মুসলিমদের সামনে নিজেকে পেশ করিলেন। সুহাইল বলল, হে মুহাম্মদ! আপনার সাথে আমার চুক্তি হয়েছে, সে অনুযায়ী প্রথম কাজ হলো তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবেন। রাঃসাঃ বলিলেন, এখনো তো চুক্তি সম্পাদিত হয়নি। সুহাইল বলল, আল্লাহর কসম! তাহলে আমি আপনাদের সঙ্গে আর কখনো সন্ধি করব না। রাঃসাঃ বলিলেন, কেবল এ লোকটিকে আমার কাছে থাকার অনুমতি দাও। সে বলল, না। এ অনুমতি আমি দেবো না। রাঃসাঃ বলিলেন, হ্যাঁ, তুমি এটা কর। সে বলল, আমি তা করব না। মিকরায বলল, আমরা তাকে আপনার কাছে থাকার অনুমতি দিলাম। আবু জানদাল রাদি. `আনহু বলিলেন, হে মুসলিম সমাজ, আমাকে মুশরিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, অথচ আমি মুসলিম হয়ে এসেছি। আপনার কি দেখছেন না, আমি কত কষ্ট পাচ্ছি। আল্লাহর রাস্তায় তাকে অনেক নির্যাতিত করা হয়েছে। উমর ইবনু খাত্তাব রাদি. `আনহু বলিলেন, আমি রাঃসাঃ এর কাছে এলাম এবং বলিলাম, আপনি কি আল্লাহর সত্য নাবী নন? তিনি বলিলেন, হ্যাঁ। আমি বলিলাম, আমরা কি হকের উপর নই? আর আমাদের দুশমনরা কি বাতিলের উপর নয়? তিনি বলিলেন, হ্যাঁ। আমি বলিলাম, তাহলে দীনের ব্যাপারে কেন আমরা হেয় হবো? রাঃসাঃ বলিলাম, `আমি অবশ্যই রাসূল; অতএব আমি তার অবাধ্য হতে পারি না, অথচ তিনিই আমার সাহার্যকারী। আমি বলিলাম, আপনি কি আমাদের বলেন নাই যে, আমরা শীঘ্রই বায়তুল্লাহ যাব এবং তাওয়অফ করব। তিনি বলিলেন, হ্যাঁ, আমি কি এ বছরই আসার কথা বলেছি? আমি বলিলাম, না। তিনি বলিলেন, তুমি অবশ্যই কা`বা গৃহে যাবে এবং তাওয়াফ করবে। উমর রাদি. `আনহু বলেন, তারপর আমি আবূ বকর রাদি. `আনহুর কাছে গিয়ে বলিলাম, হে আবূ বকর। তিনি কি আল্লাহর সত্য নাবী নন? আবূ বকর রাদি. `আনহু বলিলেন, `অবশ্যই।` আমি বলিলাম, আমরা কি সত্যের উপর নই এবং আমাদের দুশমনরা কি বাতিলের উপর নয়? আবু বকর রাদি. `আনহু বলিলেন, নিশ্চয়ই। আমি বলিলাম, তবে কেন আমরা এখন আমাদের দীনের ব্যাপারে এত হীনতা স্বীকার করব? আবূ বকর রাদি. `আনহু বলিলেন, `ওহে` নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহর রাসূল এবং তিনি তাহাঁর রবের নাফরমানী করতে পারেন না। তিনিই তাহাঁর সাহায্যকারী। তুমি তাহাঁর অনুসরণকে আকড়ে ধরো। আল্লাহর কসম! তিনি সত্যের উপর আছেন। আমি বলিলাম, তিনি কি বলেননি যে, আমরা অচিরেই বায়তুল্লাহ যাব এবং তার তাওয়াফ করব। আবু বকর রাদি. `আনহু বলিলেন, অবশ্যই। কিন্তু তুমি এবারই যে যাবে তিনি এ কথা কি বলেছিলেন? আমি বলিলাম, না। আবু বকর রাদি. `আনহু বলিলেন, তবে নিশ্চয়ই তুমি সেখানে যাবে এবং তার তাওয়াফ করবে। যুহরী [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বলেন যে, উমর রাদি. `আনহু বলেছিলেন, আমি এর জন্য [অর্থাৎ ধৈর্যহীনতার কাফফারা হিসাবে] অনেক নেক আমল করেছি। বর্ণনাকারী বলেন, সন্ধিপত্র লেখা শেষ হলে রাঃসাঃ সাহাবাদেরকে বলিলেন, তোমরা উঠ এবং কুরবানী কর ও মাথা কামিয়ে ফেল। রাবী বলেন, আল্লাহর কসম! রাঃসাঃ তা তিনবার বলার পরও কেউ উঠলেন না। তাদের কাউকে উঠতে না দেখে রাঃসাঃ উম্মে সালামা রাদি. আনহার কাছে এসে লোকদের এ আচরণের কথা বলেন। উম্মে সালামা রাদি. আনহা বলিলেন, হে আল্লাহর নাবী, আপনি যদি তাই চান, তাহলে আপনি বাইরে যান ও তাদের সাথে কোনো কথা না বলে আপনার উট আপনি কুরবানী করুন এবং ক্ষুরকার ডেকে মাথা মুড়িয়ে নিন। সেই অনুযায়ী রাঃসাঃ বেরিয়ে গেলেন এবং কারো সাথে কোনো কথা না বলে নিজের পশু কুরবানী দিলেন এবং ক্ষুরকার ডেকে মাথা মুড়িয়ে নিলেন। তা দেকে সাহাবীগণ উঠে দাঁড়ালেন ও নিজ নিজ পশু কুরবানী দিলেন এবং একে অপরের মাথা কামিয়ে দিলেন। অবস্থা এমন হলো যে, ভীড়ের কারণে একে অপরের উপর পড়তে লাগলেন। তারপর রাঃসাঃ এর কাছে কয়েকজন মুসলিম মহিলা এলেন। তখন আল্লাহ তা`আলা নাযিল করিলেন, “হে মুমিনগণ! মুমিন মহিলারা তোমাদের কাছে হিযরত করে আসলে তাদেরকে পরীক্ষা করুন”। [কোরআনের সুরা আল-মুমতাহিনা: ১০] তখন উমরা রাদি. `আনহু তার দুস্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেন, তারা মুশরিক ছিল। তাদের একজনকে মু`আবিয়া ইবনু আবূ সুফিয়ান এবং অপরজনকে সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া বিয়ে করেন। তারপর রাঃসাঃ মদীনায় ফিরে আসলেন। তখন আবু বাসীর রাদি. `আনহু নামক কোরাইশ গোত্রের এক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে রাঃসাঃ এর কাছে এলেন। মক্কার কুরাইশরা তাহাঁর তালাশে দু`জন লোক পাঠাল। তারা [রাঃসাঃ এর কাছে এসে] বলল, আপনি আমাদের সাথে যে চুক্তি করেছেন [তা পূর্ণ করুন]। তিনি তাকে ঐ দুই ব্যক্তির হাওয়ালা করে দিলেন। তাঁরা তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল এবং যুল-হুলায়ফায় পৌছে অবতরণ করল আর তাদের সাথে যে খেজুর ছিল তা খেতে লাগল। আবু বাসীর রাদি. `আনহু তাদের একজনকে বলিলেন, আল্লাহর কসম! হে অমুক, তোমার তরবারীটি খুবই চমৎকার দেখছি। সে লোকটি তরবারীটি বের করে বলল, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম! এটি একটি উৎকৃষ্ট তরবারী। আমি একাধিক বার তা পরীক্ষা করেছি। আবূ বাসীর রাদি. `আনহু বলিলেন, তলোয়ারটি আমি দেখতে চাই তা আমাকে দেখাও। তারপর লোকটি আবূ বাসীরকে তলোয়ারটি দিল। আবূ বাসীর সেটি দ্বারা তাকে এমন আঘাত করিলেন যে, তাতে সে মরে গেল। তার অপর সঙ্গী পালিয়ে মদীনায় এসে পৌছল এবং দাঁড়িয়ে মসজিদে প্রবেশ করল। রাঃসাঃ তাকে দেখে বলিলেন, এই লোকটি ভীতিজনক কিছু দেখে এসেছে। ইতিমধ্যে লোকটি নাবী রাঃসাঃ এর কাছে পৌঁছে বলল, আল্লাহর কসম! আমার সঙ্গীকে হত্যা করা হয়েছে, আমিও নিহত হতাম। এমন সময় আবূ বাসীর রাদি. `আনহুও সেখানে এসে উপস্থিত হলেন এবং বলিলেন, ইয়া নাবীআল্লাহ! আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনার দায়িত্ব সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন। আমাকে তার কাছে ফেরত দিয়েছেন; এ ব্যাপারে আল্লাহ আমাকে তাদের কবল থেকে নাজাত দিয়েছেন। নাবী রাঃসাঃ বলিলেন, সর্বনাশ! এতো যুদ্ধের আগুন প্রজ্জলিতকারী, কেউ যদি তাকে বিরত রাখত। আবূ বাসীর রাদি. `আনহু যখন এ কথা শুনলেন, তখন বুঝতে পারলেন যে, তাকে তিনি আবার কাফিরদের কাছে ফেরত পাঠাবেন। তাই তিনি বেরিয়ে নদীর তীরে এসে পড়লেন। রাবী বলেন, এ দিকে আবু জানদার ইবনু সুহাইল কাফিরদের কবল থেকে পালিয়ে এসে আবূ বাসীরের সঙ্গে মিলিত হলেন। এরপর থেকে কুরাইশ গোত্রের যে-ই ইসলাম গ্রহণ করত, সে-ই আবূ বাসীরের সঙ্গে এসে মিলিত হতো। এভাবে তাদের একটি দল হয়ে গেল। আল্লাহর কসম! তারা যখনই শুনতেন যে, কুরাইশদের কোনো বানিজ্য কাফিলা সিরিয়া যাবে, তখনই তারা তাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন আর তাদের হত্যা করতেন ও তাদের মাল সামান কেড়ে নিতেন তখন কুরাইশরা নাবী রাঃসাঃ এর কাছে লোক পাঠাল। আল্লাহ ও আত্মীয়তার ওয়াসীলা দিয়ে আবেদন করল যে, আপনি আবূ বাসীরের কাছে এর থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ পাঠান। এখন থেকে রাঃসাঃ এর কাছে] কেউ এলে সে নিরাপদ থাকবে [কুরাইশদের কাছে ফেরত পাঠাতে হবে না]। তারপর নাবী রাঃসাঃ তাদের কাছে নির্দেশ পাঠালেন। এ সময় আল্লাহ তা`আলা নাযিল করেন, “তিনি তাদের হাত তোমাদের থেকে এবং তোমাদের হাত হাত তাদের থেকে বিরত রেখেছেন…….জাহেলী যুগের অহমিকা”। পর্যন্ত [কোরআনের সুরা আল-ফাতহ: ২৬] তাদের অহমিকা এই ছিল যে, তারা মুহাম্মদ রাঃসাঃকে আল্লাহর নাবী বলে স্বীকার করেনি, `বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম` বলে স্বীকার করেনি এবং বায়তুল্লাহ ও মুসলিমদের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। [7]
জাবির ইবনু আবদুল্লাহ্ রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুদাবিয়ায় অবস্থান কালে একদিন সাহাবায়ে কেরাম পানির পীপাসায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়লেন। নাবী রাঃসাঃ এর সম্মুখে একটি [চামড়ার] পাত্রে অল্প পানি ছিল। তিনি অজু করিলেন। তাহাঁর নিকট পানি আছে মনে করে সকলে ঐ দিকে ধাবিত হলেন। নাবী রাঃসাঃ বলিলেন,তোমাদের কি হয়েছে? তাঁরা বলিলেন, আপনার সম্মুখস্থ পাত্রের সামান্য পানি ব্যতীত অজু ও পান করার মত পানি আমাদের নিকট নাই। নাবী রাঃসাঃ ঐ পাত্রে তাহাঁর হাত রাখলেন। তখনই তাহাঁর হাত উপচিয়ে ঝর্ণা ধারার ন্যায় পানি ছুটিয়ে বের হতে লাগলো। আমরা সকলেই পানি পান করলাম আর অজু করলাম। সালিম [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] [একজন রাবী] বলেন, আমি জাবির রাদি. `আনহুকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা কতজন ছিলেন? আমরা যদি এক লক্ষও হতাম, তবুও আমারদের জন্য পানি যথেষ্ট হত। তবে আমরা ছিলাম মাত্র পনেরশ`। [8]
জাবির ইবনু আবদুল্লাহ্ রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নাবী রাঃসাঃ এর সংগে ছিলাম, এ সময় আসরের সময় হয়ে গেল। অথচ আমাদের সংগে বেঁচে যাওয়া সামান্য পানি ব্যতীত কিছুই ছিল না। তখন সেটুকু একটি পাত্রে রেখে পাত্রটি নাবী রাঃসাঃ এর সামনে পেশ করা হল। তিনি পাত্রটির মধ্যে নিজের হাত ঢুকিয়ে দিলেন এবং আঙ্গলগুলো ছড়িয়ে দিলেন। এরপর বলিলেন, এস যাদের অযুর প্রয়োজন আছে। বরকত তো আসে আল্লাহ`র কাছ থেকে। জাবির রাদি. `আনহু বলেন, তখন আমি দেখলাম, নাবী রাঃসাঃ এর আঙ্গলগুলোর ফাঁক থেকে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। লোকজন অযূ করল এবং পানি পান করল। আমিও আমার উদরে যতটুকু সম্ভব ছিল ততটুকু পান করতে ত্রুটি করলাম না। কেননা, আমি জানতাম এটি বরকতে পানি। রাবী বলেন, আমি জাবির রাদি. `আনহুকে বলিলাম, সে দিন আপনারা কত লোক ছিলেন? তিনি বলিলেন, এক হাজার চারশ জন।[9]
বারা`আ ইবনু আযির রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নাবী রাঃসাঃ এর সাথে হুদাবিয়ায় চৌদ্দশ লোক ছিলাম। হুদায়বিয়া একটি কুপ, আমরা তা হতে পানি এমন ভাবে উঠিয়ে নিলাম যে তাতে এক ফোঁটা পানিও বাকী থাকলো না। নাবী রাঃসাঃ কূপের কিনারায় বসে কিছু পানি আনার জন্য আদেশ করিলেন। [সামান্য পানি আনা হলো] তিনি কুল্লি করে ঐ পানি কূপে নিক্ষেপ করিলেন। কিছু সময় অপেক্ষা করলাম। তখন কূপটি পানিতে ভরে গেল। আমরা পান করে তৃপ্তি লাভ করলাম, আমাদের উটগুলোও পানি পানে তৃপ্ত হল। অথবা বলিয়াছেন আমাদের উটগুলো পানি পান করে প্রত্যাবর্তন করল। [10]
আবদুল্লাহ ইবনু মাস`উদ রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা [সাহাবাগণ] অলৌকিক ঘটনাসমূহকে বরকত ও কল্যাণকর মনে করতাম আর তোমরা [যারা সাহাবী নও] ঐ সব ঘটনাকে ভীতিকর মনে কর। আমরা রাঃসাঃ এর সাথে সফরে ছিলাম। আমাদের পানি কমিয়ে আসল। তখন নাবী রাঃসাঃ বলিলেন, অতিরিক্ত পানি তালাশ কর। [তালাশের পর] সাহাবাগণ একটি পাত্র নিয়ে আসলেন যার ভেতর সামান্য পানি ছিল। নাবী রাঃসাঃ তাহাঁর হাত মোবারক ঐ পাত্রের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন এবং ঘোষণা করিলেন, বরকতময় পানি নিতে সকলেই এসো। এ বরকত আল্লাহ তা`আলার পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। তখন আমি দেখতে পেলাম রাঃসাঃ এর আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে পানি উপচে পড়ছে। সময় বিশেষে আমরা খাদ্য-দ্রব্যের তাসবীহ পাঠ শুনতাম আর তা খাওয়া হতো।[11]
আয়াস ইবনে সালামা রাদি. `আনহু বলেন, আমার পিতা [সালামা ইবনুল আকওয়া রাদি. `আনহু বর্ণনা করেছেন, আমরা রাঃসাঃ এর সঙ্গে হুদায়বিয়ায় আগম করলাম। আমরা সংখ্যায় ছিলাম চৌদ্দশ` এবং তাদের [মুসলিমদের] কাছে ছিলো এমন পঞ্চাশটি বকরী যাদের দুগ্ধ দোহন করা হতো না। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ [সা] সংকীর্ণ একটি কুপের পাড়ে তাশরিফ রাখলেন। পরে তিনি দো`আ করেছেন অথবা থুথু ফেলেছেন, [যা-ই হোক] ফলে কুপের পানি কানায় কানায় ভরতি হয়ে গেলো। আমরা সকলে নিজেরাও পান করলাম, আর আমাদের জানোয়ারগুলোকে পান করালাম। পরে তিনি আমাদেরকে একটি বৃক্ষের নীচে [বাবলা গাছ] বাই`য়াত করার জন্য আহবান করিলেন। তিনি [সালামা] বলেন, সকলের আগে আমিউ [তাহাঁর হাতে হাত রেখে] বাই`য়াত করলাম। পরে লোকেরা একের পর এক বাইয়াত করলো। অবশেষে বাই`য়াতের সিলসিলা মাঝামাঝি পর্যায়ে পৌঁছলে, তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বলিলেন, হে সালামা! বাইয়াত করো। আমি বলিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো সমস্ত লোকের আগেই বাইয়াত করেছি। তিনি বলিলেন, আবারও বাইয়াত করো। সুতরাং আমি দ্বিতীয়বার বাইয়াত করলাম। সালামা বলেন, রাঃসাঃ দেখলেন যে আমি নিরস্ত্র। অর্থাৎ আমার কাছে যুদ্ধের কোনো হাতিয়ার নেই। সুতরাং তিনি আমাকে একখানা ঢাল দিলেন [তিনি `হাজানা` দিয়েছেন অথবা `দারাকা`, দুটির অর্থ প্রায় কাছাকাছি]। এরপর তিনি [লোকদেরকে] বাইয়াত করাতে থাকলেন। অবশেষে যখন বাইয়াত সিলসিলা প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছলো তখন তিনি আমাকে পুনরায় লক্ষ্য করে বলিলেন, হে সালামা! তুমি কি আমার হাতে বাইয়াত করবে না? আমি বলিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো একবার সমস্ত লোকের পূর্বেই বাইয়াত করেছি। আবার মাঝখানেও একবার বাইয়াত করেছি। তিনি বলিলেন, আবারও করো। সালামা বলেন, পুনরায় তৃতীয়বার তাহাঁর হাতে বাইয়াত করলাম। পরে তিনি আমাকে বলিলেন, হে সালামা! আমি যে তোমাকে একখানা ঢাল দিয়েছিলাম, তা কি করলে? আমি বলিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার চাচা আমেরের সাথে আমার সাক্ষাত হলে, দেখলাম, তিনি নিরস্ত্র তাহাঁর কাছে কোনো হাতিয়ার নেই। অতএব, আমি তা তাঁকে দিয়ে ফেলেছি। সালামা বলেন, আমার কথা শুনে রাঃসাঃ হেসে দিলেন এবং বলিলেন, তুমি তো ঐ ব্যক্তির মতো, সে সর্বপ্রথম বলে, হে আল্লাহ! আমাকে এমন একজন বন্ধু মিলিয়ে দাও, যে হবে আমার নিজের [দেহের] চাইতে আমার কাছে অধিক প্রিয়। সালামা বলেন, পরে মুশরিকরা আমার সাথে একটা সন্ধিচুক্তি করার জন্য দূত পাঠিয়ে যোগাযোগ স্থাপন করলো। পরে আমাদের মধ্যে বার বার হাঁটাহাঁটি করলে শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথে একটা সন্ধি চুক্তি সম্পাদন হয়ে গেলো। সালামা বলেন, আমি ছিলাম, তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ্ রাদি. `আনহুর খাদেম। আমি তাহাঁর ঘোড়াকে পানি পান করাতাম ও তার গায়েল ধুলাবালি পরিস্কার করতাম এবং তাহাঁর খেদমত করতাম, এর বিনিময়ে আমি তাহাঁর খাদ্য থেকেই খাওয়া দাওয়া করতাম। আর আমার পরিবার-পরিজন ও মাল-সম্পদ যা ছিলো তা আল্লাহ তা`আলা ও তাহাঁর রাঃসাঃ এর নামে ছেড়ে রাখলাম। সালামা রাদি. `আনহু বলেন, মক্কাবাসীদের সাথে আমাদের সন্ধি-চুক্তি হয়ে গেলে, আমরা পরস্পর পরস্পরের সাথে মিলেমিশে চলতে লাগলাম। [ঠিক এ সময় একদিন] আমি একটি বৃক্ষের নীচে এসে গাছ তলার কাঁটা-কুটা পরিস্কার করে সেখানে শুয়ে পড়লাম। এমন সময় মক্কার মুশরিকদের চার ব্যক্তি আমার কাছে আসলো এবং তারা রাঃসাঃ সম্পর্কে নানা প্রকার অশোভন ও আপত্তিকর কথাবর্তা বললো। তাতে আমি তাদের ওপর ভীষণ ক্ষেপে গেলাম, পরে আমি অন্য আরেকটি গাছতলায় চলে গেলাম। এ সময় তারা তাদের হাতিয়ারগুলো গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখে সবাই শুয়ে পড়লো। ঠিক এমন সময় উপত্যকার নিম্ন প্রান্ত থেকে কোনো এক আহবানকারী চিৎকার করে এ আওয়াজ দিলো যে, “মুহাজিরীনরা কোথায়? ইবনে যুনাঈমকে হত্যা করা হয়েছে”। সালামা বলেন, এ আওয়াজ শোনার সাথে সাথেই আমি আমার তরবারী কোষমুক্ত করে ঐ চার ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অথচ তারা সবাই তখনও শায়িত অবস্থায় ছিলো্ আমি গিয়ে তাদের হাতিয়ারগুলো নিয়ে সেগুলোকে আমার হাতে মধ্যে মুঠো করে বেঁধে নিলাম। সালামা বলেন, পরে আমি বলিলাম, সেই মহান সত্তার কসম! যিনি মুহাম্মাদ রাঃসাঃ এর মুখমন্ডলকে সবচেয়ে মর্যাদা দান করেছেন। সাবধান! তোমাদের কেউ মাথা তুলবে না। যদি কেউ মাথা ওঠাও, তবে চোখে যা দেখছো ওটার দ্বারা তাকে শেষ করে দেবো। সালামা বলেন, পরে আমি তাদেরকে হাঁকিয়ে রাঃসাঃ এর কাছে নিয়ে আসলাম। তিনি বলেন, এ সময় আমার চাচা আমের ও `আবালাহ্` গোত্রের `মিকরায` নামে এক ব্যক্তিবে রাঃসাঃ এর কাছে ধরে নিয়ে আসলো। সে ছিলো সত্তরজন মুশরিকের মধ্যে একটি গাত্রাবৃত ঘোড়ার ওপর আরোহী। রাঃসাঃ তাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলিলেন, তোমরা এদের সবাইকে ছেড়ে দাও। অপরাধের সূচনা করা এবং বার বার অপরাধ করা তাদেরকেই মানায় [অর্থাৎ সন্ধিচুক্তির খেলাফ করাটা তাদেরকেই সাজে], এ বলে রাঃসাঃ তাদেরকে মাফ করে দিলেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ নাযিল করিলেন, “আমি মক্কা অঞ্চলে ওদের ওপর তোমাদেরকে বিজয়ী করার পর, তাদের হাত তোমাদের ওপর থেকে এবং তোমাদের হাত তাদের ওপর থেকে নিবারণ করেছি”। [কোরআনের সুরা আল-ফাতহ: ২৪] আয়াতটি সবটুকুই নাযিল করিলেন। সালামা বলেন, অতঃপর আমরা মদীন অভিমুখে প্রত্যাবর্তন করলাম এবং আমরা এসে এক জায়ঘায় অবস্থান করলাম। এদিকে আমাদের ও `লাহ্ইয়ান` গোত্রের মধ্যখানে একটি মাত্র পাহাড়ের ব্যবধান। আর তারা ছিলো মুশরিক। রাতের বেলায় রাঃসাঃ ও তাহাঁর সঙ্গীদের জন্য তাদের [মুশরিকদের] গোপন সংবাদ সরবরাহ করার জন্যে যে গুপ্তচর হিসেবে উক্ত পাহাড়ের ওপর আরোহণ করবে, রাঃসাঃ তার জন্যে আল্লাহর কাছে “ইস্তিগফার” করিলেন। সালামা বলেন, আমি উক্ত রাতে দু`কি তিনবার সে পাহাড়ে আরোহণ করলাম। পরে আমি মদীনায় ফিরে আসলাম। এ সময় রাঃসাঃ তাহাঁর গোলাম `রাবাহ্` কে তাহাঁর স্বীয় সওয়ারী জানোয়ার [আদ্বাহ] দিয়ে পাঠালেন এবং আমিও তার সঙ্গে ছিলাম। আর আমি বের হলাম তার সাথে তালহা রাদি. `আনহুর ঘোড়া নিয়ে মুক্ত মাঠের পানে। যখন ভোর হলো হঠাৎ সংবাদ পেলাম আবদুর রহমান আল-কাযারী অতর্কিত আক্রমণ করে রাঃসাঃ এর জানোয়ারগুলো ছিনিয়ে নিয়ে গেছে এবং তাহাঁর রাখালকেও হত্যা করে ফেলেছে। সালামা বলেন, তখন আমি বলিলাম, হে রাবাহ! ধরো, এ ঘোড়াটি নিয়ে যাও এবং ওটা তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহর কাছে পৌঁছিয়ে দাও, আর রাঃসাঃ এর নিকট এ সংবাদ জানিয়ে দাও যে, মুশরিকরা তাহাঁর পশুর পাল লুন্ঠন করে নিয়ে গেছে। সালামা বলেন, অতঃপর আমি একটি উঁচু টিলার ওপর দাঁড়িয়ে মদীনাকে সম্মুখে রেখে বলে সংকেত ধ্বনি উচ্চারণ করে তিনবার খুব জোরে চিৎকার দিলাম। অতঃপর আমি [মুশরিকদের] পিছু ধাওয়া করে তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করতে করতে বেরিয়ে পড়লাম এবং এ শোক [কবিতা] আবৃত্তি করতে থাকলাম, আমি হলাম আক্ওয়ার সুযোগ্য সন্তান এবং আজকের দিনেই প্রমাণিত হবে, কার মা তাকে অধিক দুগ্ধ পাণ করিয়েছে”। পরে আমি তাদের একজনকে আয়ত্তে পেয়ে তার সওয়ারী লক্ষ্য করে তীর ছুড়লাম, শেষ পর্যন্ত তীরটি তার বাহু ছেদ করে চলে গেলো। সালামা বলেন, তখন আমি বলিলাম, লও হে এই পুরস্কার! আমাকে চিনো? আমি হলাম আক্ওয়ার সুযোগ্য পুত্র। আজই প্রমাণিত হবে নিকৃষ্ট ইতর কে? এবং কার মা তাকে দুগ্ধপাণ করিয়েছে। সালামা বলেন, আল্লাহর কসম! আমি অনবরত বিরামহীনভাবে তাদেরকে তীর নিক্ষেপ করতে থাকলাম এবং ওদের জখমী ও আহত করতে থাকলাম। পরে যখন তাদের অশ্বারোহী আমার কাছে ফিরে আসলো, তখন আমি একটি বৃক্ষের নীচে এসে বসে পড়লাম। অতঃপর আমি তাকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে আহবান করে দিলাম। অবশেষে যখন তারা পাহাড়ের সরু পথের নিকটবর্তী হলো তখন তার মধ্যে ঢুকে গেলো। এ সময় আমি পাহাড়ের ওপরে উঠে গেলাম এবং ওপর থেকে তাদেরকে পাথর নিক্ষেপ করতে থাকলাম। সালামা বলেন, আমি সারাক্ষণ তাদের পিছু ধাওয়া করতেই থাকলাম। শেষ নাগাদ আল্লাহ সৃষ্ট রাঃসাঃ এর যে কোনো উষ্ট্র সওয়ারীকে আমি আমার পেছনেই ফেলে দিলাম। ফলে আমার ও মুশরিকদের মাঝখানে আমিই রয়ে গেলাম। এরপর আমি তীর নিক্ষেপ করতে করতে তাদের পিছু ধাওয়া করলে শেষ পর্যন্ত তারা গায়ের বোঝা হালকা করার নিমিত্তে ত্রিশখানার বেশী চাদর ও ত্রিশটি তীর ফেলে গেলো। আর আমি তাদের ফেলে যাওয়া প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর পাথর চাপা দিয়ে চিহ্ন রেখে যেতে লাগলাম, যেন রাঃসাঃ ও তাহাঁর সঙ্গীরা দেখে চিনতে পারেন যে, ওগুলো আমার ছিনতাইকৃত জিনিস। অবশেষে তারা [মুশরিকরা] এক টিলার সংকীর্ণ স্থানে গিয়ে উপস্থিত হলো। এমন সময় হঠাৎ অমুক [আবদুর রহমান] ইবনে বাদরুল ফাযারী এসে তাদের কাছে উপস্থিত হলো। তখন তারা সকলে বসে দুপুরের খানা খাচ্ছিলো, আর আমি পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে বসা ছিলাম। এ সময় ফাযারী আমাকে দেখতে পেয়ে সঙ্গের লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলো, ঐ যে ওপরে আমি দেখছি ওটা কি? তারা বললো, এই তো সে ব্যক্তি যে আমাদেরকে অস্থির করে তুলেছে। আল্লাহর শপথ! ঐ সাত-সকাল থেকেই সে আমাদের পিছু ধাওয়া করে আমাদেরকে তীরের মুখে রেখেছে। এমন কি শেষ নাগাদ আমাদের হাতে যা কিছু ছিলো সবকিছুই সে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। সালামা বলেন, তাদের কথা শুনে ইবনুল ফাযারী বললো, তোমাদের মধ্য থেকে চারজন লোক তার দিকে ওঠো। সালামা বলেন, অতঃপর তাদের থেকে চারজন পাহাড়ের মধ্যে আমার কাঠে উঠে আসলো। তিনি বলেন, যখন তারা আমার এতো নিকটে আসলো যে, এখন আমি তাদের সাথে কথাবার্তা বলতে পারি, তখন আমি বলিলাম, তোমরা কি আমাকে চিনো, আমি কে? তারা বললো, না এবং জিজ্ঞেস করলো, তুমি কে? উত্তরে বলিলাম, আমি সালামাহ ইবনুল আক্ওয়া। সেই মহান সত্তার কসম করে বলছি, যিনি মুহাম্মাদ রাঃসাঃ এর মুখমন্ডলকে মর্যাদাসম্পন্ন করেছেন, আমি তোমাদের কোনো ব্যক্তিকে ধরার সংকল্প করলে সে কখনো আমার নাগালের বাইরে যেতে পারবে না। এবং আমি তাকে ধরেই ফেলবো। কিন্তু তোমাদের কেউই আমাকে ধরতে বা কাবু করতে সক্ষম হবে না। এ সময় তাদের একজন আমার দাবীর সমর্থনে বললো, আমার ধারণাও তাই। সালামা বলেন, পরে তারা ফিরে চলে গেলো, কিন্তু আমি আমার জায়গা ত্যাগ করলাম না। অবশেষে এতক্ষণ পরে দেখলাম রাঃসাঃ এর অশ্বারোহী সৈন্যরা বাগানের ভেতরে প্রবেশ করেছে। সালামা বলেন, দেখলাম তাহাঁদের সর্বপ্রথম লোকটি হলেন আল-আখরামুল আসাদী। তাহাঁর পেছনে আবু কাতাদাহ আনসারী এবং তাহাঁর পেছনে মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ কিন্দী। তিনি বলেন, তাঁরা এখানে আসলে, আমি আখরামের ঘোড়ার লাগাম ধরে থামিয়ে বলিলাম, ওরা [মুশরিকরা] সবাই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালিয়ে গেছে। আরো বলিলাম, হে আখরাম! ওদের থেকে হুঁশিয়ার থাকো। কেননা এমন যেন না হয়, তারা তোমাকে হত্যা করে ফেলে। ইত্যবসরে রাঃসাঃ ও তাহাঁর সঙ্গীরা এসে পৌঁছে গেলেন। তখন আখরাম আমাকে লক্ষ্য করে বললো, হে সালামা! যদি তুমি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখো, আর এটাও জানো যে জান্নাত আছে, সত্য। জাহান্নাম আছে তাও সত্য- তাহলে আমার ও আমার শাহাদাতের মাঝখানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করো না। সালামা বলেন, তার কথা শুনে আমি তার রাস্তা ছেড়ে দিলাম। অতঃপর তাহাঁর ও আবদুর রহমান ফাযারীর মধ্যে মোকাবিলা [লড়াই] চললো। ফলে আখরাম, আবদুর রহমানের ঘোড়ার পা কেটে ফেললো আর আবদুর রহমান তাকে [আখরামকে] শহীদ করে দিলো এবং সে ঘোড়া পরিবর্তন করে আখরামের ঘোড়ার ওপর চড়ে বসলো। এ অবস্থা দেখে রাঃসাঃ এর অশ্বারোহী সিপাহী আবু কাতাদাহ অগ্রসর হয়ে আবদুর রহমানকে বর্শা দ্বারা আঘাত করে হত্যা করে ফেললো। সালামা বলেন, সেই মহান সত্তার শপথ করে বলছি যিনি মুহাম্মদ রাঃসাঃ কে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করেছেন! আমি ওদের [শত্রুদের] পেছনে পদব্রজে এমনভাবে দৌড়ালাম যে, আমি আমার পেছনে তাকিয়ে মুহাম্মাদ রাঃসাঃ এর সঙ্গীদের কাউকে তো দেখলামই না, এমনকি তাদের ঘোড়ার পায়ের নীচের ধুলাবালি পর্যন্ত কিছুই উড়তেও দেখলাম না। [অর্থাৎ তারা আমার অনেক দূরে পেছনে পড়ে গেলা]। অবশেষে তারা [শত্রুরা] সূর্যাস্তের পূর্বে পাহাড়ের পাদদেশের দিকে অগ্রসর হলো। সেখানে পানি ছিলো। ওটাকে `যী-কারাদ` বলা হয়। [এই কূপের নামানুসারেই উক্ত এলাকার নামকরণ হয়েছে]। তারা সেখানে পানি পান করার উদ্দেশ্যেই গিয়েছিলো। কেননা তারা সবাই ছিলো পিপাসার্ত। সালামা বলেন, যখন তারা পেছনে তাকিয়ে দেখলো যে, আমি তাদেরকে পেছন থেকে দৌড়াচ্ছি, তখন তারা সেখান থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচালো। এভাবে আমি তাদেরকে ওখান থেকে বিতাড়িত করলাম এবং এক ফোঁটা পানিও পান করতে দিলাম না। তিনি বলেন, তারা ওখান থেকে বেরিয়ে দৌড়ে এক টিলার মধ্যে আশ্রয় নিলো। তিনি বলেন, তারা সবাই দৌড়ে পালারো বটে, কিন্তু আমি তাদের এক ব্যক্তিকে আয়ত্তের মধ্যে পেয়ে এমনভাবে তীর ছুড়লাম যে, তা তার বাহুকে ছিদ্র করে চলে গেলো। তখন আমি তাকে লক্ষ্য করে বলিলাম, ওহে, লও [পুরস্কার]! জেনে নাও, “আমি হলাম আকওয়ার সুযোগ্য পুত্র। আজই প্রমাণ হবে কার মা তাকে অধিক দুগ্ধপান করিয়েছে”। [তীর খেয়ে] সে হতচকিত হয়ে বললো, ওহে তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক! তুমি কি সেই আকওা! যে প্রাতঃভোর থেকে আমাদের পেছনে ধাওয়া করছো? তিনি বলেন, উত্তরে আমি বলিলাম, হে নিজের আত্মার দুশমন! হাঁ, আমিই সেই আকওয়াম, যে প্রাতঃভোর থেকে তোমাদেরকে তাড়িয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, অতঃপর তারা টিলার ওপরে দু`টি ঘোড়া ফেলে রেখে ওখান থেকে পালিয়ে জান বাঁচালো। তিনি বলেন, অতঃপর আমি উক্ত ঘোড়া দু`টি হাঁকিয়ে রাঃসাঃ এর নিকট নিয়ে আসলাম। সালামা বলেন, এমন সময় আমেরের সাথে আমার সাক্ষাত হলো। তাহাঁর কাছে ছিলো চামড়ার একটি থলি, তার মধ্যে ছিলো সামান্য কিছু দুগ্ধ এবং আরেকটি পাত্রের মধ্যে কিছু পানি। সুতরাং আমি তা থেকে অযু করলাম এবং পানও করলাম। পরে আমি রাঃসাঃ এর কাছে আসলাম। এ সময় তিনি পানির ঐ কূপের কাছেই ছিলেন যেখান থেকে আমি ওদেরেকে [শত্রুদেরকে] বিতাড়িত করেছিলাম। এসে দেখি, আমি মুশরিকদের থেকে উট, চাদর এবং তীর-বর্শা যা কিছু ছিনিয়ে নিয়েছিলাম সে সমস্ত প্রত্যেকটি জিনিসই রাঃসাঃ নিয়ে নিয়েছেন এবং আরো দেখলাম, শত্রুদের থেকে আমার ছিনিয়ে নেওয়া উটগুলো থেকে বিলাল রাদি. `আনহু একটি উট যবেহ করে নিয়েছে এবং রাঃসাঃ এর উদ্দেশ্যে তার কলিজি [যকৃৎ] ও মেরু দাঁড়ার গোস্ত ভাজা করছে। সালামা বলেন, এ সময় আমি বলিলাম, হে আল্লাহর রাসূল আমাকে অনুমতি দিন, আমি সকলের মধ্য থেকে একশ জন লোক নির্বাচন করে, শত্রুদের পেছনে ধাওয়া করি। ফলে তাদের লোকদের কাছে সংবাদ পৌঁছানোর মত একজন লোককেও জ্যান্ত ছাড়বো না বরং সবাইকে হত্যা করে ফেলবো। তিনি বলেন, আমার সংকল্পের কথা শুনে রাঃসাঃ এমনভাবে হেসে দিলেন যে, আগুনের রৌশনীতে তাহাঁর মাড়ির দাঁত পর্যন্ত প্রকাশ হয়ে পড়লো। তখন তিনি বলিলেন, হে সালামা! তুমি স্বয়ং নিজেকে কি এরূপই মনে করো যে, তুমি এটা করতে সক্ষম? আমি বলিলাম, সেই সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সম্মানিত করেছেন, হ্যাঁ পারবো। তখন তিনি বলিলেন, এতক্ষণে তারা নিশ্চয়ই `গাতফান` ভূমিতে পৌঁছে গেছে। এমন সময় গাতফান থেকে এক ব্যক্তি এসে বললো, তাদের এ সমস্ত লোকদের জন্য অমুক ব্যক্তি একটি উট যবেহ করছে। যখন তারা উক্ত উটের চামড়া খুলে সবেমাত্র অবসর হয়েছে, এমন সময় তাকিয়ে দেখলো যে, ধুলাবালি আকাশে উড়ছে [অর্থাৎ মুসলিম সৈন্যরা এসে গেছে]। তখন মুসলিমরা তোমাদের কাছে এসে গেছে, বলে চিৎকার করে, তারা সবাই ওখান থেকে পালিয়ে গেলো। পরদিন ভোর হলে রাঃসাঃ বলিলেন, আমাদের আজকের উত্তম অশ্বারোহী ছিলেন আকু কাতাদাহ্ এবং উত্তম পদাতিক ছিলেন সালামা। সালামা বলেন, অতঃপর রাঃসাঃ [যুদ্ধলব্ধ মাল থেকে] আমাকে দু`ভাগ দিলেন, একভাগ অশ্বারোহীর এবং আরেকভাগ পদাতিকের। তিনি উক্ত দুই ভাগ একত্রেই আমাকে দিলেন। পরে তিনি আমাকে তাহাঁর নিজস্ব সওয়ারী `আদবা` ওপর তাহাঁর পেছনে বসিয়ে মদীনার দিকে প্রত্যাবর্তন করিলেন। তিনি বলেন, আমরা মদীনার দিকে রওয়ানা করে যাচ্ছিলাম ঠিক এমন সময় আনসারী এক ব্যক্তি বললো, দৌড়ে কেউ আমার আগে যেতে পারবে না। সে আবার প্রতিযোগী আহ্বান করে বললো, আছে কেউ যে, আমার আগে মদীনার পৌঁছতে পারে? সে পুনরায় আহ্বান করলো, কে আছে এমন যে আমার আগে মদীনায় পৌঁছতে পারে? সে উক্ত কথাটি বার বার পুনরাবৃত্তি করতে থাকলো। আমি তার কথা শুনে বলিলাম, তুমি কি কোনো ভদ্র লোকের সম্মান করবে না এবং কোনো শরীফ-সম্ভ্রান্ত লোককে ভয় করবে না? সে বললো, না; তবে রাঃসাঃ যদি হন, তাঁকে সম্মানও করবো এবং ভয়ও করবো। সালামা বলেন, তখন আমি বলিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতামাতা আপনার জন্যে উৎসর্গ হোক। আমাকে ছেড়ে দিন [অর্থাৎ অনুমতি দিন], আমি ঐ লোকটির সাথে প্রতিযোগিতা করবো। তিনি বলিলেন, যদি ইচ্ছে হয় যেতে পারো। সালামা বলেন, তখন আমি বলিলাম, আমি তোমার কাছে যাবো। এ বলে আমি আমার পা চালাতে লাগলাম পরে দৌড়াতে আরম্ভ করলাম এবং একটি অথবা দুটি উঁচু ভূমি তাকে পেছনে ফেলে এক জায়গায় এসে আমি আমার শরীরকে বিশ্রাম দিলাম। অতঃপর আবার তার পেছনে দৌড়াতে লাগলাম। এবারও আমি তাকে একটি অথবা দুটি উঁচুভূমি পেছনে ফেরে দিলাম। পরে আমি তার কাছে গিয়ে তার দুবাহু ধরে নাড়া দিয়ে বলিলাম, আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি। সে বললো, আমারও ধারণা যে, আমি হেরে গেছি। তিনি বলেন, সুতরাং আমি তার পূর্বেই মদীনায় পৌঁছে গেলাম।
সালামা বলেন, আল্লাহর কসম! উক্ত ঘটনার কেবলমাত্র তিন দিন পরেই আমরা রাঃসাঃ এর সঙ্গে খাইবার অভিমুখে রওয়ানা করলাম। এ সময় আমার চাচা আমের লোকদের সাথে সুরেলা কন্ঠে গাইতে লাগলেন, আল্লাহর কসম! যদি আল্লাহ অনুগ্রহ না করতেন, আমরা হেদায়েতের পথ পেতাম না। দান-সাদকা করতাম না এবং নামাযও পড়তাম না এবং আমরা তোমার করুণা থেকে বিমুখ নই। অতএব শত্রু মোকাবিলায় আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখো, আর আমাদের ওপর প্রশান্তি নাযিল করো, কবিতা শুনে রাঃসাঃ জিজ্ঞেস করিলেন, এ গায়ক কে? তিনি উত্তর দিলেন, আমি আমের। তখন রাঃসাঃ এর বলিলেন, আল্লাহ তোমাকে মাফ করুন। সালামা বলেন, রাঃসাঃ যখনই কোনো ব্যক্তি জন্যে বিশেষভাবে ইসতিগফার করেছেন সে শহীদই হয়েছে। তখন উমার ইবনুল খাত্তাব রাদি. `আনহু তাহাঁর উটের ওপর বসা ছিলেন। তিনি উচ্চস্বরে বলিলেন, হে আল্লাহর নাবী! যদি আমেরের সাথে আমাদেরকেও উপকৃত করতেন! [যদি আমাদের জন্যেও এরূপ বিশেষ দু`আ করতেন তাহলে খুবই ভালো হতো] সালামা বলেন, যখন আমরা খায়বার এলাকায় আগমন করলাম [যুদ্ধের ব্যুহ বচনা হলো এবং মোকাবিলার জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বী আহবানের পালা আসলো] তখন খায়বারবাসীদের অধিপতি মারহাব তার তরবারী উঁচু করে বলতে লাগলো, খায়বার ভূমি খুব ভালো অবগত আছে যে, আমি হলাম মারহাব, আপাদমস্তক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত একজন পরীক্ষিত বীর সেনানী। যখন যুদ্ধ সম্মুখে আসে তখন সে জ্বলন্ত অগ্নি। সালামা বলেন, আমার চাচা আমের তার মোকাবিলায় এসে দাঁড়ালেন এবং বলিলেন, খায়বার ভূমি অবশ্যই জানে আমি হলাম আমের। মজবুত অস্ত্রে সজ্জিত প্রচন্ড যুদ্ধে অপরাজেয় বীর। সালামা বলেন, এরপর তাদের দু`জনের আঘাত পরস্পরের মধ্যে ওলট-পালট হতে লাগলো। পরে মারহাবের তারবারির আঘাত এক সময় এসে আমার চাচা আমেরের ঢালের ওপর পড়লো। তখন আমের ঢালের নীচ দিয়ে তাকে আঘাত করতেই অতর্কিতভাবে তরবারী এসে তাহাঁর নিজ দেহের জোড়ার শাহরগটি কেটে দিলো, তাতেই তিনি ইনতিকাল করিলেন। সালামা বলেন, আমি বের হয়ে দেখলাম লোকেরা বলাবলি করছে যে, আমেরের সমস্ত আমল বাতিল হয়ে গেছে। কেননা সে আত্মহত্যা করেছে। সালামা বলেন, আমি কাঁদতে কাঁদতে রাঃসাঃ এর কাছে আসলাম এবং বলিলাম, আল্লাহর রাসূল! আমেরের আমল তো বাতিল হয়ে গেছে। তখন রাঃসাঃ বলিলেন, এ কথা কে বলেছে? আমি বলিলাম, আপনার সঙ্গীদের কিছুসংখ্যক লোক বলেছে। তিনি বলেন, যে এ কথা বলেছে সে মিথ্যা বলেছে, বরং সে দ্বিগুন সওয়াবের অধিকারী হয়েছে। অতঃপর তিনি আমাকে আলী রাদি. `আনহুর কাছে পাঠালেন। এ সময় তাহাঁর চোখ উঠেছে [চক্ষু রোগগ্রস্ত]। পরে রাঃসাঃ বলিলেন, আমি ইসলামী পতাকা অবশ্যই এমন ব্যক্তির হাতে অর্পণ করবো যে আল্লাহ তা`আলা ও তাহাঁর রাঃসাঃ কে ভালোবাসে। অথবা তিনি বলিয়াছেন, যাকে আল্লাহ্ও তাহাঁর রাসূল ভালোবাসেন। সালামা বলেন, পরে আমি আলী রাদি. `আনহুর কাছে আসলাম এবং তাঁকে ধরে ধরে রাঃসাঃ এর কাছে নিয়ে আসলাম। এসময়ও তিনি চক্ষু রোগে ভুগছিলেন। শেষ নাগাদ আমি তাঁকে রাঃসাঃ এর নিকট নিয়ে আসলে তিনি তাহাঁর উভয় চক্ষুর মধ্যে থুথু লাগিয়ে দিলে তৎক্ষণাতই তা আরোগ্য হয়ে গেলা এবং ইসলামী পতাকা তাহাঁর হাতেই প্রদান করিলেন। এ সময় মারহাব বেরিয়ে এসে প্রতিদ্বন্দী আহবান করে বললো, কায়বার ভালোভাবেই জানে আমি হলাম মারহাব, মজবুত অস্ত্রের অধিকারী অপরাজেয় রণবীর। যখন যুদ্ধ সম্মুখে আসে তখন প্রজ্জলিত অগ্নিকূন্ড। তার জবাবে আলী রাদি. `আনহু বলিলেন, আমি সেই রণবীর, আমার মা আমার নাম রেখেছেন হায়দার। যেমন বিশাল জঙ্গলের কুৎসিত ভয়ঙ্কর সিংহ। যারা আমার কাছে আসে আমি তাদেরকে `সুন্দরার` দাড়িপাল্লা দ্বারা কানায় কানায় ভরতি করে দিয়ে দেই। এ বলে মারহাবের মাথায় আঘাত করতেই সে নিহত হলো। অতঃপর তাহাঁর হাতেই খায়বার বিজয় হলো। [12]
মুয়ায ইবনু জাবাল রাদি. `আনহু হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন: তাবুক যুদ্ধের বছর আমরা রাঃসাঃ এর সঙ্গে [যুদ্ধে] বের হলাম। [এ সফরে] তিনি [দুই] নামায একত্রে আদায় করতেন। অর্থাৎ যোহর ও আসর একত্রে আদায় করতেন আর মাগরিব ও ইশা একত্রে আদায় করতেন। অবশেষে এক দিন [এমন] হল যে, নামায বিলম্বিত করিলেন। তারপর বের হয়ে এসে যোহব ও আসর একত্রে আদায় করিলেন, অতঃপর [তাঁবুতে] প্রবেশ করিলেন। তারপর আবার বেরিয়ে এলেন এবং মাগরিব ও ইশা একত্রে আদায় করিলেন। তারপর বলিলেন, ইনশা আল্লাহ তোমরা আগামীকাল তাবুক প্রস্রবণে পৌছবে আর চাশতের সময় না হওয়া পর্যন্ত তোমরা সেখানে পৌছতে পারবে না। তোমাদের মধ্যে যে সেখানে [প্রথমে] পৌছবে, সে যেন তার পানির কিছুই স্পর্শ না করে যতক্ষন না আমি এসে পৌছি। আমরা [যথাসময়ই] সেখানে পৌছলাম। [কিন্তু] ইতিমধ্যে দু`ব্যক্তি আমাদের আগে সেখানে পৌছে গিয়েছিল। আর প্রস্রবণটিতে জুতার ফিতার ন্যায় ক্ষীণ ধারায় কিছু সামান্য পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। মু`য়ায রাদি. আনহু বলেন, রাঃসাঃ ঐ দুজনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমরা তার থেকে কিছু পানি স্পর্শ করেছ কি? তারা দু`জন বলল, হ্যাঁ। তখন নাবী রাঃসাঃ তাদের দুজনকে তিরস্কার করিলেন। আর আল্লাহর যা ইচ্ছা, তাদের তাই বলিলেন। রাবী বলেন, তারপর লোকেরা তাদের হাত দিয়ে অঞ্জলী ভরে ভরে প্রস্রবণ থেকে অল্প অল্প করে [পানি] তুলল অবশেষে তা একটি পাত্রে কিছু পরিমাণ সঞ্চিত হল। রাবী বলেন, রাঃসাঃ তার মধ্যে তাহাঁর দু`হাত এবং মুখ মুবারক ধুলেন এবং পরে তা [পানি] তাতে [প্রস্রবণে] উলটিয়ে [ঢেলে] দিলেন। ফলে প্রস্রবণটি প্রবল পানি ধারায় অথবা রাবী বলিয়াছেন, প্রচুর পরিমাণে প্রবাহিত হতে লাগল। আবু আলী [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] সন্দেহ করেছেন যে, রাবী এর মধ্যে কোনটি বলিয়াছেন। এবার লোকেরা প্রয়োজনমত পানি পান করল। পরে নাবী রাঃসাঃ বলিলেন, হে মু`য়ায যদি তুমি দীর্ঘজিবী হও, তবে আশা করা যায় যে, তুমি দেখতে পাবে, প্রস্রবণের এ স্থানটি বাগানে ভরে গিয়েছে। [13]
[1] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৩৫৭৪।
[2] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৩৫৭২।
[3] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ১৬৯, সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ২২৭৯।
[4] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ১৯৫।
[5] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২০০।
[6] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৩৪৪।
[7] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২৭৩১।
[8] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৩৫৭৬।
[9] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৫৬৩৯।
[10] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৩৫৭৭।
[11] সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৩৫৭৯।
[12] সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ১৮০৭।
[13] সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ৭০৬।
Leave a Reply